ছেলে বনাম মেয়ে খেলোয়াড়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

সম্প্রতি সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কাকে ১২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ১-০ গোলে শক্তিশালী ভারতকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সনে ভুটানে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ নারী সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৭ সনে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের কিশোরীরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গৌরব অর্জন করেছিল। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলায় গত নভেম্বর মাসে পাকিস্তান নারী দলের বিপক্ষে জিতেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, প্রথমবারের মতো ২০২২ সনের ওয়ানডে বিশ্ব কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ছেলে ক্রিকেটারদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো শিরোপা লাভ করা সম্ভব না হলেও সেই অতৃপ্তি ঘুচিয়েছে মেয়েরা। ২০১৮ সনে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়া কাপে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শিরোপা পেল বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে পাকিস্তানকেও হারিয়েছে বাংলাদেশ।

মেয়েদের এই জয়ের কিছুদিন পূর্বে ছেলেদের টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হারের দিক থেকে সবার শীর্ষে ছিল; হেরেছে ছয়টি ম্যাচ। আইসিসির সহযোগী দেশ স্কটল্যান্ড এবং নামিবিয়াও বাংলাদেশের চেয়ে কম ম্যাচ হেরেছেÑএমন শোচনীয় হারে দেশবাসী অনেকদিন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। তবে বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে উজ্জীবিত ছিল খেলোয়াড় এবং দর্শক। কিন্তু খেলার যোগ্যতা অর্জন পর্বেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে গেল বাংলাদেশ। পাপুয়া নিউগিনি এবং ওমানকে হারিয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্ব নিশ্চিত করার পর সুপার টুয়েলভে পাঁচ ম্যাচের সবকটিতেই হেরে বাংলাদেশের সমর্থকদের দারুণভাবে হতাশ করেছে তারা। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপে লজ্জাজনক হারের পর ডিসেম্বর মাসে দেশের মাটিতে দুটি টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তানের সঙ্গে আরেকটি লজ্জাজনক হারের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। টি-টোয়েন্টি সিরিজের পর টেস্ট সিরিজেও বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করল পাকিস্তান, দুই দিনের বৃষ্টিও বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারেনি। মনে হয় বিশ্বকাপে হারার পর খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস তলানিতে নেমে গিয়েছিল, পয়েন্ট তালিকায় সবার নিচে ছিল।

বাঙালি মুসলমান এখনও মেয়েদের মাঠে নামাতে ইতস্তত করছে, মেয়েদের খেলাধুলায় মাঠে নামানো এখনও সহজ হচ্ছে না। শুরু থেকেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েদের ফুটবলে অংশগ্রহণ বেশি। সাফ ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা দলের ১১ সদস্যের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়ের সংখ্যা ছিল পাঁচজন, অথচ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র দুই শতাংশ। এই খেলায় বাংলাদেশ ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মারিয়া মান্ডা; তিনি ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের মেয়ে। ফুটবল খেলায় ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের কিশোরীদের আবির্ভাবে ফুটবল খেলায় প্রমীলা ফুটবলারদের নৈপুণ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েদের ফুটবলে নামডাক শুরু হয় কলসিন্দুরের মেয়েদের দিয়ে। ২০১৬ সনের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা ফুটবল বাছাই পর্বে উতরে মূল পর্বে উঠা ১১ জনের মধ্যে ৯ জনই ছিলেন কলসিন্দুরের। এই মেয়েরা এসেছে পার্বত্য জেলা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট এবং উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকে।

ক্রিকেটার মাশরাফি সাকিব, তামিম ইকবাল, মুশফিকের বার্ষিক আয়ের তুলনায় একেবারেই নস্যি ক্রিকেটার সালমা খাতুনদের আয়। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে খেলার মাঠে এলেও এদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দারুণ অবহেলা। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের বেতন ক্যাটাগরি অনুযায়ী দেয়া হয়ে থাকে, যিনি যেই ক্যাটাগরিতে থাকবেন তিনি সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাসিক বেতন পাবেন। একজন ছেলে ক্রিকেটার সর্বোচ্চ ৪-৬ লাখ টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন, এখন নাকি তা ৮ লাখে উন্নীত হচ্ছে; অন্যদিকে একজন নারী ক্রিকেটার পান সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা, তা বেড়ে হবে ৮০ হাজার টাকা, তবে ডি ক্যাটাগরির একজন নারী খেলোয়াড় পান মাত্র ২৫ হাজার টাকা। অবহেলার আরও কাহিনী শোনা যায়-অনূর্ধ্ব-১৬ আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতে ফিরার সময় নাকি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাসের ব্যবস্থা না করায় প্রাইভেট বাসে চড়ে নারী খেলোয়াড়দের পাবলিকের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। ২০১৫ সনে আন্তর্জাতিক হ্যান্ডবল ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত নারী হ্যান্ডবল দল পাকিস্তানকে হারিয়ে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তাদের সংবর্ধনাও দেয়া হয়নি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সাফল্য লাভ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু আর্থিক প্রণোদনা পেয়েছেন নারী খেলোয়াড়রা। এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলকে দুই কোটি টাকার আর্থিক পুরস্কার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু যারা চুক্তিবদ্ধ নন তাদের অবহেলা চরম পর্যায়ের। অনেক ক্লাবে নাকি মেয়েরা বিনা পারিশ্রমিকেই খেলতে বাধ্য হন, তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতে তথ্যটি সত্য নয়, খেলোয়াড়দের যাতায়াত-ভাড়া দেয়া হয়।

সমাজের কটূক্তি আর বিরূপ চাহনির জন্য মেয়ে সন্তানের মাঠের খেলায় অংশগ্রহণে মা-বাবাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণের একটি বড় বাধা পরিধেয় পোশাক। খেলাধুলার উপযোগী পোশাক পরে খেললে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তা মানতে চাইবে না; সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে খেলোয়াড়ারাও বিব্রতবোধ করে। আমাদের পরিবার ও সমাজ মেয়েদের চাকরিজীবী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও খেলাকে পেশা হিসেবে দেখতে একেবারেই প্রস্তুত নয়। তাই খেলাধুলায় নৈপুণ্য দেখিয়ে একটি চাকরি পাওয়ায় আশায় নিম্নবিত্তের মেয়েরা কোন একটি প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় খেলতে বেশি আগ্রহী। খেলাধুলার জগতে আসার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা পার হয়ে ক্রীড়া জগতে প্রবেশ করার পর দিনমজুরদের মতো পারিশ্রমিক দেয়া হলে আমাদের মেয়েদের এগুনো কঠিন হয়ে পড়বে। ধর্ম ও সমাজের বিরূপ পরিবেশে যুদ্ধ করে অনেকে টিকছেন না, এর মধ্যে আর্থিক অনটন না ঘুচলে মেয়েদের খেলাধুলায় মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। খেলাধুলায় কিন্তু উচ্চবিত্তের মেয়েরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না; মনে হচ্ছে আর্থিক দীনতা লাঘবের প্রত্যাশায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মেয়েরাই শুধু খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে।

আইসিসিও জানে বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট-পাগল। দেশের বাইরেও বাংলাদেশের প্রচুর সমর্থক রয়েছে। বাংলাদেশকে উৎসাহ দেয়ার জন্য প্রবাসেও হাজার হাজার বাঙালি কাজ ফেলে রেখে মাঠের গ্যালারিতে পতাকা হাতে জড় হয়; যেদিন বাংলাদেশের খেলা থাকে সেদিন গ্যালারি দর্শকে পূর্ণ থাকে। ইংল্যান্ডে যারা নাগরিকত্ব নিয়ে ওই দেশের আনুগত্য স্বীকার করেছে তারাও ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডকে সমর্থন না করে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে থাকে। সবার প্রত্যাশা বাংলাদেশ ভালো খেলুক। অতি সম্প্রতি নিউজিল্যা-ের মাটিতে টেস্ট খেলায় বাংলাদেশ ৮ উইকেটে বর্তমান বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে। বিগত ১১ বছরে নিউজিল্যা-ের মাটিতে এশিয়ার কেউ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট জিততে পারেনি; টানা ১৭ টেস্টে অপরাজিত ছিল কিউইরা। বাংলাদেশ এই প্রথম জিতল, তাই তো এই জয় বাংলাদেশের জন্য বিরাট প্রাপ্তি। শুধু তাই নয়, এই জয়ে এক লাফে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকার ৫ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ দল।

হারজিত খেলায় থাকবেই, পরাজয়ে হাল ছেড়ে দিলে জেতার সম্ভাবনার ক্ষেত্র আর তৈরি হয় না। মানুষ সব সময় জয়ের পক্ষে, ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীর গুণগান গেয়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার জয়ী হলে ইতিহাস লেখা হতো ভিন্ন আঙ্গিকে, হয়তো হিটলার হতো মহানায়ক। দু’দিন আগে যারা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল করেছে আজ তারা সবাই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে উচ্চকিত। দাপুটে বোলার ইবাদত হোসেনকে নিয়ে তো বাংলাদেশ বিমানবাহিনী অনেক গর্বিত; অথচ জয়ের একদিন আগেও জানতাম না যে ইবাদত হোসেন বিমানবাহিনীর সদস্য। জয়ের আনন্দে সবাই অংশীদার হতে চায়, মুমিনুল হক এবং লিটন দাসও হিরো হয়ে উঠেছে। আমাদের অবশ্যই খেলাকে গুরুত্ব দিতে হবে; কারণ শত শত দূতাবাস যা করতে পারে না, একজন মেরাদোনা, একজন নেইমার, একজন মেসি ও একজন সাকিব তার চেয়ে বেশি করতে পারে। আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দেয়ার জন্য একজন মেরাদোনা বা একজন মেসিই যথেষ্ট, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর জন্যই আমরা পর্তুগালকে বেশি করে চিনি, নেইমার না থাকলে শুধু সাম্বা নাচ দিয়ে ব্রাজিল এত জনপ্রিয় হতে পারতো না। মুশফিক ছাড়া সিনিয়র খেলোয়াড় ছিল নাÑনিউজিল্যা-ের এই টেস্টে নতুনদের তৈরি ইতিহাসের ভিত্তি শক্ত হোকÑএই প্রত্যাশা দেশবাসীর।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২২ , ২৫ পৌষ ১৪২৮ ৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

ছেলে বনাম মেয়ে খেলোয়াড়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

সম্প্রতি সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কাকে ১২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ১-০ গোলে শক্তিশালী ভারতকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সনে ভুটানে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ নারী সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৭ সনে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের কিশোরীরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় গৌরব অর্জন করেছিল। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলায় গত নভেম্বর মাসে পাকিস্তান নারী দলের বিপক্ষে জিতেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, প্রথমবারের মতো ২০২২ সনের ওয়ানডে বিশ্ব কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ছেলে ক্রিকেটারদের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো শিরোপা লাভ করা সম্ভব না হলেও সেই অতৃপ্তি ঘুচিয়েছে মেয়েরা। ২০১৮ সনে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়া কাপে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শিরোপা পেল বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে পাকিস্তানকেও হারিয়েছে বাংলাদেশ।

মেয়েদের এই জয়ের কিছুদিন পূর্বে ছেলেদের টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হারের দিক থেকে সবার শীর্ষে ছিল; হেরেছে ছয়টি ম্যাচ। আইসিসির সহযোগী দেশ স্কটল্যান্ড এবং নামিবিয়াও বাংলাদেশের চেয়ে কম ম্যাচ হেরেছেÑএমন শোচনীয় হারে দেশবাসী অনেকদিন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। তবে বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে উজ্জীবিত ছিল খেলোয়াড় এবং দর্শক। কিন্তু খেলার যোগ্যতা অর্জন পর্বেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে গেল বাংলাদেশ। পাপুয়া নিউগিনি এবং ওমানকে হারিয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্ব নিশ্চিত করার পর সুপার টুয়েলভে পাঁচ ম্যাচের সবকটিতেই হেরে বাংলাদেশের সমর্থকদের দারুণভাবে হতাশ করেছে তারা। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপে লজ্জাজনক হারের পর ডিসেম্বর মাসে দেশের মাটিতে দুটি টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তানের সঙ্গে আরেকটি লজ্জাজনক হারের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। টি-টোয়েন্টি সিরিজের পর টেস্ট সিরিজেও বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করল পাকিস্তান, দুই দিনের বৃষ্টিও বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারেনি। মনে হয় বিশ্বকাপে হারার পর খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস তলানিতে নেমে গিয়েছিল, পয়েন্ট তালিকায় সবার নিচে ছিল।

বাঙালি মুসলমান এখনও মেয়েদের মাঠে নামাতে ইতস্তত করছে, মেয়েদের খেলাধুলায় মাঠে নামানো এখনও সহজ হচ্ছে না। শুরু থেকেই দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়েদের ফুটবলে অংশগ্রহণ বেশি। সাফ ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা দলের ১১ সদস্যের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মেয়ের সংখ্যা ছিল পাঁচজন, অথচ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র দুই শতাংশ। এই খেলায় বাংলাদেশ ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মারিয়া মান্ডা; তিনি ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের মেয়ে। ফুটবল খেলায় ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের কিশোরীদের আবির্ভাবে ফুটবল খেলায় প্রমীলা ফুটবলারদের নৈপুণ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েদের ফুটবলে নামডাক শুরু হয় কলসিন্দুরের মেয়েদের দিয়ে। ২০১৬ সনের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা ফুটবল বাছাই পর্বে উতরে মূল পর্বে উঠা ১১ জনের মধ্যে ৯ জনই ছিলেন কলসিন্দুরের। এই মেয়েরা এসেছে পার্বত্য জেলা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট এবং উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকে।

ক্রিকেটার মাশরাফি সাকিব, তামিম ইকবাল, মুশফিকের বার্ষিক আয়ের তুলনায় একেবারেই নস্যি ক্রিকেটার সালমা খাতুনদের আয়। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে খেলার মাঠে এলেও এদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দারুণ অবহেলা। চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের বেতন ক্যাটাগরি অনুযায়ী দেয়া হয়ে থাকে, যিনি যেই ক্যাটাগরিতে থাকবেন তিনি সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাসিক বেতন পাবেন। একজন ছেলে ক্রিকেটার সর্বোচ্চ ৪-৬ লাখ টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন, এখন নাকি তা ৮ লাখে উন্নীত হচ্ছে; অন্যদিকে একজন নারী ক্রিকেটার পান সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা, তা বেড়ে হবে ৮০ হাজার টাকা, তবে ডি ক্যাটাগরির একজন নারী খেলোয়াড় পান মাত্র ২৫ হাজার টাকা। অবহেলার আরও কাহিনী শোনা যায়-অনূর্ধ্ব-১৬ আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতে ফিরার সময় নাকি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাসের ব্যবস্থা না করায় প্রাইভেট বাসে চড়ে নারী খেলোয়াড়দের পাবলিকের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। ২০১৫ সনে আন্তর্জাতিক হ্যান্ডবল ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত নারী হ্যান্ডবল দল পাকিস্তানকে হারিয়ে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তাদের সংবর্ধনাও দেয়া হয়নি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সাফল্য লাভ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু আর্থিক প্রণোদনা পেয়েছেন নারী খেলোয়াড়রা। এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলকে দুই কোটি টাকার আর্থিক পুরস্কার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু যারা চুক্তিবদ্ধ নন তাদের অবহেলা চরম পর্যায়ের। অনেক ক্লাবে নাকি মেয়েরা বিনা পারিশ্রমিকেই খেলতে বাধ্য হন, তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতে তথ্যটি সত্য নয়, খেলোয়াড়দের যাতায়াত-ভাড়া দেয়া হয়।

সমাজের কটূক্তি আর বিরূপ চাহনির জন্য মেয়ে সন্তানের মাঠের খেলায় অংশগ্রহণে মা-বাবাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণের একটি বড় বাধা পরিধেয় পোশাক। খেলাধুলার উপযোগী পোশাক পরে খেললে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তা মানতে চাইবে না; সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে খেলোয়াড়ারাও বিব্রতবোধ করে। আমাদের পরিবার ও সমাজ মেয়েদের চাকরিজীবী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও খেলাকে পেশা হিসেবে দেখতে একেবারেই প্রস্তুত নয়। তাই খেলাধুলায় নৈপুণ্য দেখিয়ে একটি চাকরি পাওয়ায় আশায় নিম্নবিত্তের মেয়েরা কোন একটি প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় খেলতে বেশি আগ্রহী। খেলাধুলার জগতে আসার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা পার হয়ে ক্রীড়া জগতে প্রবেশ করার পর দিনমজুরদের মতো পারিশ্রমিক দেয়া হলে আমাদের মেয়েদের এগুনো কঠিন হয়ে পড়বে। ধর্ম ও সমাজের বিরূপ পরিবেশে যুদ্ধ করে অনেকে টিকছেন না, এর মধ্যে আর্থিক অনটন না ঘুচলে মেয়েদের খেলাধুলায় মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। খেলাধুলায় কিন্তু উচ্চবিত্তের মেয়েরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না; মনে হচ্ছে আর্থিক দীনতা লাঘবের প্রত্যাশায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মেয়েরাই শুধু খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে।

আইসিসিও জানে বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট-পাগল। দেশের বাইরেও বাংলাদেশের প্রচুর সমর্থক রয়েছে। বাংলাদেশকে উৎসাহ দেয়ার জন্য প্রবাসেও হাজার হাজার বাঙালি কাজ ফেলে রেখে মাঠের গ্যালারিতে পতাকা হাতে জড় হয়; যেদিন বাংলাদেশের খেলা থাকে সেদিন গ্যালারি দর্শকে পূর্ণ থাকে। ইংল্যান্ডে যারা নাগরিকত্ব নিয়ে ওই দেশের আনুগত্য স্বীকার করেছে তারাও ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডকে সমর্থন না করে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে থাকে। সবার প্রত্যাশা বাংলাদেশ ভালো খেলুক। অতি সম্প্রতি নিউজিল্যা-ের মাটিতে টেস্ট খেলায় বাংলাদেশ ৮ উইকেটে বর্তমান বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে। বিগত ১১ বছরে নিউজিল্যা-ের মাটিতে এশিয়ার কেউ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট জিততে পারেনি; টানা ১৭ টেস্টে অপরাজিত ছিল কিউইরা। বাংলাদেশ এই প্রথম জিতল, তাই তো এই জয় বাংলাদেশের জন্য বিরাট প্রাপ্তি। শুধু তাই নয়, এই জয়ে এক লাফে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকার ৫ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ দল।

হারজিত খেলায় থাকবেই, পরাজয়ে হাল ছেড়ে দিলে জেতার সম্ভাবনার ক্ষেত্র আর তৈরি হয় না। মানুষ সব সময় জয়ের পক্ষে, ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীর গুণগান গেয়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার জয়ী হলে ইতিহাস লেখা হতো ভিন্ন আঙ্গিকে, হয়তো হিটলার হতো মহানায়ক। দু’দিন আগে যারা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল করেছে আজ তারা সবাই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে উচ্চকিত। দাপুটে বোলার ইবাদত হোসেনকে নিয়ে তো বাংলাদেশ বিমানবাহিনী অনেক গর্বিত; অথচ জয়ের একদিন আগেও জানতাম না যে ইবাদত হোসেন বিমানবাহিনীর সদস্য। জয়ের আনন্দে সবাই অংশীদার হতে চায়, মুমিনুল হক এবং লিটন দাসও হিরো হয়ে উঠেছে। আমাদের অবশ্যই খেলাকে গুরুত্ব দিতে হবে; কারণ শত শত দূতাবাস যা করতে পারে না, একজন মেরাদোনা, একজন নেইমার, একজন মেসি ও একজন সাকিব তার চেয়ে বেশি করতে পারে। আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করে দেয়ার জন্য একজন মেরাদোনা বা একজন মেসিই যথেষ্ট, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর জন্যই আমরা পর্তুগালকে বেশি করে চিনি, নেইমার না থাকলে শুধু সাম্বা নাচ দিয়ে ব্রাজিল এত জনপ্রিয় হতে পারতো না। মুশফিক ছাড়া সিনিয়র খেলোয়াড় ছিল নাÑনিউজিল্যা-ের এই টেস্টে নতুনদের তৈরি ইতিহাসের ভিত্তি শক্ত হোকÑএই প্রত্যাশা দেশবাসীর।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]