চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধে সংকটে এশিয়ার অর্থনীতি

-অর্থনীতিবিদ সং সেং উন

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘায়িত বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে এশিয়ার অর্থনীতিগুলোর ওপর মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধের ক্রমাগত আঘাত দ্রুত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিবিসি।

মালয়েশিয়ার বেসরকারি ব্যাংক সিআইএমবির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক অর্থনীতিবিদ সং সেং উন বলেন, পুরো এশিয়া অঞ্চলেই একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। এমন একটি সময় বাণিজ্যযুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে, যখন ১০ বছরের তুলনামূলক স্থিতিশীল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি আবার মন্থর হতে শুরু করেছে। এমনকি এ মুহূর্তে যদি কোন অলৌকিক ঘটনায় বাণিজ্যযুদ্ধ বন্ধও হয়ে যায়, তার পরও এরই মধ্যে যা ঘটছে, তার নেতিবাচক প্রভাব খুব একটা কম হবে না। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দুঃসংবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন এ তিন দেশের জন্য বিশেষভাবে হতাশাজনক ছিল। চলতি বছরের জুনে নয় মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ভারতের রপ্তানি ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পেতে দেখা গেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মাসে ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানিও ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দেশটির বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। এছাড়া গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি কমেছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

এ তিন দেশের প্রতিটিই পাম তেল ও রাসায়নিক থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিধির পণ্য চীনের কাছে বিক্রি করে থাকে। এদিকে জুন নিয়ে টানা দ্বিতীয় মাসের মতো রপ্তানিতে পতন দেখতে হয়েছে সিঙ্গাপুরকে। গত মাসে দেশটির রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি সপ্তাহে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন প্রায় তিন দশকের সর্বনিম্ন ত্রৈমাসিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। বাণিজ্যযুদ্ধ সংক্রান্ত উদ্বেগ আংশিকভাবে দেশটির প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা অর্ধেকের বেশি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর অর্থ, চীনা কোম্পানিগুলোকে ক্রেতাদের কাছে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হবে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পণ্য বিক্রি কমাতে হবে। এ ধরনের কোনো কিছুর অর্থ হলো, যেসব দেশ চীনা কারখানাগুলোর জন্য উপকরণ সরবরাহ করছে, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর শীঘ্রই এ পরিস্থিতির উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

এশীয় রপ্তানির ওপর চলতি সপ্তাহে জাপানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান নমুরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী মাসেও এ অঞ্চলের রপ্তানিতে গুমট অবস্থা বহাল থাকবে। এ অবস্থার জন্য চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতির ঘাটতিকে দায়ী করা হয়েছে। এটি বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তোলায় করপোরেট বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে পুরো অঞ্চলে বাণিজ্য সংরক্ষণবাদকে বৈদেশিক নীতিনির্ধারণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ কখন বা আদৌ সমাপ্ত হবে কিনা, তা এখনো পরিষ্কার নয়। অথবা এ বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘মুক্ত বাণিজ্য’ থেকে দূরে সরতে মার্কিন নীতির পরিবর্তনের শুরু হলো কিনা তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। যদিও এমনটাই ইঙ্গিত করেছে থিংক ট্যাংক ক্যাপিটাল ইকোনমিকস।

এরই মাধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভিয়েতনাম তার শুল্কারোপ তালিকার পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু বলে আভাস দিয়েছেন। উল্লেখ্য, বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির বাণিজ্যযুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপরও ট্রাম্প শুল্কারোপ করতে পারেন বলে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন। এদিকে বিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মের কোম্পানি ও ভোক্তাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এশিয়া। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক অর্থনীতির ৫২ শতাংশ অবদান রাখতে পারে অঞ্চলটি। এর মানে, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে যাচ্ছে এশিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাণিজ্যবিরোধী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবং আরও এশীয় দেশকে শুল্কারোপের লক্ষ্যে পরিণত করলে অঞ্চলটির দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে পক্ষান্তরে পুরো বিশ্বই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শনিবার, ২০ জুলাই ২০১৯ , ৫ শ্রাবন ১৪২৫, ১৬ জিলকদ ১৪৪০

এমন একটি সময় বাণিজ্যযুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে, যখন ১০ বছরের তুলনামূলক স্থিতিশীল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি আবার মন্থর হতে শুরু করেছে

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধে সংকটে এশিয়ার অর্থনীতি

-অর্থনীতিবিদ সং সেং উন

সংবাদ ডেস্ক

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘায়িত বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে এশিয়ার অর্থনীতিগুলোর ওপর মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধের ক্রমাগত আঘাত দ্রুত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিবিসি।

মালয়েশিয়ার বেসরকারি ব্যাংক সিআইএমবির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক অর্থনীতিবিদ সং সেং উন বলেন, পুরো এশিয়া অঞ্চলেই একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। এমন একটি সময় বাণিজ্যযুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে, যখন ১০ বছরের তুলনামূলক স্থিতিশীল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি আবার মন্থর হতে শুরু করেছে। এমনকি এ মুহূর্তে যদি কোন অলৌকিক ঘটনায় বাণিজ্যযুদ্ধ বন্ধও হয়ে যায়, তার পরও এরই মধ্যে যা ঘটছে, তার নেতিবাচক প্রভাব খুব একটা কম হবে না। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দুঃসংবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন এ তিন দেশের জন্য বিশেষভাবে হতাশাজনক ছিল। চলতি বছরের জুনে নয় মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ভারতের রপ্তানি ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পেতে দেখা গেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মাসে ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানিও ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দেশটির বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। এছাড়া গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি কমেছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

এ তিন দেশের প্রতিটিই পাম তেল ও রাসায়নিক থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিধির পণ্য চীনের কাছে বিক্রি করে থাকে। এদিকে জুন নিয়ে টানা দ্বিতীয় মাসের মতো রপ্তানিতে পতন দেখতে হয়েছে সিঙ্গাপুরকে। গত মাসে দেশটির রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি সপ্তাহে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন প্রায় তিন দশকের সর্বনিম্ন ত্রৈমাসিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। বাণিজ্যযুদ্ধ সংক্রান্ত উদ্বেগ আংশিকভাবে দেশটির প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা অর্ধেকের বেশি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর অর্থ, চীনা কোম্পানিগুলোকে ক্রেতাদের কাছে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হবে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পণ্য বিক্রি কমাতে হবে। এ ধরনের কোনো কিছুর অর্থ হলো, যেসব দেশ চীনা কারখানাগুলোর জন্য উপকরণ সরবরাহ করছে, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর শীঘ্রই এ পরিস্থিতির উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

এশীয় রপ্তানির ওপর চলতি সপ্তাহে জাপানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান নমুরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী মাসেও এ অঞ্চলের রপ্তানিতে গুমট অবস্থা বহাল থাকবে। এ অবস্থার জন্য চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতির ঘাটতিকে দায়ী করা হয়েছে। এটি বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তোলায় করপোরেট বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে পুরো অঞ্চলে বাণিজ্য সংরক্ষণবাদকে বৈদেশিক নীতিনির্ধারণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ কখন বা আদৌ সমাপ্ত হবে কিনা, তা এখনো পরিষ্কার নয়। অথবা এ বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘মুক্ত বাণিজ্য’ থেকে দূরে সরতে মার্কিন নীতির পরিবর্তনের শুরু হলো কিনা তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। যদিও এমনটাই ইঙ্গিত করেছে থিংক ট্যাংক ক্যাপিটাল ইকোনমিকস।

এরই মাধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভিয়েতনাম তার শুল্কারোপ তালিকার পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু বলে আভাস দিয়েছেন। উল্লেখ্য, বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির বাণিজ্যযুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপরও ট্রাম্প শুল্কারোপ করতে পারেন বলে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন। এদিকে বিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মের কোম্পানি ও ভোক্তাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এশিয়া। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক অর্থনীতির ৫২ শতাংশ অবদান রাখতে পারে অঞ্চলটি। এর মানে, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে যাচ্ছে এশিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত বাণিজ্যবিরোধী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবং আরও এশীয় দেশকে শুল্কারোপের লক্ষ্যে পরিণত করলে অঞ্চলটির দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে পক্ষান্তরে পুরো বিশ্বই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।