বন্যা : পানিবন্দী ১৫ লাখ

বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের জন্য হাহাকার

কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ , ফরিদপুর ও নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যমুনার পানি জামালপুরে বিপদসীমার ১৬২ ও বগুড়ায় ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব এলাকায় অন্তত ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বিষুদ্ধ পানি, খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে বানভাসিদের মধ্যে।

সুনামগঞ্জ, সিলেট, বান্দরবান, কক্সবাজারের চকরিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বাড়ছে দুর্ভোগ। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে উন্নতি হতে পারে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। রৌমারীর বন্দবের এলাকায় এলজিইডির সড়ক ভেঙে যাওয়ায় গোটা উপজেলা এখন পানিবন্দী। গত মঙ্গলবার রাতে রৌমারীতে দাঁতভাঙা এলাকার হাজিরহাট ও ধনারচরে এলজিইডির সড়ক ভেঙে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এরফলে নতুন করে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও বেসরকারি পর্যায়ের সংগঠনগুলো এগিয়ে না আসায় বানভাসিরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে আটকেপড়া মানুষজন জ্বালানি সংকটের কারণে রান্নাবান্না করতে পারছে না। উঁচু স্থানে গবাদিপশু রাখলেও গো-খাদ্যের অভাবে গেরস্তরা অসহায় হয়ে পড়েছে। এদিকে গতকাল দুপুরে উলিপুরের গুণাইগাছ ইউনিয়নের কাজির চক এলাকার সুমন মিয়ার দেড় বছরের শিশু ফুয়াদ পানিতে পড়ে মারা গেছে। এ নিয়ে গত আট দিনে জেলায় পানিতে ডুবে মারা গেল ১৩ জন।

জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুম সূত্রে জানা যায়, বন্যার ফলে ৫৬টি ইউনিয়নের ৪৯৮টি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ পরিবারের ৬ লাখ ৯ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে।

জামালপুর : ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে এবারের জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যমুনার পানি ১৯৮৮ সালে বিপদসীমার ১২২ সে.মি ও ২০১৭ সালে বিপদসীমার ১৩৪ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। গত বিপদসীমার ১৬২ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত সব রেকর্ডের চেয়ে এ বছর বন্যার পানি ২৮ সে.মি বেশি বলে জানিয়েছেন জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী।

প্রতিদিনই হু-হু করে বাড়ছে পানি। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে বানভাসীর সংখ্যা। বন্যার প্রবল পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশুপাখিসহ সহায়সম্পদ। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে ধান চালসহ খাদ্যসামগ্রী। অনেকেই বসতভিটার মায়া ছাড়তে না পেরে ঘরের ভেতর মাচা করে এবং টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছে। খাদ্য, চিকিৎসা ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবন্দী মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জেলার ৭ উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫২টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার ৬ উপজেলায় ৩ লাখ মানুষ।

ত্রাণ সংকট পুরো বন্যাকবলিত এলাকাজুড়ে। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে বানভাসীদের মধ্যে।

আটকেপড়া বানভাসীদের দ্রুত উদ্ধার তৎপরতার আশ^াস দেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সংকট নিয়ে তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনই ত্রাণের বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে এবং অব্যাহত থাকবে।

বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দির নিকট যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির প্রবল চাপে বাঁধের ৮-৯টি স্থানে পানি চোয়াচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন বাঁধ দিয়ে পানি চোয়ানো বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলছেন, এখন পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাঁধের পানি চোয়ানো বন্ধ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারী সার্বক্ষণিক সর্তকাবস্থায় রয়েছে।

যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের ১০২টি গ্রামের ৮২ হাজার ৩৮০জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। শহরসংলগ্ন খোলাহাটী ইউনিয়নের গোদারহাট এলাকায় সোনাইল বাঁধের প্রায় ৩শ’ ফুট এলাকা ধসে যাওয়ায় গাইবান্ধা জেলা শহরে পানি ঢুকেছে।

এদিকে শহরের ভেতর পানি প্রবেশ করায় জেলা প্রশাসক ও জজের বাসভবন, পিকে বিশ্বাস রোড, স্বাধীনতা প্রাঙ্গণ, সাস্তার পট্টি রোড, টেনিস কমপ্লেক্স, ডেভিড কোম্পানিপাড়া, ভিএইড রোড, মুন্সিপাড়া, ব্রিজ রোড কালিবাড়িপাড়া, কুটিপাড়া, পূর্বপাড়া, সবুজপাড়া, পুরাতন বাজার, বানিয়ারজান, পুলিশ লাইন, নশরৎপুর, বোয়ালীসহ আশপাশের এলাকায় প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ত্রিমোহিনী স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় রেললাইনের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুরের সঙ্গে ঢাকাগামী রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৪৬ সে.মি. এবং ঘাঘট নদীর পানি ৯০ সে.মি. বৃদ্ধি পাওয়ায় আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে তিস্তার পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।

এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের ২৩০টি গ্রামের ৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৯ হাজার ২৩০টি। বন্যাকবলিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য ১১৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রয় নিয়েছে ৪২ হাজার ১০২ জন। বন্যাকবলিত এলাকার রাস্তাঘাট সব ডুবে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে কাঁচা রাস্তা ৯২ কি.মি., ৬টি কালভার্ট এবং ৪ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১ হাজার ২৪৬ হেক্টর। বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হযেছে ৪ কি.মি.। এছাড়া ৩৩২টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

এ পর্যস্ত ক্ষতিগ্রস্ত ওই ৪ উপজেলায় জেলা ত্রাণভান্ডার থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ হাজার মে. চাল ও ১০ লাখ টাকা এবং ১০ হাজার কার্টন শুকনা খাবার। ওইসব সামগ্রী ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের কাজ চলছে। তবে ক্ষতির তুলনায় বরাদ্দ খুবই কম।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪.০৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই জেলার কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালিও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়ে পরেছে। জেলার কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর সদর উপজেলার যমুনা নদীতীরবর্তী অন্তত ২০টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক বন্যার দুর্ভোগে পড়েছে। গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে গোয়ালন্দ উপজেলার নদী তীরবর্তী বিভিন্ন নি¤œাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জরুরি সভায় এ তথ্য জানানো হয়।

নওগাঁ : নওগাঁর মান্দা উপজেলার আত্রাই নদীর বনকুড়া নামকস্থানে বাঁধ ভেঙে প্রায় ২২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এই বাঁধ ভেঙে গেছে।

ইসলামপুর (জামালপুর) : জামালপুরের ইসলামপুরে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বন্যার পানি বিপদসীমার ১৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, দশানীসহ উপজেলার সকল নদ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

সাঘাটা (গাইবান্ধা) : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সাঘাটা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বালিয়াকান্দি (রাজবাড়ী) : নদীভাঙনরোধে স্বল্প খরচে অল্প সময়ে বাঁশের বেড়া প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়।

শিবচর(মাদারীপুর) : পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে শিবচরের চরাঞ্চলের ৩টি ইউনিয়নে নদী ভাঙ্গন আগ্রাসী রুপ ধারন করেছে। ভাঙনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়ে অর্ধশত ঘরবাড়ি ,১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে ৩টি স্কুল ভবনসহ ৫টি স্কুল, ২টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র-কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন হাটবাজারসহ ৩ ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হাজারো বসত বাড়ি।

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণ বন্ধ থাকায় নদ-নদীর পানি কমেছে। সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ ঘোলঘর পয়েন্টে গতকাল বুধবার দুপুর বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সীমান্ত নদী যাদুকাটার পানিও বিপদসীমার নিচে বইছে। গত ৮ দিন ধরে টানা পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে জেলার ১১ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, হাটবাজার, গবাদিপশুসহ ক্ষতি হয়েছে রাস্তাঘাটের।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল ২২টি। তবে মঙ্গলবার ঢল ও বর্ষণ বন্ধ থাকায় পানি কমেছে। এতে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২২টি আ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই ২০১৯ , ৪ শ্রাবন ১৪২৫, ১৪ জিলকদ ১৪৪০

বন্যা : পানিবন্দী ১৫ লাখ

বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের জন্য হাহাকার

সংবাদ ডেস্ক

image

জামালপুর : বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা ঘরের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন -সংবাদ

কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ , ফরিদপুর ও নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যমুনার পানি জামালপুরে বিপদসীমার ১৬২ ও বগুড়ায় ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব এলাকায় অন্তত ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বিষুদ্ধ পানি, খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে বানভাসিদের মধ্যে।

সুনামগঞ্জ, সিলেট, বান্দরবান, কক্সবাজারের চকরিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বাড়ছে দুর্ভোগ। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে উন্নতি হতে পারে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। রৌমারীর বন্দবের এলাকায় এলজিইডির সড়ক ভেঙে যাওয়ায় গোটা উপজেলা এখন পানিবন্দী। গত মঙ্গলবার রাতে রৌমারীতে দাঁতভাঙা এলাকার হাজিরহাট ও ধনারচরে এলজিইডির সড়ক ভেঙে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এরফলে নতুন করে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও বেসরকারি পর্যায়ের সংগঠনগুলো এগিয়ে না আসায় বানভাসিরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে আটকেপড়া মানুষজন জ্বালানি সংকটের কারণে রান্নাবান্না করতে পারছে না। উঁচু স্থানে গবাদিপশু রাখলেও গো-খাদ্যের অভাবে গেরস্তরা অসহায় হয়ে পড়েছে। এদিকে গতকাল দুপুরে উলিপুরের গুণাইগাছ ইউনিয়নের কাজির চক এলাকার সুমন মিয়ার দেড় বছরের শিশু ফুয়াদ পানিতে পড়ে মারা গেছে। এ নিয়ে গত আট দিনে জেলায় পানিতে ডুবে মারা গেল ১৩ জন।

জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুম সূত্রে জানা যায়, বন্যার ফলে ৫৬টি ইউনিয়নের ৪৯৮টি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ পরিবারের ৬ লাখ ৯ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে।

জামালপুর : ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে এবারের জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যমুনার পানি ১৯৮৮ সালে বিপদসীমার ১২২ সে.মি ও ২০১৭ সালে বিপদসীমার ১৩৪ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। গত বিপদসীমার ১৬২ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত সব রেকর্ডের চেয়ে এ বছর বন্যার পানি ২৮ সে.মি বেশি বলে জানিয়েছেন জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী।

প্রতিদিনই হু-হু করে বাড়ছে পানি। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে বানভাসীর সংখ্যা। বন্যার প্রবল পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশুপাখিসহ সহায়সম্পদ। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে ধান চালসহ খাদ্যসামগ্রী। অনেকেই বসতভিটার মায়া ছাড়তে না পেরে ঘরের ভেতর মাচা করে এবং টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছে। খাদ্য, চিকিৎসা ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবন্দী মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জেলার ৭ উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫২টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার ৬ উপজেলায় ৩ লাখ মানুষ।

ত্রাণ সংকট পুরো বন্যাকবলিত এলাকাজুড়ে। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে বানভাসীদের মধ্যে।

আটকেপড়া বানভাসীদের দ্রুত উদ্ধার তৎপরতার আশ^াস দেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবির। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সংকট নিয়ে তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনই ত্রাণের বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে এবং অব্যাহত থাকবে।

বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দির নিকট যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির প্রবল চাপে বাঁধের ৮-৯টি স্থানে পানি চোয়াচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন বাঁধ দিয়ে পানি চোয়ানো বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলছেন, এখন পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাঁধের পানি চোয়ানো বন্ধ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারী সার্বক্ষণিক সর্তকাবস্থায় রয়েছে।

যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের ১০২টি গ্রামের ৮২ হাজার ৩৮০জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। শহরসংলগ্ন খোলাহাটী ইউনিয়নের গোদারহাট এলাকায় সোনাইল বাঁধের প্রায় ৩শ’ ফুট এলাকা ধসে যাওয়ায় গাইবান্ধা জেলা শহরে পানি ঢুকেছে।

এদিকে শহরের ভেতর পানি প্রবেশ করায় জেলা প্রশাসক ও জজের বাসভবন, পিকে বিশ্বাস রোড, স্বাধীনতা প্রাঙ্গণ, সাস্তার পট্টি রোড, টেনিস কমপ্লেক্স, ডেভিড কোম্পানিপাড়া, ভিএইড রোড, মুন্সিপাড়া, ব্রিজ রোড কালিবাড়িপাড়া, কুটিপাড়া, পূর্বপাড়া, সবুজপাড়া, পুরাতন বাজার, বানিয়ারজান, পুলিশ লাইন, নশরৎপুর, বোয়ালীসহ আশপাশের এলাকায় প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ত্রিমোহিনী স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় রেললাইনের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুরের সঙ্গে ঢাকাগামী রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৪৬ সে.মি. এবং ঘাঘট নদীর পানি ৯০ সে.মি. বৃদ্ধি পাওয়ায় আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে তিস্তার পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।

এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের ২৩০টি গ্রামের ৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৯ হাজার ২৩০টি। বন্যাকবলিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য ১১৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রয় নিয়েছে ৪২ হাজার ১০২ জন। বন্যাকবলিত এলাকার রাস্তাঘাট সব ডুবে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে কাঁচা রাস্তা ৯২ কি.মি., ৬টি কালভার্ট এবং ৪ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১ হাজার ২৪৬ হেক্টর। বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হযেছে ৪ কি.মি.। এছাড়া ৩৩২টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

এ পর্যস্ত ক্ষতিগ্রস্ত ওই ৪ উপজেলায় জেলা ত্রাণভান্ডার থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ হাজার মে. চাল ও ১০ লাখ টাকা এবং ১০ হাজার কার্টন শুকনা খাবার। ওইসব সামগ্রী ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের কাজ চলছে। তবে ক্ষতির তুলনায় বরাদ্দ খুবই কম।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪.০৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই জেলার কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালিও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়ে পরেছে। জেলার কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর সদর উপজেলার যমুনা নদীতীরবর্তী অন্তত ২০টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক বন্যার দুর্ভোগে পড়েছে। গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে গোয়ালন্দ উপজেলার নদী তীরবর্তী বিভিন্ন নি¤œাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জরুরি সভায় এ তথ্য জানানো হয়।

নওগাঁ : নওগাঁর মান্দা উপজেলার আত্রাই নদীর বনকুড়া নামকস্থানে বাঁধ ভেঙে প্রায় ২২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এই বাঁধ ভেঙে গেছে।

ইসলামপুর (জামালপুর) : জামালপুরের ইসলামপুরে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বন্যার পানি বিপদসীমার ১৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, দশানীসহ উপজেলার সকল নদ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

সাঘাটা (গাইবান্ধা) : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সাঘাটা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বালিয়াকান্দি (রাজবাড়ী) : নদীভাঙনরোধে স্বল্প খরচে অল্প সময়ে বাঁশের বেড়া প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়।

শিবচর(মাদারীপুর) : পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে শিবচরের চরাঞ্চলের ৩টি ইউনিয়নে নদী ভাঙ্গন আগ্রাসী রুপ ধারন করেছে। ভাঙনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়ে অর্ধশত ঘরবাড়ি ,১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে ৩টি স্কুল ভবনসহ ৫টি স্কুল, ২টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র-কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন হাটবাজারসহ ৩ ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হাজারো বসত বাড়ি।

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণ বন্ধ থাকায় নদ-নদীর পানি কমেছে। সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ ঘোলঘর পয়েন্টে গতকাল বুধবার দুপুর বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সীমান্ত নদী যাদুকাটার পানিও বিপদসীমার নিচে বইছে। গত ৮ দিন ধরে টানা পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে জেলার ১১ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, হাটবাজার, গবাদিপশুসহ ক্ষতি হয়েছে রাস্তাঘাটের।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল ২২টি। তবে মঙ্গলবার ঢল ও বর্ষণ বন্ধ থাকায় পানি কমেছে। এতে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২২টি আ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।