ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মাইলফলক

সাদেকুর রহমান

রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারদের রক্তে ভেজা ফেব্রুয়ারি মাসের নবম দিন আজ। শোক-উৎসবের অনির্বাচনীয় আবেগ নিরন্তর বইছে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষীর শিরায় শিরায়। সেই আবেগস্ফুরিত অনুরাগ থেকেই বুঝি দেশের প্রতিটি মানুষ আশৈশব বাংলায় কথা বলে, লিখন লেখে আপ্লুত হয়, পিয়াস মেটায়।

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কেন জানি অন্যরকম শিহরণ জাগে দেহ ও মনে। ভাষা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি-ইতিহাসের তরী যাত্রা শুরু করেছে সেই ১৯৫২-তে আর উজান বেয়ে নোঙর করল ২০২১-এ এসে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। বর্তমানে কলামে ইতিপূর্বে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত আন্দোলনের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। এরপর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত প্রতিবছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। বস্তুত ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের ঐতিহাসিক চুক্তির ৩ নম্বর দফায় পরবর্তী প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনের অঙ্গীকার থাকায় ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। এই চুক্তিতে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তারকৃত সবাইকে মুক্তিদান এবং সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেয়ায় ছাত্র জনসাধারণ অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সত্যিই এ ছিল এক অনন্য বিজয়।

এ ব্যাপারে রাজনীতিবিদ-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের লেখা তৎকালীন কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে আন্দোলনের সফলতার প্রমাণ মেলে। তিনি লিখেছেন, ‘যে বিরাট শক্তির ও দুর্জয় বিরোধিতার মধ্যে সংগ্রাম করিয়া বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীগণ যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভাষা কমিটির পক্ষ থেকে নঈম উদ্দীন আহমদ আরবি হরফে বাংলা লেখার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এ সময় লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এলে তার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ-এর (ডাকসু) পক্ষ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করা হয়।’

বিশিষ্ট লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (১ম খ-)’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড ও বর্ণমালা বিবেচনা বিশেষ কমিটির কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেছিল। যার শুরুটা এমন- আমরা মনে করিতেছি যে, আরবি হরফ প্রণয়ন প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীর ৬ষ্ঠ স্থান অধিকারী বিপুল ঐশ্বর্যময়ী ও আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবের ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ওপর হামলা করা হইতেছে।’

১৯৫০ সালে ভাষা আন্দোলন চললেও দালিলিক প্রমাণ নেই বললেই চলে। পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য গঠিত মাওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি এ বিষয়টি নিয়ে ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলেও সেটি ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদনে ভাষা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়, যেখানে তারা বাংলাকে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেছিলেন।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জ্ঞানতাপস বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, গণপরিষদ সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারী, লেখক, শিক্ষক, ছাত্র, পুস্তক প্রণেতাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তাবিদরা একটি স্মারকলিপি প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। ওই স্মারকলিপিতে বাংলাকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা অভিহিত করে ওই বছরের ১ এপ্রিল থেকে সব সরকারি কর্মচারীকে কার্যাদি বাংলা ভাষায় শুরু করার দাবি জানানো হয়। ১১ মার্চ ভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল পালিত হয়। এভাবেই ধাপে ধাপে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘বায়ান্নর ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভার পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের কর্মপ্রস্তুতি নিরলসভাবে চলতে থাকে। ছাত্রসমাজে হঠাৎ করেই যেন তৎপরতার জোয়ার সৃষ্টি হয় এবং আশ্চর্য যে ওই জোয়ার শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশব্যাপী ছাত্রসমাজ এবং তাদের সমর্থনে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য তৎপর হয়ে উঠে।

মঙ্গলবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২১ , ২৬ মাঘ ১৪২৭, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪২

আ-মরি বাংলা ভাষা

ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মাইলফলক

সাদেকুর রহমান

রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারদের রক্তে ভেজা ফেব্রুয়ারি মাসের নবম দিন আজ। শোক-উৎসবের অনির্বাচনীয় আবেগ নিরন্তর বইছে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষীর শিরায় শিরায়। সেই আবেগস্ফুরিত অনুরাগ থেকেই বুঝি দেশের প্রতিটি মানুষ আশৈশব বাংলায় কথা বলে, লিখন লেখে আপ্লুত হয়, পিয়াস মেটায়।

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কেন জানি অন্যরকম শিহরণ জাগে দেহ ও মনে। ভাষা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি-ইতিহাসের তরী যাত্রা শুরু করেছে সেই ১৯৫২-তে আর উজান বেয়ে নোঙর করল ২০২১-এ এসে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। বর্তমানে কলামে ইতিপূর্বে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত আন্দোলনের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। এরপর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত প্রতিবছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। বস্তুত ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের ঐতিহাসিক চুক্তির ৩ নম্বর দফায় পরবর্তী প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনের অঙ্গীকার থাকায় ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। এই চুক্তিতে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তারকৃত সবাইকে মুক্তিদান এবং সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেয়ায় ছাত্র জনসাধারণ অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সত্যিই এ ছিল এক অনন্য বিজয়।

এ ব্যাপারে রাজনীতিবিদ-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের লেখা তৎকালীন কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে আন্দোলনের সফলতার প্রমাণ মেলে। তিনি লিখেছেন, ‘যে বিরাট শক্তির ও দুর্জয় বিরোধিতার মধ্যে সংগ্রাম করিয়া বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীগণ যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভাষা কমিটির পক্ষ থেকে নঈম উদ্দীন আহমদ আরবি হরফে বাংলা লেখার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এ সময় লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এলে তার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ-এর (ডাকসু) পক্ষ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করা হয়।’

বিশিষ্ট লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (১ম খ-)’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড ও বর্ণমালা বিবেচনা বিশেষ কমিটির কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেছিল। যার শুরুটা এমন- আমরা মনে করিতেছি যে, আরবি হরফ প্রণয়ন প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীর ৬ষ্ঠ স্থান অধিকারী বিপুল ঐশ্বর্যময়ী ও আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবের ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ওপর হামলা করা হইতেছে।’

১৯৫০ সালে ভাষা আন্দোলন চললেও দালিলিক প্রমাণ নেই বললেই চলে। পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য গঠিত মাওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি এ বিষয়টি নিয়ে ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলেও সেটি ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদনে ভাষা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়, যেখানে তারা বাংলাকে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেছিলেন।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জ্ঞানতাপস বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, গণপরিষদ সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মচারী, লেখক, শিক্ষক, ছাত্র, পুস্তক প্রণেতাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিন্তাবিদরা একটি স্মারকলিপি প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। ওই স্মারকলিপিতে বাংলাকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা অভিহিত করে ওই বছরের ১ এপ্রিল থেকে সব সরকারি কর্মচারীকে কার্যাদি বাংলা ভাষায় শুরু করার দাবি জানানো হয়। ১১ মার্চ ভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল পালিত হয়। এভাবেই ধাপে ধাপে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘বায়ান্নর ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভার পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের কর্মপ্রস্তুতি নিরলসভাবে চলতে থাকে। ছাত্রসমাজে হঠাৎ করেই যেন তৎপরতার জোয়ার সৃষ্টি হয় এবং আশ্চর্য যে ওই জোয়ার শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশব্যাপী ছাত্রসমাজ এবং তাদের সমর্থনে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য তৎপর হয়ে উঠে।