চট্টগ্রামে জেলেদের সড়ক অবরোধ

অচল ছিল অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’

মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবরোধ : আশ্বাসের পর প্রত্যাহার

চট্টগ্রামে প্রশাসনের আশ্বাসে অবশেষে অবরোধ স্থগিত করেছেন জেলেরা। গতকাল প্রায় দেড় ঘণ্টা অবরোধের পর ৩৮ পল্লীর জেলেরা দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেন। পূর্বঘোষিত আলটিমেটাম অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগরী থেকে সীতাকুন্ডু উপজেলা পর্যন্ত ৩৮টি জেলেপল্লীর বাসিন্দারা রাস্তার একপাশে জড়ো হন। পরে পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে সাড়ে ১০টার দিকে তারা রাস্তার দু’পাশেই অবস্থান নেন। সকাল ১০টা থেকে সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে নারী ও শিশুসহ রাস্তায় অবস্থান নেন প্রায় হাজারের উপর জেলে। এ ঘটনায় প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম ও ইউএনও ঘটনাস্থলে এসে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলে আপাতত অবরোধ স্থগিত করেন জেলেরা।

মহাসড়কে অবরোধ চলাকালীন কয়েক হাজার জেলের হাতে ছিল ব্যানার-ফেস্টুন। লাল-সবুজ রঙের ছোট দুটি নৌকা মহাসড়কে আড়াআড়িভাবে রেখে, শুয়ে-বসে তারা বন্ধ করে দেন যানবাহন চলাচল। জেলেরা বলছেন, আমাদের জালে ইলিশ ধরা পড়ে না। তবে রাজা (সরকার) আমাদের কেন কষ্ট দিচ্ছে? সত্তর-ঊর্ধ্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শুরু করে কোলের শিশু নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে নারীরাও অংশ নেন এই অবরোধে।

প্রায় ৭৫ বছর বয়সী তরণী জলদাস বলেন, আমরা মাছ ধরে ভাত খাই। আমরা আর কিছুই জানি না। সরকার মাছ ধরা বন্ধ করে আমাদের পেটে লাথি দিয়েছে। আমাদের চাল দিয়ে নাকি সরকার সাহায্য করছে। আমরা চাল নেব কেন? আমরা গরিব হতে পারি, ভিখিরি নয়।

প্রতিবাদ জানাতে মহাসড়কে এসেছিলেন সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী জেলেপল্লীর বাসিন্দা রামহরি সর্দার (৭০)। তিনি আগে মাছ ধরার পাশাপাশি বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢোল-বাঁশি বাজাতেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর বাঁশিতে সুর তোলার মতো দম নেই তার। বাড়ির পাশে সাগরে ‘ভাসা জাল’ বসিয়ে ছোট চিংড়ি আর লইট্যা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, আমরা চাল চাই না। আমাদের চাল লাগবে না। আমাদের মাছ ধরতে দিলেই হবে।

বারো আউলিয়ার পাক্কা মসজিদ এলাকা থেকে আসা শুকলাল জলদাস বলেন, এক বছর আগে যদি আমরা জানতাম যে, এবার মাছ ধরতে পারব নাÑ তাহলে তো আমরা ঋণ নিয়ে নৌকা-জাল মেরামত করতাম না। এখন আমাদের ঋণের টাকা শোধ হবে কীভাবে? সরকার চাল দিচ্ছে। চালে কি পেট ভরে? এর চেয়ে আমাদের সবাইকে জেলখানায় নিয়ে যাক। সেখানে তো ফ্রিতে ভাত পাব।

বৃদ্ধা সরোজিনী জলদাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার পাঁচ ছেলে, নাতি-নাতনি, ছেলের বৌ মিলিয়ে একবেলায় আমাদের ১৫ জন খাওয়ার লোক। ১৫ দিন ধরে ছেলেরা সাগরে যেতে পারছেন না। আমাদের দিন আর চলছে না। আমরা তো ইলিশ মাছ ধরি না। আমাদের জালে ইলিশ ধরা পড়ে না। তবে রাজা (সরকার) আমাদের কেন কষ্ট দিচ্ছে?

ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, জেলের সম্প্রদায়ের লোকজন প্রথমে যখন মহাসড়কে আসার চেষ্টা করছিলেন, তখন সীতাকুন্ডু সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পুলিশকে এ সময় তাদের ওপর চড়াও হতে দেখা যায়। তবে এক সময় পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে জেলেরা মহাসড়কে অবস্থান নেন।

অবরোধ চলাকালীন বাইপাসের মুখে ফৌজদারহাট পুলিশ বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে ‘উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশন’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সমাবেশ শুরু হয়। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, সীতাকুন্ডু থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) জাহাঙ্গীর আলম, সীতাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন রায়, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন।

সমাবেশে সংগঠনের সভাপতি লিটন জলদাস বলেন, সরকার ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণা করেছে। সাত বছর ধরে সরকারিভাবে প্রতি বছর মাছ ধরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ থাকে। এতদিন এই নিষেধাজ্ঞা ছিল শুধু বাণিজ্যিক ট্রলারের জন্য। ছোট নৌকায় যারা মাছ ধরেন, তারা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন না। বর্তমানে আকস্মিক এই সিদ্ধান্তের ফলে ৩৮টি জেলেপল্লীর বাসিন্দারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, আজকের মধ্যে এই নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিলে মঙ্গলবার আমরা একই জায়গায় আবার গণঅনশনে বসব। তিনি বলেন, চাল দিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? চালে কি সবার জন্য ভাত হয়? জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ গরিব। কিন্তু তারা তো ভিক্ষা করেন না। তাহলে সরকার চাল দিচ্ছে কেন? আমরা মানুষ হয়ে মানুষের কাছে মানুষের মর্যাদা চাই।

সংসদ সদস্য দিদারুল আলম জেলে সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, আমরা আপনাদের দাবির সঙ্গে একমত। এ বিষয়ে আমি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। জেলা প্রশাসকের অফিসে গিয়ে বৈঠক করে একটা সমাধানে আসার চেষ্টা করব।

জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে সমাবেশে যাওয়ার কথা জানিয়ে ইউএনও মিল্টন রায় বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় বলেছেন, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কথা বলে তিনি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অবরোধের কারণে যানবাহন, যাত্রী, পণ্য আটকে আছে। রাস্তায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অবশ্যই আপনাদের দাবির স্থায়ী সমাধান দরকার। সরকার নিশ্চয় এর সমাধান করবে।

পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা শ্যামল কুমার পালিত বলেন, অতীতেও সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু আমাদের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হস্তক্ষেপে পতেঙ্গা থেকে সীতাকু- পর্যন্ত জেলেরা এর আওতায় ছিলেন না। কারণ তারা মাছ ধরেন বাড়ির কাছে, গভীর সাগরে যান না। তারা মাছ ধরেন ছোট নৌকায়। কিন্তু মৎস্য প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান এবার নতুন নিয়ম চালু করেছেন। তিনি বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা না করে আমলাতান্ত্রিক মনোভাব থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই সমস্যার সৃষ্টি করেছেন।

এরপর সমাবেশ থেকে অবরোধ স্থগিতের ঘোষণা আসে। দুপুর ১২টার দিকে মহাসড়ক ছেড়ে যান অবরোধকারী জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন।

জানা গেছে, প্রতিবছর ২৩ মে থেকে ২৩ জুলাই মোট ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকে। অন্যান্য বছর এই সময়টায় ছোট কাঠের নৌকার জেলেরা মাছ ধরতে পারতেন। কিন্তু এ বছর এসব ছোট নৌকার ক্ষেত্রেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ফলে দীর্ঘ দুই মাস জীবন-জীবিকার ওপর চরম প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রতিবাদে ১ জুন সাগরে মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশন এক সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে ফেডারেশন সভাপতি লিটন জলদাস আলটিমেটাম দিয়ে বলেন, ৭ দিনের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান না হলে ৯ জুন থেকে মহাসড়ক অবরোধ করা হবে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল রোববার রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন জেলেরা।

সোমবার, ১০ জুন ২০১৯ , ২৭ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ৬ শাওয়াল ১৪৪০

চট্টগ্রামে জেলেদের সড়ক অবরোধ

অচল ছিল অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’

মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবরোধ : আশ্বাসের পর প্রত্যাহার

নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরো

image

সীতাকু- : সন্দ্বীপ চ্যানেলে মাছ ধরা নিষিদ্ধের প্রতিবাদে গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন জেলেরা -সংবাদ

চট্টগ্রামে প্রশাসনের আশ্বাসে অবশেষে অবরোধ স্থগিত করেছেন জেলেরা। গতকাল প্রায় দেড় ঘণ্টা অবরোধের পর ৩৮ পল্লীর জেলেরা দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেন। পূর্বঘোষিত আলটিমেটাম অনুযায়ী চট্টগ্রাম নগরী থেকে সীতাকুন্ডু উপজেলা পর্যন্ত ৩৮টি জেলেপল্লীর বাসিন্দারা রাস্তার একপাশে জড়ো হন। পরে পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে সাড়ে ১০টার দিকে তারা রাস্তার দু’পাশেই অবস্থান নেন। সকাল ১০টা থেকে সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে নারী ও শিশুসহ রাস্তায় অবস্থান নেন প্রায় হাজারের উপর জেলে। এ ঘটনায় প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম ও ইউএনও ঘটনাস্থলে এসে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলে আপাতত অবরোধ স্থগিত করেন জেলেরা।

মহাসড়কে অবরোধ চলাকালীন কয়েক হাজার জেলের হাতে ছিল ব্যানার-ফেস্টুন। লাল-সবুজ রঙের ছোট দুটি নৌকা মহাসড়কে আড়াআড়িভাবে রেখে, শুয়ে-বসে তারা বন্ধ করে দেন যানবাহন চলাচল। জেলেরা বলছেন, আমাদের জালে ইলিশ ধরা পড়ে না। তবে রাজা (সরকার) আমাদের কেন কষ্ট দিচ্ছে? সত্তর-ঊর্ধ্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শুরু করে কোলের শিশু নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে নারীরাও অংশ নেন এই অবরোধে।

প্রায় ৭৫ বছর বয়সী তরণী জলদাস বলেন, আমরা মাছ ধরে ভাত খাই। আমরা আর কিছুই জানি না। সরকার মাছ ধরা বন্ধ করে আমাদের পেটে লাথি দিয়েছে। আমাদের চাল দিয়ে নাকি সরকার সাহায্য করছে। আমরা চাল নেব কেন? আমরা গরিব হতে পারি, ভিখিরি নয়।

প্রতিবাদ জানাতে মহাসড়কে এসেছিলেন সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী জেলেপল্লীর বাসিন্দা রামহরি সর্দার (৭০)। তিনি আগে মাছ ধরার পাশাপাশি বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢোল-বাঁশি বাজাতেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন আর বাঁশিতে সুর তোলার মতো দম নেই তার। বাড়ির পাশে সাগরে ‘ভাসা জাল’ বসিয়ে ছোট চিংড়ি আর লইট্যা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, আমরা চাল চাই না। আমাদের চাল লাগবে না। আমাদের মাছ ধরতে দিলেই হবে।

বারো আউলিয়ার পাক্কা মসজিদ এলাকা থেকে আসা শুকলাল জলদাস বলেন, এক বছর আগে যদি আমরা জানতাম যে, এবার মাছ ধরতে পারব নাÑ তাহলে তো আমরা ঋণ নিয়ে নৌকা-জাল মেরামত করতাম না। এখন আমাদের ঋণের টাকা শোধ হবে কীভাবে? সরকার চাল দিচ্ছে। চালে কি পেট ভরে? এর চেয়ে আমাদের সবাইকে জেলখানায় নিয়ে যাক। সেখানে তো ফ্রিতে ভাত পাব।

বৃদ্ধা সরোজিনী জলদাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার পাঁচ ছেলে, নাতি-নাতনি, ছেলের বৌ মিলিয়ে একবেলায় আমাদের ১৫ জন খাওয়ার লোক। ১৫ দিন ধরে ছেলেরা সাগরে যেতে পারছেন না। আমাদের দিন আর চলছে না। আমরা তো ইলিশ মাছ ধরি না। আমাদের জালে ইলিশ ধরা পড়ে না। তবে রাজা (সরকার) আমাদের কেন কষ্ট দিচ্ছে?

ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, জেলের সম্প্রদায়ের লোকজন প্রথমে যখন মহাসড়কে আসার চেষ্টা করছিলেন, তখন সীতাকুন্ডু সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পুলিশকে এ সময় তাদের ওপর চড়াও হতে দেখা যায়। তবে এক সময় পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে জেলেরা মহাসড়কে অবস্থান নেন।

অবরোধ চলাকালীন বাইপাসের মুখে ফৌজদারহাট পুলিশ বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে ‘উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশন’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সমাবেশ শুরু হয়। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, সীতাকুন্ডু থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) জাহাঙ্গীর আলম, সীতাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন রায়, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন।

সমাবেশে সংগঠনের সভাপতি লিটন জলদাস বলেন, সরকার ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণা করেছে। সাত বছর ধরে সরকারিভাবে প্রতি বছর মাছ ধরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ থাকে। এতদিন এই নিষেধাজ্ঞা ছিল শুধু বাণিজ্যিক ট্রলারের জন্য। ছোট নৌকায় যারা মাছ ধরেন, তারা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন না। বর্তমানে আকস্মিক এই সিদ্ধান্তের ফলে ৩৮টি জেলেপল্লীর বাসিন্দারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, আজকের মধ্যে এই নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিলে মঙ্গলবার আমরা একই জায়গায় আবার গণঅনশনে বসব। তিনি বলেন, চাল দিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? চালে কি সবার জন্য ভাত হয়? জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ গরিব। কিন্তু তারা তো ভিক্ষা করেন না। তাহলে সরকার চাল দিচ্ছে কেন? আমরা মানুষ হয়ে মানুষের কাছে মানুষের মর্যাদা চাই।

সংসদ সদস্য দিদারুল আলম জেলে সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, আমরা আপনাদের দাবির সঙ্গে একমত। এ বিষয়ে আমি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। জেলা প্রশাসকের অফিসে গিয়ে বৈঠক করে একটা সমাধানে আসার চেষ্টা করব।

জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে সমাবেশে যাওয়ার কথা জানিয়ে ইউএনও মিল্টন রায় বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় বলেছেন, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কথা বলে তিনি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অবরোধের কারণে যানবাহন, যাত্রী, পণ্য আটকে আছে। রাস্তায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অবশ্যই আপনাদের দাবির স্থায়ী সমাধান দরকার। সরকার নিশ্চয় এর সমাধান করবে।

পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা শ্যামল কুমার পালিত বলেন, অতীতেও সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু আমাদের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হস্তক্ষেপে পতেঙ্গা থেকে সীতাকু- পর্যন্ত জেলেরা এর আওতায় ছিলেন না। কারণ তারা মাছ ধরেন বাড়ির কাছে, গভীর সাগরে যান না। তারা মাছ ধরেন ছোট নৌকায়। কিন্তু মৎস্য প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান এবার নতুন নিয়ম চালু করেছেন। তিনি বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা না করে আমলাতান্ত্রিক মনোভাব থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই সমস্যার সৃষ্টি করেছেন।

এরপর সমাবেশ থেকে অবরোধ স্থগিতের ঘোষণা আসে। দুপুর ১২টার দিকে মহাসড়ক ছেড়ে যান অবরোধকারী জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন।

জানা গেছে, প্রতিবছর ২৩ মে থেকে ২৩ জুলাই মোট ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকে। অন্যান্য বছর এই সময়টায় ছোট কাঠের নৌকার জেলেরা মাছ ধরতে পারতেন। কিন্তু এ বছর এসব ছোট নৌকার ক্ষেত্রেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ফলে দীর্ঘ দুই মাস জীবন-জীবিকার ওপর চরম প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রতিবাদে ১ জুন সাগরে মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশন এক সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে ফেডারেশন সভাপতি লিটন জলদাস আলটিমেটাম দিয়ে বলেন, ৭ দিনের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান না হলে ৯ জুন থেকে মহাসড়ক অবরোধ করা হবে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল রোববার রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন জেলেরা।