ভাষাসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বাদশা পেলেন একুশে পদক

হাবিবুর রহমান স্বপন

আজীবন যিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণের চিন্তা করেছেন ভাষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বাদশা পাচ্ছেন মরণোত্তর একুশে পদক।

পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লায় ১৯২৯ সালের ১৪ এপ্রিল তার জন্ম। পিতা আলহাজ নূরুজ্জামান শেখ, মাতা খবিরন নেছা।

আমিনুল ইসলাম ছিলেন একজন অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। ১৯৪৩ সালে যখন তিনি পাবনা শহরের গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউটের ছাত্র তখন প্রণতি কুমার রায় ও সেলিনা বানুর সংস্পর্শে এসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গণসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। তিনি ছাত্র ফেডারেশনের পাবনা জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি গণতান্ত্রিক যুবলীগের সক্রিয় সদস্য হন। এ বছরই মার্চে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে পাবনা জেলার ভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে নির্বাচিত হন এবং উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ভাষার দাবি নিয়ে পাবনা শহরে যে মিছিল বের হয়, সেই মিছিল থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তখন তিনি ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। তাকে যগ্ম আহ্বায়ক করে ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হলে গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’। এর দু’দিন পর ২৯ ফেব্রুয়ারি মিছিল থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এর পরবর্তী বছর ১৯৪৯ সালে পুলিশ আবার তাকে গেফতার করে। প্রায় সাড়ে চার বছর পর ১৯৫২ এর ডিসেম্বর মাসে কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান। ভাষা আন্দোলনে আমিনুল ইসলাম বাদশার অবদান ছিল ব্যাপক এবং সুদূরপ্রাসারী।

পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় ১৯৪৮ এ শুরু হয় ‘রণদিভে তত্ব’। ‘ইয়া আজাদী ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়।’ এ সময় মুসলিম লীগ কমিউনিস্টদের শত্রু বলে ঘোষণা করে। শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গঠিত কৃষক সভার তেভাগা আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন। পাবনা থেকে তিনি গ্রেফতার হন। এরপর বিভিন্ন জেল ঘুরে তাকে নেয়া হয় রাজশাহী কারাগারে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে নূরুল আমিন সরকারের পুলিশ বাহিনী খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালিয়ে সাতজন রাজবন্দিকে হত্যা ও ৩৯ জনকে আহত করে। গুলি লাগে আমিনুল ইসলাম বাদশার পায়ে। যৌবনের দীর্ঘসময় কাটে তার কারাগারেই। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর তিনি মুক্তিলাভ করেন।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পাটিতে (ন্যাপ) যোগদান করেন। পরের বছর (১৯৫৮ খ্রি.) আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারির পর আপত্তিকর গ্রন্থ রাখার অভিযোগে গেফতার হন। আবার ১৯৬৪ তে সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে ন্যাপ-আওয়ামী লীগের যৌথ আন্দোলনে গ্রেফতার হন। কিছুদিন পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ও ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পাবনার ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলনে আমিনুল ইসলাম বাদশার অবদান ছিল বিশাল।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে পাবনার তখনকার জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল কাদের খানের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের জেলা কমিটির তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাবনায় অবস্থান নেয়া পাকিস্তানি বাহিনী ২৭ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সমূলে খতম হলে পাবনা মুক্ত থাকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুনরায় পাবনা দখল করে। তখন নূরুল কাদের খানসহ আমিনুল ইসলাম বাদশাসহ সব মুক্তিযোদ্ধা ভারতে চলে যান। আমিনুল ইসলাম বাদশা ভারতের করিমপুরের শরণার্থী ক্যাম্পের দায়িত্ব পলন করেন। ১৯৭৮-এ ন্যাপ বিভক্তির পর তা একত্রীকরণের প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ন্যাপ পুনরায় বিভক্ত হলে তিনি জননেতা আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেন এবং তার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং আজীবন তিনি উক্ত পদে আসীন ছিলেন।

স্কুল জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় এবং বারংবার জেলে আটকের কারণে লেখাপড়ায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। তিনি পাবনা শহরের গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন একজন বইপ্রেমী মানুষ। তিনি বিশ্বসাহিত্য, বিশ্ব ইতিহাস পাঠসহ প্রায় সব জীবনী গ্রন্থ পাঠ করেন। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। মিষ্টভাষী সদালাপী মহান মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন গণমানুষের প্রিয়জন।

আমিনুল ইসলাম বাদশা সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ’৭১-এর ঘাতক দালালবিরোধী জাতীয় সমন্বয় পরিষদের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আজীবন সংগ্রামী গণমানুষের এই নেতা ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট ঢাকার মালিবাগস্থ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ৯ ফল্গুন ১৪২৬, ২৭ জমাদিউল সানি ১৪৪১

ভাষাসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বাদশা পেলেন একুশে পদক

হাবিবুর রহমান স্বপন

আজীবন যিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণের চিন্তা করেছেন ভাষা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বাদশা পাচ্ছেন মরণোত্তর একুশে পদক।

পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লায় ১৯২৯ সালের ১৪ এপ্রিল তার জন্ম। পিতা আলহাজ নূরুজ্জামান শেখ, মাতা খবিরন নেছা।

আমিনুল ইসলাম ছিলেন একজন অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। ১৯৪৩ সালে যখন তিনি পাবনা শহরের গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউটের ছাত্র তখন প্রণতি কুমার রায় ও সেলিনা বানুর সংস্পর্শে এসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গণসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। তিনি ছাত্র ফেডারেশনের পাবনা জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি গণতান্ত্রিক যুবলীগের সক্রিয় সদস্য হন। এ বছরই মার্চে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে পাবনা জেলার ভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে নির্বাচিত হন এবং উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ভাষার দাবি নিয়ে পাবনা শহরে যে মিছিল বের হয়, সেই মিছিল থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তখন তিনি ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। তাকে যগ্ম আহ্বায়ক করে ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হলে গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’। এর দু’দিন পর ২৯ ফেব্রুয়ারি মিছিল থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এর পরবর্তী বছর ১৯৪৯ সালে পুলিশ আবার তাকে গেফতার করে। প্রায় সাড়ে চার বছর পর ১৯৫২ এর ডিসেম্বর মাসে কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান। ভাষা আন্দোলনে আমিনুল ইসলাম বাদশার অবদান ছিল ব্যাপক এবং সুদূরপ্রাসারী।

পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় ১৯৪৮ এ শুরু হয় ‘রণদিভে তত্ব’। ‘ইয়া আজাদী ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়।’ এ সময় মুসলিম লীগ কমিউনিস্টদের শত্রু বলে ঘোষণা করে। শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গঠিত কৃষক সভার তেভাগা আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন। পাবনা থেকে তিনি গ্রেফতার হন। এরপর বিভিন্ন জেল ঘুরে তাকে নেয়া হয় রাজশাহী কারাগারে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে নূরুল আমিন সরকারের পুলিশ বাহিনী খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালিয়ে সাতজন রাজবন্দিকে হত্যা ও ৩৯ জনকে আহত করে। গুলি লাগে আমিনুল ইসলাম বাদশার পায়ে। যৌবনের দীর্ঘসময় কাটে তার কারাগারেই। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর তিনি মুক্তিলাভ করেন।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পাটিতে (ন্যাপ) যোগদান করেন। পরের বছর (১৯৫৮ খ্রি.) আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারির পর আপত্তিকর গ্রন্থ রাখার অভিযোগে গেফতার হন। আবার ১৯৬৪ তে সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে ন্যাপ-আওয়ামী লীগের যৌথ আন্দোলনে গ্রেফতার হন। কিছুদিন পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ও ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পাবনার ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলনে আমিনুল ইসলাম বাদশার অবদান ছিল বিশাল।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে পাবনার তখনকার জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল কাদের খানের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের জেলা কমিটির তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাবনায় অবস্থান নেয়া পাকিস্তানি বাহিনী ২৭ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সমূলে খতম হলে পাবনা মুক্ত থাকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুনরায় পাবনা দখল করে। তখন নূরুল কাদের খানসহ আমিনুল ইসলাম বাদশাসহ সব মুক্তিযোদ্ধা ভারতে চলে যান। আমিনুল ইসলাম বাদশা ভারতের করিমপুরের শরণার্থী ক্যাম্পের দায়িত্ব পলন করেন। ১৯৭৮-এ ন্যাপ বিভক্তির পর তা একত্রীকরণের প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ন্যাপ পুনরায় বিভক্ত হলে তিনি জননেতা আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেন এবং তার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং আজীবন তিনি উক্ত পদে আসীন ছিলেন।

স্কুল জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় এবং বারংবার জেলে আটকের কারণে লেখাপড়ায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। তিনি পাবনা শহরের গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন একজন বইপ্রেমী মানুষ। তিনি বিশ্বসাহিত্য, বিশ্ব ইতিহাস পাঠসহ প্রায় সব জীবনী গ্রন্থ পাঠ করেন। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। মিষ্টভাষী সদালাপী মহান মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন গণমানুষের প্রিয়জন।

আমিনুল ইসলাম বাদশা সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ’৭১-এর ঘাতক দালালবিরোধী জাতীয় সমন্বয় পরিষদের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আজীবন সংগ্রামী গণমানুষের এই নেতা ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট ঢাকার মালিবাগস্থ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।