হিন্দু বিতাড়নের রাজনীতি

শঙ্কর প্রসাদ দে

চৌমুহনীর ভয়াবহ হামলাটি হয়েছে ১৫ অক্টোবর ২০২১ শুক্রবার। বড় মসজিদে জুমার নামাজে বড় ধরনের লোক সমাগম হওয়াই স্বাভাবিক। খতিব মওলানা শফিউল্লাহর বক্তব্য হলো তিনি মিছিল বের করতে নিষেধ করেছেন। অর্থটা দাঁড়াল নামাজিদের মধ্যে কিছু হামলাকারী ছিল। মুসল্লিদের অনেকেই হামলা যে হবে তার আভাষ পেয়েছিলেন। নিশ্চিৎভাবে বলা যায় সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো যার যার ঘরে চলে গেছেন। কিন্তু রয়ে গেছে একদল দুর্বৃত্ত। তারা রাস্তায় জড়ো হলো। পরিকল্পিতভাবে অল্পক্ষণের মধ্যে জমায়েত হলো আরও হামলাকারী। এদের সংখ্যা মোটামুটি ৩০০-৫০০ এর মধ্যে।

তারপরের ঘটনা শুধুই প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দির ভাঙচুর, মানুষ কোপানো আর নরহত্যা। পূর্বাভাষ থাকা সত্ত্বেও পাশে ছিল না কোন পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, স্থানীয় জনতা বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব। খোলাখুলি বলার সময় এসেছে। বলা হয়ে থাকে সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। প্রশ্ন হলো পূর্বাভাষ থাকা সত্ত্বেও নামাজের পর পর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কেন প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেনি। চট্টগ্রামের জেএম সেন হলেও হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। প্রাতঃভ্রমণ শেষে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি হিন্দুদের ভীতির বহিঃপ্রকাশ দেখেছি। মূল গেটের ফটক দিয়ে শুধু এক একজন করে অঞ্জলি দেয়ার জন্য ঢুকতে পারছিলেন। আগের দিন পুলিশ কমিশনার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন নামাজের পর কোন হামলা হবে না। অথচ জুমা মসজিদ থেকে যখন হামলাকারীরা জেএম সেন হলের দিকে অগ্রসর হয় তখন পুলিশ ব্যরিকেড তো ছিলই না বরং যারা ডিউটিতে ছিল তারাও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকেছে। অর্থাৎ দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মীবাহিনী অবস্থান নিলে হামলাকারীদের সাধ্য ছিল না এগিয়ে আসে।

৩২টি জেলায় হামলা হওয়ার চিত্র একই। দুশ্চিন্তার দিক হলো, পীরগঞ্জ, চাঁদপুরের মতো কয়েকটি জেলায় হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী পরিবারের তরুণ। ২০০১ সালে বিজয়ী বিএনপির নেতৃত্বেই দেশব্যাপী হামলা হয়েছে। ২০১২ সালের রামু বৌদ্ধমন্দির হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা। নাসিরনগরের হামলায় এজাহারে নাম এসেছে আওয়ামী লীগ নেতার। সারাংশ দাঁড়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ব্যাপারে দুই প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিচের দিকে ঐকমত্য আছে। সরল সমীকরণ হলো, হামলা হলে হিন্দুরা দেশ ছাড়বে। আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেয়া দরকার- এমন দর্শনে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ এক হলো কীভাবে। উভয়ের স্বার্থ এক জায়গায় মিলল কেমনে। কি সেই স্বার্থ।

আসলে হিন্দু তাড়ানোর ব্যাপারে উভয় দল একমত হলেও স্বার্থ পৃথক। বিএনপি মনে করে হিন্দুরা যতবেশি ভারতে চলে যাবে, ততই আওয়ামী লীগের ভোট কমবে। পরিসংখ্যান বলছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ মোটামুটি ৪০ শতাংশ করে ভোট পায়। দুই শতাংশ হিন্দু ভোটারকে যদি দেশত্যাগে বাধ্য করা যায় তবে বিএনপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পথে বাধা থাকে না। ২০০১ সালে নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায় বিএনপি আসন পেয়েছিল ২০০টি। ভোট পেয়েছিল ৪১.৪০%। আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছিল ৬২ আর ভোট পেয়েছিল ৪০.০২%। মাত্র ১.৩৮% ভোটের ব্যবধানে বিএনপির আসন বেড়েছে ১৩৮টি। সামনে নির্বাচন। এবারের হামলাকে বিএনপি দর্শনের ছকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। ৪০.০২% আওয়ামী ভোটের মধ্যে ৯ শতাংশ সংখ্যালঘুদের মর্মে ধারণা করা হয়।

এবার মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো ২০১২ থেকে ২০২১ সালের ঘটনা পর্যন্ত হামলাগুলোতে আওয়ামী লীগের অনেকেই জড়িত থাকার হেতু কি? প্রশাসনও শৈথিল্য দেখানোর হেতু কি? হেতু আছে! জিয়া, এরশাদ খালেদা জিয়ার ১৫ বছরের শাসনকালে প্রশাসনে নিয়োগ ও সংখ্যালঘুধের প্রতি পদোন্নতির বিমাতাসুলভ আচরণ করা হতো। ১৯৯২ সালে আমাকে জুডিশিয়াল ক্যাডারে ঢুকতে দেয়া হয়নি নিতান্ত সংখ্যালঘু বলে। রাজনৈতিক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি যে হয়েছে পিএসসির একজন চেয়ারম্যান তা স্বীকারও করেছিলেন। ২০০৯ থেকে বঞ্চিত হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবে নিয়োগে ও পদোন্নতিতে মোটামুটি বঞ্চিত হচ্ছেন না। বুকের জ্বালা অনেকে তো মুখ ফসকে বলেও ফেলেন। সিভিল প্রশাসনে এই সংখ্যালঘু বিদ্বেষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশে হিন্দু বিদ্বেষ। অনেক থানার ওসি হিন্দু, এতে অন্যদের সমস্যা কি? ২০২১ সালের হামলায় প্রশাসন ও পুলিশ নীরব থাকায় প্রধান কারণ ছিল পেশাগত বিদ্বেষ।

দুর্বৃত্ত দলকে আওয়ামী পরিবারের অনেকে নেতৃত্ব দেয়ার কারণ কি? ২০১২ সালে রামুতে ও ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর হাজিগঞ্জের পৌর এলাকায় হামলার তথ্য এমনটি। কারণ আছে-পূর্ব বাংলায় হিন্দুর সম্পত্তি, হিন্দুর মেয়ে আর হিন্দুর ব্যবসার প্রতি লোভ বহু পুরোনো। শত্রু সম্পত্তি বেহাত শুরু হয়েছে বায়াত্তর সাল থেকে। অধিকাংশই আওয়ামী বন্ধুদের হাতে। এরাই এখন ক্ষমতায়। রানা বাবুর বিখ্যাত উক্তি “এদেশে থাকলে ভোট আমার, ওদেশে গেলে জমি আমার”। বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জে হিন্দু ব্যবসায়ী প্রায় উচ্ছেদের কিনারায়। তার ওপর এই আওয়ামী দুর্বৃত্তরা ধর্মীয় রক্ষণশীলতায়ও আক্রান্ত। এরা হিন্দু ধর্মকে ঘৃণার চোখে দেখে। ইউটিউব খুললেই দেখা যায় হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী ওয়াজী বক্তৃতা।

১৯৪১ সালের আদমশুমারিতে সংখ্যালঘুর সংখ্যা ছিল ২৯.৭ ভাগ। ১৯৭৪ সালে তা নেমে আসে ১৩.৫ ভাগে। ২০০১ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৮.৫ ভাগে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৫ ভাগ হিন্দু বিতাড়িত হয়েছে ছলে বলে কৌশলে। এই বিতাড়ন প্রক্রিয়া গোটা সমাজের অভ্যন্তর থেকে ঘটেছে। রাজনীতি এই বিতাড়ন প্রক্রিয়াকে থামাতে তো পারেইনি বরং নীরবে উৎসাহিত করছে। আসলে হিন্দু-মুসলিম এই বৈরিতা রাজনীতির কারণেই অব্যাহতভাবে চলছে। এক একটি ঘটনা ঘটে আর লাখ লাখ স্বচ্ছল হিন্দুর মন ভেঙে যায়। তারা ভেবে নেয় এতদিন না গিয়ে ভুল করেছি।

একটা বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে গভীরভাবে। প্রায় পৌনে দুই কোটি হিন্দুকে কি আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো প্রায় বিতাড়িত করা সম্ভব? অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব। অভিজাত হিন্দুরা সাতচল্লিশেই চলে গেছে। পঞ্চাশের হামলা আর চৌষট্টীতে খুলনায় সবুর খানের একতরফা হিন্দু নিধনের পর, আর ১৯৬৫ এর পর মধ্যবিত্তরাও প্রায় চলে গেছে। এ কারণে ১৯৭৪ এ এসে ২৯.৭ থেকে দাঁড়াল ১৩.৫ শতাংশে। এখন আমরা যারা আছি তাদের অধিকাংশ বা আনুমানিক ১ কোটি নিম্নবর্ণের হিন্দু। কামার, কুমার, নাপিত, চাষা ও জেলেরাই এই বিশাল জনগোষ্ঠী। এদেশে এরা মানবেতর জীবনযাপন করে। ভারতে গেলেও তাদের তাই করে বাঁচতে হবে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ভাতই জুটে না। এদেশ থেকে গেলে এদের না খেয়েই মরতে হবে। সুতরাং ভনিতা ছাড়াই বলা যায় এদেশ থেকে হিন্দুদের আর ভাররতবাসী হওয়ার বাস্তব সুযোগ নেই।

তবে এদের থাকতে দেবার জন্য যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার কথা ছিল তা সজ্ঞানে ধ্বংস করা হয়েছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্র্রোতের বিপরীতে তরী বেয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা মাত্রই জিয়া সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তা বাদ দিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইসলামী আদর্শের নিচে চাপা দিলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের কাঁধে বন্দুক ছিল। বগলে ছিল ইসলামী আদর্শের স্বপ্ন।

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতা হতে পারতো হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে বেঁচে থাকার প্রধান কৌশল। জিয়া, এরশাদ, বেগম জিয়া ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে বানালেন ইসলামী বাংলাদেশ। পৃথিবীর অনেক দেশেই রাষ্ট্রকে ইসলামী করা হয়েছে। ফলাফল হয়েছে বেদনাদায়ক। বেশিরভাগ মুসলিম দেশে সংখ্যালঘু এমনভাবে উচ্ছেদ হয়েছে যে, নেই বললেই চলে। অর্ধশতকের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশ্ন, হিন্দু বিদ্বেষ সমস্যার সমাধান কি? এক ধরনের সমাধান এসেছিল একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের জন্ম হলো। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেই বললেন “আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান।” অর্থাৎ আগে এদেশের সব মানুষ বাঙালি অতঃপর হিন্দু বা মুসলমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কার্যত বাঙালিত্বকে হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর শুরু হলো ইসলামীকরণ। আমাদের বয়সীরা শুনলাম ভারত আমাদের শত্রু। বাংলাদেশে হিন্দু বিদ্বেষের জন্ম এই ভারত বিরোধিতা থেকে। জন্মদাতা বীরোত্তম জিয়া।

পৃথিবীর কোন দেশেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধ আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করা যায় না। এ জন্যই বলি যতই কঠিন শোনাক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করে না এমন দলের নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ রহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাম্প্রতিক হামলাগুলোর বিচার করতে চাইছে। আমরা এর বিরোধী। সাম্প্রতিক মামলার সংখ্যা ২৮/১০/২০২১ পর্যন্ত ১১৬টি। সংখ্যালঘু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল করতে হবে শুধু ঢাকায়, এক বা একাধিক। তৃতীয়ত; সম্ভাব্য এই আইনে মৌখিক স্বাক্ষ্যের পরিবর্তে তথ্যপ্রযুক্তি ফলাফল ও পুলিশের সাক্ষীর ওপর বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে। সাইবার ল্যাবে যদি কারো চেহারা চিহ্নিত হয় তবে ভুক্তভোগীর সাক্ষীর প্রয়োজন কি? সম্ভ্যাব্য এই ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা’ আইনে দৃষ্টান্তমূলক ও দ্রুত শাস্তির বিধান রাখতে হবে। ভারতের মতো বহুদেশে ধর্ম মন্ত্রণালয় নেই। কারণ রাষ্ট্র এমন একটি মনুষ্য সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান, যা ধর্ম কি জিনিস বোঝার কথা নয়। এজন্য চাই সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়।

সবচেয়ে বড় কথা সংখ্যালঘু বিদ্বেষ নিরসনে একটি কমিশন গঠন করা যায়। কমিশনের দায়িত্ব হওয়া উচিত কোন কোন বৈষয়িক ও রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ বাড়ছে। ফলাফলের ভিত্তিতে যুগোপযুগী আইন ছাড়া বাঙালি জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাঙালি জাতিসত্তা ছাড়া আর কোন মতবাদ রাষ্ট্রের কাছে প্রাধান্য পাওয়ার সুযোগ নেই। বহু আপোস হয়েছে, এখন শুধুই অস্তিত্বের লড়াই।

[লেখক : আইনজীবী]

বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২১ , ৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১২ রবিউস সানি ১৪৪৩

হিন্দু বিতাড়নের রাজনীতি

শঙ্কর প্রসাদ দে

চৌমুহনীর ভয়াবহ হামলাটি হয়েছে ১৫ অক্টোবর ২০২১ শুক্রবার। বড় মসজিদে জুমার নামাজে বড় ধরনের লোক সমাগম হওয়াই স্বাভাবিক। খতিব মওলানা শফিউল্লাহর বক্তব্য হলো তিনি মিছিল বের করতে নিষেধ করেছেন। অর্থটা দাঁড়াল নামাজিদের মধ্যে কিছু হামলাকারী ছিল। মুসল্লিদের অনেকেই হামলা যে হবে তার আভাষ পেয়েছিলেন। নিশ্চিৎভাবে বলা যায় সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো যার যার ঘরে চলে গেছেন। কিন্তু রয়ে গেছে একদল দুর্বৃত্ত। তারা রাস্তায় জড়ো হলো। পরিকল্পিতভাবে অল্পক্ষণের মধ্যে জমায়েত হলো আরও হামলাকারী। এদের সংখ্যা মোটামুটি ৩০০-৫০০ এর মধ্যে।

তারপরের ঘটনা শুধুই প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দির ভাঙচুর, মানুষ কোপানো আর নরহত্যা। পূর্বাভাষ থাকা সত্ত্বেও পাশে ছিল না কোন পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, স্থানীয় জনতা বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব। খোলাখুলি বলার সময় এসেছে। বলা হয়ে থাকে সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। প্রশ্ন হলো পূর্বাভাষ থাকা সত্ত্বেও নামাজের পর পর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কেন প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেনি। চট্টগ্রামের জেএম সেন হলেও হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। প্রাতঃভ্রমণ শেষে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি হিন্দুদের ভীতির বহিঃপ্রকাশ দেখেছি। মূল গেটের ফটক দিয়ে শুধু এক একজন করে অঞ্জলি দেয়ার জন্য ঢুকতে পারছিলেন। আগের দিন পুলিশ কমিশনার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন নামাজের পর কোন হামলা হবে না। অথচ জুমা মসজিদ থেকে যখন হামলাকারীরা জেএম সেন হলের দিকে অগ্রসর হয় তখন পুলিশ ব্যরিকেড তো ছিলই না বরং যারা ডিউটিতে ছিল তারাও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকেছে। অর্থাৎ দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্মীবাহিনী অবস্থান নিলে হামলাকারীদের সাধ্য ছিল না এগিয়ে আসে।

৩২টি জেলায় হামলা হওয়ার চিত্র একই। দুশ্চিন্তার দিক হলো, পীরগঞ্জ, চাঁদপুরের মতো কয়েকটি জেলায় হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী পরিবারের তরুণ। ২০০১ সালে বিজয়ী বিএনপির নেতৃত্বেই দেশব্যাপী হামলা হয়েছে। ২০১২ সালের রামু বৌদ্ধমন্দির হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা। নাসিরনগরের হামলায় এজাহারে নাম এসেছে আওয়ামী লীগ নেতার। সারাংশ দাঁড়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ব্যাপারে দুই প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিচের দিকে ঐকমত্য আছে। সরল সমীকরণ হলো, হামলা হলে হিন্দুরা দেশ ছাড়বে। আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেয়া দরকার- এমন দর্শনে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ এক হলো কীভাবে। উভয়ের স্বার্থ এক জায়গায় মিলল কেমনে। কি সেই স্বার্থ।

আসলে হিন্দু তাড়ানোর ব্যাপারে উভয় দল একমত হলেও স্বার্থ পৃথক। বিএনপি মনে করে হিন্দুরা যতবেশি ভারতে চলে যাবে, ততই আওয়ামী লীগের ভোট কমবে। পরিসংখ্যান বলছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ মোটামুটি ৪০ শতাংশ করে ভোট পায়। দুই শতাংশ হিন্দু ভোটারকে যদি দেশত্যাগে বাধ্য করা যায় তবে বিএনপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পথে বাধা থাকে না। ২০০১ সালে নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায় বিএনপি আসন পেয়েছিল ২০০টি। ভোট পেয়েছিল ৪১.৪০%। আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছিল ৬২ আর ভোট পেয়েছিল ৪০.০২%। মাত্র ১.৩৮% ভোটের ব্যবধানে বিএনপির আসন বেড়েছে ১৩৮টি। সামনে নির্বাচন। এবারের হামলাকে বিএনপি দর্শনের ছকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। ৪০.০২% আওয়ামী ভোটের মধ্যে ৯ শতাংশ সংখ্যালঘুদের মর্মে ধারণা করা হয়।

এবার মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো ২০১২ থেকে ২০২১ সালের ঘটনা পর্যন্ত হামলাগুলোতে আওয়ামী লীগের অনেকেই জড়িত থাকার হেতু কি? প্রশাসনও শৈথিল্য দেখানোর হেতু কি? হেতু আছে! জিয়া, এরশাদ খালেদা জিয়ার ১৫ বছরের শাসনকালে প্রশাসনে নিয়োগ ও সংখ্যালঘুধের প্রতি পদোন্নতির বিমাতাসুলভ আচরণ করা হতো। ১৯৯২ সালে আমাকে জুডিশিয়াল ক্যাডারে ঢুকতে দেয়া হয়নি নিতান্ত সংখ্যালঘু বলে। রাজনৈতিক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি যে হয়েছে পিএসসির একজন চেয়ারম্যান তা স্বীকারও করেছিলেন। ২০০৯ থেকে বঞ্চিত হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবে নিয়োগে ও পদোন্নতিতে মোটামুটি বঞ্চিত হচ্ছেন না। বুকের জ্বালা অনেকে তো মুখ ফসকে বলেও ফেলেন। সিভিল প্রশাসনে এই সংখ্যালঘু বিদ্বেষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশে হিন্দু বিদ্বেষ। অনেক থানার ওসি হিন্দু, এতে অন্যদের সমস্যা কি? ২০২১ সালের হামলায় প্রশাসন ও পুলিশ নীরব থাকায় প্রধান কারণ ছিল পেশাগত বিদ্বেষ।

দুর্বৃত্ত দলকে আওয়ামী পরিবারের অনেকে নেতৃত্ব দেয়ার কারণ কি? ২০১২ সালে রামুতে ও ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর হাজিগঞ্জের পৌর এলাকায় হামলার তথ্য এমনটি। কারণ আছে-পূর্ব বাংলায় হিন্দুর সম্পত্তি, হিন্দুর মেয়ে আর হিন্দুর ব্যবসার প্রতি লোভ বহু পুরোনো। শত্রু সম্পত্তি বেহাত শুরু হয়েছে বায়াত্তর সাল থেকে। অধিকাংশই আওয়ামী বন্ধুদের হাতে। এরাই এখন ক্ষমতায়। রানা বাবুর বিখ্যাত উক্তি “এদেশে থাকলে ভোট আমার, ওদেশে গেলে জমি আমার”। বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জে হিন্দু ব্যবসায়ী প্রায় উচ্ছেদের কিনারায়। তার ওপর এই আওয়ামী দুর্বৃত্তরা ধর্মীয় রক্ষণশীলতায়ও আক্রান্ত। এরা হিন্দু ধর্মকে ঘৃণার চোখে দেখে। ইউটিউব খুললেই দেখা যায় হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী ওয়াজী বক্তৃতা।

১৯৪১ সালের আদমশুমারিতে সংখ্যালঘুর সংখ্যা ছিল ২৯.৭ ভাগ। ১৯৭৪ সালে তা নেমে আসে ১৩.৫ ভাগে। ২০০১ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৮.৫ ভাগে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৫ ভাগ হিন্দু বিতাড়িত হয়েছে ছলে বলে কৌশলে। এই বিতাড়ন প্রক্রিয়া গোটা সমাজের অভ্যন্তর থেকে ঘটেছে। রাজনীতি এই বিতাড়ন প্রক্রিয়াকে থামাতে তো পারেইনি বরং নীরবে উৎসাহিত করছে। আসলে হিন্দু-মুসলিম এই বৈরিতা রাজনীতির কারণেই অব্যাহতভাবে চলছে। এক একটি ঘটনা ঘটে আর লাখ লাখ স্বচ্ছল হিন্দুর মন ভেঙে যায়। তারা ভেবে নেয় এতদিন না গিয়ে ভুল করেছি।

একটা বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে গভীরভাবে। প্রায় পৌনে দুই কোটি হিন্দুকে কি আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো প্রায় বিতাড়িত করা সম্ভব? অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব। অভিজাত হিন্দুরা সাতচল্লিশেই চলে গেছে। পঞ্চাশের হামলা আর চৌষট্টীতে খুলনায় সবুর খানের একতরফা হিন্দু নিধনের পর, আর ১৯৬৫ এর পর মধ্যবিত্তরাও প্রায় চলে গেছে। এ কারণে ১৯৭৪ এ এসে ২৯.৭ থেকে দাঁড়াল ১৩.৫ শতাংশে। এখন আমরা যারা আছি তাদের অধিকাংশ বা আনুমানিক ১ কোটি নিম্নবর্ণের হিন্দু। কামার, কুমার, নাপিত, চাষা ও জেলেরাই এই বিশাল জনগোষ্ঠী। এদেশে এরা মানবেতর জীবনযাপন করে। ভারতে গেলেও তাদের তাই করে বাঁচতে হবে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ভাতই জুটে না। এদেশ থেকে গেলে এদের না খেয়েই মরতে হবে। সুতরাং ভনিতা ছাড়াই বলা যায় এদেশ থেকে হিন্দুদের আর ভাররতবাসী হওয়ার বাস্তব সুযোগ নেই।

তবে এদের থাকতে দেবার জন্য যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার কথা ছিল তা সজ্ঞানে ধ্বংস করা হয়েছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্র্রোতের বিপরীতে তরী বেয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা মাত্রই জিয়া সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তা বাদ দিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইসলামী আদর্শের নিচে চাপা দিলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের কাঁধে বন্দুক ছিল। বগলে ছিল ইসলামী আদর্শের স্বপ্ন।

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতা হতে পারতো হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে বেঁচে থাকার প্রধান কৌশল। জিয়া, এরশাদ, বেগম জিয়া ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে বানালেন ইসলামী বাংলাদেশ। পৃথিবীর অনেক দেশেই রাষ্ট্রকে ইসলামী করা হয়েছে। ফলাফল হয়েছে বেদনাদায়ক। বেশিরভাগ মুসলিম দেশে সংখ্যালঘু এমনভাবে উচ্ছেদ হয়েছে যে, নেই বললেই চলে। অর্ধশতকের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশ্ন, হিন্দু বিদ্বেষ সমস্যার সমাধান কি? এক ধরনের সমাধান এসেছিল একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের জন্ম হলো। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেই বললেন “আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান।” অর্থাৎ আগে এদেশের সব মানুষ বাঙালি অতঃপর হিন্দু বা মুসলমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কার্যত বাঙালিত্বকে হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর শুরু হলো ইসলামীকরণ। আমাদের বয়সীরা শুনলাম ভারত আমাদের শত্রু। বাংলাদেশে হিন্দু বিদ্বেষের জন্ম এই ভারত বিরোধিতা থেকে। জন্মদাতা বীরোত্তম জিয়া।

পৃথিবীর কোন দেশেই স্বাধীনতার বিরুদ্ধ আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করা যায় না। এ জন্যই বলি যতই কঠিন শোনাক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করে না এমন দলের নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ রহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাম্প্রতিক হামলাগুলোর বিচার করতে চাইছে। আমরা এর বিরোধী। সাম্প্রতিক মামলার সংখ্যা ২৮/১০/২০২১ পর্যন্ত ১১৬টি। সংখ্যালঘু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল করতে হবে শুধু ঢাকায়, এক বা একাধিক। তৃতীয়ত; সম্ভাব্য এই আইনে মৌখিক স্বাক্ষ্যের পরিবর্তে তথ্যপ্রযুক্তি ফলাফল ও পুলিশের সাক্ষীর ওপর বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে। সাইবার ল্যাবে যদি কারো চেহারা চিহ্নিত হয় তবে ভুক্তভোগীর সাক্ষীর প্রয়োজন কি? সম্ভ্যাব্য এই ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা’ আইনে দৃষ্টান্তমূলক ও দ্রুত শাস্তির বিধান রাখতে হবে। ভারতের মতো বহুদেশে ধর্ম মন্ত্রণালয় নেই। কারণ রাষ্ট্র এমন একটি মনুষ্য সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান, যা ধর্ম কি জিনিস বোঝার কথা নয়। এজন্য চাই সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়।

সবচেয়ে বড় কথা সংখ্যালঘু বিদ্বেষ নিরসনে একটি কমিশন গঠন করা যায়। কমিশনের দায়িত্ব হওয়া উচিত কোন কোন বৈষয়িক ও রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ বাড়ছে। ফলাফলের ভিত্তিতে যুগোপযুগী আইন ছাড়া বাঙালি জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাঙালি জাতিসত্তা ছাড়া আর কোন মতবাদ রাষ্ট্রের কাছে প্রাধান্য পাওয়ার সুযোগ নেই। বহু আপোস হয়েছে, এখন শুধুই অস্তিত্বের লড়াই।

[লেখক : আইনজীবী]