প্রমাণ হলো বাংলাদেশও পারে : শেখ হাসিনা

জনগণ পাশে দাঁড়িয়েছে, সমর্থন দিয়েছেন বলেই ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণ সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সেতু নির্মাণে যারা বাধা সৃষ্টি করেছিল, সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তাদের উপযুক্ত জবাব দেয়া গেছে। প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশও পারে। গতকাল উদ্বোধনের পর গাড়িবহর নিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে মাদারীপুরের শিবচরে আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্যে দলটির প্রধান শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

দেশের উন্নয়নে প্রয়োজনে ‘জীবন দিয়ে’ হলেও কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য এই দিনটি ‘বিশেষ’ দিন উল্লেখ করে গোপালগঞ্জের মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই শরীয়তপুরে যখন এসেছি, তখন কী ছিল? লঞ্চে করে এসেছি, লঞ্চ নষ্ট হয়ে গেছে। নৌকায় করে একেকটা এলাকায় গিয়েছি, মিটিং করেছি। আজকে সেই শরীয়তপুরে অবস্থা পাল্টে গেছে। কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাস্তাঘাট, ব্রিজের উন্নয়ন হয়েছে। মাদারীপুরেও একই অবস্থা ছিল। গোপালগঞ্জ যেতে ২২ ঘণ্টা সময় লাগত। প্রত্যেকটা এলাকা এত দুর্গম ছিল। রাস্তাঘাট করেছি বলেই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে।’

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর কষ্ট করতে হবে না উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে কারও সন্তান হারাতে হবে না। বাবা, মাকে হারাতে হবে না। ভাই, বোনকে হারাতে হবে না। পদ্মা সেতুতে আপনারা নির্দ্বিধায় চলতে পারবেন। আর যারা বাধা দিয়েছে, তাদের উপযুক্ত জবাব দিয়েছি। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে জবাব দিয়েছি যে, বাংলাদেশ পারে।’ এই সেতু বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে দক্ষিণের ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহয়াক হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এর আগে সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত সুধী সমাবেশেও বক্তব্য রাখেন শেখ হাসিনা। বক্তব্য শেষে দুপুর ১২টার একটু আগে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের ফলক উন্মোচন করেন তিনি। পরে গাড়িবহর নিয়ে সেতু পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে যান, সেখানেও আরেকটি ফলক উন্মোচন করেন।

শিবচরের জনসভায় সরকারপ্রধানের বক্তব্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি উঠে আসে।

দুর্নীতি নয় বরং ‘ড. ইউনূসের তদবিরেই’ পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গিয়েছিল তা আবারও বলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কে দুর্নীতি করেছে? এই সেতু আমাদের প্রাণের সেতু। যে সেতুর সঙ্গে আমার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত, সেই সেতু করতে যেয়ে কেন দুর্নীতি হবে?’

সেতু নির্মাণে দৃঢ় সংকল্পের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী লোক বলেছিল নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আজ নিজেদের টাকায় কীভাবে পদ্মা সেতু করতে পারলাম? আপনারা, এই বাংলাদেশের জনগণ, আপনারা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন; পাশে দাঁড়িয়েছেন। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। এটা আমি বিশ্বাস করি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য (২০০১ সালে) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। খালেদা জিয়া এসে তা বন্ধ করে দিয়েছিল।’ ২০০৯ সালে আমরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার কাজ শুরু করি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন তারা (বিএনপি) কী বলেছিল? বলেছিল আওয়ামী লীগ কখনও পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না। খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞাসা করি, আসুন, দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি না।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা এই সেতু নির্মাণে বাধার সৃষ্টি করেছিল তাদের এই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে উপযুক্ত একটা জবাব আমরা দিতে পেরেছি, না, বাংলাদেশ পারে। আর বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই এবং ভবিষ্যতেও পারবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছি। সারাদেশে আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি। আজকে পদ্মা সেতু হয়েছে। এখানেও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, শিল্পাঞ্চল হবে, কর্মসংস্থান হবে, কল-কারখানা হবে, আমাদের ফসল উৎপাদন হবে। সেই ফসল আমরা প্রক্রিয়াজাত করতে পারব। দেশে-বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। এখানে যে মাছ হবে, তা আমরা প্রক্রিয়াজাত করে দেশে-বিদেশে পাঠাতে পারব। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে যাবে। ভাগ্য পরিবর্তন হবে।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনাভাইরাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি সবাইকে টিকা গ্রহণের এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলারও পরামর্শ দেন। পাশাপাশি, দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান তিনি।

আগামী প্রজন্মের উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে ‘যেকোন ত্যাগ স্বীকারে’ তিনি সর্বদা প্রস্তুত আছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আপনাদের কাছে এটাই আমার ওয়াদা।’

এদিকে মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও উঠে আসে পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় তৈরি হওয়া নানা প্রতিবন্ধকতার কথা। পাশাপাশি সে সময় সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই শক্তি পাওয়ার কথা জানান তিনি। জনগণকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে সুধী সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি, আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। আমিও আনন্দিত ও গর্বিত, উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আমরা আজ এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি। পদ্মা সেতু শুধুই একটি সেতু নয়। এই সেতু দুপারে যে বন্ধন তৈরি করেছে তা-ও নয়, এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্টের তৈরি একটি অবকাঠামো নয়; এই সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব।’ তিনি বলেন, ‘মানুষের শক্তি বড় শক্তি, সেই শক্তি নিয়েই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেছিলাম। জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা। পদ্মা সেতু সফলভাবে নির্মাণের জন্য জনগণকে স্যালুট জানাই।’

ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণে দুই বছর বিলম্বের কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা কিন্তু কখনও হতোদ্যম হইনি, হতাশ হইনি এবং শেষ পর্যন্ত সব অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি। আজকে পদ্মার বুকে লাল-নীল আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ, এই স্তম্ভ যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু এটুকুই বলব- যখন সব প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়াল, তখন পার্লামেন্টে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করব, নিজস্ব অর্থায়নে করব। এ ঘোষণার পর আমার দেশবাসী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম। মানুষের শক্তি বড় শক্তি, সেই শক্তি নিয়েই এই সেতুর নির্মাণকাজ আমি শুরু করি।’ আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘অনেকের মন্তব্য ছিল, নিজস্ব অর্থায়নে আবার কীভাবে করব? ধারণা ছিল এই বাংলাদেশ সারা জীবন পরনির্ভরশীল থাকবে, আর অন্যের দয়ার ওপরই চলতে হবে। জাতির পিতা আমাদের শিখিয়েছেন আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে।’

দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেদিন তারা শুধু আমার পাশে দাঁড়াননি, অনেকে অর্থ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। যে যতটুকু পেরেছিলেন। আমি বলেছিলাম, আমরা বাজেট থেকে করতে পারব, ওটাও তো জনগণেরই টাকা। আল্লাহর রহমতে আমরা সেটাই করেছি। যারা তখন বলেছিলেন, এটা হবে না, নিজস্ব অর্থায়নে সম্ভব না, এটা একটা স্বপ্নমাত্র, এটার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ইত্যাদি। যাহোক আমার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অনুযোগ নেই।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের চিন্তার দৈন্য আছে, আত্মবিশ্বাসের দৈন্য আছে। আমি মনে করি এতে তাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। বাংলাদেশের জনগণই হচ্ছে আমার সাহসের ঠিকানা, তাই জনগণকে আমি স্যালুট জানাই। আশা করি, এ সেতুর কাজ বন্ধ করতে যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, তাদের হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে, দেশের মানুষের প্রতি তারা দায়িত্ববান হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যার অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই, এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।’

রবিবার, ২৬ জুন ২০২২ , ১২ আষাড় ১৪২৮ ২৬ জিলকদ ১৪৪৩

প্রমাণ হলো বাংলাদেশও পারে : শেখ হাসিনা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

জনগণ পাশে দাঁড়িয়েছে, সমর্থন দিয়েছেন বলেই ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণ সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সেতু নির্মাণে যারা বাধা সৃষ্টি করেছিল, সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তাদের উপযুক্ত জবাব দেয়া গেছে। প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশও পারে। গতকাল উদ্বোধনের পর গাড়িবহর নিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে মাদারীপুরের শিবচরে আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্যে দলটির প্রধান শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

দেশের উন্নয়নে প্রয়োজনে ‘জীবন দিয়ে’ হলেও কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য এই দিনটি ‘বিশেষ’ দিন উল্লেখ করে গোপালগঞ্জের মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই শরীয়তপুরে যখন এসেছি, তখন কী ছিল? লঞ্চে করে এসেছি, লঞ্চ নষ্ট হয়ে গেছে। নৌকায় করে একেকটা এলাকায় গিয়েছি, মিটিং করেছি। আজকে সেই শরীয়তপুরে অবস্থা পাল্টে গেছে। কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাস্তাঘাট, ব্রিজের উন্নয়ন হয়েছে। মাদারীপুরেও একই অবস্থা ছিল। গোপালগঞ্জ যেতে ২২ ঘণ্টা সময় লাগত। প্রত্যেকটা এলাকা এত দুর্গম ছিল। রাস্তাঘাট করেছি বলেই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে।’

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর কষ্ট করতে হবে না উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে কারও সন্তান হারাতে হবে না। বাবা, মাকে হারাতে হবে না। ভাই, বোনকে হারাতে হবে না। পদ্মা সেতুতে আপনারা নির্দ্বিধায় চলতে পারবেন। আর যারা বাধা দিয়েছে, তাদের উপযুক্ত জবাব দিয়েছি। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে জবাব দিয়েছি যে, বাংলাদেশ পারে।’ এই সেতু বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে দক্ষিণের ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহয়াক হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এর আগে সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত সুধী সমাবেশেও বক্তব্য রাখেন শেখ হাসিনা। বক্তব্য শেষে দুপুর ১২টার একটু আগে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের ফলক উন্মোচন করেন তিনি। পরে গাড়িবহর নিয়ে সেতু পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে যান, সেখানেও আরেকটি ফলক উন্মোচন করেন।

শিবচরের জনসভায় সরকারপ্রধানের বক্তব্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি উঠে আসে।

দুর্নীতি নয় বরং ‘ড. ইউনূসের তদবিরেই’ পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গিয়েছিল তা আবারও বলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কে দুর্নীতি করেছে? এই সেতু আমাদের প্রাণের সেতু। যে সেতুর সঙ্গে আমার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত, সেই সেতু করতে যেয়ে কেন দুর্নীতি হবে?’

সেতু নির্মাণে দৃঢ় সংকল্পের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী লোক বলেছিল নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আজ নিজেদের টাকায় কীভাবে পদ্মা সেতু করতে পারলাম? আপনারা, এই বাংলাদেশের জনগণ, আপনারা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন; পাশে দাঁড়িয়েছেন। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। এটা আমি বিশ্বাস করি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য (২০০১ সালে) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। খালেদা জিয়া এসে তা বন্ধ করে দিয়েছিল।’ ২০০৯ সালে আমরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার কাজ শুরু করি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন তারা (বিএনপি) কী বলেছিল? বলেছিল আওয়ামী লীগ কখনও পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না। খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞাসা করি, আসুন, দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি না।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা এই সেতু নির্মাণে বাধার সৃষ্টি করেছিল তাদের এই পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে উপযুক্ত একটা জবাব আমরা দিতে পেরেছি, না, বাংলাদেশ পারে। আর বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই এবং ভবিষ্যতেও পারবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছি। সারাদেশে আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি। আজকে পদ্মা সেতু হয়েছে। এখানেও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, শিল্পাঞ্চল হবে, কর্মসংস্থান হবে, কল-কারখানা হবে, আমাদের ফসল উৎপাদন হবে। সেই ফসল আমরা প্রক্রিয়াজাত করতে পারব। দেশে-বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। এখানে যে মাছ হবে, তা আমরা প্রক্রিয়াজাত করে দেশে-বিদেশে পাঠাতে পারব। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে যাবে। ভাগ্য পরিবর্তন হবে।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনাভাইরাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি সবাইকে টিকা গ্রহণের এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলারও পরামর্শ দেন। পাশাপাশি, দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান তিনি।

আগামী প্রজন্মের উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে ‘যেকোন ত্যাগ স্বীকারে’ তিনি সর্বদা প্রস্তুত আছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আপনাদের কাছে এটাই আমার ওয়াদা।’

এদিকে মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও উঠে আসে পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় তৈরি হওয়া নানা প্রতিবন্ধকতার কথা। পাশাপাশি সে সময় সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই শক্তি পাওয়ার কথা জানান তিনি। জনগণকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে সুধী সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি, আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। আমিও আনন্দিত ও গর্বিত, উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আমরা আজ এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি। পদ্মা সেতু শুধুই একটি সেতু নয়। এই সেতু দুপারে যে বন্ধন তৈরি করেছে তা-ও নয়, এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্টের তৈরি একটি অবকাঠামো নয়; এই সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব।’ তিনি বলেন, ‘মানুষের শক্তি বড় শক্তি, সেই শক্তি নিয়েই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেছিলাম। জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা। পদ্মা সেতু সফলভাবে নির্মাণের জন্য জনগণকে স্যালুট জানাই।’

ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণে দুই বছর বিলম্বের কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা কিন্তু কখনও হতোদ্যম হইনি, হতাশ হইনি এবং শেষ পর্যন্ত সব অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি। আজকে পদ্মার বুকে লাল-নীল আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ, এই স্তম্ভ যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু এটুকুই বলব- যখন সব প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়াল, তখন পার্লামেন্টে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করব, নিজস্ব অর্থায়নে করব। এ ঘোষণার পর আমার দেশবাসী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম। মানুষের শক্তি বড় শক্তি, সেই শক্তি নিয়েই এই সেতুর নির্মাণকাজ আমি শুরু করি।’ আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘অনেকের মন্তব্য ছিল, নিজস্ব অর্থায়নে আবার কীভাবে করব? ধারণা ছিল এই বাংলাদেশ সারা জীবন পরনির্ভরশীল থাকবে, আর অন্যের দয়ার ওপরই চলতে হবে। জাতির পিতা আমাদের শিখিয়েছেন আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে।’

দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেদিন তারা শুধু আমার পাশে দাঁড়াননি, অনেকে অর্থ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। যে যতটুকু পেরেছিলেন। আমি বলেছিলাম, আমরা বাজেট থেকে করতে পারব, ওটাও তো জনগণেরই টাকা। আল্লাহর রহমতে আমরা সেটাই করেছি। যারা তখন বলেছিলেন, এটা হবে না, নিজস্ব অর্থায়নে সম্ভব না, এটা একটা স্বপ্নমাত্র, এটার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ইত্যাদি। যাহোক আমার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অনুযোগ নেই।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের চিন্তার দৈন্য আছে, আত্মবিশ্বাসের দৈন্য আছে। আমি মনে করি এতে তাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। বাংলাদেশের জনগণই হচ্ছে আমার সাহসের ঠিকানা, তাই জনগণকে আমি স্যালুট জানাই। আশা করি, এ সেতুর কাজ বন্ধ করতে যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, তাদের হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে, দেশের মানুষের প্রতি তারা দায়িত্ববান হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যার অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই, এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।’