নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার ছয় মাসে ২০৮৩ নারী ও শিশু

  • ধর্ষণ ৭৩১
  • প্রতিরোধে ৩২ সুপারিশ মহিলা পরিষদের

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২ হাজার ৮৩ নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের হারও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচার সুফিয়া কামাল ভবন মিলনায়তনে ‘বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতি, অব্যাহত নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সামাজিক নিরাপত্তা’র দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নসহ সব প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েশিশুদের সমঅধিকার নিশ্চিত করা, উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, হত্যা ও নিপীড়নরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাসহ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৩২টি সুপারিশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, লিগ্যাল এইডের পরিচালক মাকসুদা আক্তারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা বলেন, নারী ও কন্যার প্রতি এই ধরনের সহিংসতা নারীর অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করছে এবং নারীর স্বাধীন চলাচল ও উন্নয়নের ধারার গতি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সমাজের মধ্যে নানা ধরনের অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি একটি বিশেষ পরিস্থিতি হিসেবে ঘোষণা করে সমগ্র জাতিকে এই বিষয়টিকে জাতীয় সমস্যা বিবেচনা করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আয়শা খানম বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানসহ সব জনগণের উদ্যোগে প্রচারাভিযান এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি নারী আন্দোলনের সুপারিশগুলোকে গুরুত্বে সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে আহ্বান জানান।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংরক্ষিত ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে জানুয়ারি-জুন (২০১৯ ) সময়কালে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিসহ মোট ২ হাজার ৮৩ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৭৩১টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৯২ জন, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে, এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৩ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৫৪ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭০ জন। অ্যাসিডদগ্ধের শিকার হয়েছেন ১৮ জন, এর মধ্য ২ জনের এসিডদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে ৩৭ জন, তার মধ্যে ৯ জন অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৬৩টি এবং নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটেছে ৩টি। বিভিন্ন কারণে ২৭৬ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯৪ জন, এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৪৭ জনকে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১৭ জন। উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৪৬ জন, এর মধ্যে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ৯ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ১০৬ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, এর মধ্যে আত্মহত্যায় প্ররোচনার শিকার ৩৭ জন এবং ১০৩ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ৭১টি ও বাল্যবিয়ের প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে ২৯টি। এছাড়া অন্যান্যরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে আরও বলা হয়, নারী ও কন্যাদের উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা নিত্যদিনের খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪-১৮ সময়কালে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিসহ মোট ৫ হাজার ২৭৪ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৩ হাজার ৯৮০ জন। তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৪৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪৯ জনকে, এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৭৩০ জনকে। উত্ত্যক্ত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে এক হাজার ৫৭৯ জন। তার মধ্যে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে এক হাজার ৪৭৭ জনকে, উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ১০২ জন, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নির্যাতন করা হয়েছে ৭৬ জনকে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫০২ জন। এসব ঘটনায় মাত্র ৩-৪ শতাংশ এর মামলায় সাজা দেয়া সম্ভব হয়েছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে যা নারী আন্দোলনকে ভাবিয়ে তুলেছে।

মহিলা পরিষদের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নরোধে হাইকোর্টের রায়ের আলোকে পৃথক আইন প্রণয়ন করা; নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করা; বিচারকাজের সঙ্গে যুক্ত সম্মানিত বিচারকরা, আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ সূচিতে নারীর মানবাধিকারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা; কারও হেফাজতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে ঘটনার শিকার নারী ও কন্যার পরিবর্তে তাকে প্রমাণ করতে হবে সে এ ঘটনা ঘটায়নি মর্মে প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করা। ১৮ বছর এর আগে বিয়ে নয়, এ বিষয়ে সরকারকে ব্যাপক প্রচারণা চালানো; নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতন বন্ধে যে আইনগুলো রয়েছে সেই আইনগুলো সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা; পারিবারিক সুরক্ষামূলক আইনগুলোসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা চালানো; নারী ও কন্যার প্রতি সবপ্রকার সহিংসতারোধে তরুণ-যুবসমাজকে সচেতনকরণ সাপেক্ষে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত করা; আন্তর্জাতিক সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর ওপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা।

এছাড়া বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার দিতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করা; মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এবং ওসিসির কার্যক্রম দেশব্যাপী প্রচার ও বিস্তৃত করা; নারী ও কন্যার প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে নারী-পুরুষের সমতার ধারণা, নারীর মানবাধিকার ইস্যুগুলো সমন্বিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা; মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পৃথক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় করা; প্রজাতন্ত্রের সেবা প্রদানের সব স্তরে পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে জবাবদিহি নিশ্চিত করা; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি এবং শাস্তির আওতায় আনা; স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই লক্ষ্যে লোকাল গভ. অ্যাক্টের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা; জাতিধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সব জনগণের নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া; দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সুনিশ্চিত করা; ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষ, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, পরিবার সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নারী নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করা; সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের বিচার নিশ্চিত করাসহ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; যেসব সীমানা দিয়ে অবাধে মাদকদ্রব্য আসছে, সেসব জায়গায় তৎপরতা বৃদ্ধি করা উল্লেখ্যযোগ্য।

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০১৯ , ২৫ আষাঢ় ১৪২৫, ৫ জ্বিলকদ ১৪৪০

নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার ছয় মাসে ২০৮৩ নারী ও শিশু

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

  • ধর্ষণ ৭৩১
  • প্রতিরোধে ৩২ সুপারিশ মহিলা পরিষদের

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২ হাজার ৮৩ নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের হারও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচার সুফিয়া কামাল ভবন মিলনায়তনে ‘বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতি, অব্যাহত নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সামাজিক নিরাপত্তা’র দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নসহ সব প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েশিশুদের সমঅধিকার নিশ্চিত করা, উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, হত্যা ও নিপীড়নরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাসহ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৩২টি সুপারিশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, লিগ্যাল এইডের পরিচালক মাকসুদা আক্তারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা বলেন, নারী ও কন্যার প্রতি এই ধরনের সহিংসতা নারীর অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করছে এবং নারীর স্বাধীন চলাচল ও উন্নয়নের ধারার গতি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সমাজের মধ্যে নানা ধরনের অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি একটি বিশেষ পরিস্থিতি হিসেবে ঘোষণা করে সমগ্র জাতিকে এই বিষয়টিকে জাতীয় সমস্যা বিবেচনা করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আয়শা খানম বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানসহ সব জনগণের উদ্যোগে প্রচারাভিযান এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি নারী আন্দোলনের সুপারিশগুলোকে গুরুত্বে সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে আহ্বান জানান।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংরক্ষিত ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে জানুয়ারি-জুন (২০১৯ ) সময়কালে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিসহ মোট ২ হাজার ৮৩ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৭৩১টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৯২ জন, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে, এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৩ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৫৪ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭০ জন। অ্যাসিডদগ্ধের শিকার হয়েছেন ১৮ জন, এর মধ্য ২ জনের এসিডদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে ৩৭ জন, তার মধ্যে ৯ জন অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৬৩টি এবং নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটেছে ৩টি। বিভিন্ন কারণে ২৭৬ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯৪ জন, এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৪৭ জনকে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১৭ জন। উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৪৬ জন, এর মধ্যে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ৯ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ১০৬ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, এর মধ্যে আত্মহত্যায় প্ররোচনার শিকার ৩৭ জন এবং ১০৩ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ৭১টি ও বাল্যবিয়ের প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে ২৯টি। এছাড়া অন্যান্যরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে আরও বলা হয়, নারী ও কন্যাদের উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা নিত্যদিনের খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪-১৮ সময়কালে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিসহ মোট ৫ হাজার ২৭৪ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৩ হাজার ৯৮০ জন। তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৪৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪৯ জনকে, এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৭৩০ জনকে। উত্ত্যক্ত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে এক হাজার ৫৭৯ জন। তার মধ্যে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে এক হাজার ৪৭৭ জনকে, উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ১০২ জন, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নির্যাতন করা হয়েছে ৭৬ জনকে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫০২ জন। এসব ঘটনায় মাত্র ৩-৪ শতাংশ এর মামলায় সাজা দেয়া সম্ভব হয়েছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে যা নারী আন্দোলনকে ভাবিয়ে তুলেছে।

মহিলা পরিষদের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নরোধে হাইকোর্টের রায়ের আলোকে পৃথক আইন প্রণয়ন করা; নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করা; বিচারকাজের সঙ্গে যুক্ত সম্মানিত বিচারকরা, আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ সূচিতে নারীর মানবাধিকারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা; কারও হেফাজতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে ঘটনার শিকার নারী ও কন্যার পরিবর্তে তাকে প্রমাণ করতে হবে সে এ ঘটনা ঘটায়নি মর্মে প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করা। ১৮ বছর এর আগে বিয়ে নয়, এ বিষয়ে সরকারকে ব্যাপক প্রচারণা চালানো; নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতন বন্ধে যে আইনগুলো রয়েছে সেই আইনগুলো সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা; পারিবারিক সুরক্ষামূলক আইনগুলোসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা চালানো; নারী ও কন্যার প্রতি সবপ্রকার সহিংসতারোধে তরুণ-যুবসমাজকে সচেতনকরণ সাপেক্ষে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত করা; আন্তর্জাতিক সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর ওপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা।

এছাড়া বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার দিতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করা; মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এবং ওসিসির কার্যক্রম দেশব্যাপী প্রচার ও বিস্তৃত করা; নারী ও কন্যার প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে নারী-পুরুষের সমতার ধারণা, নারীর মানবাধিকার ইস্যুগুলো সমন্বিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা; মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পৃথক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় করা; প্রজাতন্ত্রের সেবা প্রদানের সব স্তরে পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে জবাবদিহি নিশ্চিত করা; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি এবং শাস্তির আওতায় আনা; স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই লক্ষ্যে লোকাল গভ. অ্যাক্টের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা; জাতিধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সব জনগণের নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া; দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সুনিশ্চিত করা; ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারী-পুরুষ, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, পরিবার সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নারী নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করা; সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের বিচার নিশ্চিত করাসহ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; যেসব সীমানা দিয়ে অবাধে মাদকদ্রব্য আসছে, সেসব জায়গায় তৎপরতা বৃদ্ধি করা উল্লেখ্যযোগ্য।