গৃহ বদলের মানুষ জীবন

মামুন হুসাইন

তুমি অথবা তোমাদের ভাড়াটে এ রকম ভাবছিলে কোনদিন- হয়ত খাঁচা ভর্তি স্মৃতি, জোনাকির মতো বুদ্বুদ আশা অথবা মৃত্যুর শান্ত-নীরবতা : ফিরে ফিরে দেখলে, বন্ধ হয়ে যাওয়া পোস্ট মাস্টারের নীল চোখ, পারসেল ওজন হচ্ছে; তোমার আঙুল অনুভব করল, পারসেলের নট তোমার অচীন দূর গাঁ-ঘরের এক সুকন্যা ধীরে ধীরে খুলছে- আর আপাত নিষিদ্ধ-ভীরু পারসেল তখন মৃদু জলস্রোতে বিবিধ গল্প ভাসায় তোমার জন্য : সকল কালেই তুমি দেখবে মৃত্যু কেবল হয় মৃত লোকটির, মৃতদেহ এমনকি খুনীর কাছেও পৌঁছয় না, মৃতদেহ মৃত-মানুষটির একক সম্পত্তি... ... শুধু বেদনা প্রকাশের কালে মৃতব্যক্তিকে নিয়ে রচিত ইচ্ছা-রাজ্যের ঐশী শক্তি জলে নেমে যায়, ভূমিকম্প হয়, স্বৈরাচার হয়, ও প্রজাপতির ঈশারা নির্মাণ করে। স্মরণ করো- হয়ত এর সামান্য দিনক্ষণ পরে, হেড মওলানার মেয়ে, পায়ে জোঁক সেঁটে থাকা হাওরের গরিব রাজকন্যা এবং তোমাদের নিচতলার উঁকিঝুঁকি জন্ম-জন্মান্তরের মরীচিকা সখী একত্রে চাঁদের একক বন্ধু হয়ে আমাদের জঙ্গল স্নান সমাপ্ত করায়, অর্ধস্ফুট ভিখারী করে এবং সম্পর্ক তৈরির নতুন এক শৈলী বিজ্ঞান শেখায়- সামান্য কয়েক মাস আমরা পরস্পরকে ভালোবাসার ব্রহ্ম- দান করি, ...তারপর, আকাশে তারা ওঠেনি, ঘরের টিয়া উত্তেজিত হয়নি, ইঁদুরের মরণ স্রোত তৈরি হয়নি- ষড়রিপুর এমন এক রহস্যকালে সে ফিরে যায় চিরকালের মতো। ভাড়াবাড়ির সেই কন্যা আর দেখা দেয় না- ... তোমরা দরজা ধাক্কা দিতে দিতে শাপ শাপান্ত করলে, ওর চোখ ধূসর হয়ে যাক, ওর সৌন্দর্য নিঃশেষ হোক; আর আমি প্রার্থনা করলাম ও আগের সকল সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বেঁচে থাকুক আমাদের যৌথ স্মৃতিতে, ধ্যানে, আঁতুড় ঘরে এবং জন্মান্ধ পিঁপড়ের সমবেত কান্নায়।

‘পিঁপড়া-পিঁপড়া কয়টা ডিম...’ এই গুঞ্জনে তুমি, আমি এবং সে জলের গভীরে নেমে যাই। মাঝে মাঝে একটা ঝাপসা গাছ আসে। একটা স্কুল আসে, একটা হোস্টেল এবং দীর্ঘ নারকেল বাগান। আমাদের সম্মিলিত প্রতিজ্ঞায় হোস্টেলের নারকেল চুরি হতে হতে ব্যক্তিগত ট্রাংক এবং সুটকেসে আশ্রয় পায়। আমরা আঁধার রাস্তায় ইঁট বিছিয়ে রাখি, যেন রিক্সাবালক গোত্তা খায় এবং অশ্লীল খিস্তি উপহার দিতে পারে। আমরা প্রতিরাতে স্কুল কম্পাউন্ডের দেয়াল ভেঙ্গে চূর্ণ করি। আমাদের জাগরণ হয় এবং কলেজ ইউনিয়নের ঈষৎ ক্ষমতাবান বইয়ে নাম লেখাই। আমরা বড় দাদাদের নির্দেশে চাঁদা তুলি, ত্রাণ সংগ্রহ করি, গণসঙ্গীত গাই। মেডিকেল ক্যাম্প করি, পত্রিকা বানাই, বর্ষা মঙ্গল করি, পয়লা বৈশাখ করি এবং খাসজমি দখলের স্বপ্নে রাত কাটাই নাচোল-আদিবাসীর শীতার্ত আঁধার বারান্দায়। ক্লাস ফাইনাল শেষে বাস কন্ডাকটরকে বশীভূত করে আমরা বিনে পয়সায় লম্বা রাস্তা পেরিয়ে সমুদ্র দেখতে যাই- একবার অমাবশ্যায়, একবার ভরা পূর্ণিমায়। জলের ভেতর ভেসে-ভেসে আমরা কিঞ্চিৎ নিষিদ্ধ জল খেয়ে অনন্ত আকাশের দিকে যেতে যেতে রাজাধিরাজ হয়ে যাই,... আর শুয়ে থাকি বালিয়াড়িতে, আর কি তীব্র ক্ষুধা...; ঝাউবন, আকাশ এবং নক্ষত্ররাজি, আমাদের বিশ্রুত করে, অপার্থিব করে আর রোমাঞ্চ ছড়ায়, আর ভাবায়... ডিক্লাসড্ হচ্ছি... না, না ডিক্লাস্ড নয়,... পলায়নের চিক চিক আনন্দ, ও ঘোলাটে জোৎন্সা পান করতে করতে পুনরায় গৃহ প্রত্যাবর্তন। অথবা পড়া তৈরির সেই ঝিম-ঝিম বাতি- ... আমাদের বাতিঘর বটে!... যে বাতি-ই জ্বালাই না কেন, কাছের জায়গা আলোকিত হলেও দূরের দিগন্ত অনন্তকালের রাতের গভীরতা দিয়ে পরিবেষ্টিত। আমরা আনন্দের ভুল ও বিভ্রমে সত্য দেখার স্তর খুঁজি, আর শিখি- মানবজীবনের দুই জমজ ভাইবোন হচ্ছে আকাক্সক্ষা ও ক্লান্তি। ...হয়ত পরাজিত হই, শপথ ভঙ্গ করি, পরজীবী হই এবং আবারও দুপুরের ভাত-ঘুম সমাধা করে সন্ধ্যায় অনেক দেরিতে আমাদের অতিপ্রাকৃত-অধিবিদ্যাকে সেই হারিকেন-জোছনায় খুঁজতে বসি; কালিমাখা হারিকেন, তোমাদের স্বাধীন-ইচ্ছার জোরে আর প্রপিতামহদের প্রযতে্ন, একদা মুসলিম লীগের প্রাচীন হ্যারিকেন মার্কা ভোটের কাগজ হয়ে গাছপালার ঝগড়া শোনে। তোমরা গাছেদের চুল স্পর্শ করলে। ভাঙ্গা-অস্পষ্ট রামধনুর ভেতর, মাথা ভর্তি অন্ধকারের ভেতর তোমাদের স্বপ্ন দ্বিধা ও সন্তান-সন্ততি উৎপাদন হয়। তোমরা আদিগন্ত মাতৃগর্ভ থেকে নেমে আসা উড়ন্ত সখা-সখী, পরস্পরের পাঁজর গুচ্ছ, আজঁল ভর্তি স্বপ্ন, মাকড়সার জাল, মাছরাঙ্গার ওড়াউড়ি, গৃহস্থের ভিটেমাটি এবং বৃষ্টিভেজা ভিক্ষার চাল। তোমাদের রান্নাঘর হয় এবং বৃষ্টিভেজা ভিক্ষার চাল থেকে সুগন্ধ খাদ্য নির্মাণ হয়। খাদ্য থেকে নির্মাণ হয় কৃষিকাজ (...মন তুমি কৃষিকাজ জানো না...) খাদ্য থেকে তারপর ইস্টিশন, ভাষাতত্ত্ব, মলমূত্র, টিয়াপাখি, নিমগাছ, পূর্বরাগ, অন্ন-ঘাম, একবাক্স রাশিচক্র এবং জন্মান্তরের খড়কুটো-স্বপ্নগাছ নির্মাণের মিছিল। তোমরা দেখলে কাদার ভেতর একটি না লেখা কাব্যগ্রন্থ। বৃষ্টিভেজা ভিক্ষার চাল তোমাদেরকে বিপজ্জনক বৃষ্টিতে ডুবিয়ে ইন্দ্রিয়ময় করে। তুমি সেই প্রথম হিজল গাছ চিনলে। তুমি সূর্যাস্ত, জোৎস্না ও মৃত পিঁপড়ে রান্না করার কৌশল শিখলে। সারারাত-সারাঘর কে যেন হেঁটে বেড়ালো। তুমি দিনলিপি রচনা করার কৌশল শিখলে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে আর তোমরা ডুবজলে ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক হতে হতে আবিষ্কার করলে, তোমাদের মাঝখানে কে একজন মহল্লার ভাড়াবাড়ির রাজকন্যা হয়ে গোলাপ সুন্দরী হয়ে এইমাত্র ইস্টিশান ত্যাগ করলো। তোমাদের কর্দমাক্ত আশাবাদ বধির হয় এক-দুবেলা, বোকা স্বপ্নগাছ হয়, গেরুয়া রমণী হয়, গর্ভবতী হয় এবং রচনা করে এক বিস্ময়-বিরহ পরিবৃত অবিনশ্বর আত্মজীবনী।

হেড মওলানার মেয়ে, পায়ে জোঁক সেঁটে থাকা হাওরের গরিব রাজকন্যা এবং তোমাদের নিচতলার উঁকি-ঝুকি জন্ম-জন্মান্তররের মরীচিকা সখী­- থ্রী ইন ওয়ান হয়ে আমাদের এই যৌথ আত্মজীবন বর্ণনায় অন্য এক অন্তর্লীন-অতলান্ত-পদচিহ্নের অভিমুখ তৈরি করে। ঝুলন্ত চাঁদের পাশে একদা রাজকন্যার এলোচুলের গভীর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে তোমাদের নাভিমূলের অবিমিশ্র স্বপ্ন অনুবাদের ফাঁকে মূক ও বধির ইন্দ্রীয়সমূহে ক্রমশ সন্ধ্যা জলের ঘ্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। জলের ভেতর, স্বপ্নের ভেতর, পবিত্র পাপের ভেতর তুমি দেখলে পেছনের জানালা খোলা- একটি বালিকার স্তব্ধ মৃতদেহ, একটি মুমূর্ষু মথ মৃতদেহের খোলা বুকে মুখ ডুবিয়ে আর পরিত্যক্ত হরিতকি গাছ। আমরা লিখলাম- আমাদের জীবন ছোট এবং আমাদের মায়েদের কোমরজুড়ে অনন্তকালের ব্যথা। লেখা হলো- তুমি আমার কেউ না, তবুও তোমার কাছে অন্ন-নুনের লোভে বারবার আসি। লেখা হলো- মা ও বাবা যেমন করে দরমার দেয়াল থেকে উঁইপোকা হত্যা করতো, আমাদের প্রতিপালনের কালে, সেই হত্যাযজ্ঞের কথা। আমাদের একটি নকল গরু ছিল, মা-মরা বাছুরকে বাল্যশিক্ষা দেওয়ার জন্য। ধরা যাক একটি ভাঙা বাড়ির মালিক হওয়ার আগে মা, তুমি, আমরা সবাই বাধ্যতামূলক গৃহচ্যুত হই। ভাদুড়ি বাড়ির রমা মাসী, যে ছিল মায়ের অনন্ত সখী, দেশান্তরের আগে ওঁর পিসিমার গল্প শুনিয়েছিল: ... বাল্যবিধবা পিসিমাকে মাছ খাওয়ানোর আশ্চর্য-সৃজনশীল আয়োজন- ... পিসিমা মাছ ভালবাসতেন, উপায় কী? তরকারী-সবজিতে মাছের ভাস্কর্য তৈরি করে, ভেতরে ভেতরে নির্দোষ বৃক্ষলতার অপরূপ সরু ডাল পুঁতে দেয়া হতো কাঁটার বিভ্রম আনার জন্য। পিসিমা এই সরল মিথ্যা চোখ ছল-ছল করে আজীবন গলাধঃকরন করে গেছেন। পিসিমা মাছ-ভাতে ক্রমে ক্রমে বাঙালি হন, আর সেই নামহীন-গোত্রহীন মাছের ভাস্কর্য দেখতে দেখতে আত্মজীবন বর্ণনার অন্য অধ্যায়ে আমরা মায়ের মতো কাউকে খুঁজি- একটি সাবান আসে বর্ণনায়, সাবান অর্থ সাবানের ঘ্রাণ, এই সাবানের ঘ্রাণ, মায়ের ঘ্রাণ হয়ে, মায়ের হাত হয়ে আমার মুখম-ল সিঞ্চন করে। একজন দিদিমা আসেন,... হয়ত মায়ের দিদিমা- পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখেছিলেন ১৯৯৫-এর ২৪ অক্টোবর, এক্সরে প্লেট গোল করে, দিদিমা ক্ষয়িষ্ণু চোখের ভেতর সূর্যগ্রহণ নির্মাণ করেন... দেখলাম, পয়লা চাঁদ সামান্য খামচে ধরেছে, তারপর সূর্য হয়ে উঠেছে চাঁদের মত সরু, মাটির ওপর আঁকাবাঁকা ছায়া, দিনের আলো ক্ষীণ হচ্ছে, হঠাৎ-ই ঠাণ্ডা বাতাস, পশুপাখি শান্ত-সুনসান, তাপমাত্রা কমে গেল, যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সূর্য হারিয়ে গেছে পূর্ণ, দু’টো তারা আকাশে, ... এবার দক্ষিণ পশ্চিম থেকে আলোর ছটা, হিরের আংটির মতো, ... সূর্য দেখা দিচ্ছে আবার... এইবার পুরো সূর্য এলো... সূর্যগ্রহণের কালে কল্যাণ চিন্তা করে আমরা উপহার বদল করি, নদীতে স্নান করি,...; আর বিরত হই খাদ্য গ্রহণ থেকে; আমরা দূরের ভ্রমণসূচি ও স্থগিত করি এবং শৌচাগার এড়িয়ে যাই...! সূর্যগ্রহণ চাক্ষুষকারী দিদিমা, হয়ত মায়ের দিদিমা, তারপর কীভাবে গৃহসন্ন্যাসী হন, নির্জন ডাকবাক্স হন, ছেঁড়া মাদুরের কিশোরী হন, স্তব্ধ মৃতদেহ হন,... আমরা আমাদের লিখনকর্মে তা চুপিসারে কর্তন করি। হয়ত চোখ জুড়ে সুদূর প্রহেলিকা; স্বপ্ন ও কান্নার ভেতর আমাদের অনিশ্চয়-অনুগত প্রেমপত্র ভেসে যায় সারারাত গাছে ঝুলে থাকা প্রেমিকাদের পত পত শরীর বরাবর, আর আমাদের ভেতর উৎপাদিত হয় এক নিঝুম ব্যর্থ সন্ধ্যাকাল। তখন মায়ের ঘ্রাণ আসে, অথবা সাবান থেকে চুরি হয়ে যাওয়া মায়ের স্পর্শ গলা-বুক লেপ্টে থাকে। মায়ের হাতে সন্ধ্যা-বিকেল শুধুই ক্রুশ কাঁটা, রুমাল ও সোয়েটারের অলৌকিক রংধনু। নতুন মহল্লার অপর কে এক ভাড়াটে মায়ের সই হয় এবং তারা রান্না বদল করে। নিয়মমাফিক মায়েদের দুই-তিন-এর অধিক সন্তানাদি হয়। মায়েরা কাথা জুড়ে নৌকা, মাছ ও ঘরবাড়ির ছবি আঁকে; মা বটি হাতে সারারাত গোপনে পাহারা করে যেন তিন আত্মজার কাছে শকুন-শেয়াল সহসা পৌঁছতে না পারে। গৃহ ত্যাগের সময় মায়ের পুঁটলিতে গোপনে বহনকৃত ভিটে মাটির শুকনো আমের আঁটি। মা নতুন গ্রামদেশের মাটিতে গির্জা দেখে, কয়লার ইঞ্জিন দেখে, জগন্নাথ মন্দির দেখে এবং নদীর জল স্পর্শ করে। মা এক আঁজলা জল মুখে ছড়ায় এবং পুণ্যের আশায় প্রিয় যুবকের চুলে ছড়িয়ে দেয়। অনেকদিন পর তার ব্যক্তিগত রান্নার খাতা হয়। তার সাধের আমগাছে অঙ্কুর হয় এবং সে সন্তান সম্ভবা হয়। তার একটা রেডিও হয়- রেডিওর ভেতর ‘গর্ভবতী মায়েদের যত্ন’ উৎপন্ন হয়; মা পোস্টকার্ড লেখেন রেডিওর ঠিকানায়- যখন শুনলো হাঁসের ডিম বেশি উপকারী, তখন সে চারটি হাঁস কিনে ফেলে। হাঁসের সম্মেলক আওয়াজে মাঝে মাঝে রেডিও-নিসৃত একটি দুটি দেশাত্মবোধক গান মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে অথবা অতিরিক্ত এক স্তব্ধতা আসে ঘর বাড়িতে- মা ভাবেন, নিখোঁজ ভিটেমাটির আমগাছ বড় হলে আমি এতে দোল খাব। মা দোল খেতে খেতে অতীন্দ্রিয় সব গানে আহ্লাদ ছড়ায়। মা বড় হয়, বৃদ্ধ হয়, আর শেফালি ফুলের ঘ্রাণ নির্মাণ করে উঠোনজুড়ে। মায়ের উঠোন-বারান্দা জুড়ে তখন বিস্তৃত রান্নার ক্লাস- ডালের বড়ি, মাছ ভাজা, পুঁটিমাছের ঝোল, কাঁঠালের বিচি, কাঁচা আমের চাটনি আর কাসোন্দ। আর দেখো স্কুল মাঠের শেষ বিকেলে সেই রাষ্ট্রীয় তথ্য-অফিসের বায়োস্কোপওয়ালা,- একটা প্রজেক্টর, একটা সাদা পর্দা, একটা গর্ত খোঁড়ার শাবল, আর সিনেমার গুচ্ছ ক্যান। সিনেমার সাদা কালো পর্দার ভেতর মানব-মানবী দেখতে দেখতে মা একটু-একটু বদলায়। ছেলেমেয়েরাও বদলায়, আর ঘর-উঠোনে ক্ষণে-ক্ষণে দূর-নিকটের সম্পর্ক ছড়ায়। মায়ের বড় ছেলে গোপন দলের সদস্য হওয়ায় সাদা পুলিশের দৌরাত্ম্যে ছাদে-ছাদে করে পালায় এবং তাৎক্ষণিক পরামর্শে সকল পুস্তক ও লিফলেট বিসর্জিত হয় কুয়োর জলে। একদিন অনেক পরে পাড়া জুড়ে আচমকা সেলফোন-আসক্তি তথা তীব্র গার্হস্থ্য-জীবন শুরু হওয়ায় মায়ের তৈরি পাড়ার লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। মা টেলিভিশনের একখ- বাক্য ফিস ফিস বলে... মেরে প্যায়ারে ভাইয়ো অর বহিনো...; মায়ের একমাত্র হিন্দি-শব্দভাণ্ডার! আর সেই সন্ধ্যায় সন্ন্যাস-রোগে মা বাক্যরহিত হয়; মায়ের স্নান ও বাথরুমের দায়িত্ব আমাদের অনুজ কেউ পবিত্র জ্ঞানে অব্যাহত রাখে। মাস কয়েক পর মা আমাদের কাঁধে শেষ যাত্রার আগে, মায়ের যে আঁচল জুড়ে জোনাকি নামতো, সেই আঁচল দিয়ে শেষবারের মতো আমার কপালের ঘাম স্পর্শ করি, মায়ের দেখানো চাঁদস্পর্শ করি, ভুতগ্রস্ত হই, প্রাচীন ভিটেমাটির রোপণকৃত গাছ থেকে স্বপ্ন জমা করি বাটিতে, আর দূরে কাকতাড়ুয়া দেখতে-দেখতে বাবাকে সামনে আনি- বাবা মায়ের শান্ত-স্থির মৃত-হিম কপাল স্পর্শ করতে করতে, মায়ের সৌন্দর্য বর্ণনার ফাঁকে চুপিসারে চোখ মোছেন হাতের চেটোয়। আমাদের ভাবনায়- মায়ের মৃত্যু দশা নির্মাণের সূত্রে এ ভাবেই একদিন স্তব্ধ হয় আমাদের আত্মজীবন বর্ণনার বুদ্ধিতত্ত্ব, কালতত্ত্ব ও সীমাহীন আমোদ আহ্লাদ!

অনেকদিন আগে হেড মওলানার মেয়ে, অথবা শিক্ষা-ভ্রমণ উপলক্ষ্যে দৃশ্যমান- পায়ে জোঁক সেঁটে থাকা হাওরের গরিব রাজকন্যা এবং তোমাদের নিচতলার উঁকি-ঝুঁকি জন্ম-জন্মান্তরের মরীচিকা-সখী এবার দ্রবিভূত হয়ে ... আত্মজীবন রচনায় যুক্ত আমাদের যে কোনো একজন, অথবা সবাইকে একটি কৃত্রিম অথবা বাস্তব ভাব-ভাষ্যে অন্তরীণ করে। লোকসকল ও যুবকেরা দেখে নিচতলার ভাড়াটে বাড়িতে অসুস্থতার চলাচল আন্দাজ করার জন্য প্রায় প্রায়ই পোর্টেবল এক্সরে মেশিন আসে, ল্যাবরেটরির টেকনিশিয়ান আসে এবং এই ফাঁকে মাঝে মাঝে একজোড়া নগ্ন সাদা হাতের মতো কেউ, জানালা-দরজা-পর্দা দুলিয়ে আমাদেরকে নতুন গল্পের চিহ্ন দান করে, আস্থাহীন করে, অথবা নির্বাসনে পাঠায়- আর আমাদের চেনা জগত ফলত:, হয় শূন্যতায় ডুবে যায়, অথবা নতুন কোনো এক জগত প্রতিষ্ঠা পেল করে তক্ষনি। নতুন কালের বাবা-মা অথবা অপর ভাড়াটেরা চাইছেন আমাদের এই মরীচিকা-সখীর আত্মজনেরা এই ঘরবাড়ি ত্যাগ করুক-... কারণ কে একজন তীব্র অসুস্থ মানুষ ওদের ঘরদোর থেকে মাঝে মাঝে গোঙানি ছড়ায় এবং সকাল হলেই মল-মূত্রের বাসি টাটকা প্রতিভাস আনে বাতাসে, যার অপর অর্থ, এরা একেবারেই ইকো-ফ্রেন্ডলি নয়! তুমি রাজকন্যার মুখ ভেবে লজ্জিত হলে- ভাবলে, এই উচ্ছেদ অবাস্তব, আবার বাস্তবও বটে... বাস্তবের ভ্রুণ, একখণ্ড মায়াবী উপষঙ্গ,... একখণ্ড আশ্চর্য ভ্রমণ অথবা আমাদের অনন্ত শয়ন এবং অন্তর্জাগতিক খোয়াব। ভাবলে এই দালানকোঠার অধিপতিদের রক্তচক্ষু দাপট ও শাসন-সন্ত্রাস থেকে রাজকন্যাকে রক্ষা করে তার অস্থির আঁধার নিশ্চিহ্ন করা অতীব কর্তব্য। তুমি নিজের কান চুলকালে এবং অনেকক্ষণ ধরে নেইল ক্লিপার নাড়তে থাকলে। তুমি শুনলে রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’র পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেন বিলেতের রেলভ্রমণে। তোমার জানা হলো- রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় খরচ করেন আটাশ টাকা দু’পয়সা। রবীন্দ্রচেতনা আড়াল করে এরপর রাজকন্যা বিতাড়নের সম্ভাব্য নকশা ভাবতে ভাবতে তুমি এবং তোমাদের অনেকে অনন্ত শুয়ে থাকে। কেউ বললো- আমার বিলাসিতা নির্ঘুম রাত। কেউ এবং অনেকে ভাবলে, চলো মাথার ভেতর আঁকিবুঁকি রচনা করি। অনেকগুলো রং-পেন্সিল যোগাড় হলো এবং সময় নষ্ট হলো। মাথার ভেতর ওভারব্রিজ ও রেলস্টেশন আসে। তুমি এবং আমি সবার মাঝখানে জেগে থাকি। তুমি এখন কী করবে ভেবে দেখ-। নদীতে শ্মশানের ছাইভস্ম এবং এমপি মহোদয়ের পরিত্যক্ত রজনীগন্ধা পাকশী-রায়টা ঘাট অভিমুখে। তুমি কিছু ভাবছো? কোনো আয়না নেই যে মুখ দেখবো। তোমাদের ডাকটিকিটে এত খ্যাতিমান মানুষের ছবি... আর তুমি থুথু দিয়ে দিয়ে তাবড় বিশিষ্টদের ছবি খামে লাগাও; অন্য কিছু ভাবছো তাহলে? চোখের দুর্বল পাওয়ারে বই পড়তে তোমার কষ্ট হলেও সানি লিওন দেখতে ন্যূনতম কষ্ট হয় না। তোমার এ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোতো উকুঁন বোধহয়, কেমন গা ঘষে চলেছে- মাছ তুলে, উকুঁন তুলে এবার মিথিলিন ব্লু মেশানো জলে তিন-চারদিন রাখো। সোনালি মাছের কোমলতা দেখার জন্য তোমার হাত এ্যাকুরিয়ামের লাল-হলুদ কাচ দেখছে,... নাকি তুমি আতঙ্কের অপেক্ষায় অসহিষ্ণু? তুমি স্বপ্ন দেখলে, ...সবে তো দুপুর, ড্রয়ার উথালপাতাল হলো, পাখিদের গান বন্ধ হয় এবং একই গান শুরু হয় চকিতে। দেখলে, কে একজন দরজা বানিয়ে চলেছে মাথা নিচু করে। তুমি দূর থেকে, কে একজন ঝুড়িতে পোড়া মাটির ঘোড়া সাজিয়ে বসে আছে রাস্তায়, তাই দেখলে। কেন যে মনে হলো,... আজ থেকে পৃথিবীতে নতুন কিছু হবে! মহল্লার ভাড়াবাড়ির মেয়েটি কী আমাদের ফিরিয়ে দেয়? আমাকে এবং আমাদের সবাইকে?... কিন্তু কী এক ইশারা ছিল আলো-আঁধারের মতো। হাঁটু মুড়ে থাকা মেয়েটিকে আমরা কল্পনা শক্তির প্রাবল্যে আলতো স্পর্শ করি,... সত্যিই বেঁচে আছে কিনা! তার লবণাক্ত ঠোঁট খুঁজে পায় কেউ কল্পনায়। তোমরা বৃষ্টিতে ভিজে বালির সৈকত জুড়ে পোর্ট্রেট করলে রাজকন্যার। তোমরা স্কুলের বিদ্যা অস্বীকার করে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালে অন্যমনষ্ক। তোমরা জুতো খুলে রাস্তার গভীর খাদে হাঁটলে। তোমরা আলাদা হতে চাইলে, তারপর আবার দ্বিধান্বিত হলে। তোমরা কাগজের নৌকা ভাসালে। তোমরা অনেক দূর থেকে রাজকন্যার চুলের খোঁপা এবং ক্লথ-ক্লিপে ঝুলে থাকা ব্লাউজের হুক স্পর্শ করার জন্য ভূতের হাত প্রার্থনা করলে। তোমরা চোখে চিক চিক জল আনার কৌশল শিখলে। তোমরা আড়াল হলে, প্রকাশ্য হলে এবং ভিজে পা শুকিয়ে ফেলার বক্তিগত শাস্ত্র আবিষ্কার করলে। তারপর আঁজল ভরে স্ফটিক জলে মরীচিকা রাজকন্যার শান্ত-লাল-ফ্যাকাসে পায়ের পদ্ম ভেজাতে ভেজাতে আলতার খালি শিশি হারিয়ে ফেললে। তোমরা নিজেদের ছোট বেলার সত্য-মিথ্যা নাম খুঁজলে এবং কাউকে চিহ্নিত করলে অদ্রিশ নামে- বললে অদ্রিশ-এর মাসি সুচিত্রা সেন-এর বাল্যসখী ছিলেন। কে জানে, তোমাদের হয়ত ভুল হলো। অদ্রিশ নামে তখন কেউই হয়ত বেঁচে নেই। ভাবলে এক ফাঁকে- মৃত বন্ধুর জন্য এবং নিরুদ্দিষ্ট সকল যুবকের জন্য যৌথ আমরা একটি রচনা কর্ম নির্মাণ করবো: ... হয়ত শিরোনাম হবে- মৃত্যু সম্পর্কে আরো / দূরের টেবিল / আমাদের নাটক/ আমাদের প্রীতি উপহার/ চিঠির বদলে / বিষয়টা যখন প্রতিস্তব্ধতা... ইত্যাদি! সবাই তোমরা মৃত্যুদৃশ্যে গিটার বাজাতে বাজাতে তখন এই গলিটায় গেছ জলপাই গাছ চিনতে। তুমি এবং তোমাদের মরীচিকা-রাজকন্যার হাতে জল, ওষধিগুল্ম এবং এক-দুটি ছেঁড়া বোতাম। তোমাদের ঘরের সামনে কেউ মাটিতে চশমার ভাঙ্গা ডাঁটি পুঁতেছে আর মেয়েটি এসে দরজায় দাঁড়ালো তখন... আর ওর গলায় ছায়া পড়ে জামগাছের, আর চশমার ডাঁটি ছুঁয়ে একটি পুঁইলতা ছড়িয়ে যায় দরজার ফ্রেমে। উদ্বাস্তু যুবকদের চোখে বিকিরণ হয়। যুবকেরা দেয়ালে সেঁটিয়ে পড়ে। যুবকেরা মনমরা হয়; উঁকি দেয়, নর্দমার গন্ধ সত্ত্বেও। আঁধারে পথ হাঁটে, নতুন তর্ক করে, নতুন গান বাঁধে এবং নতুন জলের দিকে হেঁটে যায়। তাদের ইচ্ছাপত্রে একটি ডার্ক চকোলেট উপস্থিত হয়ে শ্বাসরুদ্ধ করছিল। তারা এ বাড়ির দরজায় তালা লাগায় এবং তালা খুলে দেয়। তারা মরীচিকা-রাজকন্যার বাড়ির সামনে পা টিপে টিপে হাঁটে, নিচুমুখে তাকায়, মুখ ফেরায়, চোখ ধরে এবং সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ বুঝবার জন্য দিব্যদৃষ্টি প্রার্থনা করে। অবশেষে এই পরমক্ষণে দিব্যদৃষ্টির ভেতর তারা দেখতে পেল- প্রাচীন এক স্তব্ধতা ও বিষাদ জানালার ধারে লেপ মুড়ি দিয়ে শান্ত অভিমানের গান শুনিয়ে চলেছে; আর একটি পরিচ্ছন্ন ভূত অভিমানে শব্দের নোলক পরে কান্না মুখরিত। কান্নার ঘূর্ণাবর্তে অনেকদিন আগের সেই মরীচিকা রাজকন্যাকে এবার দেখা যায় একটি নৌকা বাঁধা ঘাটে, একটি অখ্যাত শহরের বিবর্ণ ঘরের চৌকাঠে, একটি মানিপ্ল্যান্ট গাছের টলমল পাতার গায়ে, আর সে হয়ত উড়ছে নিম্বাস মেঘের মতো ডানা মেলে।

এরকম মেঘে বৃষ্টি আসে। দেখলে বৃষ্টিতে আবার ঐ ভাড়াটে বাড়ির ফ্লোর বেয়ে, রাজকন্যার ভাইবোন-পিতা মাতা কারোর অসুস্থ মল-মূত্রের স্রোত যাচ্ছে সপ্তরথ সাজিয়ে। শুকনো খোলায় ভাজা চিঁড়ের স্বাদ-গন্ধ নেয়ার আগে আবারও অসুখ তদন্তের জন্য পোর্টেবল এক্সরে ঢুকছে নিচতলায়, আবারও ইলেকট্রালাইটস, ... বেড-সোর এবং চামড়ার ক্ষতে মিছেমিছি নেবানল পাউডার। মায়ের তীব্র গভীর ক্ষতের ভেতর মরীচিকা রাজকন্যা অথবা অপর কেয়ার গিভারদের অধৈর্য নিঃশ্বাস পড়ে। মেয়েরা হাঁটু মুড়ে, ধরা যাক, মায়ের বিকশিত বেডসোর থেকে জাগ্রত আসন্ন মৃত্যুকালের দৃশ্যকল্প ভেবে বিষাদাছন্ন হয়, অথবা মায়ের সম্ভাব্য স্বাধীন উজ্জ্বলতম স্বর্গবাসের আকাক্সক্ষায় ক্ষীণ সুখ নির্মাণ করে। অথবা মায়ের চোখেমুখে বিপদ জ্ঞাপক কিছু চিহ্ন নির্মাণ করে মেয়েরা উদ্বায়ী হয়, খণ্ডিত হয়, জীবন্ত হয়, অথবা অজান্তেই হয় শান্ত, মারমুখি, কিম্বা কেবলই বিশ্লেষণরত, শ্রবণরত ও ক্রন্দনরত। মেয়েরা এবং আমরা পোর্টেবল এক্সরের লাগাতার খরচ ভাবতে-ভাবতে মুমূর্ষু ঘড়বাড়ি-সিঁড়ির আলোছায়া দেখি, শব্দহীন হই, নির্জনতম হই এবং বিস্তীর্ণ চাঁদের নুড়ি-পাথরে মানুষের মুখ খুঁজতে যেয়ে কাগজে লিখি অথবা নিছক মুগ্ধতা জ্ঞাপন- আমি সেই সুন্দরীকে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এপারে- বিয়োবার দেরি নাই, রূপ ঝরে পড়ে তার...; যুবকেরা অতি ধীরে পদধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার ছবি আঁকে এবং দলছুট এন্ট্রির জন্ম-সম্ভাবনায় নিদ্রাহীন হয় : ...যুবকেরা হেসে খুন হয় এবং কী এক পিপাসায় কাগজ-পুতুল-আয়না ছুঁয়ে, বাবা-মায়ের দৈনিকের হিসাব পড়ে গোপনে- ... ঘর-বার করে শেষ সন্ধ্যায় ও ফিরে এলো। দুপুরে খেল। রাস্তায় মাইক। শনিবার নিমন্ত্রণ। সন্ধেবেলায় চীনা রেস্তরাঁর খাবার; কাজের মেয়ে আনলো। শীত কম, তবু হিটার জ্বালালাম। রাতের কাজের মেয়েটি এলো। গাড়িতে ফিরলাম। টেবিল ল্যাম্প এ্যাডজাস্ট করা। কালকে ওদের কলেজ পরিদর্শন। দুপুরে স্নান, দাড়ি সেভ এবং প্রেশার চেক (...ও কে)। পিএইচডি এনরোলমেন্ট-এর ভাইভা, ¯ন্যাকস্, সন্দেশ ও চীনা স্যুপ। মতির মা কাল আসবে না। [লোসার্টান + এ্যালজোলাম + ইনহেলার + রোসুভা = ৬০৯/- (২৩/- ছাড়)।] সেই একই গাড়িতে আবার। অরণ্য খাবে না, বন্ধুর সঙ্গে বাইরে খেয়ে এসেছে,... আমি খাটে, ওরা মেঝেতে। দর্জি কাপড় নিয়ে গেল অল্টার করার জন্য। চাদর বদল হলো। ...কে যেন ওর জামা কাপড় চুরি করেছে। সন্দেহ করছি.....?? ঘড়ি এ্যাডজাস্ট হলো, লাঠির পায়ে রাবার বসালাম। কলে পানি নেই। ট্যাংক সাফ হচ্ছে। অনেক উপহার-... মিষ্টির হাঁড়ি সমেত। তিনটি পাজামা + কাপড় + বানানোর খরচ...? সন্ধ্যাবেলায় নিচে বসলাম। অনেক খাবার এবং গল্পসল্প। সিটবেল্ট না পরার জন্য জরিমানা- কাল কোর্টে যাবে। মায়ের সঙ্গে আলোচনা। বিয়ের নেমন্তন্ন। কাবাতুল্লাহর ওপর অবিচুয়ারি। ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স। ফোনে কথাবার্তা। গরম জলের গিজার মিস্ত্রি বাবদ ২০০/-। পুরনো বাংলা সিনেমা দেখলাম। দুপুরে স্নান, শ্যাম্পু এবং নতুন আলু-ট্যাংরা। নতুন মোবাইল পেলাম। বই দিলাম মমতাজকে। নিউ ফুড হাট থেকে- ভেজিটেবল পরোটা এবং চিকেন সসেজ। একটু হেঁটে এলাম। বিস্কুট কিনলাম। নখ কাটলাম।... নো স্নান; ইলিশ ভাত। মিস্ত্রি বাথরুমের পাইপ সাফ করলো। বজ্র বিদ্যুৎ। প্রচণ্ড মেঘ, অল্প বিষ্টি। লোডসেডিং, দুপুর থেকে লোডশেডিং। বারান্দায় বসলাম কিছুক্ষণ। শরীরটা এলোমেলো লাগছে। স্নান। নতুন পাসপোর্ট। উল্টা দিকের বাড়িতে ছাদের ওপর ঘর তৈরি হচ্ছে। মাইকের অত্যাচার। ফেরার পথে দুটো চিকেন কাটলেট।... [ এবার থেকে বড় বড় অক্ষরে লিখবো।] বিকেলে ঘুম এল। পাজামায় দাগ, ... ওয়াশ করতে হবে। সকালে পায়ের নখ কাটা, রাতে পড়াশোনা ও ভাত-মাছ। দুপুরে সুনীলের মৃত্যু-সংবাদ। ডাক্তার এল; প্রেসার = ও. কে। প্যাকেট লাঞ্চ...। তথ্য চিত্র দেখলাম সিদ্ধেশ^রীকে নিয়ে। অনেক গরম জামা কাপড় ধুইয়ে আনলো। রাবার ব্যান্ড = ২০/-। হিটার জ্বালিয়ে লেখাপত্র- হিসাব নিকেশ। বক্তৃতা + গল্প-সল্প + প্রেসার চেক + মাছ-ভাত + নোস্নান...। ওর সঙ্গে বকবক। কফি।... নতুন ক্যালেন্ডার লাগালো। মিষ্টি রোদ। বেশ শীত। আর ঘুম ঘুম ...। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৮ মাঘ ১৪২৭, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪২

গৃহ বদলের মানুষ জীবন

মামুন হুসাইন

image

শিল্পী : সমর মজুমদার

তুমি অথবা তোমাদের ভাড়াটে এ রকম ভাবছিলে কোনদিন- হয়ত খাঁচা ভর্তি স্মৃতি, জোনাকির মতো বুদ্বুদ আশা অথবা মৃত্যুর শান্ত-নীরবতা : ফিরে ফিরে দেখলে, বন্ধ হয়ে যাওয়া পোস্ট মাস্টারের নীল চোখ, পারসেল ওজন হচ্ছে; তোমার আঙুল অনুভব করল, পারসেলের নট তোমার অচীন দূর গাঁ-ঘরের এক সুকন্যা ধীরে ধীরে খুলছে- আর আপাত নিষিদ্ধ-ভীরু পারসেল তখন মৃদু জলস্রোতে বিবিধ গল্প ভাসায় তোমার জন্য : সকল কালেই তুমি দেখবে মৃত্যু কেবল হয় মৃত লোকটির, মৃতদেহ এমনকি খুনীর কাছেও পৌঁছয় না, মৃতদেহ মৃত-মানুষটির একক সম্পত্তি... ... শুধু বেদনা প্রকাশের কালে মৃতব্যক্তিকে নিয়ে রচিত ইচ্ছা-রাজ্যের ঐশী শক্তি জলে নেমে যায়, ভূমিকম্প হয়, স্বৈরাচার হয়, ও প্রজাপতির ঈশারা নির্মাণ করে। স্মরণ করো- হয়ত এর সামান্য দিনক্ষণ পরে, হেড মওলানার মেয়ে, পায়ে জোঁক সেঁটে থাকা হাওরের গরিব রাজকন্যা এবং তোমাদের নিচতলার উঁকিঝুঁকি জন্ম-জন্মান্তরের মরীচিকা সখী একত্রে চাঁদের একক বন্ধু হয়ে আমাদের জঙ্গল স্নান সমাপ্ত করায়, অর্ধস্ফুট ভিখারী করে এবং সম্পর্ক তৈরির নতুন এক শৈলী বিজ্ঞান শেখায়- সামান্য কয়েক মাস আমরা পরস্পরকে ভালোবাসার ব্রহ্ম- দান করি, ...তারপর, আকাশে তারা ওঠেনি, ঘরের টিয়া উত্তেজিত হয়নি, ইঁদুরের মরণ স্রোত তৈরি হয়নি- ষড়রিপুর এমন এক রহস্যকালে সে ফিরে যায় চিরকালের মতো। ভাড়াবাড়ির সেই কন্যা আর দেখা দেয় না- ... তোমরা দরজা ধাক্কা দিতে দিতে শাপ শাপান্ত করলে, ওর চোখ ধূসর হয়ে যাক, ওর সৌন্দর্য নিঃশেষ হোক; আর আমি প্রার্থনা করলাম ও আগের সকল সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বেঁচে থাকুক আমাদের যৌথ স্মৃতিতে, ধ্যানে, আঁতুড় ঘরে এবং জন্মান্ধ পিঁপড়ের সমবেত কান্নায়।

‘পিঁপড়া-পিঁপড়া কয়টা ডিম...’ এই গুঞ্জনে তুমি, আমি এবং সে জলের গভীরে নেমে যাই। মাঝে মাঝে একটা ঝাপসা গাছ আসে। একটা স্কুল আসে, একটা হোস্টেল এবং দীর্ঘ নারকেল বাগান। আমাদের সম্মিলিত প্রতিজ্ঞায় হোস্টেলের নারকেল চুরি হতে হতে ব্যক্তিগত ট্রাংক এবং সুটকেসে আশ্রয় পায়। আমরা আঁধার রাস্তায় ইঁট বিছিয়ে রাখি, যেন রিক্সাবালক গোত্তা খায় এবং অশ্লীল খিস্তি উপহার দিতে পারে। আমরা প্রতিরাতে স্কুল কম্পাউন্ডের দেয়াল ভেঙ্গে চূর্ণ করি। আমাদের জাগরণ হয় এবং কলেজ ইউনিয়নের ঈষৎ ক্ষমতাবান বইয়ে নাম লেখাই। আমরা বড় দাদাদের নির্দেশে চাঁদা তুলি, ত্রাণ সংগ্রহ করি, গণসঙ্গীত গাই। মেডিকেল ক্যাম্প করি, পত্রিকা বানাই, বর্ষা মঙ্গল করি, পয়লা বৈশাখ করি এবং খাসজমি দখলের স্বপ্নে রাত কাটাই নাচোল-আদিবাসীর শীতার্ত আঁধার বারান্দায়। ক্লাস ফাইনাল শেষে বাস কন্ডাকটরকে বশীভূত করে আমরা বিনে পয়সায় লম্বা রাস্তা পেরিয়ে সমুদ্র দেখতে যাই- একবার অমাবশ্যায়, একবার ভরা পূর্ণিমায়। জলের ভেতর ভেসে-ভেসে আমরা কিঞ্চিৎ নিষিদ্ধ জল খেয়ে অনন্ত আকাশের দিকে যেতে যেতে রাজাধিরাজ হয়ে যাই,... আর শুয়ে থাকি বালিয়াড়িতে, আর কি তীব্র ক্ষুধা...; ঝাউবন, আকাশ এবং নক্ষত্ররাজি, আমাদের বিশ্রুত করে, অপার্থিব করে আর রোমাঞ্চ ছড়ায়, আর ভাবায়... ডিক্লাসড্ হচ্ছি... না, না ডিক্লাস্ড নয়,... পলায়নের চিক চিক আনন্দ, ও ঘোলাটে জোৎন্সা পান করতে করতে পুনরায় গৃহ প্রত্যাবর্তন। অথবা পড়া তৈরির সেই ঝিম-ঝিম বাতি- ... আমাদের বাতিঘর বটে!... যে বাতি-ই জ্বালাই না কেন, কাছের জায়গা আলোকিত হলেও দূরের দিগন্ত অনন্তকালের রাতের গভীরতা দিয়ে পরিবেষ্টিত। আমরা আনন্দের ভুল ও বিভ্রমে সত্য দেখার স্তর খুঁজি, আর শিখি- মানবজীবনের দুই জমজ ভাইবোন হচ্ছে আকাক্সক্ষা ও ক্লান্তি। ...হয়ত পরাজিত হই, শপথ ভঙ্গ করি, পরজীবী হই এবং আবারও দুপুরের ভাত-ঘুম সমাধা করে সন্ধ্যায় অনেক দেরিতে আমাদের অতিপ্রাকৃত-অধিবিদ্যাকে সেই হারিকেন-জোছনায় খুঁজতে বসি; কালিমাখা হারিকেন, তোমাদের স্বাধীন-ইচ্ছার জোরে আর প্রপিতামহদের প্রযতে্ন, একদা মুসলিম লীগের প্রাচীন হ্যারিকেন মার্কা ভোটের কাগজ হয়ে গাছপালার ঝগড়া শোনে। তোমরা গাছেদের চুল স্পর্শ করলে। ভাঙ্গা-অস্পষ্ট রামধনুর ভেতর, মাথা ভর্তি অন্ধকারের ভেতর তোমাদের স্বপ্ন দ্বিধা ও সন্তান-সন্ততি উৎপাদন হয়। তোমরা আদিগন্ত মাতৃগর্ভ থেকে নেমে আসা উড়ন্ত সখা-সখী, পরস্পরের পাঁজর গুচ্ছ, আজঁল ভর্তি স্বপ্ন, মাকড়সার জাল, মাছরাঙ্গার ওড়াউড়ি, গৃহস্থের ভিটেমাটি এবং বৃষ্টিভেজা ভিক্ষার চাল। তোমাদের রান্নাঘর হয় এবং বৃষ্টিভেজা ভিক্ষার চাল থেকে সুগন্ধ খাদ্য নির্মাণ হয়। খাদ্য থেকে নির্মাণ হয় কৃষিকাজ (...মন তুমি কৃষিকাজ জানো না...) খাদ্য থেকে তারপর ইস্টিশন, ভাষাতত্ত্ব, মলমূত্র, টিয়াপাখি, নিমগাছ, পূর্বরাগ, অন্ন-ঘাম, একবাক্স রাশিচক্র এবং জন্মান্তরের খড়কুটো-স্বপ্নগাছ নির্মাণের মিছিল। তোমরা দেখলে কাদার ভেতর একটি না লেখা কাব্যগ্রন্থ। বৃষ্টিভেজা ভিক্ষার চাল তোমাদেরকে বিপজ্জনক বৃষ্টিতে ডুবিয়ে ইন্দ্রিয়ময় করে। তুমি সেই প্রথম হিজল গাছ চিনলে। তুমি সূর্যাস্ত, জোৎস্না ও মৃত পিঁপড়ে রান্না করার কৌশল শিখলে। সারারাত-সারাঘর কে যেন হেঁটে বেড়ালো। তুমি দিনলিপি রচনা করার কৌশল শিখলে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে আর তোমরা ডুবজলে ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক হতে হতে আবিষ্কার করলে, তোমাদের মাঝখানে কে একজন মহল্লার ভাড়াবাড়ির রাজকন্যা হয়ে গোলাপ সুন্দরী হয়ে এইমাত্র ইস্টিশান ত্যাগ করলো। তোমাদের কর্দমাক্ত আশাবাদ বধির হয় এক-দুবেলা, বোকা স্বপ্নগাছ হয়, গেরুয়া রমণী হয়, গর্ভবতী হয় এবং রচনা করে এক বিস্ময়-বিরহ পরিবৃত অবিনশ্বর আত্মজীবনী।

হেড মওলানার মেয়ে, পায়ে জোঁক সেঁটে থাকা হাওরের গরিব রাজকন্যা এবং তোমাদের নিচতলার উঁকি-ঝুকি জন্ম-জন্মান্তররের মরীচিকা সখী­- থ্রী ইন ওয়ান হয়ে আমাদের এই যৌথ আত্মজীবন বর্ণনায় অন্য এক অন্তর্লীন-অতলান্ত-পদচিহ্নের অভিমুখ তৈরি করে। ঝুলন্ত চাঁদের পাশে একদা রাজকন্যার এলোচুলের গভীর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে তোমাদের নাভিমূলের অবিমিশ্র স্বপ্ন অনুবাদের ফাঁকে মূক ও বধির ইন্দ্রীয়সমূহে ক্রমশ সন্ধ্যা জলের ঘ্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। জলের ভেতর, স্বপ্নের ভেতর, পবিত্র পাপের ভেতর তুমি দেখলে পেছনের জানালা খোলা- একটি বালিকার স্তব্ধ মৃতদেহ, একটি মুমূর্ষু মথ মৃতদেহের খোলা বুকে মুখ ডুবিয়ে আর পরিত্যক্ত হরিতকি গাছ। আমরা লিখলাম- আমাদের জীবন ছোট এবং আমাদের মায়েদের কোমরজুড়ে অনন্তকালের ব্যথা। লেখা হলো- তুমি আমার কেউ না, তবুও তোমার কাছে অন্ন-নুনের লোভে বারবার আসি। লেখা হলো- মা ও বাবা যেমন করে দরমার দেয়াল থেকে উঁইপোকা হত্যা করতো, আমাদের প্রতিপালনের কালে, সেই হত্যাযজ্ঞের কথা। আমাদের একটি নকল গরু ছিল, মা-মরা বাছুরকে বাল্যশিক্ষা দেওয়ার জন্য। ধরা যাক একটি ভাঙা বাড়ির মালিক হওয়ার আগে মা, তুমি, আমরা সবাই বাধ্যতামূলক গৃহচ্যুত হই। ভাদুড়ি বাড়ির রমা মাসী, যে ছিল মায়ের অনন্ত সখী, দেশান্তরের আগে ওঁর পিসিমার গল্প শুনিয়েছিল: ... বাল্যবিধবা পিসিমাকে মাছ খাওয়ানোর আশ্চর্য-সৃজনশীল আয়োজন- ... পিসিমা মাছ ভালবাসতেন, উপায় কী? তরকারী-সবজিতে মাছের ভাস্কর্য তৈরি করে, ভেতরে ভেতরে নির্দোষ বৃক্ষলতার অপরূপ সরু ডাল পুঁতে দেয়া হতো কাঁটার বিভ্রম আনার জন্য। পিসিমা এই সরল মিথ্যা চোখ ছল-ছল করে আজীবন গলাধঃকরন করে গেছেন। পিসিমা মাছ-ভাতে ক্রমে ক্রমে বাঙালি হন, আর সেই নামহীন-গোত্রহীন মাছের ভাস্কর্য দেখতে দেখতে আত্মজীবন বর্ণনার অন্য অধ্যায়ে আমরা মায়ের মতো কাউকে খুঁজি- একটি সাবান আসে বর্ণনায়, সাবান অর্থ সাবানের ঘ্রাণ, এই সাবানের ঘ্রাণ, মায়ের ঘ্রাণ হয়ে, মায়ের হাত হয়ে আমার মুখম-ল সিঞ্চন করে। একজন দিদিমা আসেন,... হয়ত মায়ের দিদিমা- পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখেছিলেন ১৯৯৫-এর ২৪ অক্টোবর, এক্সরে প্লেট গোল করে, দিদিমা ক্ষয়িষ্ণু চোখের ভেতর সূর্যগ্রহণ নির্মাণ করেন... দেখলাম, পয়লা চাঁদ সামান্য খামচে ধরেছে, তারপর সূর্য হয়ে উঠেছে চাঁদের মত সরু, মাটির ওপর আঁকাবাঁকা ছায়া, দিনের আলো ক্ষীণ হচ্ছে, হঠাৎ-ই ঠাণ্ডা বাতাস, পশুপাখি শান্ত-সুনসান, তাপমাত্রা কমে গেল, যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সূর্য হারিয়ে গেছে পূর্ণ, দু’টো তারা আকাশে, ... এবার দক্ষিণ পশ্চিম থেকে আলোর ছটা, হিরের আংটির মতো, ... সূর্য দেখা দিচ্ছে আবার... এইবার পুরো সূর্য এলো... সূর্যগ্রহণের কালে কল্যাণ চিন্তা করে আমরা উপহার বদল করি, নদীতে স্নান করি,...; আর বিরত হই খাদ্য গ্রহণ থেকে; আমরা দূরের ভ্রমণসূচি ও স্থগিত করি এবং শৌচাগার এড়িয়ে যাই...! সূর্যগ্রহণ চাক্ষুষকারী দিদিমা, হয়ত মায়ের দিদিমা, তারপর কীভাবে গৃহসন্ন্যাসী হন, নির্জন ডাকবাক্স হন, ছেঁড়া মাদুরের কিশোরী হন, স্তব্ধ মৃতদেহ হন,... আমরা আমাদের লিখনকর্মে তা চুপিসারে কর্তন করি। হয়ত চোখ জুড়ে সুদূর প্রহেলিকা; স্বপ্ন ও কান্নার ভেতর আমাদের অনিশ্চয়-অনুগত প্রেমপত্র ভেসে যায় সারারাত গাছে ঝুলে থাকা প্রেমিকাদের পত পত শরীর বরাবর, আর আমাদের ভেতর উৎপাদিত হয় এক নিঝুম ব্যর্থ সন্ধ্যাকাল। তখন মায়ের ঘ্রাণ আসে, অথবা সাবান থেকে চুরি হয়ে যাওয়া মায়ের স্পর্শ গলা-বুক লেপ্টে থাকে। মায়ের হাতে সন্ধ্যা-বিকেল শুধুই ক্রুশ কাঁটা, রুমাল ও সোয়েটারের অলৌকিক রংধনু। নতুন মহল্লার অপর কে এক ভাড়াটে মায়ের সই হয় এবং তারা রান্না বদল করে। নিয়মমাফিক মায়েদের দুই-তিন-এর অধিক সন্তানাদি হয়। মায়েরা কাথা জুড়ে নৌকা, মাছ ও ঘরবাড়ির ছবি আঁকে; মা বটি হাতে সারারাত গোপনে পাহারা করে যেন তিন আত্মজার কাছে শকুন-শেয়াল সহসা পৌঁছতে না পারে। গৃহ ত্যাগের সময় মায়ের পুঁটলিতে গোপনে বহনকৃত ভিটে মাটির শুকনো আমের আঁটি। মা নতুন গ্রামদেশের মাটিতে গির্জা দেখে, কয়লার ইঞ্জিন দেখে, জগন্নাথ মন্দির দেখে এবং নদীর জল স্পর্শ করে। মা এক আঁজলা জল মুখে ছড়ায় এবং পুণ্যের আশায় প্রিয় যুবকের চুলে ছড়িয়ে দেয়। অনেকদিন পর তার ব্যক্তিগত রান্নার খাতা হয়। তার সাধের আমগাছে অঙ্কুর হয় এবং সে সন্তান সম্ভবা হয়। তার একটা রেডিও হয়- রেডিওর ভেতর ‘গর্ভবতী মায়েদের যত্ন’ উৎপন্ন হয়; মা পোস্টকার্ড লেখেন রেডিওর ঠিকানায়- যখন শুনলো হাঁসের ডিম বেশি উপকারী, তখন সে চারটি হাঁস কিনে ফেলে। হাঁসের সম্মেলক আওয়াজে মাঝে মাঝে রেডিও-নিসৃত একটি দুটি দেশাত্মবোধক গান মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে অথবা অতিরিক্ত এক স্তব্ধতা আসে ঘর বাড়িতে- মা ভাবেন, নিখোঁজ ভিটেমাটির আমগাছ বড় হলে আমি এতে দোল খাব। মা দোল খেতে খেতে অতীন্দ্রিয় সব গানে আহ্লাদ ছড়ায়। মা বড় হয়, বৃদ্ধ হয়, আর শেফালি ফুলের ঘ্রাণ নির্মাণ করে উঠোনজুড়ে। মায়ের উঠোন-বারান্দা জুড়ে তখন বিস্তৃত রান্নার ক্লাস- ডালের বড়ি, মাছ ভাজা, পুঁটিমাছের ঝোল, কাঁঠালের বিচি, কাঁচা আমের চাটনি আর কাসোন্দ। আর দেখো স্কুল মাঠের শেষ বিকেলে সেই রাষ্ট্রীয় তথ্য-অফিসের বায়োস্কোপওয়ালা,- একটা প্রজেক্টর, একটা সাদা পর্দা, একটা গর্ত খোঁড়ার শাবল, আর সিনেমার গুচ্ছ ক্যান। সিনেমার সাদা কালো পর্দার ভেতর মানব-মানবী দেখতে দেখতে মা একটু-একটু বদলায়। ছেলেমেয়েরাও বদলায়, আর ঘর-উঠোনে ক্ষণে-ক্ষণে দূর-নিকটের সম্পর্ক ছড়ায়। মায়ের বড় ছেলে গোপন দলের সদস্য হওয়ায় সাদা পুলিশের দৌরাত্ম্যে ছাদে-ছাদে করে পালায় এবং তাৎক্ষণিক পরামর্শে সকল পুস্তক ও লিফলেট বিসর্জিত হয় কুয়োর জলে। একদিন অনেক পরে পাড়া জুড়ে আচমকা সেলফোন-আসক্তি তথা তীব্র গার্হস্থ্য-জীবন শুরু হওয়ায় মায়ের তৈরি পাড়ার লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। মা টেলিভিশনের একখ- বাক্য ফিস ফিস বলে... মেরে প্যায়ারে ভাইয়ো অর বহিনো...; মায়ের একমাত্র হিন্দি-শব্দভাণ্ডার! আর সেই সন্ধ্যায় সন্ন্যাস-রোগে মা বাক্যরহিত হয়; মায়ের স্নান ও বাথরুমের দায়িত্ব আমাদের অনুজ কেউ পবিত্র জ্ঞানে অব্যাহত রাখে। মাস কয়েক পর মা আমাদের কাঁধে শেষ যাত্রার আগে, মায়ের যে আঁচল জুড়ে জোনাকি নামতো, সেই আঁচল দিয়ে শেষবারের মতো আমার কপালের ঘাম স্পর্শ করি, মায়ের দেখানো চাঁদস্পর্শ করি, ভুতগ্রস্ত হই, প্রাচীন ভিটেমাটির রোপণকৃত গাছ থেকে স্বপ্ন জমা করি বাটিতে, আর দূরে কাকতাড়ুয়া দেখতে-দেখতে বাবাকে সামনে আনি- বাবা মায়ের শান্ত-স্থির মৃত-হিম কপাল স্পর্শ করতে করতে, মায়ের সৌন্দর্য বর্ণনার ফাঁকে চুপিসারে চোখ মোছেন হাতের চেটোয়। আমাদের ভাবনায়- মায়ের মৃত্যু দশা নির্মাণের সূত্রে এ ভাবেই একদিন স্তব্ধ হয় আমাদের আত্মজীবন বর্ণনার বুদ্ধিতত্ত্ব, কালতত্ত্ব ও সীমাহীন আমোদ আহ্লাদ!

অনেকদিন আগে হেড মওলানার মেয়ে, অথবা শিক্ষা-ভ্রমণ উপলক্ষ্যে দৃশ্যমান- পায়ে জোঁক সেঁটে থাকা হাওরের গরিব রাজকন্যা এবং তোমাদের নিচতলার উঁকি-ঝুঁকি জন্ম-জন্মান্তরের মরীচিকা-সখী এবার দ্রবিভূত হয়ে ... আত্মজীবন রচনায় যুক্ত আমাদের যে কোনো একজন, অথবা সবাইকে একটি কৃত্রিম অথবা বাস্তব ভাব-ভাষ্যে অন্তরীণ করে। লোকসকল ও যুবকেরা দেখে নিচতলার ভাড়াটে বাড়িতে অসুস্থতার চলাচল আন্দাজ করার জন্য প্রায় প্রায়ই পোর্টেবল এক্সরে মেশিন আসে, ল্যাবরেটরির টেকনিশিয়ান আসে এবং এই ফাঁকে মাঝে মাঝে একজোড়া নগ্ন সাদা হাতের মতো কেউ, জানালা-দরজা-পর্দা দুলিয়ে আমাদেরকে নতুন গল্পের চিহ্ন দান করে, আস্থাহীন করে, অথবা নির্বাসনে পাঠায়- আর আমাদের চেনা জগত ফলত:, হয় শূন্যতায় ডুবে যায়, অথবা নতুন কোনো এক জগত প্রতিষ্ঠা পেল করে তক্ষনি। নতুন কালের বাবা-মা অথবা অপর ভাড়াটেরা চাইছেন আমাদের এই মরীচিকা-সখীর আত্মজনেরা এই ঘরবাড়ি ত্যাগ করুক-... কারণ কে একজন তীব্র অসুস্থ মানুষ ওদের ঘরদোর থেকে মাঝে মাঝে গোঙানি ছড়ায় এবং সকাল হলেই মল-মূত্রের বাসি টাটকা প্রতিভাস আনে বাতাসে, যার অপর অর্থ, এরা একেবারেই ইকো-ফ্রেন্ডলি নয়! তুমি রাজকন্যার মুখ ভেবে লজ্জিত হলে- ভাবলে, এই উচ্ছেদ অবাস্তব, আবার বাস্তবও বটে... বাস্তবের ভ্রুণ, একখণ্ড মায়াবী উপষঙ্গ,... একখণ্ড আশ্চর্য ভ্রমণ অথবা আমাদের অনন্ত শয়ন এবং অন্তর্জাগতিক খোয়াব। ভাবলে এই দালানকোঠার অধিপতিদের রক্তচক্ষু দাপট ও শাসন-সন্ত্রাস থেকে রাজকন্যাকে রক্ষা করে তার অস্থির আঁধার নিশ্চিহ্ন করা অতীব কর্তব্য। তুমি নিজের কান চুলকালে এবং অনেকক্ষণ ধরে নেইল ক্লিপার নাড়তে থাকলে। তুমি শুনলে রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’র পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেন বিলেতের রেলভ্রমণে। তোমার জানা হলো- রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় খরচ করেন আটাশ টাকা দু’পয়সা। রবীন্দ্রচেতনা আড়াল করে এরপর রাজকন্যা বিতাড়নের সম্ভাব্য নকশা ভাবতে ভাবতে তুমি এবং তোমাদের অনেকে অনন্ত শুয়ে থাকে। কেউ বললো- আমার বিলাসিতা নির্ঘুম রাত। কেউ এবং অনেকে ভাবলে, চলো মাথার ভেতর আঁকিবুঁকি রচনা করি। অনেকগুলো রং-পেন্সিল যোগাড় হলো এবং সময় নষ্ট হলো। মাথার ভেতর ওভারব্রিজ ও রেলস্টেশন আসে। তুমি এবং আমি সবার মাঝখানে জেগে থাকি। তুমি এখন কী করবে ভেবে দেখ-। নদীতে শ্মশানের ছাইভস্ম এবং এমপি মহোদয়ের পরিত্যক্ত রজনীগন্ধা পাকশী-রায়টা ঘাট অভিমুখে। তুমি কিছু ভাবছো? কোনো আয়না নেই যে মুখ দেখবো। তোমাদের ডাকটিকিটে এত খ্যাতিমান মানুষের ছবি... আর তুমি থুথু দিয়ে দিয়ে তাবড় বিশিষ্টদের ছবি খামে লাগাও; অন্য কিছু ভাবছো তাহলে? চোখের দুর্বল পাওয়ারে বই পড়তে তোমার কষ্ট হলেও সানি লিওন দেখতে ন্যূনতম কষ্ট হয় না। তোমার এ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোতো উকুঁন বোধহয়, কেমন গা ঘষে চলেছে- মাছ তুলে, উকুঁন তুলে এবার মিথিলিন ব্লু মেশানো জলে তিন-চারদিন রাখো। সোনালি মাছের কোমলতা দেখার জন্য তোমার হাত এ্যাকুরিয়ামের লাল-হলুদ কাচ দেখছে,... নাকি তুমি আতঙ্কের অপেক্ষায় অসহিষ্ণু? তুমি স্বপ্ন দেখলে, ...সবে তো দুপুর, ড্রয়ার উথালপাতাল হলো, পাখিদের গান বন্ধ হয় এবং একই গান শুরু হয় চকিতে। দেখলে, কে একজন দরজা বানিয়ে চলেছে মাথা নিচু করে। তুমি দূর থেকে, কে একজন ঝুড়িতে পোড়া মাটির ঘোড়া সাজিয়ে বসে আছে রাস্তায়, তাই দেখলে। কেন যে মনে হলো,... আজ থেকে পৃথিবীতে নতুন কিছু হবে! মহল্লার ভাড়াবাড়ির মেয়েটি কী আমাদের ফিরিয়ে দেয়? আমাকে এবং আমাদের সবাইকে?... কিন্তু কী এক ইশারা ছিল আলো-আঁধারের মতো। হাঁটু মুড়ে থাকা মেয়েটিকে আমরা কল্পনা শক্তির প্রাবল্যে আলতো স্পর্শ করি,... সত্যিই বেঁচে আছে কিনা! তার লবণাক্ত ঠোঁট খুঁজে পায় কেউ কল্পনায়। তোমরা বৃষ্টিতে ভিজে বালির সৈকত জুড়ে পোর্ট্রেট করলে রাজকন্যার। তোমরা স্কুলের বিদ্যা অস্বীকার করে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালে অন্যমনষ্ক। তোমরা জুতো খুলে রাস্তার গভীর খাদে হাঁটলে। তোমরা আলাদা হতে চাইলে, তারপর আবার দ্বিধান্বিত হলে। তোমরা কাগজের নৌকা ভাসালে। তোমরা অনেক দূর থেকে রাজকন্যার চুলের খোঁপা এবং ক্লথ-ক্লিপে ঝুলে থাকা ব্লাউজের হুক স্পর্শ করার জন্য ভূতের হাত প্রার্থনা করলে। তোমরা চোখে চিক চিক জল আনার কৌশল শিখলে। তোমরা আড়াল হলে, প্রকাশ্য হলে এবং ভিজে পা শুকিয়ে ফেলার বক্তিগত শাস্ত্র আবিষ্কার করলে। তারপর আঁজল ভরে স্ফটিক জলে মরীচিকা রাজকন্যার শান্ত-লাল-ফ্যাকাসে পায়ের পদ্ম ভেজাতে ভেজাতে আলতার খালি শিশি হারিয়ে ফেললে। তোমরা নিজেদের ছোট বেলার সত্য-মিথ্যা নাম খুঁজলে এবং কাউকে চিহ্নিত করলে অদ্রিশ নামে- বললে অদ্রিশ-এর মাসি সুচিত্রা সেন-এর বাল্যসখী ছিলেন। কে জানে, তোমাদের হয়ত ভুল হলো। অদ্রিশ নামে তখন কেউই হয়ত বেঁচে নেই। ভাবলে এক ফাঁকে- মৃত বন্ধুর জন্য এবং নিরুদ্দিষ্ট সকল যুবকের জন্য যৌথ আমরা একটি রচনা কর্ম নির্মাণ করবো: ... হয়ত শিরোনাম হবে- মৃত্যু সম্পর্কে আরো / দূরের টেবিল / আমাদের নাটক/ আমাদের প্রীতি উপহার/ চিঠির বদলে / বিষয়টা যখন প্রতিস্তব্ধতা... ইত্যাদি! সবাই তোমরা মৃত্যুদৃশ্যে গিটার বাজাতে বাজাতে তখন এই গলিটায় গেছ জলপাই গাছ চিনতে। তুমি এবং তোমাদের মরীচিকা-রাজকন্যার হাতে জল, ওষধিগুল্ম এবং এক-দুটি ছেঁড়া বোতাম। তোমাদের ঘরের সামনে কেউ মাটিতে চশমার ভাঙ্গা ডাঁটি পুঁতেছে আর মেয়েটি এসে দরজায় দাঁড়ালো তখন... আর ওর গলায় ছায়া পড়ে জামগাছের, আর চশমার ডাঁটি ছুঁয়ে একটি পুঁইলতা ছড়িয়ে যায় দরজার ফ্রেমে। উদ্বাস্তু যুবকদের চোখে বিকিরণ হয়। যুবকেরা দেয়ালে সেঁটিয়ে পড়ে। যুবকেরা মনমরা হয়; উঁকি দেয়, নর্দমার গন্ধ সত্ত্বেও। আঁধারে পথ হাঁটে, নতুন তর্ক করে, নতুন গান বাঁধে এবং নতুন জলের দিকে হেঁটে যায়। তাদের ইচ্ছাপত্রে একটি ডার্ক চকোলেট উপস্থিত হয়ে শ্বাসরুদ্ধ করছিল। তারা এ বাড়ির দরজায় তালা লাগায় এবং তালা খুলে দেয়। তারা মরীচিকা-রাজকন্যার বাড়ির সামনে পা টিপে টিপে হাঁটে, নিচুমুখে তাকায়, মুখ ফেরায়, চোখ ধরে এবং সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ বুঝবার জন্য দিব্যদৃষ্টি প্রার্থনা করে। অবশেষে এই পরমক্ষণে দিব্যদৃষ্টির ভেতর তারা দেখতে পেল- প্রাচীন এক স্তব্ধতা ও বিষাদ জানালার ধারে লেপ মুড়ি দিয়ে শান্ত অভিমানের গান শুনিয়ে চলেছে; আর একটি পরিচ্ছন্ন ভূত অভিমানে শব্দের নোলক পরে কান্না মুখরিত। কান্নার ঘূর্ণাবর্তে অনেকদিন আগের সেই মরীচিকা রাজকন্যাকে এবার দেখা যায় একটি নৌকা বাঁধা ঘাটে, একটি অখ্যাত শহরের বিবর্ণ ঘরের চৌকাঠে, একটি মানিপ্ল্যান্ট গাছের টলমল পাতার গায়ে, আর সে হয়ত উড়ছে নিম্বাস মেঘের মতো ডানা মেলে।

এরকম মেঘে বৃষ্টি আসে। দেখলে বৃষ্টিতে আবার ঐ ভাড়াটে বাড়ির ফ্লোর বেয়ে, রাজকন্যার ভাইবোন-পিতা মাতা কারোর অসুস্থ মল-মূত্রের স্রোত যাচ্ছে সপ্তরথ সাজিয়ে। শুকনো খোলায় ভাজা চিঁড়ের স্বাদ-গন্ধ নেয়ার আগে আবারও অসুখ তদন্তের জন্য পোর্টেবল এক্সরে ঢুকছে নিচতলায়, আবারও ইলেকট্রালাইটস, ... বেড-সোর এবং চামড়ার ক্ষতে মিছেমিছি নেবানল পাউডার। মায়ের তীব্র গভীর ক্ষতের ভেতর মরীচিকা রাজকন্যা অথবা অপর কেয়ার গিভারদের অধৈর্য নিঃশ্বাস পড়ে। মেয়েরা হাঁটু মুড়ে, ধরা যাক, মায়ের বিকশিত বেডসোর থেকে জাগ্রত আসন্ন মৃত্যুকালের দৃশ্যকল্প ভেবে বিষাদাছন্ন হয়, অথবা মায়ের সম্ভাব্য স্বাধীন উজ্জ্বলতম স্বর্গবাসের আকাক্সক্ষায় ক্ষীণ সুখ নির্মাণ করে। অথবা মায়ের চোখেমুখে বিপদ জ্ঞাপক কিছু চিহ্ন নির্মাণ করে মেয়েরা উদ্বায়ী হয়, খণ্ডিত হয়, জীবন্ত হয়, অথবা অজান্তেই হয় শান্ত, মারমুখি, কিম্বা কেবলই বিশ্লেষণরত, শ্রবণরত ও ক্রন্দনরত। মেয়েরা এবং আমরা পোর্টেবল এক্সরের লাগাতার খরচ ভাবতে-ভাবতে মুমূর্ষু ঘড়বাড়ি-সিঁড়ির আলোছায়া দেখি, শব্দহীন হই, নির্জনতম হই এবং বিস্তীর্ণ চাঁদের নুড়ি-পাথরে মানুষের মুখ খুঁজতে যেয়ে কাগজে লিখি অথবা নিছক মুগ্ধতা জ্ঞাপন- আমি সেই সুন্দরীকে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এপারে- বিয়োবার দেরি নাই, রূপ ঝরে পড়ে তার...; যুবকেরা অতি ধীরে পদধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার ছবি আঁকে এবং দলছুট এন্ট্রির জন্ম-সম্ভাবনায় নিদ্রাহীন হয় : ...যুবকেরা হেসে খুন হয় এবং কী এক পিপাসায় কাগজ-পুতুল-আয়না ছুঁয়ে, বাবা-মায়ের দৈনিকের হিসাব পড়ে গোপনে- ... ঘর-বার করে শেষ সন্ধ্যায় ও ফিরে এলো। দুপুরে খেল। রাস্তায় মাইক। শনিবার নিমন্ত্রণ। সন্ধেবেলায় চীনা রেস্তরাঁর খাবার; কাজের মেয়ে আনলো। শীত কম, তবু হিটার জ্বালালাম। রাতের কাজের মেয়েটি এলো। গাড়িতে ফিরলাম। টেবিল ল্যাম্প এ্যাডজাস্ট করা। কালকে ওদের কলেজ পরিদর্শন। দুপুরে স্নান, দাড়ি সেভ এবং প্রেশার চেক (...ও কে)। পিএইচডি এনরোলমেন্ট-এর ভাইভা, ¯ন্যাকস্, সন্দেশ ও চীনা স্যুপ। মতির মা কাল আসবে না। [লোসার্টান + এ্যালজোলাম + ইনহেলার + রোসুভা = ৬০৯/- (২৩/- ছাড়)।] সেই একই গাড়িতে আবার। অরণ্য খাবে না, বন্ধুর সঙ্গে বাইরে খেয়ে এসেছে,... আমি খাটে, ওরা মেঝেতে। দর্জি কাপড় নিয়ে গেল অল্টার করার জন্য। চাদর বদল হলো। ...কে যেন ওর জামা কাপড় চুরি করেছে। সন্দেহ করছি.....?? ঘড়ি এ্যাডজাস্ট হলো, লাঠির পায়ে রাবার বসালাম। কলে পানি নেই। ট্যাংক সাফ হচ্ছে। অনেক উপহার-... মিষ্টির হাঁড়ি সমেত। তিনটি পাজামা + কাপড় + বানানোর খরচ...? সন্ধ্যাবেলায় নিচে বসলাম। অনেক খাবার এবং গল্পসল্প। সিটবেল্ট না পরার জন্য জরিমানা- কাল কোর্টে যাবে। মায়ের সঙ্গে আলোচনা। বিয়ের নেমন্তন্ন। কাবাতুল্লাহর ওপর অবিচুয়ারি। ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স। ফোনে কথাবার্তা। গরম জলের গিজার মিস্ত্রি বাবদ ২০০/-। পুরনো বাংলা সিনেমা দেখলাম। দুপুরে স্নান, শ্যাম্পু এবং নতুন আলু-ট্যাংরা। নতুন মোবাইল পেলাম। বই দিলাম মমতাজকে। নিউ ফুড হাট থেকে- ভেজিটেবল পরোটা এবং চিকেন সসেজ। একটু হেঁটে এলাম। বিস্কুট কিনলাম। নখ কাটলাম।... নো স্নান; ইলিশ ভাত। মিস্ত্রি বাথরুমের পাইপ সাফ করলো। বজ্র বিদ্যুৎ। প্রচণ্ড মেঘ, অল্প বিষ্টি। লোডসেডিং, দুপুর থেকে লোডশেডিং। বারান্দায় বসলাম কিছুক্ষণ। শরীরটা এলোমেলো লাগছে। স্নান। নতুন পাসপোর্ট। উল্টা দিকের বাড়িতে ছাদের ওপর ঘর তৈরি হচ্ছে। মাইকের অত্যাচার। ফেরার পথে দুটো চিকেন কাটলেট।... [ এবার থেকে বড় বড় অক্ষরে লিখবো।] বিকেলে ঘুম এল। পাজামায় দাগ, ... ওয়াশ করতে হবে। সকালে পায়ের নখ কাটা, রাতে পড়াশোনা ও ভাত-মাছ। দুপুরে সুনীলের মৃত্যু-সংবাদ। ডাক্তার এল; প্রেসার = ও. কে। প্যাকেট লাঞ্চ...। তথ্য চিত্র দেখলাম সিদ্ধেশ^রীকে নিয়ে। অনেক গরম জামা কাপড় ধুইয়ে আনলো। রাবার ব্যান্ড = ২০/-। হিটার জ্বালিয়ে লেখাপত্র- হিসাব নিকেশ। বক্তৃতা + গল্প-সল্প + প্রেসার চেক + মাছ-ভাত + নোস্নান...। ওর সঙ্গে বকবক। কফি।... নতুন ক্যালেন্ডার লাগালো। মিষ্টি রোদ। বেশ শীত। আর ঘুম ঘুম ...। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)