শহীদ দিবস পালন প্রচলনের ইতিবৃত্ত

এমএ বার্ণিক

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য উক্ত দিবসটিকে ‘শহীদ দিবস’ পালনের সর্বপ্রথম দাবি তুলেছিল তমদ্দুন মজলিস। ২৭-২৯ জানুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির এক জরুরি সভার দ্বিতীয় দিনে (২৮ জানুয়ারি ১৯৫৩) সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, তমদ্দুন মজলিস ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করবে। তাই তমদ্দুন মজলিস ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে জাগ্রত করে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি বছর উক্ত দিবসটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালনের জন্য সকল মহলের প্রতি দাবি জানায়। ‘২১ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক শহীদ দিবস পালনের আহ্বান পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ’ শিরোনামে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি নিম্নে প্রদত্ত হল-

বিগত ২৭ জানুয়ারি হতে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় দফতরে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি সভা হয়। বিগত ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের জন্য এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে আরও ব্যাপক ও জোরদার করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির সে দিনের বৈঠকে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শহীদ দিবস পালনের এক প্রস্তাবে বলা হয়-

পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির এই সভা আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এই দিবস যথাযথভাবে পালনের জন্য মজলিসের নিম্নতর কমিটিসমূহের প্রতি এতদ্বারা নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটি অন্যান্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি ঐক্যবদ্ধভাবে এই দিবস পালনে এগিয়ে আসার জন্য আবেদন জানাচ্ছে। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৫৩)।

অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেছেন, তিনি মনে করেছিলেন যে, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে রক্ত ঝরেছে, তাতে আপামর বাঙালি মানসকে আহত করে যে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়েছে, সেই ভাবাবেগকে সুদূর বাঙালি মানসে প্রবাহিত করা গেলে একুশের জন্য একটি যুগোত্তর মাতৃভাষাকেন্দ্রিক চেতনার জন্ম হতে পারে এবং সেই চিন্তা থেকেই তিনি ও তার সঙ্গীরা ঐ দিবসটিকে অমর করে রাখার জন্য ‘শহীদ দিবস’ পালনের একটি ধারা সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত হন। তমদ্দুন মজলিস সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ বছর তমদ্দুন মজলিসের নিজস্ব কর্মসূচি ছাড়াও রাজনৈতিক ফ্রন্ট খেলাফতে রাব্বানি পার্টিসহ সকল ফ্রন্ট থেকে পৃথক পৃথকভাবে শহীদ দিবসের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

অধ্যাপক কাসেম আরও বলেন, তমদ্দুন মজলিসের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে জানানো হলে তারাও বিষয়টি সমর্থন করেন। সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে একটি সমন্বিত কর্মসূচি গৃহীত হয়। অতঃপর ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দাবিতে ঐ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে দেশব্যাপী ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সংক্রান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবর নিম্নে প্রদত্ত হল-

‘৩ ফেব্রুয়ারি। গতকাল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, লীগ সরকারের কসাইবৃত্তির প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আটক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পরিপূর্ণ মর্যাদার সহিত দেশব্যাপী শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

কর্মসূচি : ২০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রোজা পালন ও জুম্মার নামাজে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা। ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট (হরতাল), ভোর ৫টায় প্রভাতফেরি, শহীদগণের কবরের উপর পুষ্পমাল্য দান, কালো ব্যাজ পরিধান, ঘরে ঘরে কালো পতাকা উত্তোলন এবং শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন, শোভাযাত্রা, বিকাল ৩ ঘটিকায় ছাত্র ও জনসভা। সমগ্র কর্মসূচি নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য প্রত্যেকটি পাক-নাগরিকের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩)।

তমদ্দুন মজলিস ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অবশেষে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এ সংক্রান্ত পত্রিকার খবর নিম্নরূপ-

‘ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারি সমাগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকা নগরীতে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আবেদনক্রমে ২০ তারিখে রোজা রাখা ও মসজিদে মসজিদে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা, ঘরে ঘরে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ পরিধান করা হয়। শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ... প্রত্যুষে প্রভাত ফেরি আজিমপুরে গোরস্থানে সমবেত হয়। শহীদদের সমাধি পুষ্পস্তবকে আচ্ছাদিত হয়ে যায় এবং শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। শহীদদের সমাধিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ, আওয়ামী লীগ, তমদ্দুন মজলিস, বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠান, হল ও কলেজ ইউনিয়ন, যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ হতে মাল্যদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল, ইকবাল হল, মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল, ছাত্রীনিবাসসমূহ এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভীর শোকের প্রতীক হিসেবে কালো পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ঐ সময়ে বেসরকারি বাসগৃহসমূহেও কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। অর্ধ লক্ষাধিক লোকের মিছিল রাজধানীর রাজপথ পরিভ্রমণকালে উফুল্ল অভিযাত্রীরা পুষ্পবৃষ্টি দ্বারা নাগরিকদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। শহীদদের সম্মানে ফজলুল হক হল, মেডিকেল কলেজ ও কামরুন্নেছা গার্লস স্কুলে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়।’ (সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩)।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ তারিখে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার প্রতিশ্রুতির একটি দফায় (১৮নং দফা) ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন এবং ঐদিন সরকারি ছুটি ঘোষণার পেছনে ২১ দফা রচনার সঙ্গে জড়িত আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেমের ভূমিকা ছিল। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলো বিশেষভাবে তমদ্দুন মজলিস ও তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্ট খেলাফতে রব্বানি পার্টি, নেজামে ইসলামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজ নিজ দলীয় অবস্থান থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের কিছুকাল পরেই ফ্রন্টের কৃষি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রী আবু হাসেন সরকার (রংপুর শাখা তমদ্দুন মজলিসের সাবেক নেতা এবং ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব) পরবর্তী বছর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছুটির দিন ঘোষণার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানান। এ সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতিবেদন নিম্নরূপ-

‘সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ কৃষি ও স্বাস্থ্য সচিব (মন্ত্রীকে তখন সচিব বলা হতো- গ্রন্থকার) জনাব আবু হোসেন সরকার গাইবান্ধার এক জনসভায় এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে ঘোষণা করেন যে, আগামী বছর হতে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা করবে বলে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিবেচনা করছে।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ মে ১৯৫৪)। কিন্তু ১৯৫৫ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে সরকারি ছুটি ঘোষণার আগেই হক সাহেবের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের অপসারণ ঘটে। অতঃপর সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিতে যাতে করে কোনরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করা না যায় সেজন্য এক আদেশ জারি করে। এ বিষয়ে ‘২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে সরকারের আতঙ্ক’ শিরোনামে সাপ্তাহিক সৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন নিম্নে উদ্ধৃত করা হল-

‘গত ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার পূর্ববঙ্গ সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি হতে পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি পূর্ববঙ্গের কোন মিছিল, জনসভা বা জমায়েত আহ্বান করতে কিংবা ওই জন্য কোন উদ্যোগ নিতে বা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে এবং তাতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। প্রেসনোটে এটাও বলা হয়েছে যে, ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় সরকার এটা করেছেন।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৭ম বর্ষ ১০ সংখ্যা, ২৭ জানুয়ারি ১৯৫৫)।

সরকারের উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রকাশিত হলে পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে পত্রিকার প্রতিবেদন নিম্নে প্রদত্ত হল- ‘প্রেসনোট বের হওয়ার পরের দিনই পাকিস্তান ছাত্র শক্তির (তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট) আহ্বায়ক ফরমান উল্লাহ খান, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মোমিন তালুকদার, তমদ্দুন মজলিসের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ হতে চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের ইব্রাহিম তাহা, পূর্ব-পাক ছাত্রলীগের সম্পাদক আবদুল আউয়াল এবং বিভিন্ন হলের ভিপিগণ ও অন্যান্য ছাত্র প্রতিনিধিবৃন্দ এ যুক্ত বিবৃতিতে প্রেস নোটের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির প্রতীক। আর এ দাবি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই স্বীকার করে লয়েছেন। এহেন একটি বিষয় নিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা অবান্তর ও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ...যুক্তফ্রন্ট অফিসে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদেও সভায় এক প্রস্তাবক্রমে শহীদ দিবস পালনের উপর হতে সর্বপ্রকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানানা হয়। সভায় আওয়ামী লীগ, রব্বানি পার্টি (তমদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্ট), কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান ছাত্রশক্তি (তমদ্দুন মজলিস ছাত্র ফ্রন্ট), কর্মশিবির এবং অন্যান্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

‘শহীদ দিবস পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় পূর্ববঙ্গ সরকারের শহীদ দিবস সম্পর্কিত প্রেসনোট জনগণকে তাদের শোক প্রকাশের অধিকার হতে বঞ্চিত করেছে’ শিরোনামে এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়-

‘সরকারের এ ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যমূলক মনোভাবের স্বরূপ লোকচক্ষুর সামনে উদ্ঘাটন করে দিতে হবে। ... হুকুমনামার দু’তিন দিনের মধ্যেই ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহীদ দিবস উদযাপনের যে কোন প্রচেষ্টাকে এমনকি শহীদ দিবস উদযাপনের জন্য কমিটি গঠন এবং কালো ব্যাজ পরিধানের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। শহীদ দিবস পালনের জন্য যারা সামান্যতম চেষ্টা করবেন, তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে, এরকম ভীতিপ্রদর্শনও সরকার প্রকাশ্যেই করেছেন। ... শোক প্রকাশের অধিকার নেহায়েত প্রাথমিক ব্যক্তিগত অধিকার; কালো ব্যাজ পরিধানের অধিকার হতে পাকিস্তানের নাগরিকদিগকে বঞ্চিত করে পূর্ববঙ্গ সরকার পাকিস্তানের ইতিহাসে যে কলংকময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করলেন, তার সত্যিই তুলনা নেই। ...যে লীগ মন্ত্রিসভাকে আমরা শতকণ্ঠে নিন্দা করেছি, তাদের আমলে তো তবু শান্তিপূর্ণভাবে ‘শহীদ দিবস উদযাপনের ন্যূনতম অধিকার আমরা পেয়েছিলাম, কিন্তু গণতন্ত্রের নামে একাহারা আমাদের মাথার উপরে চেপে যারা আমাদের ভাইদের মৃত্যুতে শাক প্রকাশের অধিকার হতেও আমাদিগকে বঞ্চিত করছে? ...এরা কি মনে করেন বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে চিরদিন জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও ন্যায্য দাবি-দাওয়াকে চেপে রাখা সম্ভব হবে?

...অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির প্রতীক হল ‘শহীদ দিবস’। জনগণের সংগ্রামের মুখে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় উভয় সরকারই এ দাবির যৌক্তিকতা একাধিকবার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। ...গত দু’বছর শহীদ দিবসে শত উত্তেজনার মুখেও জনগণ কিভাবে শান্তি রক্ষা করেছে তা সরকার জানেন। এটা ছিল মূল লক্ষ্য সমাধানে জনগণের অটল ধৈর্যেরই পরিচায়ক। কিন্তু যে কোন উস্কানিমূলক দমননীতির মুখেও শান্তিরক্ষার নাকেখৎ কোন সরকারই জনগণের কাছে আশা করতে পারেন না ...।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সমাবেত হলে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ তারিখে পুলিশ তাদের উপর চড়াও হয় এবং লাঠিচার্জ করে ১৫/২০ জন ছাত্রছাত্রীকে আহত করে। পুলিশ প্রায় ৩০০ জন ছাত্রছাত্রীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট পাকিস্তান ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফরমান উল্লাহ খান, এসএম হলের সমাজ সেবা সম্পাদক শরিফ উল্লাহ হারুন, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের সভাপতি ইব্রাহিম তাহা (‘ল’ অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক), জগন্নাথ কলেজ ছাত্রশক্তির সভাপতি ও উক্ত কলেজের জিএস মো. শাহজাহান, মেডিকেল কলেজ ছাত্রশক্তি নেতা এসএম হারুন, ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) ভিপি ইকরামুল হক প্রমুখ। তাছাড়া বিভিন্ন হল ও ছাত্রাবাসে কালো পতাকা তালা হলে পুলিশ তা নামিয়ে ফেলে। শোক প্রকাশের জন্য যারা কালো ব্যাজ পরেছেন পুলিশ সে ব্যাজ খুলে ফেলে, কিন্তু যারা খুলতে অস্বীকার করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এ বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

শহীদ দিবস পালনে পুলিশের বাধা ও নিরপরাধ গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট এবং ঢাকা শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয় (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ মার্চ, ১৯৫৫)। শহীদ দিবসে ক্লাসে যোগদান না করায় ঢাকা ভেটেরিনারি কলেজের ৬ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয় এবং নটরডেম কলেজ হতে খুরশিদ ওয়াদুদ ও রাশেদ মওদুদ খান নামক দু’জন ছাত্রকে বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে কলেজের প্রিন্সিপাল কর্তৃক তাদের পার্সেন্টেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনে সরকারি বাধা এবং ঢাকায় ছাত্রদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফেণীতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। উক্ত ধর্মঘট চলাকালীন শহীদ দিবস পালনে সরকারের বাধা দান, ছাত্রদের ওপর নগ্ন হামলার প্রতিবাদে ফেনীতে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এসব কাজে নেতৃত্ব দানের অপরাধে ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের সম্পাদক ও ছাত্রশক্তির নেতা মোস্তফা আবদুল হাই আল আজাদ, হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও ছাত্রশক্তি সদস্য মো. ফয়েজ উল্লাহ এবং ৫/৬ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

শহীদ দিবসে শোভাযাত্রা বের করার অপরাধে বরিশালে শতাধিক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। মুন্সীগঞ্জে শহীদ দিবস পালনে পুলিশ বাধা দেয়। ছাত্ররা শহীদ মিনার নির্মাণ করলে এবং কালো পতাকা উত্তোলন করলে পুলিশ তা অপসারণ করে ফেলে। অতঃপর একটি শান্তিপূর্ণ ছাত্রসমাবেশ থেকে পুলিশ ৩০ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রশক্তির মুন্সীগঞ্জ শাখার সম্পাদক জহিরুল ইসলাম, মমিন উদ্দীন, আলতাফ হাসেন, মাসুদুর রহমান (ছাত্রশক্তি), আলামিন আহমদ, তানজের আলী, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন (প্রাক্তন জিএস), আবদুন নূর, আবদুল বাতেন প্রভৃতি। পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

অবশেষে ২১ মার্চ ১৯৫৫ তারিখে শহীদ দিবসে ধৃত ছাত্রদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হয়। কেবল ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ঐদিন ১৪১ জন ছাত্র মুক্তি লাভ করে। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৪ মার্চ, ১৯৫৫)। মুক্তি প্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফরমান উল্লাহ খান, ছাত্রশক্তির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফ আবদুল্লাহ হারুন, বিশ্ববিদ্যালয় ‘ল’ অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ইব্রাহিম তাহা (ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ), ছাত্রলীগের আবদুল মমিন তালুকদার ও আবদুল আউয়াল, ফজলুল হক হলের ভিপি মনসুর আলী, ইকবাল হলের ভিপি ইকরামুল হক, জগন্নাথ কলেজের ভিপি ইউসুফ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশক্তি নেতা মোমিনুল হক, মেডিকেল কলেজ ছাত্রশক্তি নেতা এসএম হারুন প্রভৃতি। (সূত্র : সাপ্তহিক সৈনিক, ২৪ মার্চ ১৯৫৫)।

১৯৫৫ সালের ৪ এপ্রিল মুক্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের সম্মানে তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রশক্তির উদ্যোগে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে এক সংবর্ধনা সভার আয়াজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নিরোদ বিহারী নাগ। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৭ এপ্রিল ১৯৫৫)।

এভাবে সরকার দমননীতির মাধ্যমে শহীদ দিবস পালনে জনগণকে বিরত রাখার প্রয়াস পেলেও কিন্তু যে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। অতঃপর আবু হাসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার (৬ জুন ১৯৫৫ তারিখে গঠিত) নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু শহীদ দিবস হিসেবে তা উল্লেখ না থাকায় এ ব্যাপারে ভাষা-আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক গর্জে ওঠে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেবল ছুটির দিন নয় ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করতে হবে শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ সরকার একুশে ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন সত্য, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, ঘোষণার কোথাও উক্ত দিবসকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ স্মৃতি দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করতে হবে এটা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের দ্ব্যর্থহীন দাবি। তা না করে কেবল মাত্র ‘ছুটি দিবস’ হিসেবে ঘোষণার পেছনে সরকারের কোন গোপন অভিসন্ধি আছে বলে আশঙ্কা করা অন্যায় নহে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই যে, ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা না করে কেবল মাত্র ‘ছুটির দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার অর্থ পরোক্ষভাবে শহীদদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করা। অতএব, আমাদের দাবি উক্ত দিবসকে ‘শহীদ দিবস’ বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে জাতীয় ছুটির দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, শহীদ দিবস সংখ্যা, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬)।

একই সময় তমদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্ট খেলাফতে রব্বানি পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল গফুর এক বিবৃতিতে শহীদ দিবসকে স্থায়ীভাবে বাৎসরিক ছুটির তালিকাভুক্ত করার দাবি জানান। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬)। এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা শহীদ দিবসের মধ্যে প্রবাহিত হয়।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র বাতিল করে সামরিক আইন জারি করা হলে ‘শহীদ দিবস উদযাপনে সমস্যা দেখা দেয়। কারণ সামরিক শাসনে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। অপরদিকে সামরিক আইনের কারণে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছুটি পালনের বিষয়টি অবাস্তবায়িত থাকে। ১৯৬০ সালে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শহীদ দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটি ঘোষণার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (সূত্র : The Pakistan Observer, 17 February 1959)। পরে সরকারি চাপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ খবরের প্রতিবাদ করে জানায় যে, সে দিবসটি রোববার হওয়ার কারণে ছুটি পালনের প্রয়োজনীয়তা নেই। (সূত্র : The Pakistan Observer, 23 February 1960)। ১৯৬২ সালে পুনরায় শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হলে সে বছর থেকে শহীদ দিবস পালনের ওপর পূর্বারোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় (সূত্র : পূর্ব পাকিস্তান সরকার, শিক্ষা বিভাগ শাখা নং ৩, সার্কুলার নং ৪২২, শিক্ষা তারিখ ২৭ মার্চ ১৯৬২)। এভাবে শহীদ দিবস সরকারিভাবে স্বীকৃত হয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বাঙালি মানসে একটি প্রেরণা। আমাদের আত্মপরিচয় ও আত্মোপলব্ধির জন্য প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি নতুন বার্তা নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়। বাংলাদেশি বাঙালিরা কারও কাছে মাথা নত করে নাÑ এ চেতনায় আমরা আত্মসচেতন হওয়ার সুযোগ পাই এই শহীদ দিবসকে ঘিরে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদেরা আমাদের জাতীয় বীর (যদিও সরকারিভাবে আজও তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া হয়নি; যতদিন এ দাবি বাস্তবায়ন না হবে ততদিন এটি বাঙালিদের প্রাণের দাবিরূপে জাগরুক থাকবেÑ লেখক)। তারা আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের যুগ যুগ ধরে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়ার পথ তৈরি করে গেছেন। তাই শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্তটি কেবল একটি দিবস পালনের লক্ষ্য নিয়েই করা হয়নি, ভাষা-আন্দোলনের চেতনা অনন্তকাল ধরে বাঙালি মানসে জাগরুক রাখার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গৃহীত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন যে আমাদের একটি গর্ব এবং এ গর্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ও জাতির জন্ম হয়েছিল, তা প্রতি বছর শহীদ দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় দিবসের মর্যাদা প্রদান করা হয়। এ দিবসে সরকারিভাবে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশি দুজন কৃতীসন্তান রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের নানামুখী প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বাঙালিদের মাতৃভাষাপ্রীতির স্মরণীয় দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক পরিম-লে স্মরণীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত টঘঊঝঈঙ-এর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে আমাদের গর্বের ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ভাষা আন্দোলনের গর্বগাথা অমর একুশে আজ আর আমাদের বাংলাভাষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রতীক ও প্রেরণা হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃত ও সমাদৃত হয়েছে। অমর একুশের শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমা আজ বিশ্বের প্রতিটি জাতির কাছে স্ব স্ব ভাষাভাষীদের ভাষাপ্রেমের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বাঙালিরা বিশ্বের দরবারে এজন্য একটি গৌরবের আসনে সমাসীন।

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ একাকার হয়ে গেছে। বিশ্ববাসী আমাদের শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আমাদের ভাষাশহীদদের প্রতিই কেবল সম্মান প্রদর্শন করছে না, বাংলাভাষীদের মাতৃভাষাপ্রীতির অনুপ্রেরণায় নিজেরাও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। বাঙালিদের মাতৃভাষা চেতনা সমগ্র বিশ্ববাসীর মাতৃভাষা চেতনাকে আলোড়িত করে বাংলা ভাষার জন্য একটি কালোত্তীর্ণ গৌরবের আসন তৈরি করে দিয়েছে অমর একুশে। একুশ বাংলাদেশি মানুষের গর্ব, একুশ বাঙালির গর্ব, একুশ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষা প্রেমের নিদর্শন হিসেবে চিরকাল মর্যাদাম-িত হয়ে থাকবে।

[লেখক : ভাষা আন্দোলন গবেষক এবং সভাপতি ইতিহাস গবেষণা সংসদ]

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৯ ফল্গুন ১৪২৬, ২৭ জমাদিউল সানি ১৪৪১

শহীদ দিবস পালন প্রচলনের ইতিবৃত্ত

এমএ বার্ণিক

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য উক্ত দিবসটিকে ‘শহীদ দিবস’ পালনের সর্বপ্রথম দাবি তুলেছিল তমদ্দুন মজলিস। ২৭-২৯ জানুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির এক জরুরি সভার দ্বিতীয় দিনে (২৮ জানুয়ারি ১৯৫৩) সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, তমদ্দুন মজলিস ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করবে। তাই তমদ্দুন মজলিস ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে জাগ্রত করে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি বছর উক্ত দিবসটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালনের জন্য সকল মহলের প্রতি দাবি জানায়। ‘২১ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক শহীদ দিবস পালনের আহ্বান পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ’ শিরোনামে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি নিম্নে প্রদত্ত হল-

বিগত ২৭ জানুয়ারি হতে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় দফতরে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি সভা হয়। বিগত ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের জন্য এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে আরও ব্যাপক ও জোরদার করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির সে দিনের বৈঠকে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শহীদ দিবস পালনের এক প্রস্তাবে বলা হয়-

পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটির এই সভা আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এই দিবস যথাযথভাবে পালনের জন্য মজলিসের নিম্নতর কমিটিসমূহের প্রতি এতদ্বারা নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটি অন্যান্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি ঐক্যবদ্ধভাবে এই দিবস পালনে এগিয়ে আসার জন্য আবেদন জানাচ্ছে। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৫৩)।

অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেছেন, তিনি মনে করেছিলেন যে, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারিতে যে রক্ত ঝরেছে, তাতে আপামর বাঙালি মানসকে আহত করে যে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়েছে, সেই ভাবাবেগকে সুদূর বাঙালি মানসে প্রবাহিত করা গেলে একুশের জন্য একটি যুগোত্তর মাতৃভাষাকেন্দ্রিক চেতনার জন্ম হতে পারে এবং সেই চিন্তা থেকেই তিনি ও তার সঙ্গীরা ঐ দিবসটিকে অমর করে রাখার জন্য ‘শহীদ দিবস’ পালনের একটি ধারা সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত হন। তমদ্দুন মজলিস সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ বছর তমদ্দুন মজলিসের নিজস্ব কর্মসূচি ছাড়াও রাজনৈতিক ফ্রন্ট খেলাফতে রাব্বানি পার্টিসহ সকল ফ্রন্ট থেকে পৃথক পৃথকভাবে শহীদ দিবসের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

অধ্যাপক কাসেম আরও বলেন, তমদ্দুন মজলিসের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে জানানো হলে তারাও বিষয়টি সমর্থন করেন। সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে একটি সমন্বিত কর্মসূচি গৃহীত হয়। অতঃপর ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দাবিতে ঐ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে দেশব্যাপী ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সংক্রান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবর নিম্নে প্রদত্ত হল-

‘৩ ফেব্রুয়ারি। গতকাল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, লীগ সরকারের কসাইবৃত্তির প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আটক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পরিপূর্ণ মর্যাদার সহিত দেশব্যাপী শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

কর্মসূচি : ২০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রোজা পালন ও জুম্মার নামাজে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা। ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট (হরতাল), ভোর ৫টায় প্রভাতফেরি, শহীদগণের কবরের উপর পুষ্পমাল্য দান, কালো ব্যাজ পরিধান, ঘরে ঘরে কালো পতাকা উত্তোলন এবং শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন, শোভাযাত্রা, বিকাল ৩ ঘটিকায় ছাত্র ও জনসভা। সমগ্র কর্মসূচি নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য প্রত্যেকটি পাক-নাগরিকের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩)।

তমদ্দুন মজলিস ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অবশেষে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এ সংক্রান্ত পত্রিকার খবর নিম্নরূপ-

‘ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারি সমাগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকা নগরীতে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আবেদনক্রমে ২০ তারিখে রোজা রাখা ও মসজিদে মসজিদে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা, ঘরে ঘরে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ পরিধান করা হয়। শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ... প্রত্যুষে প্রভাত ফেরি আজিমপুরে গোরস্থানে সমবেত হয়। শহীদদের সমাধি পুষ্পস্তবকে আচ্ছাদিত হয়ে যায় এবং শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। শহীদদের সমাধিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ, আওয়ামী লীগ, তমদ্দুন মজলিস, বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠান, হল ও কলেজ ইউনিয়ন, যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ হতে মাল্যদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল, ইকবাল হল, মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল, ছাত্রীনিবাসসমূহ এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভীর শোকের প্রতীক হিসেবে কালো পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ঐ সময়ে বেসরকারি বাসগৃহসমূহেও কালো পতাকা উত্তোলিত হয়। অর্ধ লক্ষাধিক লোকের মিছিল রাজধানীর রাজপথ পরিভ্রমণকালে উফুল্ল অভিযাত্রীরা পুষ্পবৃষ্টি দ্বারা নাগরিকদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। শহীদদের সম্মানে ফজলুল হক হল, মেডিকেল কলেজ ও কামরুন্নেছা গার্লস স্কুলে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়।’ (সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩)।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ তারিখে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার প্রতিশ্রুতির একটি দফায় (১৮নং দফা) ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন এবং ঐদিন সরকারি ছুটি ঘোষণার পেছনে ২১ দফা রচনার সঙ্গে জড়িত আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেমের ভূমিকা ছিল। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলো বিশেষভাবে তমদ্দুন মজলিস ও তাদের রাজনৈতিক ফ্রন্ট খেলাফতে রব্বানি পার্টি, নেজামে ইসলামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজ নিজ দলীয় অবস্থান থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের কিছুকাল পরেই ফ্রন্টের কৃষি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রী আবু হাসেন সরকার (রংপুর শাখা তমদ্দুন মজলিসের সাবেক নেতা এবং ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব) পরবর্তী বছর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছুটির দিন ঘোষণার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানান। এ সংক্রান্ত পত্রিকার প্রতিবেদন নিম্নরূপ-

‘সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ কৃষি ও স্বাস্থ্য সচিব (মন্ত্রীকে তখন সচিব বলা হতো- গ্রন্থকার) জনাব আবু হোসেন সরকার গাইবান্ধার এক জনসভায় এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে ঘোষণা করেন যে, আগামী বছর হতে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা করবে বলে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিবেচনা করছে।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ মে ১৯৫৪)। কিন্তু ১৯৫৫ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে সরকারি ছুটি ঘোষণার আগেই হক সাহেবের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের অপসারণ ঘটে। অতঃপর সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিতে যাতে করে কোনরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করা না যায় সেজন্য এক আদেশ জারি করে। এ বিষয়ে ‘২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে সরকারের আতঙ্ক’ শিরোনামে সাপ্তাহিক সৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন নিম্নে উদ্ধৃত করা হল-

‘গত ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার পূর্ববঙ্গ সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি হতে পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি পূর্ববঙ্গের কোন মিছিল, জনসভা বা জমায়েত আহ্বান করতে কিংবা ওই জন্য কোন উদ্যোগ নিতে বা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে এবং তাতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। প্রেসনোটে এটাও বলা হয়েছে যে, ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় সরকার এটা করেছেন।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৭ম বর্ষ ১০ সংখ্যা, ২৭ জানুয়ারি ১৯৫৫)।

সরকারের উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রকাশিত হলে পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে পত্রিকার প্রতিবেদন নিম্নে প্রদত্ত হল- ‘প্রেসনোট বের হওয়ার পরের দিনই পাকিস্তান ছাত্র শক্তির (তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট) আহ্বায়ক ফরমান উল্লাহ খান, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মোমিন তালুকদার, তমদ্দুন মজলিসের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ হতে চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের ইব্রাহিম তাহা, পূর্ব-পাক ছাত্রলীগের সম্পাদক আবদুল আউয়াল এবং বিভিন্ন হলের ভিপিগণ ও অন্যান্য ছাত্র প্রতিনিধিবৃন্দ এ যুক্ত বিবৃতিতে প্রেস নোটের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির প্রতীক। আর এ দাবি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই স্বীকার করে লয়েছেন। এহেন একটি বিষয় নিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা অবান্তর ও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ...যুক্তফ্রন্ট অফিসে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদেও সভায় এক প্রস্তাবক্রমে শহীদ দিবস পালনের উপর হতে সর্বপ্রকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানানা হয়। সভায় আওয়ামী লীগ, রব্বানি পার্টি (তমদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্ট), কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান ছাত্রশক্তি (তমদ্দুন মজলিস ছাত্র ফ্রন্ট), কর্মশিবির এবং অন্যান্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

‘শহীদ দিবস পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় পূর্ববঙ্গ সরকারের শহীদ দিবস সম্পর্কিত প্রেসনোট জনগণকে তাদের শোক প্রকাশের অধিকার হতে বঞ্চিত করেছে’ শিরোনামে এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়-

‘সরকারের এ ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যমূলক মনোভাবের স্বরূপ লোকচক্ষুর সামনে উদ্ঘাটন করে দিতে হবে। ... হুকুমনামার দু’তিন দিনের মধ্যেই ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহীদ দিবস উদযাপনের যে কোন প্রচেষ্টাকে এমনকি শহীদ দিবস উদযাপনের জন্য কমিটি গঠন এবং কালো ব্যাজ পরিধানের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। শহীদ দিবস পালনের জন্য যারা সামান্যতম চেষ্টা করবেন, তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে, এরকম ভীতিপ্রদর্শনও সরকার প্রকাশ্যেই করেছেন। ... শোক প্রকাশের অধিকার নেহায়েত প্রাথমিক ব্যক্তিগত অধিকার; কালো ব্যাজ পরিধানের অধিকার হতে পাকিস্তানের নাগরিকদিগকে বঞ্চিত করে পূর্ববঙ্গ সরকার পাকিস্তানের ইতিহাসে যে কলংকময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করলেন, তার সত্যিই তুলনা নেই। ...যে লীগ মন্ত্রিসভাকে আমরা শতকণ্ঠে নিন্দা করেছি, তাদের আমলে তো তবু শান্তিপূর্ণভাবে ‘শহীদ দিবস উদযাপনের ন্যূনতম অধিকার আমরা পেয়েছিলাম, কিন্তু গণতন্ত্রের নামে একাহারা আমাদের মাথার উপরে চেপে যারা আমাদের ভাইদের মৃত্যুতে শাক প্রকাশের অধিকার হতেও আমাদিগকে বঞ্চিত করছে? ...এরা কি মনে করেন বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে চিরদিন জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও ন্যায্য দাবি-দাওয়াকে চেপে রাখা সম্ভব হবে?

...অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির প্রতীক হল ‘শহীদ দিবস’। জনগণের সংগ্রামের মুখে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় উভয় সরকারই এ দাবির যৌক্তিকতা একাধিকবার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। ...গত দু’বছর শহীদ দিবসে শত উত্তেজনার মুখেও জনগণ কিভাবে শান্তি রক্ষা করেছে তা সরকার জানেন। এটা ছিল মূল লক্ষ্য সমাধানে জনগণের অটল ধৈর্যেরই পরিচায়ক। কিন্তু যে কোন উস্কানিমূলক দমননীতির মুখেও শান্তিরক্ষার নাকেখৎ কোন সরকারই জনগণের কাছে আশা করতে পারেন না ...।’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সমাবেত হলে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ তারিখে পুলিশ তাদের উপর চড়াও হয় এবং লাঠিচার্জ করে ১৫/২০ জন ছাত্রছাত্রীকে আহত করে। পুলিশ প্রায় ৩০০ জন ছাত্রছাত্রীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট পাকিস্তান ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফরমান উল্লাহ খান, এসএম হলের সমাজ সেবা সম্পাদক শরিফ উল্লাহ হারুন, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের সভাপতি ইব্রাহিম তাহা (‘ল’ অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক), জগন্নাথ কলেজ ছাত্রশক্তির সভাপতি ও উক্ত কলেজের জিএস মো. শাহজাহান, মেডিকেল কলেজ ছাত্রশক্তি নেতা এসএম হারুন, ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) ভিপি ইকরামুল হক প্রমুখ। তাছাড়া বিভিন্ন হল ও ছাত্রাবাসে কালো পতাকা তালা হলে পুলিশ তা নামিয়ে ফেলে। শোক প্রকাশের জন্য যারা কালো ব্যাজ পরেছেন পুলিশ সে ব্যাজ খুলে ফেলে, কিন্তু যারা খুলতে অস্বীকার করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এ বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

শহীদ দিবস পালনে পুলিশের বাধা ও নিরপরাধ গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট এবং ঢাকা শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয় (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ মার্চ, ১৯৫৫)। শহীদ দিবসে ক্লাসে যোগদান না করায় ঢাকা ভেটেরিনারি কলেজের ৬ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয় এবং নটরডেম কলেজ হতে খুরশিদ ওয়াদুদ ও রাশেদ মওদুদ খান নামক দু’জন ছাত্রকে বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে কলেজের প্রিন্সিপাল কর্তৃক তাদের পার্সেন্টেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনে সরকারি বাধা এবং ঢাকায় ছাত্রদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফেণীতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। উক্ত ধর্মঘট চলাকালীন শহীদ দিবস পালনে সরকারের বাধা দান, ছাত্রদের ওপর নগ্ন হামলার প্রতিবাদে ফেনীতে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এসব কাজে নেতৃত্ব দানের অপরাধে ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের সম্পাদক ও ছাত্রশক্তির নেতা মোস্তফা আবদুল হাই আল আজাদ, হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও ছাত্রশক্তি সদস্য মো. ফয়েজ উল্লাহ এবং ৫/৬ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

শহীদ দিবসে শোভাযাত্রা বের করার অপরাধে বরিশালে শতাধিক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। মুন্সীগঞ্জে শহীদ দিবস পালনে পুলিশ বাধা দেয়। ছাত্ররা শহীদ মিনার নির্মাণ করলে এবং কালো পতাকা উত্তোলন করলে পুলিশ তা অপসারণ করে ফেলে। অতঃপর একটি শান্তিপূর্ণ ছাত্রসমাবেশ থেকে পুলিশ ৩০ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রশক্তির মুন্সীগঞ্জ শাখার সম্পাদক জহিরুল ইসলাম, মমিন উদ্দীন, আলতাফ হাসেন, মাসুদুর রহমান (ছাত্রশক্তি), আলামিন আহমদ, তানজের আলী, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন (প্রাক্তন জিএস), আবদুন নূর, আবদুল বাতেন প্রভৃতি। পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫)।

অবশেষে ২১ মার্চ ১৯৫৫ তারিখে শহীদ দিবসে ধৃত ছাত্রদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হয়। কেবল ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ঐদিন ১৪১ জন ছাত্র মুক্তি লাভ করে। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৪ মার্চ, ১৯৫৫)। মুক্তি প্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফরমান উল্লাহ খান, ছাত্রশক্তির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফ আবদুল্লাহ হারুন, বিশ্ববিদ্যালয় ‘ল’ অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ইব্রাহিম তাহা (ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ), ছাত্রলীগের আবদুল মমিন তালুকদার ও আবদুল আউয়াল, ফজলুল হক হলের ভিপি মনসুর আলী, ইকবাল হলের ভিপি ইকরামুল হক, জগন্নাথ কলেজের ভিপি ইউসুফ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশক্তি নেতা মোমিনুল হক, মেডিকেল কলেজ ছাত্রশক্তি নেতা এসএম হারুন প্রভৃতি। (সূত্র : সাপ্তহিক সৈনিক, ২৪ মার্চ ১৯৫৫)।

১৯৫৫ সালের ৪ এপ্রিল মুক্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের সম্মানে তমদ্দুন মজলিসের ছাত্রফ্রন্ট ছাত্রশক্তির উদ্যোগে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে এক সংবর্ধনা সভার আয়াজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নিরোদ বিহারী নাগ। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ৭ এপ্রিল ১৯৫৫)।

এভাবে সরকার দমননীতির মাধ্যমে শহীদ দিবস পালনে জনগণকে বিরত রাখার প্রয়াস পেলেও কিন্তু যে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। অতঃপর আবু হাসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার (৬ জুন ১৯৫৫ তারিখে গঠিত) নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু শহীদ দিবস হিসেবে তা উল্লেখ না থাকায় এ ব্যাপারে ভাষা-আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক গর্জে ওঠে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেবল ছুটির দিন নয় ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করতে হবে শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ সরকার একুশে ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন সত্য, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, ঘোষণার কোথাও উক্ত দিবসকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ স্মৃতি দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করতে হবে এটা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের দ্ব্যর্থহীন দাবি। তা না করে কেবল মাত্র ‘ছুটি দিবস’ হিসেবে ঘোষণার পেছনে সরকারের কোন গোপন অভিসন্ধি আছে বলে আশঙ্কা করা অন্যায় নহে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই যে, ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা না করে কেবল মাত্র ‘ছুটির দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার অর্থ পরোক্ষভাবে শহীদদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করা। অতএব, আমাদের দাবি উক্ত দিবসকে ‘শহীদ দিবস’ বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে জাতীয় ছুটির দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, শহীদ দিবস সংখ্যা, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬)।

একই সময় তমদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্ট খেলাফতে রব্বানি পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল গফুর এক বিবৃতিতে শহীদ দিবসকে স্থায়ীভাবে বাৎসরিক ছুটির তালিকাভুক্ত করার দাবি জানান। (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬)। এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা শহীদ দিবসের মধ্যে প্রবাহিত হয়।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র বাতিল করে সামরিক আইন জারি করা হলে ‘শহীদ দিবস উদযাপনে সমস্যা দেখা দেয়। কারণ সামরিক শাসনে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। অপরদিকে সামরিক আইনের কারণে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছুটি পালনের বিষয়টি অবাস্তবায়িত থাকে। ১৯৬০ সালে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শহীদ দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটি ঘোষণার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (সূত্র : The Pakistan Observer, 17 February 1959)। পরে সরকারি চাপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ খবরের প্রতিবাদ করে জানায় যে, সে দিবসটি রোববার হওয়ার কারণে ছুটি পালনের প্রয়োজনীয়তা নেই। (সূত্র : The Pakistan Observer, 23 February 1960)। ১৯৬২ সালে পুনরায় শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হলে সে বছর থেকে শহীদ দিবস পালনের ওপর পূর্বারোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় (সূত্র : পূর্ব পাকিস্তান সরকার, শিক্ষা বিভাগ শাখা নং ৩, সার্কুলার নং ৪২২, শিক্ষা তারিখ ২৭ মার্চ ১৯৬২)। এভাবে শহীদ দিবস সরকারিভাবে স্বীকৃত হয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বাঙালি মানসে একটি প্রেরণা। আমাদের আত্মপরিচয় ও আত্মোপলব্ধির জন্য প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি নতুন বার্তা নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়। বাংলাদেশি বাঙালিরা কারও কাছে মাথা নত করে নাÑ এ চেতনায় আমরা আত্মসচেতন হওয়ার সুযোগ পাই এই শহীদ দিবসকে ঘিরে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদেরা আমাদের জাতীয় বীর (যদিও সরকারিভাবে আজও তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া হয়নি; যতদিন এ দাবি বাস্তবায়ন না হবে ততদিন এটি বাঙালিদের প্রাণের দাবিরূপে জাগরুক থাকবেÑ লেখক)। তারা আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের যুগ যুগ ধরে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়ার পথ তৈরি করে গেছেন। তাই শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্তটি কেবল একটি দিবস পালনের লক্ষ্য নিয়েই করা হয়নি, ভাষা-আন্দোলনের চেতনা অনন্তকাল ধরে বাঙালি মানসে জাগরুক রাখার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গৃহীত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন যে আমাদের একটি গর্ব এবং এ গর্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ও জাতির জন্ম হয়েছিল, তা প্রতি বছর শহীদ দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় দিবসের মর্যাদা প্রদান করা হয়। এ দিবসে সরকারিভাবে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশি দুজন কৃতীসন্তান রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের নানামুখী প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বাঙালিদের মাতৃভাষাপ্রীতির স্মরণীয় দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক পরিম-লে স্মরণীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত টঘঊঝঈঙ-এর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে আমাদের গর্বের ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ভাষা আন্দোলনের গর্বগাথা অমর একুশে আজ আর আমাদের বাংলাভাষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রতীক ও প্রেরণা হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃত ও সমাদৃত হয়েছে। অমর একুশের শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমা আজ বিশ্বের প্রতিটি জাতির কাছে স্ব স্ব ভাষাভাষীদের ভাষাপ্রেমের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বাঙালিরা বিশ্বের দরবারে এজন্য একটি গৌরবের আসনে সমাসীন।

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ একাকার হয়ে গেছে। বিশ্ববাসী আমাদের শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আমাদের ভাষাশহীদদের প্রতিই কেবল সম্মান প্রদর্শন করছে না, বাংলাভাষীদের মাতৃভাষাপ্রীতির অনুপ্রেরণায় নিজেরাও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। বাঙালিদের মাতৃভাষা চেতনা সমগ্র বিশ্ববাসীর মাতৃভাষা চেতনাকে আলোড়িত করে বাংলা ভাষার জন্য একটি কালোত্তীর্ণ গৌরবের আসন তৈরি করে দিয়েছে অমর একুশে। একুশ বাংলাদেশি মানুষের গর্ব, একুশ বাঙালির গর্ব, একুশ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষা প্রেমের নিদর্শন হিসেবে চিরকাল মর্যাদাম-িত হয়ে থাকবে।

[লেখক : ভাষা আন্দোলন গবেষক এবং সভাপতি ইতিহাস গবেষণা সংসদ]