অণুজীব গবেষণার গুরুত্ব

শাহাদাত সুমন

সারাবিশ্বকে বর্তমানে কার্যত বিকল করে রেখেছে করোনাভাইরাস নামক এক ধরনের অণুজীব। তবে করোনার সমগোত্রীয় অনেক অণুজীবও নিকট ভবিষ্যতে মহামারী আকার ধারণ করে মানবসব্যতাকে পুনর্বার স্থবির করে দিতে পারে।

যেমন ইবোলা, এইচআইভি, হেপাটাইটিস, সোয়াইন ফ্লু, হেমোরেজিক জ্বরের জন্য দায়ী মারবার্গ ভাইরাস ইত্যাদি মারণভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর বিশ্বে মৃত্যুহার বিচলিত করার মতো। যে কোন সময় সংক্রমণ মহামারী রূপে সারাবিশে^ ছড়িয়ে যেতে পারে।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিরল হলেও অন্যান্য সংক্রামক রোগের মতো ইবোলা একটি মারাত্মক রোগ এবং বিশে^ যে কোন সময় মহামারী রূপ ধারণ করে একুশ শতকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

ভাইরাসটি সাধারণত বন্য প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয় এবং মানবদেহে সংক্রমণের মাধ্যমে স্বল্পসময়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেঙে দিতে সক্ষম। বমি, ডায়রিয়া, ফুসকুড়ি, স্মৃতিভ্রম ঘটিয়ে রোগীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গড় মৃত্যুহার প্রায় পঞ্চাশ থেকে নব্বই শতাংশ এবং এর নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত পান করার জন্য সামান্য মিষ্টি ও নোনতা জল খাইয়ে বা ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপির মাধ্যমে অথবা ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড দেয়ার মাধ্যমে কিছুটা সাহায্য করা যায়।

ইবোলা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে তাই প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে।

মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বলছে, এই সংক্রামক রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ কিছু প্যাকেজ সফলভাবে প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে। যেমন কেস ম্যানেজমেন্ট, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পূর্ববর্তী কেস স্টাডি, একটি ভালো পরীক্ষাগার পরিষেবা, নিরাপদ সমাধিক্রিয়া, অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক গতিবদ্ধকরণ এবং নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হলে প্রতিষেধক টিকার উদ্ভাবন করা।

বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা আরেকটি মারণভাইরাস হলো মারবার্গ ভাইরাস। এটি প্রধানত হেমোরেজিক জ্বরের কারণ এবং এর প্রভাবে পরিপাকতন্ত্র ও ত্বকে রক্তক্ষরণ হয়ে গড় মৃত্যুহার প্রায় চব্বিশ থেকে আটাশি শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবহনতন্ত্র অকেজো হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়।

বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হলেও এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ পঁচাত্তর হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে সোয়াইন ফ্লু।

বাংরাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, সব ধরনের ফ্লু’র ভাইরাসগুলো নিজেদের মধ্যে জিনগত উপাদান অদল বদল করতে পারার সক্ষমতা থাকায়, কোন ধরনের সোয়াইন ফ্লু মহামারি ডেকে আনতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

এছাড়া প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায় হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে। অধিকাংশ মারা যায় হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে। ভাইরাসটি যকৃতে আক্রমণ করে যকৃত সিরোসিস বা যকৃত ক্যান্সার সৃষ্টি করে রোগীর মৃত্যু ঘটায়।

হেপাটাইটিস সি তুলনামূলক কম বিপজ্জনক হলেও প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ এ মারনভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাই হেপাটাইটিসকে অবহেলা করার কোনো অবকাশ নেই এবং একে বৈশ্বিকভাবে আরেকটি মহামারীর অশনি সঙ্কেত হিসেবে ধরা যায়।

এছাড়া মানবদেহকে প্রতিরোধহীন করে নিরাময়হীন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া এইচআইভি সর্বপ্রথম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে অন্য জীবাণু সংক্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বিশে^ এ ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর অর্ধেকও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পায় না বলে প্রতি বছর ২০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।

বর্তমানে এ রোগের কার্যত কোনো চিকিৎসা নেই বলে মহামারীরূপে সারাবিশে ছড়িয়ে পড়লে মানবজাতিকে আরও একবার অসহায় আত্মসমর্পণ করা লাগবে প্রকৃতির কাছে।

ভাইরাসের মতো অণুজীবগুলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্যে এক বড় চ্যালেঞ্জ। তাই অণুজীব গবেষণায় বিশ^কে আরও বেশি মনোযোগী ও সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

কারণ বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের জীবাণু শনাক্তকরণ, রোগের প্রতিষেধক তৈরি, অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি, ওষুধের মাইক্রোবায়োলজিক্যাল গুণগত মান নির্ণয় ইত্যাদি বিষয়ে সাফল্য অর্জন নির্ভর করে অণুজীববিজ্ঞানে গবেষণার উৎকর্ষের উপর।

তাই অণুজীব গবেষণা ও মহামারী মোকাবিলায় সুদূরপ্রসারী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই একমাত্র বিশ^বাসীকে করোনাভাইরাস মহামারীর মতো অনাগত ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১ , ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৭ শাওয়াল ১৪৪২

অণুজীব গবেষণার গুরুত্ব

শাহাদাত সুমন

সারাবিশ্বকে বর্তমানে কার্যত বিকল করে রেখেছে করোনাভাইরাস নামক এক ধরনের অণুজীব। তবে করোনার সমগোত্রীয় অনেক অণুজীবও নিকট ভবিষ্যতে মহামারী আকার ধারণ করে মানবসব্যতাকে পুনর্বার স্থবির করে দিতে পারে।

যেমন ইবোলা, এইচআইভি, হেপাটাইটিস, সোয়াইন ফ্লু, হেমোরেজিক জ্বরের জন্য দায়ী মারবার্গ ভাইরাস ইত্যাদি মারণভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর বিশ্বে মৃত্যুহার বিচলিত করার মতো। যে কোন সময় সংক্রমণ মহামারী রূপে সারাবিশে^ ছড়িয়ে যেতে পারে।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিরল হলেও অন্যান্য সংক্রামক রোগের মতো ইবোলা একটি মারাত্মক রোগ এবং বিশে^ যে কোন সময় মহামারী রূপ ধারণ করে একুশ শতকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

ভাইরাসটি সাধারণত বন্য প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয় এবং মানবদেহে সংক্রমণের মাধ্যমে স্বল্পসময়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেঙে দিতে সক্ষম। বমি, ডায়রিয়া, ফুসকুড়ি, স্মৃতিভ্রম ঘটিয়ে রোগীকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গড় মৃত্যুহার প্রায় পঞ্চাশ থেকে নব্বই শতাংশ এবং এর নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত পান করার জন্য সামান্য মিষ্টি ও নোনতা জল খাইয়ে বা ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপির মাধ্যমে অথবা ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড দেয়ার মাধ্যমে কিছুটা সাহায্য করা যায়।

ইবোলা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে তাই প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই এর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে।

মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বলছে, এই সংক্রামক রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ কিছু প্যাকেজ সফলভাবে প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে। যেমন কেস ম্যানেজমেন্ট, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পূর্ববর্তী কেস স্টাডি, একটি ভালো পরীক্ষাগার পরিষেবা, নিরাপদ সমাধিক্রিয়া, অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক গতিবদ্ধকরণ এবং নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হলে প্রতিষেধক টিকার উদ্ভাবন করা।

বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা আরেকটি মারণভাইরাস হলো মারবার্গ ভাইরাস। এটি প্রধানত হেমোরেজিক জ্বরের কারণ এবং এর প্রভাবে পরিপাকতন্ত্র ও ত্বকে রক্তক্ষরণ হয়ে গড় মৃত্যুহার প্রায় চব্বিশ থেকে আটাশি শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংবহনতন্ত্র অকেজো হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়।

বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হলেও এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ পঁচাত্তর হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে সোয়াইন ফ্লু।

বাংরাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, সব ধরনের ফ্লু’র ভাইরাসগুলো নিজেদের মধ্যে জিনগত উপাদান অদল বদল করতে পারার সক্ষমতা থাকায়, কোন ধরনের সোয়াইন ফ্লু মহামারি ডেকে আনতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

এছাড়া প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায় হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে। অধিকাংশ মারা যায় হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে। ভাইরাসটি যকৃতে আক্রমণ করে যকৃত সিরোসিস বা যকৃত ক্যান্সার সৃষ্টি করে রোগীর মৃত্যু ঘটায়।

হেপাটাইটিস সি তুলনামূলক কম বিপজ্জনক হলেও প্রতিবছর সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ এ মারনভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাই হেপাটাইটিসকে অবহেলা করার কোনো অবকাশ নেই এবং একে বৈশ্বিকভাবে আরেকটি মহামারীর অশনি সঙ্কেত হিসেবে ধরা যায়।

এছাড়া মানবদেহকে প্রতিরোধহীন করে নিরাময়হীন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া এইচআইভি সর্বপ্রথম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে অন্য জীবাণু সংক্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বিশে^ এ ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর অর্ধেকও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পায় না বলে প্রতি বছর ২০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।

বর্তমানে এ রোগের কার্যত কোনো চিকিৎসা নেই বলে মহামারীরূপে সারাবিশে ছড়িয়ে পড়লে মানবজাতিকে আরও একবার অসহায় আত্মসমর্পণ করা লাগবে প্রকৃতির কাছে।

ভাইরাসের মতো অণুজীবগুলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্যে এক বড় চ্যালেঞ্জ। তাই অণুজীব গবেষণায় বিশ^কে আরও বেশি মনোযোগী ও সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

কারণ বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের জীবাণু শনাক্তকরণ, রোগের প্রতিষেধক তৈরি, অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি, ওষুধের মাইক্রোবায়োলজিক্যাল গুণগত মান নির্ণয় ইত্যাদি বিষয়ে সাফল্য অর্জন নির্ভর করে অণুজীববিজ্ঞানে গবেষণার উৎকর্ষের উপর।

তাই অণুজীব গবেষণা ও মহামারী মোকাবিলায় সুদূরপ্রসারী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই একমাত্র বিশ^বাসীকে করোনাভাইরাস মহামারীর মতো অনাগত ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]