মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

২১ ফেব্রুয়ারি

টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোমবার এখানে বলেন যে, উপমহাদেশের স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের পত্তন হয়েছিল আজও তার সমাপ্তি ঘটেনি। ষড়যন্ত্রকারীরা চুপ করে বসে নেই বলে প্রকাশ করে তিনি বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী কুচক্রিরা আজও আমাদের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহীদ দিবস উপলক্ষে টেলিভিশন সাক্ষৎকারে তিনি উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধুর পুরাতন বন্ধু বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব কে জি মোস্তফা এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বাঙালিদের বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদীদলের চক্রান্তের ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস পর্যালোচনা করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বাঙালিকে চুষে যাবে, সেটা ১৯৪৭ সালেই টের পাওয়া গিয়েছিল। বাংলা ভাষা আন্দোলনের “১৯৫২ সালের স্মৃতি” শীর্ষে আয়োজিত এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, পাকিস্তানের স্রষ্টা জনাব জিন্নার বাঙালিদের প্রতি কোনো দরদ ছিল না, তিনি বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তার ব্যবসায়ী সমাজের একটি উপনিবেশ করতে চেয়েছিলেন।

শেখ মুজিব বলেন যে, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জনাব জিন্না একদিনের জন্যও বাংলার মানুষের অবস্থা দেখতে বংলায় পদার্পণ করেন নি। শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তান হবার পরে পরেই শোষণকারীরা এবং তাদের অনুচররা ঢাকায় এক সাম্প্রদায়িক গোলমাল ঘটালো এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য চেষ্টা করলো। উদ্দেশ্যটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল এবং তা হলো বাঙালিদের নির্মূল করা। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা আমাদের ভাষা ও কৃষ্টির ওপর হামলা চালানোর জন্যে তাদের প্রশাসনকে নির্দেশ দিলো। আমরা জানতাম, এখনই এবং এখানেই ষড়যন্ত্রকারীদের রুখতে হবে, তা না হলে আমাদের জাতির ইতিহাস অন্ধকার হয়ে যাবে। প্রথম গণপরিষদে শ্রী ধীরেন দত্ত যখন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে বাংলা ভাষার দাবি করেছিলেন, তখন ষড়যন্ত্রকারীরা এতো একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাহেব যখন বল্লেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলে দেশের পক্ষে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে, তখন তাকেই সমর্থন দিলো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ছাত্ররা তা ভেবে ছিলাম আমাদের আর একটা স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হবে। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু ইয়াহিয়ার সাঙ্গপাঙ্গরা আমাদের মানুষ মেরেছে। ওরা সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী এবং যুবকদের হত্যা করেছে। আমাদের নতুন করে দেশ গঠন করতে হবে।

ভুট্টোর পিপলস পার্টির হটকারিতার প্রতিবাদে পেশোয়ারে শত শত পাঠান পুলিশের ধর্মঘট

রাওয়ালপিন্ডি। প্রেসিডেন্ট জেড, এ, ভুট্টোর ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির হটকারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে শত শত পাঠান পুলিশ গত রাতে ধর্মঘট করে পেশোয়ার শহরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। তারা শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত থানায় থানায় অভিযান চালায়। সাংবাদিকদের তারা জানায় যে, ভুট্টোর সমালোচক অবসর প্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খানের একটা রাজনৈতিক সভায় লোহার বাঁধানো লাঠি হাতে পুলিশ এক দল বিবদমান লোককে ছত্রভঙ্গ করলে পিপিপি-কর্মীরা পুলিশকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। পেশোয়ারের প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ধর্মঘট পুলিশের সংখ্যা দুই হাজার হবে বলে প্রকাশ। চলতি মাসে পাকিস্তানে এটা হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে পুলিশ হায়দারাবাদে আর একবার দু’দিনব্যাপী ধর্মঘট চালিয়ে ছিল। গত ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের পর থেকেই দেশে শ্রমিক, ছাত্র ও বেসামরিক কর্মচারীদের প্রতিবাদ ধর্মঘট লেগেই রয়েছে। পেশোয়ার সাংবাদিকরা জানান যে, কিছু কিছু পুলিশ কনস্টেবল ধর্মঘটী পুলিশের সাথে যোগ দিতে অস্বীকার করায় ধর্মঘটি পুলিশরা তিনটি থানায় দরজা-জানালা ভেঙে দেয়। এছাড়া পার্শ্ববর্তী শহরগুলি পুলিশের প্রতিও তারা প্রতিবাদ ধর্মঘটে যোগ দেয়ার জন্য খবর পাঠিয়েছে। পিপিআই-এর খবরে প্রকাশ, এয়ার মার্শাল আসগর খানের সভায় হামলা কালে ন্যূনতম ৭ জন আহত হয়। ওয়ালী খানের পরে এবারে মার্শাল আসগর খানই প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারে তার অস্বীকৃতির তীব্র সমালোচক।

নির্বাচনী সভায় ইন্দিরা ভারত তার নিরপেক্ষ

নীতি ত্যাগ করেনি

বোম্বাই। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি পুনরায় ঘোষণা করেন যে, ভারত উহার জোট নিরপেক্ষ থাকার নীতি ত্যাগ করে নাই। গতকাল দক্ষিণ বোম্বাইয়ের চৌপট্টি সেন্ডে এক বিরাট নির্বাচনী প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, সে আর কোনো দেশের সাথে সৌহার্দ্য করবে না। এর অর্থ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নই কামনা করুক, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই কামনা করুক, দেশকে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈদেশিক ঋণের উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, ভারত যেসব বৈদেশিক সাহায্য পাচ্ছে সেটা এমনিতে নিতে পাচ্ছে না, এর জন্য তাকে মূল্য দিতে হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এটাই হচ্ছে পার্থক্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

২২ ফেব্রুয়ারি

বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে জাকার্তা অনির্দিষ্টকাল

অপেক্ষা করবে না

জাকার্তা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক বলেন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নেতারা জাকার্তা বৈঠকে যদি না আসেন, তাহলে এই দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার জন্য ইন্দোনেশিয়া অন্য পথ দেখবে। তিনি অবশ্য এই অন্য পথটি কি তা খুলে বলেন। তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর বিশেষ দূত জনাব গোলাম মোস্তফা যাতে এ সপ্তাহে তার নির্ধারিত জাকার্তা সফর স্থগিত ঘোষণা করার পর তিনি এ মন্তব্য করেন। জাকার্তায় এটা বিশ্বাস করা হচ্ছে যে, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জনাব তুই বেংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে জনাব আদম মালিক প্রস্তাবিত বৈঠক প্রশ্নে নয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগে এ প্রস্তাবিত বৈঠক হচ্ছে না বলে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রের বিবৃতির প্রশ্নে জনাব গোলম মোস্তফা জাতে তার জাকার্তা সহগিত রেখেছেন। এই দুই নেতৃত্বের বৈঠকে বিলম্বিত হচ্ছে দৃশ্যতঃ এই প্রেক্ষিতে জনাব মালিক আজ এই আভাস দিয়েছেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়া অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা করতে পারে না। নেতৃত্ব বৈঠক যদি অনুষ্ঠিত না হয়, তা হলে আশা করা যাচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নটা আগামি সপ্তহে অনুষ্ঠিতব্য দেশ ইসলামি দেশগুলোর জেন্দা সম্মেলনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে উত্থাপন করবে।

দূরে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পল্লীতে চিত্র গ্রহণ করব

বিশ্ববিখ্যাত চলচিত্র প্রযোজক ও পরিচালক সত্যজিৎ রায় গত মঙ্গলবারে এখানে প্রকাশ করেন যে, অদূর ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশের পল্লীতে তার চলচিত্র গ্রহণের স্থান নির্বাচন করবেন। একদিনের। জন্য বাংলাদেশ সফরে এসে দেশে ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, বিশ্বে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের তুলনা নেই। আমি বাংলাদেশে চলচিত্র নির্মাণ করতে পারলে খুব খুশি হব। এক বছর আগেও এ চিন্তা কল্পনাতীত ছিল বলে তিনি মন্তব্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের কোনো অভিনেতা তার চিত্রে স্থান দেয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে শ্রী রায় বলেন যে, এ সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। সব সময়ই এ সম্ভাবনা রয়ে গেছে বলে তিনি মতো প্রকাশ করেন। চিত্রপরিচালক বাংলার বীর সন্তানদের শহীদ দিবস পালন প্রত্যক্ষ করে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ বাংলা ভাষাকে বিশ্বে একটা মর্যাদার আসনে বসাতে পারায় তিনি খুব গর্ববোধ করেছেন। আগামী মার্চে বাংলাদেশে ব্যাপক সফরে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধু সকাশে বিশিষ্ট ভারতীয় সাহিত্যিক : মঙ্গলবার রাতে ভারতের কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সাথে তার সরকারি বাসভবনে সাক্ষাত করেন। এই সব সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা হচ্ছেন, শ্রী প্রবোধ সান্যাল, মনোজ বসু, দক্ষিণা রঞ্জন বসু, সন্তোষ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী এবং সুনীল গাঙ্গুলী। শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ভারতীয় সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা ঢাকা এসেছেন।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৯ ফল্গুন ১৪২৬, ২৭ জমাদিউল সানি ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

২১ ফেব্রুয়ারি

টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোমবার এখানে বলেন যে, উপমহাদেশের স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের পত্তন হয়েছিল আজও তার সমাপ্তি ঘটেনি। ষড়যন্ত্রকারীরা চুপ করে বসে নেই বলে প্রকাশ করে তিনি বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী কুচক্রিরা আজও আমাদের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহীদ দিবস উপলক্ষে টেলিভিশন সাক্ষৎকারে তিনি উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধুর পুরাতন বন্ধু বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব কে জি মোস্তফা এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বাঙালিদের বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদীদলের চক্রান্তের ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস পর্যালোচনা করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে বাঙালিকে চুষে যাবে, সেটা ১৯৪৭ সালেই টের পাওয়া গিয়েছিল। বাংলা ভাষা আন্দোলনের “১৯৫২ সালের স্মৃতি” শীর্ষে আয়োজিত এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, পাকিস্তানের স্রষ্টা জনাব জিন্নার বাঙালিদের প্রতি কোনো দরদ ছিল না, তিনি বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তার ব্যবসায়ী সমাজের একটি উপনিবেশ করতে চেয়েছিলেন।

শেখ মুজিব বলেন যে, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জনাব জিন্না একদিনের জন্যও বাংলার মানুষের অবস্থা দেখতে বংলায় পদার্পণ করেন নি। শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তান হবার পরে পরেই শোষণকারীরা এবং তাদের অনুচররা ঢাকায় এক সাম্প্রদায়িক গোলমাল ঘটালো এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য চেষ্টা করলো। উদ্দেশ্যটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল এবং তা হলো বাঙালিদের নির্মূল করা। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা আমাদের ভাষা ও কৃষ্টির ওপর হামলা চালানোর জন্যে তাদের প্রশাসনকে নির্দেশ দিলো। আমরা জানতাম, এখনই এবং এখানেই ষড়যন্ত্রকারীদের রুখতে হবে, তা না হলে আমাদের জাতির ইতিহাস অন্ধকার হয়ে যাবে। প্রথম গণপরিষদে শ্রী ধীরেন দত্ত যখন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে বাংলা ভাষার দাবি করেছিলেন, তখন ষড়যন্ত্রকারীরা এতো একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাহেব যখন বল্লেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলে দেশের পক্ষে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে, তখন তাকেই সমর্থন দিলো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ছাত্ররা তা ভেবে ছিলাম আমাদের আর একটা স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হবে। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু ইয়াহিয়ার সাঙ্গপাঙ্গরা আমাদের মানুষ মেরেছে। ওরা সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী এবং যুবকদের হত্যা করেছে। আমাদের নতুন করে দেশ গঠন করতে হবে।

ভুট্টোর পিপলস পার্টির হটকারিতার প্রতিবাদে পেশোয়ারে শত শত পাঠান পুলিশের ধর্মঘট

রাওয়ালপিন্ডি। প্রেসিডেন্ট জেড, এ, ভুট্টোর ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির হটকারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে শত শত পাঠান পুলিশ গত রাতে ধর্মঘট করে পেশোয়ার শহরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। তারা শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত থানায় থানায় অভিযান চালায়। সাংবাদিকদের তারা জানায় যে, ভুট্টোর সমালোচক অবসর প্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খানের একটা রাজনৈতিক সভায় লোহার বাঁধানো লাঠি হাতে পুলিশ এক দল বিবদমান লোককে ছত্রভঙ্গ করলে পিপিপি-কর্মীরা পুলিশকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। পেশোয়ারের প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ধর্মঘট পুলিশের সংখ্যা দুই হাজার হবে বলে প্রকাশ। চলতি মাসে পাকিস্তানে এটা হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে পুলিশ হায়দারাবাদে আর একবার দু’দিনব্যাপী ধর্মঘট চালিয়ে ছিল। গত ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের পর থেকেই দেশে শ্রমিক, ছাত্র ও বেসামরিক কর্মচারীদের প্রতিবাদ ধর্মঘট লেগেই রয়েছে। পেশোয়ার সাংবাদিকরা জানান যে, কিছু কিছু পুলিশ কনস্টেবল ধর্মঘটী পুলিশের সাথে যোগ দিতে অস্বীকার করায় ধর্মঘটি পুলিশরা তিনটি থানায় দরজা-জানালা ভেঙে দেয়। এছাড়া পার্শ্ববর্তী শহরগুলি পুলিশের প্রতিও তারা প্রতিবাদ ধর্মঘটে যোগ দেয়ার জন্য খবর পাঠিয়েছে। পিপিআই-এর খবরে প্রকাশ, এয়ার মার্শাল আসগর খানের সভায় হামলা কালে ন্যূনতম ৭ জন আহত হয়। ওয়ালী খানের পরে এবারে মার্শাল আসগর খানই প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারে তার অস্বীকৃতির তীব্র সমালোচক।

নির্বাচনী সভায় ইন্দিরা ভারত তার নিরপেক্ষ

নীতি ত্যাগ করেনি

বোম্বাই। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি পুনরায় ঘোষণা করেন যে, ভারত উহার জোট নিরপেক্ষ থাকার নীতি ত্যাগ করে নাই। গতকাল দক্ষিণ বোম্বাইয়ের চৌপট্টি সেন্ডে এক বিরাট নির্বাচনী প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, সে আর কোনো দেশের সাথে সৌহার্দ্য করবে না। এর অর্থ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নই কামনা করুক, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই কামনা করুক, দেশকে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈদেশিক ঋণের উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, ভারত যেসব বৈদেশিক সাহায্য পাচ্ছে সেটা এমনিতে নিতে পাচ্ছে না, এর জন্য তাকে মূল্য দিতে হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এটাই হচ্ছে পার্থক্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

২২ ফেব্রুয়ারি

বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে জাকার্তা অনির্দিষ্টকাল

অপেক্ষা করবে না

জাকার্তা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক বলেন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নেতারা জাকার্তা বৈঠকে যদি না আসেন, তাহলে এই দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার জন্য ইন্দোনেশিয়া অন্য পথ দেখবে। তিনি অবশ্য এই অন্য পথটি কি তা খুলে বলেন। তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর বিশেষ দূত জনাব গোলাম মোস্তফা যাতে এ সপ্তাহে তার নির্ধারিত জাকার্তা সফর স্থগিত ঘোষণা করার পর তিনি এ মন্তব্য করেন। জাকার্তায় এটা বিশ্বাস করা হচ্ছে যে, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জনাব তুই বেংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে জনাব আদম মালিক প্রস্তাবিত বৈঠক প্রশ্নে নয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগে এ প্রস্তাবিত বৈঠক হচ্ছে না বলে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রের বিবৃতির প্রশ্নে জনাব গোলম মোস্তফা জাতে তার জাকার্তা সহগিত রেখেছেন। এই দুই নেতৃত্বের বৈঠকে বিলম্বিত হচ্ছে দৃশ্যতঃ এই প্রেক্ষিতে জনাব মালিক আজ এই আভাস দিয়েছেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়া অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা করতে পারে না। নেতৃত্ব বৈঠক যদি অনুষ্ঠিত না হয়, তা হলে আশা করা যাচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নটা আগামি সপ্তহে অনুষ্ঠিতব্য দেশ ইসলামি দেশগুলোর জেন্দা সম্মেলনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে উত্থাপন করবে।

দূরে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পল্লীতে চিত্র গ্রহণ করব

বিশ্ববিখ্যাত চলচিত্র প্রযোজক ও পরিচালক সত্যজিৎ রায় গত মঙ্গলবারে এখানে প্রকাশ করেন যে, অদূর ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশের পল্লীতে তার চলচিত্র গ্রহণের স্থান নির্বাচন করবেন। একদিনের। জন্য বাংলাদেশ সফরে এসে দেশে ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, বিশ্বে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের তুলনা নেই। আমি বাংলাদেশে চলচিত্র নির্মাণ করতে পারলে খুব খুশি হব। এক বছর আগেও এ চিন্তা কল্পনাতীত ছিল বলে তিনি মন্তব্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের কোনো অভিনেতা তার চিত্রে স্থান দেয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে শ্রী রায় বলেন যে, এ সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। সব সময়ই এ সম্ভাবনা রয়ে গেছে বলে তিনি মতো প্রকাশ করেন। চিত্রপরিচালক বাংলার বীর সন্তানদের শহীদ দিবস পালন প্রত্যক্ষ করে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ বাংলা ভাষাকে বিশ্বে একটা মর্যাদার আসনে বসাতে পারায় তিনি খুব গর্ববোধ করেছেন। আগামী মার্চে বাংলাদেশে ব্যাপক সফরে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধু সকাশে বিশিষ্ট ভারতীয় সাহিত্যিক : মঙ্গলবার রাতে ভারতের কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সাথে তার সরকারি বাসভবনে সাক্ষাত করেন। এই সব সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা হচ্ছেন, শ্রী প্রবোধ সান্যাল, মনোজ বসু, দক্ষিণা রঞ্জন বসু, সন্তোষ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী এবং সুনীল গাঙ্গুলী। শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ভারতীয় সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা ঢাকা এসেছেন।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২