ভিয়েতনামে কাজের কথা বলে ১২ শতাধিক শ্রমিক পাচার

বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি নেই, তারপরও ভিয়েতনামে বিভিন্ন ভিসায় পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি শ্রমিক। গত কয়েক বছরে ১২ শতাধিক বাংলাদেশি শ্রমিককে উচ্চ বেতনে চাকরি বা ভালো কাজের কথা বলে ভিয়েতনাম পাচার করা হয়েছে। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসে পাচার করা হয় ১০৬ বাংলাদেশিকে, যারা গত আগস্ট মাসে খালি হাতে দেশে ফেরেন। এরমধ্যে ৮১ জন জেলে আছেন।

তবে জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর ভাষ্য তারা কেউই পাচারের শিকার হয়নি। অথচ তাদের ভিয়েতনামে পাঠানো, দেশটিতে আটকে টাকা দাবি এবং নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে তা আইন অনুযায়ী স্পষ্ট মানবপাচারের অপরাধের মধ্যে পড়ে। কোন যুক্তিতে বিএমইটি ভিয়েতনামে পাঠানোর ক্ষেত্রে পাচার হিসেবে দেখছে না তা স্পষ্ট নয়। তবে ফেরত আসা ১০৬ বাংলাদেশি যে ১১ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যায়, বিএমইটি সেই ১১ রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার লক করে তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কতিপয় রিক্রুটিং এজেন্সি এবং দালাল মিলে উচ্চ বেতনে চাকরির আশ্বাস দিয়ে ভিয়েতনামে বাংলাদেশিদের পাঠিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সবকিছু জেনেও প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টদের। সম্প্রতি চাকরির আশ্বাস দিয়ে ভিয়েতনাম পাঠানো ১০৬ বাংলাদেশি দেশটিতে যাওয়ার পর অবৈধ হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় এসব শ্রমিককে ফিরিয়ে আনা হলেও এখনও ওই দেশে অবস্থান করা ১২ শতাধিক শ্রমিকের ভাগ্যে কী ঘটছে তা জানে না কেউই। প্রতারণার মাধ্যমে ভিয়েতনামে মানবপাচারের অভিযোগে গত ৩ সেপ্টেম্বর পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলার তদন্তে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডির) মানবপাচার প্রতিরোধ সেলের কর্মকর্তারা ভিয়েতনামে মানবপাচারে জড়িত চক্রের নানা তথ্য পেয়েছে।

ভিয়েতনামে মানবপাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি প্রশিক্ষণ ব্যুরো ও কর্মসংস্থান (বিএমইটির) মহাপরিচালক শামছুল আলম বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর কোন চুক্তি নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র ১২টি দেশে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি আছে। চুক্তি না থাকলে ১৭৫টি দেশে শ্রমিকরা যাচ্ছে বিভিন্ন ভিসায়। যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি নেই এমন দেশে ডিএল ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসায় লোকজন গিয়ে কাজ করছে। ভিয়েতনাম যারা যাচ্ছে তাদের পাচার করা হচ্ছে না। পৃথিবীর অনেক দেশেই মানুষ কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। ভিয়েতনামেও এ পর্যন্ত ১২০০ বেশি শ্রমিক গিয়েছে। গত আগস্ট মাসে যে ১০৬ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে তারা ডিএম ভিসায় এবং এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে তারা সেখানে কোন কাজ পায়নি। তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা অবৈধ হয়ে পড়ে। পরে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের যেসব রিক্রটিং এজেন্সিগুলো পাঠিয়েছে, তাদের কাছ থেকে বিমান ভাড়া আদায় করা হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) পরিচালক (ইমিগ্রেশন, এমপ্লয়মেন্ট ও অ্যাডমিন) ডিএম আতিকুর রহমান সংবাদকে জানান, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া দালালের মাধ্যমে কোন লোক গেলে সেটি পাচার বলে গণ্য। তবে কোন রিক্রুটিং এজেন্সি যদি লোক পাঠিয়ে প্রতারণা করে, অথবা তাদের জিম্মি করে, অত্যাচার নির্যাতন করে সেক্ষেত্রে মানব পাচার আইনের ধারা অনুযায়ী অপরাধ হলে তা ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। ভিয়েতনাম থেকে ফেরত আসা ১০৬ বাংলাদেশি যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলেন, সেই ১১টি রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার লক করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছেন। বিদেশে কোন শ্রমিক পাঠানোর নামে পাচার হলে সেক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা হয়। মামলা সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তদন্ত করে। তবে এর বাইরে বিএমইটির কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে সেটি তদন্ত করা হয়, শুনানি করা হয়। গত ৩ বছরে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে প্রতারিত বা অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রায় ৪ কোটি টাকা অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আদায় করে দেয়া হয়েছে। বিদেশে যেতে হলে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নথিপত্র দেখে যেকোন কাজের ক্ষেত্রে বিএমইটি থেকে একটি স্মার্ট কার্ড দেয়া হয়। এটি অপব্যহার করে বা মিথ্যে তথ্যে নিলে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্সও বাতিল করে দেয়া হয়।

তিনি বলেন, বর্তমানে ভিয়েতনামে ১২০০’র বেশি শ্রমিক কাজ করছে। তারা সেখানে ভালো আছে এবং ভালোভাবে কাজ করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। যাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে রিক্রটিং এজেন্সি কি ধরনের প্রতারণা করেছে, কিভাবে পাঠিয়েছিল, তা তদন্ত করা হচ্ছে। যদি কোন অপরাধ পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সরকার বিশেষ বিমানে ভিয়েতনামে চাকরির জন্য যাওয়ার পর অবৈধ হয়ে পড়া এবং দালাল চক্রের নির্যাতনের শিকার ১০৬ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনে। এরপর এসব বাংলাদেশিদের দিয়াবাড়িতে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। তখন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ওইসব প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কর্মকর্তারাও ওইসব প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশের কাছে ওইসব প্রবাসী কিভাবে, কার মাধ্যমে ভিয়েতনাম গিয়েছেন, তাদের কি কথা বলে ভিয়েতনাম পাঠানো হয়, কত টাকা করে নেয়া হয়, নেয়ার পর সেখানে দালাল চক্র তাদের সঙ্গে কি আচরণ করেছে তার সব আদ্যোপান্ত প্রতারিত হওয়া প্রবাসীরা পুলিশকে জানিয়েছে। যদিও ১০৬ প্রবাসীর মধ্যে ৮১ জনকে ৫৪ ধারায় আটক করে পুলিশ। বাকিদের ছেড়ে দেয়। আটক রাখা ৮১ ভিয়েতনাম প্রবাসীসহ ৮৩ জনের বিরুদ্ধে উত্তরার তুরাগ থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। পরে অপরাধী উল্লেখ করে আদালতে হাজির করে ফরওয়ার্ডিং দেয় পুলিশ। পুলিশের সেই ফরওয়ার্ডিংয়ে পুলিশ ওই ৮৩ প্রবাসীকে আটক রাখার আবেদন জানিয়ে বলে, তারা বিদেশে বিভিন্ন অপরাধ করেছে। করোনার কারণে ভিয়েতনাম সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠায়। এরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে পারিবারিক সহিংসতাসহ নানা অপরাধ করতে পারে। অপরদিকে দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে কাজের আশায় ভিয়েতনাম গিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শরীয়তপুরের আলমগীর হাসান নামের একজন মানবপাচার আইনে একটি মামলা করে। সেই মামলা এখন সিআইডি তদন্ত করছে।

গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভিয়েতনামে পাচার করা ১০৬ বাংলাদেশি শ্রমিকের মধ্যে নীলফামারী জেলার বিভিন্ন থানার ৫ শ্রমিক রয়েছে। যারা ভিয়েতনাম থেকে খালি হাতে ফিরে এসে ওই দেশটিকে অপরাধ করার অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হন। তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানোর পর আদালত তাদের জেলে পাঠায় পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে। তারা জেলে আছেন। এসব শ্রমিকদের পরিবার এখন অনিশ্চিত ভবিষদের দিকে তাকিয়ে আছে। একে তো রিকুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের খপ্পড়ে জমি, গরু, ভিটামাটি বিক্রি. এবং সুদের উপর টাকা নিয়ে ভিয়েতনাম গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এরপর খালি হাতে ফিরে মিথ্যে অভিযোগে জেলে আছেন। এরমধ্যে রয়েছেন নীলফামারি জেলার সদর থানার টুপামারী নিজপাড়া গ্রামের আসলাম উদ্দিনের ছেলে মো. মমিনুর রহমান, একই এলাকার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে রকিবুল আলম বাবু, মোশারফ হোসেন শাহ’র ছেলে মো. নুরে আলম শাহ মানিক। এরা সবাই জমি, গরু বিক্রি করে এবং সুদের উপর টাকা নিয়ে স্থানীয় দালাল নীলফামারী সদর থানার রামনগর ইউনিয়নের টেকনার পাড় এলাকার জিন্নাত ভাটিয়া, তার ছেলে ইউসুফ এবং দারোগের মাধ্যমে ভিয়েতনাম পাচার হয়েছেন। এদের প্রত্যেকে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে ভিয়েতনামে কাজ দেয়ার কথা বলে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে নেয়া হয়। বিমানে ওঠার আধাঘণ্টা আগে এদের হাতে পাসপোর্ট ধরিয়ে দেয়া হয়। ভিয়েতনামের রাজধানীতে পৌঁছার পর স্থানীয় দালাল চক্রের সহযোগী ভিয়েতনামে বসবাসকারি বাংলাদেশি দালালরা তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে একটি ঘরে নিয়ে আটকে রাখে। ওই শ্রমিকরা যখন কাজের কথা বলেন, তখন তাদের কাছে আরও ১ থেকে ২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় এদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করিয়ে নেয় দালাল চক্র। দালাল চক্র তাদের নিয়ে যেতো এবং কাজ শেষ করিয়ে আবার নিজেদের ডেরায় আটকে রাখতো। প্রতিবাদ করায় এদের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা হতো। এক পর্যায়ে গোপনে তারা দেশে থাকা স্বজনদের কাছে নিজেদের করুন কাহিনী তুলে ধরে। ওইসব শ্রমিকদের স্বজনরা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দালাল জিন্নাত ভাটিয়া, তার ছেলে ইউসুফ এবং দারোগা এ বলে হুমকি দেয় কোন কথা বললে বা কাউকে এ বিষয়ে জানালে একজনকেও জীবিত রাখা হবে না। শুধু নীলফামারীর ওই হত্যভাগরাই নয় এমন পরিস্থিতির শিকার হন হবিগঞ্জ, শরীয়তপুর টাঙ্গাইল, মাগুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনী ময়মনসিংহ, কুমিল্লা দিনাজপুর, লক্ষ্মীপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে যাওয় ১০৬ বাংলাদেশি। যদিও এদের ফিরিয়ে আনার পর তাদের কোন দালাল পাঠিয়েছেন, কোন রিক্রটিং এজেন্টির মাধ্যমে তারা পাচার হয়েছেন সব তথ্যই পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিএমইটিসহ সংশ্লিষ্টরা। দালাল চক্র এবং প্রতারক রিক্রটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ১০৬ প্রবাসীর মধ্যে ৮৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার দেখিয়েছে। তারা বর্তমানে জেলে আছে। ওইসব শ্রকিদের স্বজনরা জানান, ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতনের লোভ দেখিয়ে তাদের ভিয়েতনাম পাঠানো হয়। ভিয়েতনামে যাওয়ার জন্য বিমানে ওঠার আধাঘন্টা আগে পাসপোর্ট দেয়ার কারণে কেউই কোন ভিসায় ভিয়েতনাম যাচ্ছেন তা দেখতে পারেননি। ভিয়েতনাম পৌঁছার পর টাকা পয়সা, পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে ভিয়েতনামে দালাল চক্রের সহযোগীরা তাদের জিম্মি করে ফেলে। ঠিকমতো বেতন তো দূরের কথা খাবারও দিতো না। নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। সেখানে তাদের মেরে ফেলারও হুমকি দেয়া হত। বাধ্য হয়ে তারা দেশে থাকা স্বজনদের কাছে ঘটনা জানিয়ে তাদের বাঁচানোর কথা বলেন।

বাংলাদেশ সরকারে একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ‘মানবপাচার’ অর্থ কোন ব্যক্তিকে (ক) ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগ করিয়া বা (খ) প্রতারণা করিয়া বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোন অসহায়ত্বকে (াঁষহবৎধনরষরঃ) কাজে লাগাইয়া, বা (গ) অর্থ বা অন্য কোন সুবিধা (শরহফ) লেনদেন-পূর্বক উক্ত ব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রহিয়াছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করিয়া; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোন শোষণ বা নিপীড়নের (বীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ) উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকাইয়া রাখা বা আশ্রয় দেয়া (যধৎনড়ঁৎ)। (২) যেইক্ষেত্রে কোন শিশু পাচারের শিকার হয়, সেইক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এর দফা (ক) হইতে (গ) তে বর্ণিত মানবপাচার অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমসমূহ (সবধহং) অনুসৃত হইয়াছে কিনা তাহা বিবেচিত হইবে না। ব্যাখ্যা। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, যদি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে প্রতারণার মাধ্যমে, অসৎ উদ্দেশ্যে এবং বাধ্যতামূলক শ্রম বা ‘সার্ভিচিউড’ (ংবৎারঃঁফব) বা ধারা-২ এর উপ-ধারা (১৫) এ বর্ণিত কোন শোষণ বা নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির শিকার হইতে পারে মর্মে জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন ব্যক্তিকে কাজ বা চাকরির উদ্দেশ্যে গমন, অভিবাসন বা বহির্গমন করিতে প্রলুব্ধ বা সহায়তা করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির উক্ত কর্ম উপ-ধারা (১) এ সংজ্ঞায়িত ‘মানবপাচার’ এর অন্তর্ভুক্ত হইবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মানবপাচার প্রতিরোধে মানবপাচার আইন (২০১২) করা হয়েছে। সেই আইনে মানবপাচারের সংজ্ঞা, মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি, মামলা সবকিছু স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এরপরও নানাভাবে মানবপাচার হলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আইনে ফাঁক-ফোকর দিয়ে মানবপাচারকারী রিক্রুটিং এজেন্সি ও তাদের সহযোগীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

সিআইডির মানবপাচার প্রতিরোধ সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকতারুজ্জামান জানান, কয়েক দশক ধরে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে চাকরি বা কাজ দেয়ার কথা বলে জনবল পাচার হয়ে আসছে। ভিয়েতনামসহ অনেক দেশে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর কোন চুক্তি নেই। অথচ এসব দেশে দেশি ও বিদেশি সংঘবদ্ধ চক্র মিলে মানবপাচার করেছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানবপাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। গত কয়েক বছরে মানবপাচারের অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলা সিআইডি তদন্ত করছে। বিভিন্ন সময়ে মানবপাচারের অভিযোগে দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তবুও নানা কৌশলে মানবপাচার অব্যাহত রয়েছে। সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক বছর ধরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভিয়েতনামে মানবপাচার করে আসছিল। কোন দেশের সঙ্গে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি না থাকলে ওইসব দেশে শ্রমিক পাঠানোর কথা নয়। কিন্তু চক্রটি নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এসব শ্রমিকদের ভিয়েতনামে পাঠিয়েছে। ভিয়েতনামে সর্বশেষ ১০৬ জন বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরি দেয়ার কথা বলে পাঠালেও তাদের কোন কাজ দেয়া হয়নি। তাদের ওয়ার্ক ভিসায় না পাঠিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসায় পাঠায়। পরে ভিয়েতনামে ওইসব বাংলাদেশিদের জিম্মি করে তাদের দিয়ে বিনা পয়সায় বিভিন্ন কোম্পানির কাজ করিয়ে নেয় দালাল চক্র। এসব অভিযোগ পাওয়ার পর সিআইডি তদন্ত শুরু করে। সিআইডি জানতে পারে চাকরির জন্য যাওয়ার পর অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ১০৬ বাংলাদেশি দূতাবাসে আশ্রয় নেয়। পরে তাদের ফিরিয়ে আনা হলে সিআইডি প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে।

সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ০৯ মহররম ১৪৪২, ১০ আশ্বিন ১৪২৭

ভিয়েতনামে কাজের কথা বলে ১২ শতাধিক শ্রমিক পাচার

সাইফ বাবলু

বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি নেই, তারপরও ভিয়েতনামে বিভিন্ন ভিসায় পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি শ্রমিক। গত কয়েক বছরে ১২ শতাধিক বাংলাদেশি শ্রমিককে উচ্চ বেতনে চাকরি বা ভালো কাজের কথা বলে ভিয়েতনাম পাচার করা হয়েছে। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসে পাচার করা হয় ১০৬ বাংলাদেশিকে, যারা গত আগস্ট মাসে খালি হাতে দেশে ফেরেন। এরমধ্যে ৮১ জন জেলে আছেন।

তবে জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর ভাষ্য তারা কেউই পাচারের শিকার হয়নি। অথচ তাদের ভিয়েতনামে পাঠানো, দেশটিতে আটকে টাকা দাবি এবং নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে তা আইন অনুযায়ী স্পষ্ট মানবপাচারের অপরাধের মধ্যে পড়ে। কোন যুক্তিতে বিএমইটি ভিয়েতনামে পাঠানোর ক্ষেত্রে পাচার হিসেবে দেখছে না তা স্পষ্ট নয়। তবে ফেরত আসা ১০৬ বাংলাদেশি যে ১১ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যায়, বিএমইটি সেই ১১ রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার লক করে তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কতিপয় রিক্রুটিং এজেন্সি এবং দালাল মিলে উচ্চ বেতনে চাকরির আশ্বাস দিয়ে ভিয়েতনামে বাংলাদেশিদের পাঠিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সবকিছু জেনেও প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টদের। সম্প্রতি চাকরির আশ্বাস দিয়ে ভিয়েতনাম পাঠানো ১০৬ বাংলাদেশি দেশটিতে যাওয়ার পর অবৈধ হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় এসব শ্রমিককে ফিরিয়ে আনা হলেও এখনও ওই দেশে অবস্থান করা ১২ শতাধিক শ্রমিকের ভাগ্যে কী ঘটছে তা জানে না কেউই। প্রতারণার মাধ্যমে ভিয়েতনামে মানবপাচারের অভিযোগে গত ৩ সেপ্টেম্বর পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলার তদন্তে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডির) মানবপাচার প্রতিরোধ সেলের কর্মকর্তারা ভিয়েতনামে মানবপাচারে জড়িত চক্রের নানা তথ্য পেয়েছে।

ভিয়েতনামে মানবপাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি প্রশিক্ষণ ব্যুরো ও কর্মসংস্থান (বিএমইটির) মহাপরিচালক শামছুল আলম বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর কোন চুক্তি নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র ১২টি দেশে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি আছে। চুক্তি না থাকলে ১৭৫টি দেশে শ্রমিকরা যাচ্ছে বিভিন্ন ভিসায়। যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি নেই এমন দেশে ডিএল ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসায় লোকজন গিয়ে কাজ করছে। ভিয়েতনাম যারা যাচ্ছে তাদের পাচার করা হচ্ছে না। পৃথিবীর অনেক দেশেই মানুষ কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। ভিয়েতনামেও এ পর্যন্ত ১২০০ বেশি শ্রমিক গিয়েছে। গত আগস্ট মাসে যে ১০৬ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে তারা ডিএম ভিসায় এবং এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে তারা সেখানে কোন কাজ পায়নি। তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা অবৈধ হয়ে পড়ে। পরে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের যেসব রিক্রটিং এজেন্সিগুলো পাঠিয়েছে, তাদের কাছ থেকে বিমান ভাড়া আদায় করা হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) পরিচালক (ইমিগ্রেশন, এমপ্লয়মেন্ট ও অ্যাডমিন) ডিএম আতিকুর রহমান সংবাদকে জানান, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া দালালের মাধ্যমে কোন লোক গেলে সেটি পাচার বলে গণ্য। তবে কোন রিক্রুটিং এজেন্সি যদি লোক পাঠিয়ে প্রতারণা করে, অথবা তাদের জিম্মি করে, অত্যাচার নির্যাতন করে সেক্ষেত্রে মানব পাচার আইনের ধারা অনুযায়ী অপরাধ হলে তা ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। ভিয়েতনাম থেকে ফেরত আসা ১০৬ বাংলাদেশি যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলেন, সেই ১১টি রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভার লক করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছেন। বিদেশে কোন শ্রমিক পাঠানোর নামে পাচার হলে সেক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা হয়। মামলা সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তদন্ত করে। তবে এর বাইরে বিএমইটির কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে সেটি তদন্ত করা হয়, শুনানি করা হয়। গত ৩ বছরে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে প্রতারিত বা অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রায় ৪ কোটি টাকা অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আদায় করে দেয়া হয়েছে। বিদেশে যেতে হলে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নথিপত্র দেখে যেকোন কাজের ক্ষেত্রে বিএমইটি থেকে একটি স্মার্ট কার্ড দেয়া হয়। এটি অপব্যহার করে বা মিথ্যে তথ্যে নিলে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্সও বাতিল করে দেয়া হয়।

তিনি বলেন, বর্তমানে ভিয়েতনামে ১২০০’র বেশি শ্রমিক কাজ করছে। তারা সেখানে ভালো আছে এবং ভালোভাবে কাজ করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। যাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে রিক্রটিং এজেন্সি কি ধরনের প্রতারণা করেছে, কিভাবে পাঠিয়েছিল, তা তদন্ত করা হচ্ছে। যদি কোন অপরাধ পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সরকার বিশেষ বিমানে ভিয়েতনামে চাকরির জন্য যাওয়ার পর অবৈধ হয়ে পড়া এবং দালাল চক্রের নির্যাতনের শিকার ১০৬ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনে। এরপর এসব বাংলাদেশিদের দিয়াবাড়িতে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। তখন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ওইসব প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কর্মকর্তারাও ওইসব প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। পুলিশের কাছে ওইসব প্রবাসী কিভাবে, কার মাধ্যমে ভিয়েতনাম গিয়েছেন, তাদের কি কথা বলে ভিয়েতনাম পাঠানো হয়, কত টাকা করে নেয়া হয়, নেয়ার পর সেখানে দালাল চক্র তাদের সঙ্গে কি আচরণ করেছে তার সব আদ্যোপান্ত প্রতারিত হওয়া প্রবাসীরা পুলিশকে জানিয়েছে। যদিও ১০৬ প্রবাসীর মধ্যে ৮১ জনকে ৫৪ ধারায় আটক করে পুলিশ। বাকিদের ছেড়ে দেয়। আটক রাখা ৮১ ভিয়েতনাম প্রবাসীসহ ৮৩ জনের বিরুদ্ধে উত্তরার তুরাগ থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। পরে অপরাধী উল্লেখ করে আদালতে হাজির করে ফরওয়ার্ডিং দেয় পুলিশ। পুলিশের সেই ফরওয়ার্ডিংয়ে পুলিশ ওই ৮৩ প্রবাসীকে আটক রাখার আবেদন জানিয়ে বলে, তারা বিদেশে বিভিন্ন অপরাধ করেছে। করোনার কারণে ভিয়েতনাম সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠায়। এরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে পারিবারিক সহিংসতাসহ নানা অপরাধ করতে পারে। অপরদিকে দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে কাজের আশায় ভিয়েতনাম গিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শরীয়তপুরের আলমগীর হাসান নামের একজন মানবপাচার আইনে একটি মামলা করে। সেই মামলা এখন সিআইডি তদন্ত করছে।

গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভিয়েতনামে পাচার করা ১০৬ বাংলাদেশি শ্রমিকের মধ্যে নীলফামারী জেলার বিভিন্ন থানার ৫ শ্রমিক রয়েছে। যারা ভিয়েতনাম থেকে খালি হাতে ফিরে এসে ওই দেশটিকে অপরাধ করার অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হন। তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানোর পর আদালত তাদের জেলে পাঠায় পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে। তারা জেলে আছেন। এসব শ্রমিকদের পরিবার এখন অনিশ্চিত ভবিষদের দিকে তাকিয়ে আছে। একে তো রিকুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের খপ্পড়ে জমি, গরু, ভিটামাটি বিক্রি. এবং সুদের উপর টাকা নিয়ে ভিয়েতনাম গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এরপর খালি হাতে ফিরে মিথ্যে অভিযোগে জেলে আছেন। এরমধ্যে রয়েছেন নীলফামারি জেলার সদর থানার টুপামারী নিজপাড়া গ্রামের আসলাম উদ্দিনের ছেলে মো. মমিনুর রহমান, একই এলাকার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে রকিবুল আলম বাবু, মোশারফ হোসেন শাহ’র ছেলে মো. নুরে আলম শাহ মানিক। এরা সবাই জমি, গরু বিক্রি করে এবং সুদের উপর টাকা নিয়ে স্থানীয় দালাল নীলফামারী সদর থানার রামনগর ইউনিয়নের টেকনার পাড় এলাকার জিন্নাত ভাটিয়া, তার ছেলে ইউসুফ এবং দারোগের মাধ্যমে ভিয়েতনাম পাচার হয়েছেন। এদের প্রত্যেকে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে ভিয়েতনামে কাজ দেয়ার কথা বলে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে নেয়া হয়। বিমানে ওঠার আধাঘণ্টা আগে এদের হাতে পাসপোর্ট ধরিয়ে দেয়া হয়। ভিয়েতনামের রাজধানীতে পৌঁছার পর স্থানীয় দালাল চক্রের সহযোগী ভিয়েতনামে বসবাসকারি বাংলাদেশি দালালরা তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে একটি ঘরে নিয়ে আটকে রাখে। ওই শ্রমিকরা যখন কাজের কথা বলেন, তখন তাদের কাছে আরও ১ থেকে ২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় এদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করিয়ে নেয় দালাল চক্র। দালাল চক্র তাদের নিয়ে যেতো এবং কাজ শেষ করিয়ে আবার নিজেদের ডেরায় আটকে রাখতো। প্রতিবাদ করায় এদের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা হতো। এক পর্যায়ে গোপনে তারা দেশে থাকা স্বজনদের কাছে নিজেদের করুন কাহিনী তুলে ধরে। ওইসব শ্রমিকদের স্বজনরা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দালাল জিন্নাত ভাটিয়া, তার ছেলে ইউসুফ এবং দারোগা এ বলে হুমকি দেয় কোন কথা বললে বা কাউকে এ বিষয়ে জানালে একজনকেও জীবিত রাখা হবে না। শুধু নীলফামারীর ওই হত্যভাগরাই নয় এমন পরিস্থিতির শিকার হন হবিগঞ্জ, শরীয়তপুর টাঙ্গাইল, মাগুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনী ময়মনসিংহ, কুমিল্লা দিনাজপুর, লক্ষ্মীপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে যাওয় ১০৬ বাংলাদেশি। যদিও এদের ফিরিয়ে আনার পর তাদের কোন দালাল পাঠিয়েছেন, কোন রিক্রটিং এজেন্টির মাধ্যমে তারা পাচার হয়েছেন সব তথ্যই পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিএমইটিসহ সংশ্লিষ্টরা। দালাল চক্র এবং প্রতারক রিক্রটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ১০৬ প্রবাসীর মধ্যে ৮৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার দেখিয়েছে। তারা বর্তমানে জেলে আছে। ওইসব শ্রকিদের স্বজনরা জানান, ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতনের লোভ দেখিয়ে তাদের ভিয়েতনাম পাঠানো হয়। ভিয়েতনামে যাওয়ার জন্য বিমানে ওঠার আধাঘন্টা আগে পাসপোর্ট দেয়ার কারণে কেউই কোন ভিসায় ভিয়েতনাম যাচ্ছেন তা দেখতে পারেননি। ভিয়েতনাম পৌঁছার পর টাকা পয়সা, পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে ভিয়েতনামে দালাল চক্রের সহযোগীরা তাদের জিম্মি করে ফেলে। ঠিকমতো বেতন তো দূরের কথা খাবারও দিতো না। নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। সেখানে তাদের মেরে ফেলারও হুমকি দেয়া হত। বাধ্য হয়ে তারা দেশে থাকা স্বজনদের কাছে ঘটনা জানিয়ে তাদের বাঁচানোর কথা বলেন।

বাংলাদেশ সরকারে একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে ‘মানবপাচার’ অর্থ কোন ব্যক্তিকে (ক) ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগ করিয়া বা (খ) প্রতারণা করিয়া বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোন অসহায়ত্বকে (াঁষহবৎধনরষরঃ) কাজে লাগাইয়া, বা (গ) অর্থ বা অন্য কোন সুবিধা (শরহফ) লেনদেন-পূর্বক উক্ত ব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রহিয়াছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করিয়া; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোন শোষণ বা নিপীড়নের (বীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ) উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকাইয়া রাখা বা আশ্রয় দেয়া (যধৎনড়ঁৎ)। (২) যেইক্ষেত্রে কোন শিশু পাচারের শিকার হয়, সেইক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এর দফা (ক) হইতে (গ) তে বর্ণিত মানবপাচার অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমসমূহ (সবধহং) অনুসৃত হইয়াছে কিনা তাহা বিবেচিত হইবে না। ব্যাখ্যা। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, যদি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে প্রতারণার মাধ্যমে, অসৎ উদ্দেশ্যে এবং বাধ্যতামূলক শ্রম বা ‘সার্ভিচিউড’ (ংবৎারঃঁফব) বা ধারা-২ এর উপ-ধারা (১৫) এ বর্ণিত কোন শোষণ বা নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির শিকার হইতে পারে মর্মে জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোন ব্যক্তিকে কাজ বা চাকরির উদ্দেশ্যে গমন, অভিবাসন বা বহির্গমন করিতে প্রলুব্ধ বা সহায়তা করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির উক্ত কর্ম উপ-ধারা (১) এ সংজ্ঞায়িত ‘মানবপাচার’ এর অন্তর্ভুক্ত হইবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মানবপাচার প্রতিরোধে মানবপাচার আইন (২০১২) করা হয়েছে। সেই আইনে মানবপাচারের সংজ্ঞা, মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি, মামলা সবকিছু স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এরপরও নানাভাবে মানবপাচার হলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আইনে ফাঁক-ফোকর দিয়ে মানবপাচারকারী রিক্রুটিং এজেন্সি ও তাদের সহযোগীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

সিআইডির মানবপাচার প্রতিরোধ সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকতারুজ্জামান জানান, কয়েক দশক ধরে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে চাকরি বা কাজ দেয়ার কথা বলে জনবল পাচার হয়ে আসছে। ভিয়েতনামসহ অনেক দেশে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর কোন চুক্তি নেই। অথচ এসব দেশে দেশি ও বিদেশি সংঘবদ্ধ চক্র মিলে মানবপাচার করেছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানবপাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। গত কয়েক বছরে মানবপাচারের অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলা সিআইডি তদন্ত করছে। বিভিন্ন সময়ে মানবপাচারের অভিযোগে দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তবুও নানা কৌশলে মানবপাচার অব্যাহত রয়েছে। সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক বছর ধরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভিয়েতনামে মানবপাচার করে আসছিল। কোন দেশের সঙ্গে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি না থাকলে ওইসব দেশে শ্রমিক পাঠানোর কথা নয়। কিন্তু চক্রটি নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এসব শ্রমিকদের ভিয়েতনামে পাঠিয়েছে। ভিয়েতনামে সর্বশেষ ১০৬ জন বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরি দেয়ার কথা বলে পাঠালেও তাদের কোন কাজ দেয়া হয়নি। তাদের ওয়ার্ক ভিসায় না পাঠিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসায় পাঠায়। পরে ভিয়েতনামে ওইসব বাংলাদেশিদের জিম্মি করে তাদের দিয়ে বিনা পয়সায় বিভিন্ন কোম্পানির কাজ করিয়ে নেয় দালাল চক্র। এসব অভিযোগ পাওয়ার পর সিআইডি তদন্ত শুরু করে। সিআইডি জানতে পারে চাকরির জন্য যাওয়ার পর অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ১০৬ বাংলাদেশি দূতাবাসে আশ্রয় নেয়। পরে তাদের ফিরিয়ে আনা হলে সিআইডি প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে।