চার মাসে ২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা

ফাইজারের টিকা আসছে ফেব্রুয়ারিতে

প্রথম দুই মাসেই এক কোটি মানুষকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ টিকার দুই ডোজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আর চার মাসে দুই কোটি মানুষকে করোনার টিকা দেয়া হবে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ অথবা মার্চের শুরুতেই ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র প্রায় চার লাখ ডোজ করোনার ভ্যাকসিন আসছে বাংলাদেশে। ‘ফাইজার’র টিকা শুধুমাত্র রাজধানীকেন্দ্রিক সম্মুখসারির (ফ্রন্টলাইন) স্বাস্থ্যকর্মীদের দেয়া হবে। যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ নেবেন তারা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে একই টিকা নেবেন। আর যারা ফাইজারের টিকা নেবেন তারা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ফাইজারের টিকাই নেবেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র ভ্যাকসিন সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশ ১৮ জানুয়ারির আগেই ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় ‘ফাইজার’র টিকা নেয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) ও বিশে^র অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে স্বল্পমূল্যে টিকা দেয়ার লক্ষ্যে গ্যাভিকে (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) জানিয়ে দেয়ার কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এদিকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ- এই দুই মাসেই এক কোটি মানুষকে ‘অক্সফোর্ড’র টিকার প্রথম ডোজ দেয়া হবে। টিকাদান কর্মসূচি কিছুটা পরিবর্তন করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আগের পরিকল্পনা ছিল, প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসলে তা দিয়ে ২৫ লাখ মানুষের টিকাকরণ সম্পন্ন করা হবে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র ভ্যাকসিন আগামী ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আসবে বলে গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়।

ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক বলেন, ‘১৮ বছরের নিচে এবং গর্ভবতী নারীদের করোনার টিকা দেয়া হবে না।

পরিকল্পনা পরিবর্তনের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার নতুন তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ডোজ দেয়ার ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে। এর আগে আমাদের জানানো হয়েছিল, প্রথম ডোজ দেয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। সে হিসাবে প্রথমে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল।’

টিকাদান কর্মসূচি পরিবর্তনের বিষয় জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. এএসএম আলমগীর গতকাল সংবাদকে বলেছেন, ‘আমাদের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল, প্রতিমাসে যেহেতু ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসবে, তা দিয়ে ২৫ লাখ মানুষকে ভ্যাক্সিনাইজেশন (টিকাকরণ) দিয়ে দেব.. সেকেন্ড ডোজ যেহেতু লাগবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন চার থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সেকেন্ড ডোজ দিলেই হয়... পরে দিলেও সমস্যা নেই। এ কারণে আমরা যা করব, তা হলো প্রথম দুইমাসে ৫০ লাখ, ৫০ লাখ... মোট এক কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়ে দেব। আট সপ্তাহে গিয়ে সেকেন্ড ডোজ দেব। এতে করে আগামী চার মাসের মধ্যে দুই কোটি মানুষের ভ্যাক্সিনাইজেশন সম্পন্ন হয়ে যাবে। এজন্য ২৫ লাখ, ২৫ লাখ ... ভাগ করব না।’

লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক বলেন, তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীকে ৮ সপ্তাহ ব্যবধানে (১ম ডোজের ৮ সপ্তাহ পর ২য় ডোজ) ভ্যাকসিন প্রদান করা হবে। কেউ যদি ২ ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণে ইচ্ছুক হন তবে তাকে অবশ্যই ২ ডোজের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান নির্ধারিত ৮ সপ্তাহ দেশে অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে বৈধ কাগজপত্রাদি (পাসপোর্ট, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি) দাখিল করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কেউ ভ্যাকসিন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাকে জোরপূর্বক তা দেয়া হবে না। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন নিতে হতে পারে।’

ফাইজারের টিকা শুধু ঢাকার ফ্রন্টলাইনের স্বাস্থ্যকর্মীদের

‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি’র (কোভ্যাক্স) আওতায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আট কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) কেনার চুক্তি করেছে। এই সুবিধার আওতায় ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা, যার প্রথম চালান হিসাবে প্রায় চার লাখ ডোজ ‘ফাউজার বায়োএনটেক’র টিকা আগামী মার্চের মধ্যে পাচ্ছে বাংলাদেশ।

ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা নেয়ার বিষয়ে ‘আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফাইজারের টিকা নিলে অন্তত আমরা ঢাকা ভ্যাক্সিনাইজেশন করতে পারব। আমাদের নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই টিকা আমরা নেব। ফাইজারের টিকা আমাদের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি অনুযায়ী, শুধু ঢাকায় মানুষকে দেয়া যাবে। পরবর্তীতে আরও টিকা আমরা পাব, সেগুলো স্টোরেজ ক্যাপাসিটি অনুযায়ী অন্যান্য জেলায়ও দেয়া হবে।’

‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। তা না হলে টিকার গুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফাইজারের টিকা প্রয়োগের জন্য যে সুই-সিরিঞ্জ দরকার হয়, তা প্রচলিত সুই-সিরিঞ্জের চেয়ে আলাদা। ইতোমধ্যে ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

গ্যাভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ বার্কলি গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ কোভ্যাক্স উদ্যোগের ১৯২টি সদস্যদেশকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, তারা জানুয়ারির শেষ নাগাদ বা ফেব্রুয়ারিতে কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে স্বল্পসংখ্যক টিকা দিতে চায়। এই টিকা ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে, জাতীয় করোনা টিকা পরিকল্পনায় একাধিক ধরনের টিকা ব্যবহারের ইচ্ছার প্রকাশ থাকতে হবে, ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফাইজারের টিকার অনুমোদন করাতে হবে এবং এর সঙ্গে ফাইজারের দায়মুক্তির একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে।

ওই চিঠিতে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলা হয়েছে, ১৮ জানুয়ারির মধ্যে সদস্যদেশগুলোকে আগ্রহের বিষয়টি কোভ্যাক্সকে জানাতে হবে। ১৯ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ বা গ্যাভি সংশ্লিষ্ট দেশের আগ্রহপত্র ও অবকাঠামো পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং ২৯ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ঢেউয়ের টিকা বিতরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে এবং সদস্যদেশগুলোকে জানিয়ে দেবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘১৮ জানুয়ারির আগেই গ্যাভিকে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। তারা প্রাথমিকভাবে দেশের জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চায়।’

সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। এ হিসাবে চার লাখের বেশি ডোজ ‘ফাইজার’র টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে করোনার টিকা কর্মসূচির আওতায় নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

প্রথম পর্যায়ের টিকায় যাদের অগ্রাধিকার

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম যে ভ্যাকসিন আসবে তা প্রথম ফেইজের প্রথম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠী ৮ দশমিক ৬৮ ভাগ মানুষকে দেয়া হবে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী (চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী) পাবেন চার লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন। পাশাপাশি ছয় লাখ বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীও টিকা পাবেন।

এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পাবেন দুই লাখ ১০ হাজার জন, সম্মুখসারির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের মধ্যে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর তিন লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ জন কর্মী, ৫০ হাজার সরকারি কর্মচারী, ৫০ হাজার সম্মুখসারির গণমাধ্যমকর্মী, এবং বিভিন্ন পর্যায়ের এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন জনপ্রতিনিধি প্রথম পর্যায়ে টিকা পাবেন।

অন্যদের মধ্যে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মীদের মধ্যে দেড় লাখ, মৃতদেহ সৎকার কর্মীদের মধ্যে ৭৫ হাজার, জরুরি পানি, গ্যাস ও পয়ঃনিষ্কাশন কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে চার লাখ, স্থল-নৌ-বিমানবন্দরকর্মীদের মধ্যে দেড় লাখ, প্রবাসী অদক্ষ কর্মী এক লাখ ২০ হাজার, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জরুরি সেবায় নিয়োজিত চার লাখ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী ছয় লাখ ২৫ হাজার জন প্রথম পর্যায়ে টিকা পাওয়ার অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছেন।

এছাড়াও ৮০ বছরের ঊর্ধ্ব ১৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ জন, ৭৭ থেকে ৭৯ বছর ১১ লাখ তিন হাজার ৬৫৩ জন, জাতীয় দলের খেলোয়াড় ২১ হাজার ৮৬৩ জনকে টিকা প্রদানের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। আর জরুরি প্রয়োজনের জন্য ৭০ হাজার ডোজ টিকা রাখা হবে।

বুধবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২১ , ২৯ পৌষ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২

চার মাসে ২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা

ফাইজারের টিকা আসছে ফেব্রুয়ারিতে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

প্রথম দুই মাসেই এক কোটি মানুষকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ টিকার দুই ডোজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আর চার মাসে দুই কোটি মানুষকে করোনার টিকা দেয়া হবে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ অথবা মার্চের শুরুতেই ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র প্রায় চার লাখ ডোজ করোনার ভ্যাকসিন আসছে বাংলাদেশে। ‘ফাইজার’র টিকা শুধুমাত্র রাজধানীকেন্দ্রিক সম্মুখসারির (ফ্রন্টলাইন) স্বাস্থ্যকর্মীদের দেয়া হবে। যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ নেবেন তারা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে একই টিকা নেবেন। আর যারা ফাইজারের টিকা নেবেন তারা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ফাইজারের টিকাই নেবেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র ভ্যাকসিন সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশ ১৮ জানুয়ারির আগেই ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় ‘ফাইজার’র টিকা নেয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) ও বিশে^র অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে স্বল্পমূল্যে টিকা দেয়ার লক্ষ্যে গ্যাভিকে (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) জানিয়ে দেয়ার কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এদিকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ- এই দুই মাসেই এক কোটি মানুষকে ‘অক্সফোর্ড’র টিকার প্রথম ডোজ দেয়া হবে। টিকাদান কর্মসূচি কিছুটা পরিবর্তন করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আগের পরিকল্পনা ছিল, প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসলে তা দিয়ে ২৫ লাখ মানুষের টিকাকরণ সম্পন্ন করা হবে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র ভ্যাকসিন আগামী ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আসবে বলে গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়।

ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক বলেন, ‘১৮ বছরের নিচে এবং গর্ভবতী নারীদের করোনার টিকা দেয়া হবে না।

পরিকল্পনা পরিবর্তনের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার নতুন তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ডোজ দেয়ার ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাবে। এর আগে আমাদের জানানো হয়েছিল, প্রথম ডোজ দেয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। সে হিসাবে প্রথমে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল।’

টিকাদান কর্মসূচি পরিবর্তনের বিষয় জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. এএসএম আলমগীর গতকাল সংবাদকে বলেছেন, ‘আমাদের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল, প্রতিমাসে যেহেতু ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসবে, তা দিয়ে ২৫ লাখ মানুষকে ভ্যাক্সিনাইজেশন (টিকাকরণ) দিয়ে দেব.. সেকেন্ড ডোজ যেহেতু লাগবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন চার থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সেকেন্ড ডোজ দিলেই হয়... পরে দিলেও সমস্যা নেই। এ কারণে আমরা যা করব, তা হলো প্রথম দুইমাসে ৫০ লাখ, ৫০ লাখ... মোট এক কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়ে দেব। আট সপ্তাহে গিয়ে সেকেন্ড ডোজ দেব। এতে করে আগামী চার মাসের মধ্যে দুই কোটি মানুষের ভ্যাক্সিনাইজেশন সম্পন্ন হয়ে যাবে। এজন্য ২৫ লাখ, ২৫ লাখ ... ভাগ করব না।’

লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক বলেন, তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীকে ৮ সপ্তাহ ব্যবধানে (১ম ডোজের ৮ সপ্তাহ পর ২য় ডোজ) ভ্যাকসিন প্রদান করা হবে। কেউ যদি ২ ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণে ইচ্ছুক হন তবে তাকে অবশ্যই ২ ডোজের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান নির্ধারিত ৮ সপ্তাহ দেশে অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে বৈধ কাগজপত্রাদি (পাসপোর্ট, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি) দাখিল করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কেউ ভ্যাকসিন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাকে জোরপূর্বক তা দেয়া হবে না। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন নিতে হতে পারে।’

ফাইজারের টিকা শুধু ঢাকার ফ্রন্টলাইনের স্বাস্থ্যকর্মীদের

‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি’র (কোভ্যাক্স) আওতায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আট কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) কেনার চুক্তি করেছে। এই সুবিধার আওতায় ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা, যার প্রথম চালান হিসাবে প্রায় চার লাখ ডোজ ‘ফাউজার বায়োএনটেক’র টিকা আগামী মার্চের মধ্যে পাচ্ছে বাংলাদেশ।

ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা নেয়ার বিষয়ে ‘আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফাইজারের টিকা নিলে অন্তত আমরা ঢাকা ভ্যাক্সিনাইজেশন করতে পারব। আমাদের নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই টিকা আমরা নেব। ফাইজারের টিকা আমাদের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি অনুযায়ী, শুধু ঢাকায় মানুষকে দেয়া যাবে। পরবর্তীতে আরও টিকা আমরা পাব, সেগুলো স্টোরেজ ক্যাপাসিটি অনুযায়ী অন্যান্য জেলায়ও দেয়া হবে।’

‘ফাইজার-বায়োএনটেক’র টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। তা না হলে টিকার গুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফাইজারের টিকা প্রয়োগের জন্য যে সুই-সিরিঞ্জ দরকার হয়, তা প্রচলিত সুই-সিরিঞ্জের চেয়ে আলাদা। ইতোমধ্যে ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

গ্যাভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ বার্কলি গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ কোভ্যাক্স উদ্যোগের ১৯২টি সদস্যদেশকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, তারা জানুয়ারির শেষ নাগাদ বা ফেব্রুয়ারিতে কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে স্বল্পসংখ্যক টিকা দিতে চায়। এই টিকা ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে, জাতীয় করোনা টিকা পরিকল্পনায় একাধিক ধরনের টিকা ব্যবহারের ইচ্ছার প্রকাশ থাকতে হবে, ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফাইজারের টিকার অনুমোদন করাতে হবে এবং এর সঙ্গে ফাইজারের দায়মুক্তির একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে।

ওই চিঠিতে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলা হয়েছে, ১৮ জানুয়ারির মধ্যে সদস্যদেশগুলোকে আগ্রহের বিষয়টি কোভ্যাক্সকে জানাতে হবে। ১৯ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ বা গ্যাভি সংশ্লিষ্ট দেশের আগ্রহপত্র ও অবকাঠামো পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং ২৯ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ঢেউয়ের টিকা বিতরণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে এবং সদস্যদেশগুলোকে জানিয়ে দেবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘১৮ জানুয়ারির আগেই গ্যাভিকে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। তারা প্রাথমিকভাবে দেশের জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চায়।’

সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। এ হিসাবে চার লাখের বেশি ডোজ ‘ফাইজার’র টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে করোনার টিকা কর্মসূচির আওতায় নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

প্রথম পর্যায়ের টিকায় যাদের অগ্রাধিকার

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম যে ভ্যাকসিন আসবে তা প্রথম ফেইজের প্রথম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠী ৮ দশমিক ৬৮ ভাগ মানুষকে দেয়া হবে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী (চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী) পাবেন চার লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন। পাশাপাশি ছয় লাখ বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীও টিকা পাবেন।

এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পাবেন দুই লাখ ১০ হাজার জন, সম্মুখসারির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের মধ্যে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর তিন লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ জন কর্মী, ৫০ হাজার সরকারি কর্মচারী, ৫০ হাজার সম্মুখসারির গণমাধ্যমকর্মী, এবং বিভিন্ন পর্যায়ের এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন জনপ্রতিনিধি প্রথম পর্যায়ে টিকা পাবেন।

অন্যদের মধ্যে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মীদের মধ্যে দেড় লাখ, মৃতদেহ সৎকার কর্মীদের মধ্যে ৭৫ হাজার, জরুরি পানি, গ্যাস ও পয়ঃনিষ্কাশন কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে চার লাখ, স্থল-নৌ-বিমানবন্দরকর্মীদের মধ্যে দেড় লাখ, প্রবাসী অদক্ষ কর্মী এক লাখ ২০ হাজার, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জরুরি সেবায় নিয়োজিত চার লাখ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী ছয় লাখ ২৫ হাজার জন প্রথম পর্যায়ে টিকা পাওয়ার অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছেন।

এছাড়াও ৮০ বছরের ঊর্ধ্ব ১৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ জন, ৭৭ থেকে ৭৯ বছর ১১ লাখ তিন হাজার ৬৫৩ জন, জাতীয় দলের খেলোয়াড় ২১ হাজার ৮৬৩ জনকে টিকা প্রদানের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। আর জরুরি প্রয়োজনের জন্য ৭০ হাজার ডোজ টিকা রাখা হবে।