এসডিজি : অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কেন জরুরি

সাজেদুল ইসলাম

সবার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ হলো জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মূলমন্ত্র। ২০১৫ সালে বিশে^র সব দেশ কর্তৃক ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ গৃহীত হয়েছিল, যেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণ, ধরনী সুরক্ষা এবং সব মানুষ যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে শান্তি এবং সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে তার সার্বজনীন আহ্বান জানানো হয়েছিল। ‘কাউকেই পেছনে রাখা যাবে না’ এই অঙ্গীকারের মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্টসমূহ সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়নের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।

বর্তমানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আর্থ-সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথ্যনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ জীবনে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নানান বাধার সম্মুখীন হয়েছে তারা, যা কিনা টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়। অন্তর্র্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাভাবিক জীবনযত্রার মান নিশ্চিত করে। উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য আর্থ-সামাজিক বাধাগুলোকে অতিক্রম করে সবার পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা দরকার।

আমরা এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে হাঁটছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল কথা হচ্ছে সকল জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তকরণ। এই লক্ষ্যমাত্রার ১০ নাম্বারে বৈষম্য হ্রাস করার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো, তার নাগরিকদের সঠিক মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা, আর এই উন্নয়ন যাত্রায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সরকার বিশেষ ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, বিনা সুদে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সুবিধাসহ নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিলেও এখনও এই ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধীদের আর্থিক সম্পৃক্তায় অন্তর্ভুক্তি, দক্ষতা উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ, যথাযথ কর্মসংস্থান, প্রতিবন্ধীবান্ধব কর্ম-পরিবেশের ব্যবস্থা নেওয়া। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের আর্থিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টি, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যুগে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কর্মসূচি অত্যন্ত জরুরি। দারিদ্র্য ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগগুলোয় ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করা যায়। প্রতিবন্ধীদের সমাজের বাইরে রেখে সমতার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কাজের জায়গা সীমিত, তাদের এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি সমাজ ও ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সমাজে যে প্রচলিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেটা কোনোভাবেই একটি মানবিক সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না। প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সমাজ তৈরি করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার একযোগে কাজ করাটা জরুরি।

প্রতিবন্ধীদের জন্য যদি তাদের বিশেষ চাহিদাগুলো মাথায় রেখে ভৌত-অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবে তাদের কর্মক্ষমতা ও সক্ষমতা প্রচলিত ধারণার সুস্থ শরীরের থেকে কোনোভাবেই খাটো নয়। প্রতিবন্ধীবান্ধব ভৌত-অবকাঠামো নির্মাণ, প্রশিক্ষণ প্রদান ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে বাধাগুলো আছে সেগুলো দূরীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বার্ডো) জানায়, আমাদের দেশের প্রায় ৮%-১০% মানুষ কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের বিরাট একটি অংশ বৈষম্যের কারণে সমাজের মূলধারা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন এবং বঞ্চিত জীবন-যাপন করছে।

প্রায় এক যুগ হতে চললো বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাগ্যের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০১৭ এখনো মানা হচ্ছে না। দেশে এখনও প্রতিবন্ধীদের প্রবেশগম্যতার অভাব সর্বত্র, কারণ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানছে না কেউ। এছাড়া গণপরিবহন ব্যবস্থা এখনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বান্ধব নয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বৈষম্য বিরাজমান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের কমিটিগুলো কার্যকর হচ্ছে না।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে এখনও নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। ফলে তারা কর্মসংস্থান, শিক্ষা, সামাজিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকাংশই দারিদ্র্যতার মধ্যে দিনযাপন করে থাকে। প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি এখনও উন্নযন কর্মকা-ে যুক্ত করা হয়নি।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। প্রতিবন্ধীরা নানাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তাদের সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবন্ধীদের মতামত সাধারণত গ্রাহ্য করা হয় না এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের অধিকারসমুহ লঙ্ঘন করা হয়, যেটা শেষ পর্ষন্ত তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে ১৩ ডিসেম্ভর ২০০৬ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ক সনদ অনুমোদন করা হয়, যেটা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা সুরক্ষা, অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং তাদের সহজাত মর্যাদার প্রতি যথাযথভাবে সম্মানের জন্য গৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার সনদটি ৩০ নভেম্বর ২০০৭ সালে অনুস্বাক্ষর করে।

জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশকে উন্নয়নের বাহিরে রেখে কোন দেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কখনই সম্ভব নয়। জাতীয় উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থেই প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটি অধিকারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করার জন্য যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবেÑ যেখানে সবাই কোনরূপ বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারে। সংবিধানেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯নং ধারায় সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আবার সংবিধানের ২৮নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র কখনো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের সাথে বেষম্য করবে না। একইভাবে সংবিধানের ২৮(৪) ধারায় সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

এটা আমাদের প্রত্যাশা যে, আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীরা সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত হবে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবার অধিকার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গঠিত হবে। এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

মঙ্গলবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২২ , ২০ পৌষ ১৪২৮ ৩০ জমাদিউল আউয়াল

এসডিজি : অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কেন জরুরি

সাজেদুল ইসলাম

সবার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ হলো জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মূলমন্ত্র। ২০১৫ সালে বিশে^র সব দেশ কর্তৃক ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ গৃহীত হয়েছিল, যেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণ, ধরনী সুরক্ষা এবং সব মানুষ যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে শান্তি এবং সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে তার সার্বজনীন আহ্বান জানানো হয়েছিল। ‘কাউকেই পেছনে রাখা যাবে না’ এই অঙ্গীকারের মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্টসমূহ সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়নের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।

বর্তমানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আর্থ-সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথ্যনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ জীবনে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নানান বাধার সম্মুখীন হয়েছে তারা, যা কিনা টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়। অন্তর্র্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাভাবিক জীবনযত্রার মান নিশ্চিত করে। উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য আর্থ-সামাজিক বাধাগুলোকে অতিক্রম করে সবার পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা দরকার।

আমরা এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে হাঁটছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল কথা হচ্ছে সকল জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তকরণ। এই লক্ষ্যমাত্রার ১০ নাম্বারে বৈষম্য হ্রাস করার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো, তার নাগরিকদের সঠিক মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা, আর এই উন্নয়ন যাত্রায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সরকার বিশেষ ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, বিনা সুদে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য সুবিধাসহ নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিলেও এখনও এই ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধীদের আর্থিক সম্পৃক্তায় অন্তর্ভুক্তি, দক্ষতা উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ, যথাযথ কর্মসংস্থান, প্রতিবন্ধীবান্ধব কর্ম-পরিবেশের ব্যবস্থা নেওয়া। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের আর্থিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টি, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যুগে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কর্মসূচি অত্যন্ত জরুরি। দারিদ্র্য ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগগুলোয় ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করা যায়। প্রতিবন্ধীদের সমাজের বাইরে রেখে সমতার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কাজের জায়গা সীমিত, তাদের এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি সমাজ ও ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সমাজে যে প্রচলিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেটা কোনোভাবেই একটি মানবিক সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না। প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সমাজ তৈরি করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার একযোগে কাজ করাটা জরুরি।

প্রতিবন্ধীদের জন্য যদি তাদের বিশেষ চাহিদাগুলো মাথায় রেখে ভৌত-অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবে তাদের কর্মক্ষমতা ও সক্ষমতা প্রচলিত ধারণার সুস্থ শরীরের থেকে কোনোভাবেই খাটো নয়। প্রতিবন্ধীবান্ধব ভৌত-অবকাঠামো নির্মাণ, প্রশিক্ষণ প্রদান ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে বাধাগুলো আছে সেগুলো দূরীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বার্ডো) জানায়, আমাদের দেশের প্রায় ৮%-১০% মানুষ কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের বিরাট একটি অংশ বৈষম্যের কারণে সমাজের মূলধারা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন এবং বঞ্চিত জীবন-যাপন করছে।

প্রায় এক যুগ হতে চললো বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাগ্যের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০১৭ এখনো মানা হচ্ছে না। দেশে এখনও প্রতিবন্ধীদের প্রবেশগম্যতার অভাব সর্বত্র, কারণ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানছে না কেউ। এছাড়া গণপরিবহন ব্যবস্থা এখনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বান্ধব নয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বৈষম্য বিরাজমান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের কমিটিগুলো কার্যকর হচ্ছে না।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে এখনও নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। ফলে তারা কর্মসংস্থান, শিক্ষা, সামাজিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকাংশই দারিদ্র্যতার মধ্যে দিনযাপন করে থাকে। প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি এখনও উন্নযন কর্মকা-ে যুক্ত করা হয়নি।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। প্রতিবন্ধীরা নানাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তাদের সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবন্ধীদের মতামত সাধারণত গ্রাহ্য করা হয় না এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের অধিকারসমুহ লঙ্ঘন করা হয়, যেটা শেষ পর্ষন্ত তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনে ১৩ ডিসেম্ভর ২০০৬ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ক সনদ অনুমোদন করা হয়, যেটা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা সুরক্ষা, অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং তাদের সহজাত মর্যাদার প্রতি যথাযথভাবে সম্মানের জন্য গৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার সনদটি ৩০ নভেম্বর ২০০৭ সালে অনুস্বাক্ষর করে।

জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশকে উন্নয়নের বাহিরে রেখে কোন দেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কখনই সম্ভব নয়। জাতীয় উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থেই প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটি অধিকারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করার জন্য যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবেÑ যেখানে সবাই কোনরূপ বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারে। সংবিধানেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯নং ধারায় সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আবার সংবিধানের ২৮নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র কখনো ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের সাথে বেষম্য করবে না। একইভাবে সংবিধানের ২৮(৪) ধারায় সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

এটা আমাদের প্রত্যাশা যে, আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীরা সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত হবে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবার অধিকার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গঠিত হবে। এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]