অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ

সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে মামলা

ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এসকে সিনহা) ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিটপ্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের স্থায়ী বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান, একই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, সান্ত্রী রায় ওরফে সিমি ও তার স্বামী রনজিৎ চন্দ্র সাহা।

দুদক সূত্র জানায়, গত বছর রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (এসকে সিনহা) ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দুদকের পরিচালক ইকবাল মাহমুদ ও সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন টিমকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করে কমিশন। তখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে, তা প্রকাশ করেনি দুদক। পরে নানাভাবে বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আর কেউ নন, তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহীতা ব্যবসায়ী নিরঞ্জন ও শাজাহানকে তলব করে অনুসন্ধান টিম। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর নিরঞ্জন ও শাহজাহানের আইনজীবীরা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে ৪ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে তার বাড়ির দাম। ফারমার্স ব্যাংকের পে-অর্ডারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে এসকে সিনহার ব্যাংক হিসাবে ওই টাকা দেয়া হয়। দুই আইনজীবী আফাজ মাহমুদ রুবেল ও নাজমুল আলম ওইদিন বলেন, দুদকের তলবে হাজির হয়ে তারা ১৭১ পৃষ্ঠার নথিপত্র জমা দিয়েছেন। তাদের দুই মক্কেল কোন অন্যায় করেননি দাবি করে তারা বলেন, সরল বিশ্বাসে তারা সান্ত্রী রায় ও রঞ্জিত সাহাকে সহায়তা করেছেন। তাদের দাবি, এসকে সিনহার উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ছয়তলা বাড়িটি ২০১৬ সালের শুরুর দিকে টাঙ্গাইলের বাসিন্দা সান্ত্রী রায় ৬ কোটি টাকায় কেনার জন্য বায়না করেন। সান্ত্রী রায় সাবেক প্রধান বিচারপতির ‘কথিত পিএস’ রনজিতের স্ত্রী। বাড়িটি বায়না করার পর হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ৫৫ লাখ ও বাড়ি নির্মাণের সময় নেয়া আরও ১ কোটি ৪০ লাখসহ মোট ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয় ফারমার্স ব্যাংকের পে-অর্ডারের মাধ্যমে। ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার জন্য জন্য সান্ত্রী রায় ব্যবহার করেন নিরঞ্জন ও শাহজাহানকে। নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা সান্ত্রী রায়ের স্বামী রনজিতের ভাতিজা। আর শাহজাহান রনজিতের বন্ধু। ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় বন্ধক রাখা হয় সান্ত্রী রায়ের মালিকানায় থাকা সাভারের ৩২ শতাংশ জমি। আইনজীবীদের তথ্যানুযায়ী ২০১৬ সালের মে মাসে জমির বায়না দলিল হয় এবং ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এসকে সিনহা সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা গ্রহণ করেন। ২৪ নভেম্বর হস্তান্তর দলিলের মাধ্যমে বাড়িটি সান্ত্রী রায় বুঝে নেন।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নিরঞ্জন সাংবাদিকদের জানান, তিনি কৃষিকাজ করেন। চাচার কথামতো তাকে সহায়তার জন্য ঋণ নিয়েছেন। শাহজাহান জানান, রনজিৎ তার বন্ধু। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি এলাকায় তার দোকান রয়েছে। রনজিতের কথামতো ঋণ নিয়ে তাকে দিয়ে দিয়েছেন। রনজিৎ ওই টাকা কাকে দিয়েছেন, সেটি তিনি জানেন না।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহারপূবর্ক অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে প্রতারণার মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক লি., গুলশান শাখা থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ৪ কোটি টাকা ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ওই টাকা একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তরিত করেন। পরে ওই অপরাধলব্ধ আয় ব্যক্তিগত হিসাব থেকে অস্বাভাবিক নগদ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য হিসাবে হস্তান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে নিজেদের ভোগদখল ও এর অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান গোপনের মাধ্যমে পাচার বা পাচারের প্রচেষ্টায় সংঘবদ্ধভাবে সম্পৃক্ত থেকে দ-বিধি ১৮৬০-এর ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২), (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

মামলায় বলা হয়েছে, অভিযোগ অনুসন্ধানকালে রেকর্ডপত্র, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংক লি:, গুলশান শাখায় পৃথক ২টি চলতি হিসাব খোলেন (যার নং-০১১১১০০১৫৬৩৪১ ও ০১১১১০০১৫৬৩৪৯)। পরের দিন ৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংক লি., গুলশান শাখায় উভয়ে পৃথকভাবে ২ কোটি টাকা করে মোট ৪ কোটি টাকার ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ঋণ আবেদন করেন। ওই ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ঋণ আবেদনপত্রে তারা উভয়ে তাদের ঠিকানা বাড়ি-৫১, রোড-১২, সেক্টর-১০, উত্তরা আবাসিক এলাকা উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানকালে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে ওই বাড়িটি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার। এছাড়া ঋণ আবেদনে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্র সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামীয় সাভারে অবস্থিত ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করেন। তারা দু’জনও সাবেক প্রধান বিচারপতি আসামি সুরেন্দ কুমার সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠজন। ওই ঋণ সংক্রান্ত আবেদন দুটি কোন রকম যাচাই-বাছাই, রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ এবং ব্যাংকের কোন নিয়ম-নীতি না মেনেই শুধু গ্রাহকের আবেদনের ওপর ব্যাংক শাখার ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শাখার অপরেশন ম্যানেজার লুৎফল হক ও ক্রেডিট ইনচার্জ শাফিউদ্দিন আসকারী মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ প্রপোজাল প্রস্তুত করে এতে সবাই স্বাক্ষর করেন। এরপর ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ হাতে হাতে ঋণ প্রস্তাব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়াই অফিস নোট তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর প্রদান করে ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান এবং গাজী সালাহউদ্দিনও কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাতে স্বাক্ষর করে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীমের কাছে নিয়ে যান। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ পলিসি সংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী ওই ঋণ দুটির প্রস্তাব অনুমোদন করার ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের না থাকা সত্ত্বেও এ সংক্রান্ত কোনরূপ যাচাই-বাছাই বা নির্দেশনা না দিয়ে ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি অনুমোদন দিয়ে দেন। ফারমার্স ব্যাংক লি., প্রধান কার্যালয়ে ঋণ অনুমোদন জন্য নথি উপস্থাপিত হলে নথির নোটাংশে হাতে লেখা হয় এভাবেÑ তিনি এমআর থেকে এই ধরনের সহায়তা পেয়েছেন। এসকে সিনহা, চিফ জাস্টিস হাউস, কাকরাইল, ঢাকা। পরে ওই নোট পরিবর্তন করে নতুন করে নোট প্রস্তুত করে তাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ এমডি স্বাক্ষর করেন। ওই প্রক্রিয়ায় ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পরের দিনই ৮ নভেম্বর বর্ণিত দুই ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবে অনুমোদিত ৪ কোটি টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার (যার নং-০০৯২০৪৬ ও ০০৯২০৪৭) সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইস্যু করা হয়। সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামীয় সোনালী ব্যাংক, সুপ্রিম কোর্ট শাখার হিসাব নং-৪৪৩৫৪৩৪০০৪৪৭৫-তে গত ৯ নভেম্বর ওই ৪ কোটি টাকা জমা হয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ ও চেক/পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করেন। তন্মধ্যে শাহজালাল ব্যাংক লি, উত্তরা শাখায় তার আপন ভাইয়ের নামীয় হিসাব নং-৪০০৮১২১০০০৪৯০৪২-এ দুটি চেকের মাধ্যমে ২৮ নভেম্বর যথাক্রমে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার ও ৭৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে ওই হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলিত হয়েছে। আসামি রনজিৎ চন্দ্র সাহা ব্যাংকে উপস্থিত থেকে ঋণ আবেদন দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির নাম করে প্রভাব বিস্তার করেন। এছাড়া ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার ভাতিজা ও শাহজাহান রনজিৎ চন্দ্র সাহার ছোটকালের বন্ধু। তারা দু’জনই অত্যন্ত গরিব-দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি বা তাদের কোন ব্যবসা নেই মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার মাধ্যমে তাদের ভুল বুঝিয়ে ব্যাংকের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেয়ার ব্যবস্থা করেন।

মামলার বিষয়ে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কথা বলেন সংস্থাটির সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত। সাবেক প্রধান বিচারপতি বিদেশে অবস্থান করছেন। তাকে দেশে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ আছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের আইনে সব ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তার ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আলোচিত সমালোচিত এসকে সিনহা

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারিতে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন বিচারপতি এসকে সিনহা। এরপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। ২০১৭ সালের দিকে তিনি অবসরকালীন ছুটিতে যান। তার ছুটি নিয়ে নানা ধরনের বির্তক তৈরি হয়। বিতর্কে জড়িয়ে ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান এসকে সিনহা। এরপর তার বিরুদ্ধে নানা অপকর্ম, ঘুষ ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ প্রকাশ পেতে থাকে। এসব বিতর্কের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় থেকে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি। এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন মানিকের অবসরের পর পেনশন বন্ধ করেন। তা নিয়ে এসকে সিনহার সঙ্গে শামসুদ্দিন মানিকের মতবিরোধ দেখা দেয়। ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে একটি বইমেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে এসকে সিনহা অভিযোগ করেন, সরকারের নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিতে চাচ্ছে। তার এমন মন্তব্যে সরকার অস্বস্তিতে পড়ে। দেশের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মীর কাসেম আলীসহ জামায়াত-বিএনপির যুদ্ধাপরাধ মামলার বেশকিছু চূড়ান্ত রায় আসে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ থেকে। ২০১৬ সালে ৭ জুন জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাজে হতাশা প্রকাশ করেন এসকে সিনহা। এ সময় প্রসিকিউটরদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ভবনের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়তে হয় সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করতে সরকারকে বারবার সময় দেন এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। এ সময় বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের মনোভাব নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ভর্ৎসনা করেন তিনি।

২০১৭ সালের ৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। এরপর পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়। রায় প্রকাশের পর এ নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংক্ষুব্ধ হয়। ওই পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে সরকার সমর্থিত আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন। এই বিতর্কের মুখে এসকে সিনহা ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান। সেখান থেকে পরে তিনি সিঙ্গাপুর যান এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসে তার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে পাঠান। পদত্যাগ করার পর এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ওঠে। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএনএফ) সভাপতি ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা। এছাড়া সুুপ্রিম কোর্টের সরকারি প্রসিকিউটরদের পক্ষ থেকেও এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ঘুষ নেয়ার অভিযোগ করা হয়। সাবেক এক বিচারপতিও এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তা তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তোলেন। নানা বিতর্কে পড়ে এসকে সিনহা গোপনে দেশ ত্যাগ করেন। পরে সরকারের মাধ্যমে জানানো হয় তিনি পদত্যাগ করেছেন।

বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০১৯ , ২৭ আষাঢ় ১৪২৫, ৭ জ্বিলকদ ১৪৪০

অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ

সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এসকে সিনহা) ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিটপ্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের স্থায়ী বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান, একই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, সান্ত্রী রায় ওরফে সিমি ও তার স্বামী রনজিৎ চন্দ্র সাহা।

দুদক সূত্র জানায়, গত বছর রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (এসকে সিনহা) ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দুদকের পরিচালক ইকবাল মাহমুদ ও সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন টিমকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করে কমিশন। তখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে, তা প্রকাশ করেনি দুদক। পরে নানাভাবে বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আর কেউ নন, তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহীতা ব্যবসায়ী নিরঞ্জন ও শাজাহানকে তলব করে অনুসন্ধান টিম। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর নিরঞ্জন ও শাহজাহানের আইনজীবীরা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে ৪ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে তার বাড়ির দাম। ফারমার্স ব্যাংকের পে-অর্ডারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকে এসকে সিনহার ব্যাংক হিসাবে ওই টাকা দেয়া হয়। দুই আইনজীবী আফাজ মাহমুদ রুবেল ও নাজমুল আলম ওইদিন বলেন, দুদকের তলবে হাজির হয়ে তারা ১৭১ পৃষ্ঠার নথিপত্র জমা দিয়েছেন। তাদের দুই মক্কেল কোন অন্যায় করেননি দাবি করে তারা বলেন, সরল বিশ্বাসে তারা সান্ত্রী রায় ও রঞ্জিত সাহাকে সহায়তা করেছেন। তাদের দাবি, এসকে সিনহার উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ছয়তলা বাড়িটি ২০১৬ সালের শুরুর দিকে টাঙ্গাইলের বাসিন্দা সান্ত্রী রায় ৬ কোটি টাকায় কেনার জন্য বায়না করেন। সান্ত্রী রায় সাবেক প্রধান বিচারপতির ‘কথিত পিএস’ রনজিতের স্ত্রী। বাড়িটি বায়না করার পর হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ৫৫ লাখ ও বাড়ি নির্মাণের সময় নেয়া আরও ১ কোটি ৪০ লাখসহ মোট ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয় ফারমার্স ব্যাংকের পে-অর্ডারের মাধ্যমে। ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার জন্য জন্য সান্ত্রী রায় ব্যবহার করেন নিরঞ্জন ও শাহজাহানকে। নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা সান্ত্রী রায়ের স্বামী রনজিতের ভাতিজা। আর শাহজাহান রনজিতের বন্ধু। ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সময় বন্ধক রাখা হয় সান্ত্রী রায়ের মালিকানায় থাকা সাভারের ৩২ শতাংশ জমি। আইনজীবীদের তথ্যানুযায়ী ২০১৬ সালের মে মাসে জমির বায়না দলিল হয় এবং ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এসকে সিনহা সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা গ্রহণ করেন। ২৪ নভেম্বর হস্তান্তর দলিলের মাধ্যমে বাড়িটি সান্ত্রী রায় বুঝে নেন।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নিরঞ্জন সাংবাদিকদের জানান, তিনি কৃষিকাজ করেন। চাচার কথামতো তাকে সহায়তার জন্য ঋণ নিয়েছেন। শাহজাহান জানান, রনজিৎ তার বন্ধু। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি এলাকায় তার দোকান রয়েছে। রনজিতের কথামতো ঋণ নিয়ে তাকে দিয়ে দিয়েছেন। রনজিৎ ওই টাকা কাকে দিয়েছেন, সেটি তিনি জানেন না।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহারপূবর্ক অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে প্রতারণার মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক লি., গুলশান শাখা থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ৪ কোটি টাকা ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ওই টাকা একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তরিত করেন। পরে ওই অপরাধলব্ধ আয় ব্যক্তিগত হিসাব থেকে অস্বাভাবিক নগদ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য হিসাবে হস্তান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে নিজেদের ভোগদখল ও এর অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান গোপনের মাধ্যমে পাচার বা পাচারের প্রচেষ্টায় সংঘবদ্ধভাবে সম্পৃক্ত থেকে দ-বিধি ১৮৬০-এর ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২), (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

মামলায় বলা হয়েছে, অভিযোগ অনুসন্ধানকালে রেকর্ডপত্র, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, শাহাজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংক লি:, গুলশান শাখায় পৃথক ২টি চলতি হিসাব খোলেন (যার নং-০১১১১০০১৫৬৩৪১ ও ০১১১১০০১৫৬৩৪৯)। পরের দিন ৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংক লি., গুলশান শাখায় উভয়ে পৃথকভাবে ২ কোটি টাকা করে মোট ৪ কোটি টাকার ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ঋণ আবেদন করেন। ওই ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ঋণ আবেদনপত্রে তারা উভয়ে তাদের ঠিকানা বাড়ি-৫১, রোড-১২, সেক্টর-১০, উত্তরা আবাসিক এলাকা উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানকালে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে ওই বাড়িটি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার। এছাড়া ঋণ আবেদনে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্র সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামীয় সাভারে অবস্থিত ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করেন। তারা দু’জনও সাবেক প্রধান বিচারপতি আসামি সুরেন্দ কুমার সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠজন। ওই ঋণ সংক্রান্ত আবেদন দুটি কোন রকম যাচাই-বাছাই, রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ এবং ব্যাংকের কোন নিয়ম-নীতি না মেনেই শুধু গ্রাহকের আবেদনের ওপর ব্যাংক শাখার ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শাখার অপরেশন ম্যানেজার লুৎফল হক ও ক্রেডিট ইনচার্জ শাফিউদ্দিন আসকারী মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ প্রপোজাল প্রস্তুত করে এতে সবাই স্বাক্ষর করেন। এরপর ম্যানেজার মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ হাতে হাতে ঋণ প্রস্তাব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়াই অফিস নোট তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর প্রদান করে ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান এবং গাজী সালাহউদ্দিনও কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাতে স্বাক্ষর করে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীমের কাছে নিয়ে যান। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ পলিসি সংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী ওই ঋণ দুটির প্রস্তাব অনুমোদন করার ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের না থাকা সত্ত্বেও এ সংক্রান্ত কোনরূপ যাচাই-বাছাই বা নির্দেশনা না দিয়ে ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি অনুমোদন দিয়ে দেন। ফারমার্স ব্যাংক লি., প্রধান কার্যালয়ে ঋণ অনুমোদন জন্য নথি উপস্থাপিত হলে নথির নোটাংশে হাতে লেখা হয় এভাবেÑ তিনি এমআর থেকে এই ধরনের সহায়তা পেয়েছেন। এসকে সিনহা, চিফ জাস্টিস হাউস, কাকরাইল, ঢাকা। পরে ওই নোট পরিবর্তন করে নতুন করে নোট প্রস্তুত করে তাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ এমডি স্বাক্ষর করেন। ওই প্রক্রিয়ায় ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পরের দিনই ৮ নভেম্বর বর্ণিত দুই ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবে অনুমোদিত ৪ কোটি টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার (যার নং-০০৯২০৪৬ ও ০০৯২০৪৭) সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইস্যু করা হয়। সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামীয় সোনালী ব্যাংক, সুপ্রিম কোর্ট শাখার হিসাব নং-৪৪৩৫৪৩৪০০৪৪৭৫-তে গত ৯ নভেম্বর ওই ৪ কোটি টাকা জমা হয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ ও চেক/পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করেন। তন্মধ্যে শাহজালাল ব্যাংক লি, উত্তরা শাখায় তার আপন ভাইয়ের নামীয় হিসাব নং-৪০০৮১২১০০০৪৯০৪২-এ দুটি চেকের মাধ্যমে ২৮ নভেম্বর যথাক্রমে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার ও ৭৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে ওই হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলিত হয়েছে। আসামি রনজিৎ চন্দ্র সাহা ব্যাংকে উপস্থিত থেকে ঋণ আবেদন দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির নাম করে প্রভাব বিস্তার করেন। এছাড়া ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার ভাতিজা ও শাহজাহান রনজিৎ চন্দ্র সাহার ছোটকালের বন্ধু। তারা দু’জনই অত্যন্ত গরিব-দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি বা তাদের কোন ব্যবসা নেই মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রনজিৎ চন্দ্র সাহার মাধ্যমে তাদের ভুল বুঝিয়ে ব্যাংকের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেয়ার ব্যবস্থা করেন।

মামলার বিষয়ে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কথা বলেন সংস্থাটির সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত। সাবেক প্রধান বিচারপতি বিদেশে অবস্থান করছেন। তাকে দেশে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ আছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের আইনে সব ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তার ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আলোচিত সমালোচিত এসকে সিনহা

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারিতে দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন বিচারপতি এসকে সিনহা। এরপর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। ২০১৭ সালের দিকে তিনি অবসরকালীন ছুটিতে যান। তার ছুটি নিয়ে নানা ধরনের বির্তক তৈরি হয়। বিতর্কে জড়িয়ে ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান এসকে সিনহা। এরপর তার বিরুদ্ধে নানা অপকর্ম, ঘুষ ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ প্রকাশ পেতে থাকে। এসব বিতর্কের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় থেকে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি। এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন মানিকের অবসরের পর পেনশন বন্ধ করেন। তা নিয়ে এসকে সিনহার সঙ্গে শামসুদ্দিন মানিকের মতবিরোধ দেখা দেয়। ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে একটি বইমেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে এসকে সিনহা অভিযোগ করেন, সরকারের নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিতে চাচ্ছে। তার এমন মন্তব্যে সরকার অস্বস্তিতে পড়ে। দেশের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মীর কাসেম আলীসহ জামায়াত-বিএনপির যুদ্ধাপরাধ মামলার বেশকিছু চূড়ান্ত রায় আসে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ থেকে। ২০১৬ সালে ৭ জুন জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাজে হতাশা প্রকাশ করেন এসকে সিনহা। এ সময় প্রসিকিউটরদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ভবনের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়তে হয় সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করতে সরকারকে বারবার সময় দেন এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। এ সময় বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের মনোভাব নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে ভর্ৎসনা করেন তিনি।

২০১৭ সালের ৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। এরপর পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশিত হয়। রায় প্রকাশের পর এ নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংক্ষুব্ধ হয়। ওই পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে সরকার সমর্থিত আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন। এই বিতর্কের মুখে এসকে সিনহা ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান। সেখান থেকে পরে তিনি সিঙ্গাপুর যান এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসে তার পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে পাঠান। পদত্যাগ করার পর এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ওঠে। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএনএফ) সভাপতি ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা। এছাড়া সুুপ্রিম কোর্টের সরকারি প্রসিকিউটরদের পক্ষ থেকেও এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ঘুষ নেয়ার অভিযোগ করা হয়। সাবেক এক বিচারপতিও এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তা তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তোলেন। নানা বিতর্কে পড়ে এসকে সিনহা গোপনে দেশ ত্যাগ করেন। পরে সরকারের মাধ্যমে জানানো হয় তিনি পদত্যাগ করেছেন।