ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রথম পদক্ষেপেই করের বোঝা

ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ফি ৬ গুণ বৃদ্ধির প্রস্তাব

দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় উৎসাহিত করার কথা মুখে বলা হলেও বাস্তবে দেখা গেছে ব্যতিক্রম। নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে গেলে প্রথম ধাপেই করের বোঝা মাথায় নিতে হবে ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীদের। কেননা আগামী বাজেটে ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রথম ধাপ ট্রেড লাইসেন্সের নবায়ন ফি ৫ থেকে ৬ গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানোয় মাঝারি আয়ের মানুষও করজালের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এমনভাবে কর ও ভ্যাটের জাল বাড়ানো হয়েছে যাতে দেশের বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও করের আওতায় চলে আসছেন। একই সঙ্গে ব্যবসার জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র সংগ্রহের কার্যক্রমেও নানা ধরনের করের পরিমাণ ও আওতা বাড়ানো হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসা করতে গেলে সবার আগে নিতে হয় একটি ট্রেড লাইসেন্স। প্রতিবছর এটি নবায়ন করতে হয়। আগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় নির্ধারিত ফির বিপরীতে ৫০০ টাকা উৎসে কর দিতে হতো। প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এটি ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ করহার ৬ গুণ বাড়ানো হয়েছে। অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা, জেলা শহরের পৌরসভা এলাকার জন্য ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা এবং দেশের অন্য এলাকায় ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা, টার্নওভার সীমা ও টার্নওভার ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একইভাবে টার্নওভার ট্যাক্সের সীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা এবং টার্নওভার ট্যাক্স ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন ব্যবসায়ীর বার্ষিক বেচাবিক্রির পরিমাণ ৫০ লাখ টাকার নিচে হলে ভ্যাটযোগ্য পণ্য বিক্রি করলেও ভ্যাট দিতে হবে না। কিন্তু ৫০ লাখের বেশি বেচাকেনা হলে টার্নওভার ট্যাক্সের জন্য তালিকাভুক্ত হতে হবে। বার্ষিক ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বেচাকেনা হলে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে। এই হিসাবে গড়ে দৈনিক যেসব ব্যবসায়ী ১৩ হাজার ৭০০ টাকা বিক্রি করবেন, তারাই টার্নওভার সীমার মধ্যে পড়বেন। তাকে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে।

ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের মহাসচিব ও এফবিসিসিআই’র পরিচালক আবু মোতালেব প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে বলেন, পুরান ঢাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। কারণ প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দৈনিক যার বেচাকেনা ১৩ হাজার ৭০০ টাকা, সে-ই টার্নওভার ট্যাক্সের মধ্যে পড়বেন। এতে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও নতুন করে এই করের আওতায় আসবেন। আবু মোতালেব বলেন, পুরান ঢাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী পাইকারি ব্যবসা করেন। তাদের দৈনিক বেচাকেনা অনেক বেশি। ফলে তাদের সবাইকে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায় ৪ শতাংশ মুনাফা করা যায় না। তাই ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৮০ লাখ টাকা, টার্নওভারের সীমা ৫ কোটি টাকা এবং টার্নওভার ট্যাক্স ১ শতাংশ নির্ধারণ করলে ব্যবসায়ীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দিতে এগিয়ে আসবেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, টার্নওভার ট্যাক্স ৪ শতাংশ অনেক বেশি। এটি কমানো উচিত। তাহলে ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা কমবে। তা না হলে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা বেশি চাপবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যবসায়ে যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে তাতে বিশেষ করে পাইকারি ব্যবসায় ৪ শতাংশ মুনাফা হয় না। ফলে কর ৪ শতাংশ দিলে ব্যবসায়ীদের মুনাফা থাকবে না। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই বিভিন্ন জোগানদার হিসেবে প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক পণ্য ও সেবা সরবরাহ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটে সেখানেও ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনের আওতায় ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মুনাফা কমতে পারে।

এদিকে বেশ কয়েক বছর যাবৎ করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকায় আটকে রেখেছে সরকার। আগামী অর্থবছরেও এই হার বহাল থাকছে। যা বর্তমান বাজার মূল্যের হিসেবে ঠিক হয়নি। আড়াই লাখ টাকা মানে হচ্ছে মাসে ২১ হাজার টাকা আয় হলেই কর দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান বাজারের চাহিদা অনুসারে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জীবন যাত্রার ব্যয় বহনেই খরচ হয়ে যায়।

মঙ্গলবার, ১৮ জুন ২০১৯ , ৪ আষাঢ় ১৪২৫, ১৪ শাওয়াল ১৪৪০

ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রথম পদক্ষেপেই করের বোঝা

ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ফি ৬ গুণ বৃদ্ধির প্রস্তাব

রোকন মাহমুদ

দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় উৎসাহিত করার কথা মুখে বলা হলেও বাস্তবে দেখা গেছে ব্যতিক্রম। নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে গেলে প্রথম ধাপেই করের বোঝা মাথায় নিতে হবে ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীদের। কেননা আগামী বাজেটে ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রথম ধাপ ট্রেড লাইসেন্সের নবায়ন ফি ৫ থেকে ৬ গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এছাড়া করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানোয় মাঝারি আয়ের মানুষও করজালের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এমনভাবে কর ও ভ্যাটের জাল বাড়ানো হয়েছে যাতে দেশের বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও করের আওতায় চলে আসছেন। একই সঙ্গে ব্যবসার জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র সংগ্রহের কার্যক্রমেও নানা ধরনের করের পরিমাণ ও আওতা বাড়ানো হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসা করতে গেলে সবার আগে নিতে হয় একটি ট্রেড লাইসেন্স। প্রতিবছর এটি নবায়ন করতে হয়। আগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় নির্ধারিত ফির বিপরীতে ৫০০ টাকা উৎসে কর দিতে হতো। প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এটি ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ করহার ৬ গুণ বাড়ানো হয়েছে। অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা, জেলা শহরের পৌরসভা এলাকার জন্য ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা এবং দেশের অন্য এলাকায় ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা, টার্নওভার সীমা ও টার্নওভার ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একইভাবে টার্নওভার ট্যাক্সের সীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা এবং টার্নওভার ট্যাক্স ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন ব্যবসায়ীর বার্ষিক বেচাবিক্রির পরিমাণ ৫০ লাখ টাকার নিচে হলে ভ্যাটযোগ্য পণ্য বিক্রি করলেও ভ্যাট দিতে হবে না। কিন্তু ৫০ লাখের বেশি বেচাকেনা হলে টার্নওভার ট্যাক্সের জন্য তালিকাভুক্ত হতে হবে। বার্ষিক ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বেচাকেনা হলে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে। এই হিসাবে গড়ে দৈনিক যেসব ব্যবসায়ী ১৩ হাজার ৭০০ টাকা বিক্রি করবেন, তারাই টার্নওভার সীমার মধ্যে পড়বেন। তাকে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে।

ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের মহাসচিব ও এফবিসিসিআই’র পরিচালক আবু মোতালেব প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে বলেন, পুরান ঢাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। কারণ প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দৈনিক যার বেচাকেনা ১৩ হাজার ৭০০ টাকা, সে-ই টার্নওভার ট্যাক্সের মধ্যে পড়বেন। এতে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও নতুন করে এই করের আওতায় আসবেন। আবু মোতালেব বলেন, পুরান ঢাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী পাইকারি ব্যবসা করেন। তাদের দৈনিক বেচাকেনা অনেক বেশি। ফলে তাদের সবাইকে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায় ৪ শতাংশ মুনাফা করা যায় না। তাই ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৮০ লাখ টাকা, টার্নওভারের সীমা ৫ কোটি টাকা এবং টার্নওভার ট্যাক্স ১ শতাংশ নির্ধারণ করলে ব্যবসায়ীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দিতে এগিয়ে আসবেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, টার্নওভার ট্যাক্স ৪ শতাংশ অনেক বেশি। এটি কমানো উচিত। তাহলে ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা কমবে। তা না হলে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা বেশি চাপবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যবসায়ে যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে তাতে বিশেষ করে পাইকারি ব্যবসায় ৪ শতাংশ মুনাফা হয় না। ফলে কর ৪ শতাংশ দিলে ব্যবসায়ীদের মুনাফা থাকবে না। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই বিভিন্ন জোগানদার হিসেবে প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক পণ্য ও সেবা সরবরাহ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটে সেখানেও ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনের আওতায় ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মুনাফা কমতে পারে।

এদিকে বেশ কয়েক বছর যাবৎ করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকায় আটকে রেখেছে সরকার। আগামী অর্থবছরেও এই হার বহাল থাকছে। যা বর্তমান বাজার মূল্যের হিসেবে ঠিক হয়নি। আড়াই লাখ টাকা মানে হচ্ছে মাসে ২১ হাজার টাকা আয় হলেই কর দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান বাজারের চাহিদা অনুসারে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জীবন যাত্রার ব্যয় বহনেই খরচ হয়ে যায়।