আজ বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস

খাদ্যের বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রবিধানমালা বাস্তবায়নে বড় বাধা প্রস্তুত কোম্পানিগুলো

সাইফ বাবলু

আজ বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নিরাপদ আগামীকাল স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য’। তবে বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্যের বড় বাধা ট্রান্সফ্যাটের অতিমাত্রার ব্যবহার। বাংলাদেশে বেকারি খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাবারে মাত্রাহীন ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে হৃদরোগ থেকে শুরু করে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

খাদ্যের বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ প্রবিধানমালা নিয়ে কাজ করছে। ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার প্রতি ১শ’ গ্রামে ২ পার্সেন্ট ব্যবহার নিশ্চিত করার গাইডলাইন থাকলেও এখনও প্রবিধান মালা চূড়ান্ত হয়নি। ট্রান্সফ্যাট নিয়ে দেরিতে কাজ শুরুর ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টার্গেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ পার্সেন্ট নিশ্চিত করতে কমপক্ষে ৫ বছর সময় চাচ্ছে। সে দাবি মানলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে ট্রান্সফ্যাটের সঠিক মাত্রা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, যত দেরি তত ক্ষতি। এদিকে বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস উপলক্ষে সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রবিধানমালা চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে অ্যাডভোকেসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)।

প্রজ্ঞার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট খাদ্যের একটি বিষাক্ত উপাদান যা হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ তৈরি করলেও সেটি চূড়ান্ত করার কাজ এখনও চলমান রয়েছে।

নিরপাদ খাদ্য উৎপাদনের দাবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ চূড়ান্তকরণের কাজ গত বছর থেকে শুরু করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ২০ মে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এবং ৩০ মে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত করে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মারফত আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়।

ট্রান্সফ্যাটবিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি গাইডলাইন দিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ পার্সেন্টে নামিয়ে আনতে হবে কিন্তু আমরা খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট ব্যবহারের একটি প্রবিধানমালা তৈরির যে কাজটি শুরু করেছে সেটি অনেক দেরিতে করেছি। দেরিতে কাজ শুরু করলেও আমাদের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রবিধানমালা নিয়ে কথা বলেছি। ব্যবসায়ীরাও আমাদের সঙ্গে একমত কিন্তু ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, তাদের কমপক্ষে ৫ বছর সময় দিতে হবে।

মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে একটি বিধিমালা তৈরি করে দেয়া। সেটি আগামী ৬ মাসের মধ্যে আমরা চূড়ান্ত করতে পারব বলে আশাবাদী কিন্ত বাকি যে কাজ অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী এটি বাস্তবায়ন কীভাবে করবে সেটি সরকারকে করতে হবে। এখানে অনেক প্রতিষ্ঠান যুক্ত। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো রয়েছে। গাইডলাইন বাস্তবায়নে রোডম্যাপ সরকারকে ঠিক করতে হবে যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টার্গেট অনুযায়ী ২০২৪ সাল থেকে খাদ্যে ২ পার্সেন্ট ট্র্যান্সফ্যাট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, ছোট বড় সব বয়সের মানুষের সার্বিক সুস্থতার জন্য ট্রান্সফ্যাট পরিহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড (টিএফএ) বা ট্রান্সফ্যাট মানব স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিষাক্ত এবং অযাচিত খাদ্য উপাদান। ট্রান্সফ্যাট এক ধরনের ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য উপাদান যা রক্তের এলডিএল বা ‘খারাপ কোলেস্টেরল’ বৃদ্ধি করে, অপরদিকে এইচডিএল বা ‘ভালো কোলেস্টেরল’-এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে হৃদরোগীরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খাদ্যে বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাটের ব্যবহারের মাত্রা বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্ব সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালের মধ্যেই খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ পার্সেন্ট করতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন খাদ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর মাত্রা ১০ পার্সেন্ট বা তারও বেশি। আপনারা জানেন, অতিমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট যুক্ত খাবার রক্তে কোলেস্টেরল তৈরি করে আর এ ক্ষতিকর কোলেস্টেরল থেকে হৃদরোগ হয়। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যত দেরি করা হবে তত বেশি ঝুঁকি তৈরি হবে আমাদের জন্য। আমাদের জীবন এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে আর দেরি করলে চলবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও, যা বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামেই সুপরিচিত। সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে পিএইচও বা ডালডা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও বা ডালডা ব্র্যান্ডসমূহের মোট ২৪টি নমুনা বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফল বলেছে, ৯২ শতাংশ নমুনায় ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।

শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি অর্থাৎ সব ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করা অথবা পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল- পিএইচওর উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গবেষকরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী সব তেল, চর্বি এবং খাদ্যে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাটের সীমা বেঁধে দিয়ে তা সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কার্যকর করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১”-এ বলা হয়েছে রুমিন্যান্ট বা প্রাণিজ উৎসজাত টিএফএ বাদে চর্বির ইমালসনসহ যে কোন তেল ও চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যে কোন খাদ্যের উদ্দেশ্যে অথবা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তেরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যে কোন খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্ততের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং প্রক্রিয়াজাত, মোড়কাবদ্ধ, সরাসরি আহার্য খাদ্য (রেডি-টু-ইট) অথবা যে কোন খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি অর্থাৎ প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রামের অধিক টিএফএ থাকলে তা বিক্রয়, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানি করা যাবে না। এছাড়া, মোড়কজাত খাদ্যের লেবেলে অবশ্যই ট্রান্স ফ্যাটি এসিড ও পিএইচও সম্পর্কিত তথ্য ঘোষণা করতে হবে।

খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রণীত খসড়া প্রবিধানমালাকে অবিলম্বে চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়ে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)-এর নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব করা যাবে না কোন অজুহাতে। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল হলে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যু থেকে অনেকাংশে রেহাই পাবে এদেশের সব স্তরের মানুষ।’ এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত বৃদ্ধির মাধ্যমে ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করছে সংগঠনটি। ক্যাম্পেইনটির দাবি ‘ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করি, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাই।’

সোমবার, ০৭ জুন ২০২১ , ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৫ শাওয়াল ১৪৪২

আজ বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস

খাদ্যের বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রবিধানমালা বাস্তবায়নে বড় বাধা প্রস্তুত কোম্পানিগুলো

সাইফ বাবলু

image

গতকাল রাজধানীতে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু -সংবাদ

আজ বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নিরাপদ আগামীকাল স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য’। তবে বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্যের বড় বাধা ট্রান্সফ্যাটের অতিমাত্রার ব্যবহার। বাংলাদেশে বেকারি খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাবারে মাত্রাহীন ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে হৃদরোগ থেকে শুরু করে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

খাদ্যের বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ প্রবিধানমালা নিয়ে কাজ করছে। ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার প্রতি ১শ’ গ্রামে ২ পার্সেন্ট ব্যবহার নিশ্চিত করার গাইডলাইন থাকলেও এখনও প্রবিধান মালা চূড়ান্ত হয়নি। ট্রান্সফ্যাট নিয়ে দেরিতে কাজ শুরুর ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টার্গেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ পার্সেন্ট নিশ্চিত করতে কমপক্ষে ৫ বছর সময় চাচ্ছে। সে দাবি মানলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে ট্রান্সফ্যাটের সঠিক মাত্রা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, যত দেরি তত ক্ষতি। এদিকে বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস উপলক্ষে সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রবিধানমালা চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে অ্যাডভোকেসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)।

প্রজ্ঞার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট খাদ্যের একটি বিষাক্ত উপাদান যা হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ তৈরি করলেও সেটি চূড়ান্ত করার কাজ এখনও চলমান রয়েছে।

নিরপাদ খাদ্য উৎপাদনের দাবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ চূড়ান্তকরণের কাজ গত বছর থেকে শুরু করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ২০ মে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এবং ৩০ মে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত করে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মারফত আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়।

ট্রান্সফ্যাটবিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি গাইডলাইন দিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ পার্সেন্টে নামিয়ে আনতে হবে কিন্তু আমরা খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট ব্যবহারের একটি প্রবিধানমালা তৈরির যে কাজটি শুরু করেছে সেটি অনেক দেরিতে করেছি। দেরিতে কাজ শুরু করলেও আমাদের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রবিধানমালা নিয়ে কথা বলেছি। ব্যবসায়ীরাও আমাদের সঙ্গে একমত কিন্তু ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, তাদের কমপক্ষে ৫ বছর সময় দিতে হবে।

মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে একটি বিধিমালা তৈরি করে দেয়া। সেটি আগামী ৬ মাসের মধ্যে আমরা চূড়ান্ত করতে পারব বলে আশাবাদী কিন্ত বাকি যে কাজ অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী এটি বাস্তবায়ন কীভাবে করবে সেটি সরকারকে করতে হবে। এখানে অনেক প্রতিষ্ঠান যুক্ত। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো রয়েছে। গাইডলাইন বাস্তবায়নে রোডম্যাপ সরকারকে ঠিক করতে হবে যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টার্গেট অনুযায়ী ২০২৪ সাল থেকে খাদ্যে ২ পার্সেন্ট ট্র্যান্সফ্যাট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, ছোট বড় সব বয়সের মানুষের সার্বিক সুস্থতার জন্য ট্রান্সফ্যাট পরিহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড (টিএফএ) বা ট্রান্সফ্যাট মানব স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিষাক্ত এবং অযাচিত খাদ্য উপাদান। ট্রান্সফ্যাট এক ধরনের ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য উপাদান যা রক্তের এলডিএল বা ‘খারাপ কোলেস্টেরল’ বৃদ্ধি করে, অপরদিকে এইচডিএল বা ‘ভালো কোলেস্টেরল’-এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে হৃদরোগীরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও মৃত্যুঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খাদ্যে বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাটের ব্যবহারের মাত্রা বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্ব সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালের মধ্যেই খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ পার্সেন্ট করতে হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন খাদ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর মাত্রা ১০ পার্সেন্ট বা তারও বেশি। আপনারা জানেন, অতিমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট যুক্ত খাবার রক্তে কোলেস্টেরল তৈরি করে আর এ ক্ষতিকর কোলেস্টেরল থেকে হৃদরোগ হয়। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যত দেরি করা হবে তত বেশি ঝুঁকি তৈরি হবে আমাদের জন্য। আমাদের জীবন এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে আর দেরি করলে চলবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও, যা বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামেই সুপরিচিত। সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে পিএইচও বা ডালডা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও বা ডালডা ব্র্যান্ডসমূহের মোট ২৪টি নমুনা বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফল বলেছে, ৯২ শতাংশ নমুনায় ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।

শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি অর্থাৎ সব ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করা অথবা পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল- পিএইচওর উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গবেষকরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী সব তেল, চর্বি এবং খাদ্যে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাটের সীমা বেঁধে দিয়ে তা সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কার্যকর করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১”-এ বলা হয়েছে রুমিন্যান্ট বা প্রাণিজ উৎসজাত টিএফএ বাদে চর্বির ইমালসনসহ যে কোন তেল ও চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যে কোন খাদ্যের উদ্দেশ্যে অথবা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তেরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যে কোন খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্ততের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং প্রক্রিয়াজাত, মোড়কাবদ্ধ, সরাসরি আহার্য খাদ্য (রেডি-টু-ইট) অথবা যে কোন খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি অর্থাৎ প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রামের অধিক টিএফএ থাকলে তা বিক্রয়, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানি করা যাবে না। এছাড়া, মোড়কজাত খাদ্যের লেবেলে অবশ্যই ট্রান্স ফ্যাটি এসিড ও পিএইচও সম্পর্কিত তথ্য ঘোষণা করতে হবে।

খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রণীত খসড়া প্রবিধানমালাকে অবিলম্বে চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়ে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)-এর নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, ‘ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব করা যাবে না কোন অজুহাতে। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল হলে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যু থেকে অনেকাংশে রেহাই পাবে এদেশের সব স্তরের মানুষ।’ এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত বৃদ্ধির মাধ্যমে ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করছে সংগঠনটি। ক্যাম্পেইনটির দাবি ‘ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করি, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাই।’