আমরাই সংকট, আমরাই সমাধান

পাভেল পার্থ

বৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ ন্যায়বিচার নিয়ে কাজের সুবাদে প্রায়ই অনেকে একটা প্রশ্ন করেন, দেশে প্রাণবৈচিত্র্যের কী অবস্থা? অবশ্য তাদের অধিকাংশই ‘জীববৈচিত্র্য’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। এর ভেতর আবার বড় অংশটিই ‘জীববৈচিত্র্য’ বলতে শুধু বন্যপ্রাণী বোঝেন। এর ভেতর বড় দলটি বন্যপ্রাণী বলতে বাঘ, বানর, হাতি কিংবা কুমিরকে সামনে রাখেন। তো, অধিকাংশ সময় আমি এই মৌলিক প্রশ্নটির কোনো যুতসই উত্তর দাঁড় করাতে পারি না। কারণ এ প্রশ্নটি শুনলে বারবার আমার মনে হয়, প্রশ্নটি তো আমাকেও করা হয়েছে। কারণ শুধু বাঘ বা হাতি তো নয়, গাছ কী পাখি বা শামুক কী মানুষ এই দুনিয়ার আমরা সবাই মিলেই তো প্রাণের বৈচিত্র্য। প্রাণবৈচিত্র্য। কিন্তু দেশে প্রকাশিত পাঠ্য কী পাঠ্যের বাইরের তথাকথিত মূলধারার পুস্তকগুলো বরাবর প্রাণবৈচিত্র্য বলতে ‘জীববৈচিত্র্যই’ বোঝাচ্ছে আর ‘জীববৈচিত্র্য’ বলতে মূলত বৃহৎ মেরুদণ্ডী বন্য জন্তুকে চেনাচ্ছে। যারা প্রাণবৈচিত্র্যের এমন একতরফা ও খন্ডিত মানে দাঁড় করিয়েছেন তারা এ বিষয়ে যে অনভিজ্ঞ বা উদাসীন এমন নয়; বরং হিসাবটা অন্য জায়গা। এ এক গভীর রাজনীতি। বৈষম্য এবং চক্রান্তও বলা যায়। কারণ প্রাণবৈচিত্র্যর সদস্য হিসেবে মানুষকে বাদ রেখে চিন্তা করলে যারা এই চিন্তা চাপিয়ে দিচ্ছেন তাদের বেশ ফায়দা হয়। তারা মনে করেন এই দুনিয়া তাদের মতো কিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার তরুলতা, পাখপাখালি, শামুক-ঝিনুক, বাঘ-ভাল্লুক সব মানুষের পদানত হয়েই তো থাকবে। এই দুনিয়ায় তাই এককভাবে মানুষের টিকে থাকবার জন্য আর সব প্রাণকেই শেষ করে দেয়া যায়। লুট, গুম, ধর্ষণ ও হত্যা করা যায়। লাগাতার একতরফা বাণিজ্য করা যায়। আর তাই প্রাণবৈচিত্র্যের তথাকথিত মূলধারার সংজ্ঞা ও উদাহরণে আমরা কখনোই মানুষের প্রতিকৃতি দেখি না। আমাদের দেখানো হয় বাঘ, হাতি বা সিংহের ছবি। কোনো এলাকায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প চাপিয়ে দেয়ার আগে এখন রাষ্ট্রও বলে ‘জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি হবে না, জীববৈচিত্র্য সংক্ষণ করা হবে’। রাষ্ট্রের কাছেও জীববৈচিত্র্য মানে শুধু বন্যপ্রাণী। প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যায়তন, সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, গণমাধ্যম কী রাষ্ট্র এমন এক ভীষণ বৈষম্যমূলক ধারণাকে অনিবার্য করে তুলছে যা দেশের প্রাণবৈচিত্র্যের ধারাকে অবিরাম দম চেপে ধরছে। অথচ বাংলাদেশের গ্রামীণ নি¤œবর্গ হাজার বছর ধরে মনে করে, প্রাণবৈচিত্র্য মানে দুনিয়ার দেখা-অদেখা জানা-অজানা দৃশ্য কি অদৃশ্যমান সব প্রাণের বহুপাক্ষিক বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য। আমাদের সংকট হলো আমরা দেশের মানুষের চিন্তা, জ্ঞান ও দর্শনকে বুঝতে চাইনি, পাত্তা দিইনি, আস্থা রাখিনি। আর তাই আজ তলিয়ে যাওয়া হাওরে মাছ বা ধান মরলে মানুষের কিছু যায় আসে না, নির্বিচারে মানুষ মরলেও তা কীভাবে বন্যপ্রাণকে প্রভাবিত করতে পারে তা আন্দাজ করা হয় না। প্রজাতি হিসেবে মানুষের ভেতর এক অসহনীয় বৈচিত্র্যবিমুখতা তৈরি হয়েছে। আর তাই নিরাপদে প্রশ্নহীনভাবে প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে প্রাণের বৈচিত্র্য, এক সহিংস জোরজুলুমের ভেতর টিকে থাকবার আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু বিবর্তনবিদ্যার নিয়মে এটি প্রজাতির টিকে থাকবার প্রাকৃতিক সংগ্রাম নয়।

২.

প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় এবং বিদ্যায়তনিক পরিসরে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের খতিয়ান বর্ণনা করতে বরাবরই বাংলাদেশের গাছ-পাখি-মাছ এর প্রজাতি সংখ্যা তুলে ধরা হয়। দেশে ভিন্ন ভিন্ন ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলে এখনও অসংখ্য প্রজাতির ধানজাত চাষ হলেও ধান বিজ্ঞানী ড. হেক্টর দেখিয়েছেন একটা সময় এদেশে প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি ধানের চাষ হতো। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষির উন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের ধানের বৈচিত্র্য আজ নিরুদ্দেশ হয়েছে। দেশের সবচে বড় হাওর হাকালুকি, যেখানে প্রতি শীত মওসুমে পরিযায়ী পাখিদের খুন করা হয়। সুন্দরবনের বাঘ আজ মাত্র ১০৬। এক শিঙা গণ্ডার আর হাতি বাণিজ্যের কারণে আগেই প্রাকৃতিক বন থেকে উধাও হয়েছে। রাজা-বাদশাহ কি ব্রিটিশ শোষণ গেলেও এখনও স্বাধীন রাষ্ট্রে হরিণ ও বুনো পাখির মাংশ প্রভাবশালীরাই খায়। দেশের টিকে থাকা একমাত্র জলাবন রাতারগুলকে প্রজাতিশূন্য করবার চেষ্টা চলছে। ভালো নেই শালবন, বর্ষারণ্য, পাহাড়ি বন, গর্জন বন, ঘাসবন, গ্রামীণ বন কী বাদাবন। দেশের সব বাস্তুসংস্থানসহ সামগ্রিক প্রতিবেশ এক জটিল সংকটের মুখোমুখি। মানুষসহ প্রাণের সব বৈচিত্র্যকে আজ শুধু খাদ্য বা আবাস নয়, নিরাপত্তার জন্যও লড়তে হচ্ছে। কিছু মুনাফাভোগী লুটেরা দুর্বৃত্ত লোভী মানুষের জন্যই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুধু তৈরি হয়নি, এটি বহাল আছে এবং এটিই যেন চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রাণবৈচিত্র্যর প্রতি এই যে অবিরাম নিষ্ঠুরতা আর সহিংসতা এর বিরুদ্ধে কী তবে জাগবে না বাংলাদেশ? স্ন্দুরবনের বাঘ, মহানন্দার ঘড়িয়াল, টাঙ্গুয়ার হাওরের বুনো গোলাপ, পদ্মার ইলিশ, লাউয়াছড়ার উল্লুক, শ্যালা নদীর ইরাবতী ডলফিন, হাকালুকির কালিম, উপকূল দ্বীপের চামচ-ঠুঁটো বাটান কী মল্লিকপুরের বিশ্ববট এদের পাশে কী দাঁড়াবে না মানুষ? মানুষের পাশেই তো এরা জীবনভর দাঁড়িয়েছে, জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মানুষ কী করেছে? হাতি মেরে দাঁতের দোকান দিয়েছে। বাঘের চামড়া দেয়ালে ঝুলিয়ে ব্যাটাগিরি প্রমাণ করছে। গরম জামার জন্য ভাল্লুক খুন করছে। কারখানা আর ইটভাটার জন্য গাছেদের নির্মূল করছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর এমন নির্দয় সহিংসতাকে রুখে দাঁড়ায়নি। বরং নানাভাবে তা উসকে দিচ্ছে। রাষ্ট্র যেন আজ প্রাণের দেশ নয়, নির্মম বহুজাতিক বিষ কোম্পানি। শুধু নিজের মুনাফাই গুনছে। ধান জমিনের পোকা দমনে বিষ দিতে গিয়ে মরছে জলের মাছ, মাটির কেঁচো। প্রতিদিন এমন লাগাতার মৃত্যুর নেই কোনো পরিসংখ্যান, নেই ন্যায়বিচার।

৩.

প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ নানা আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হলেও এসবের কোনো প্রয়োগ নেই। প্রাণবৈচিত্র্যের আন্তর্জাতিক সনদের রূপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা এ্যাডহক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করে। ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ সালের সম্মেলনের ভেতর দিয়ে ২২ শে মে ১৯৯২ সালে আফ্রিকার নাইরোবিতে প্রাণবৈচিত্র্য সনদের মূল সনদ অনুমোদনের ভেতর দিয়ে কমিটির কাজ শেষ হয়। ১৯৯২ সালের ৫ জুন ব্রাজিলের রাজধানী রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে স্বাক্ষরের জন্য সনদটি উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯৩ সালের ৪ জুন পর্যন্ত তা স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং ১৬৮টি দেশ তাতে স্বাক্ষর করে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ৫ জুন এ সনদটি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালের ৩ মে অনুসমর্থন দান করে। উক্ত সনদের আলোকে বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে “Biodiversity and community knowledge protection act’’ নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছিল। যদিও এই খসড়াকে বাদ দিয়ে পরবর্তীতে ‘জীববৈচিত্র্য আইন’ চূড়ান্ত হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ সভার দ্বিতীয় কমিটিতে প্রথম উত্থাপিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের’ কথা। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি পালিত হয় প্রতি বছরের ২৯ ডিসেম্বর। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের তারিখটি পরিবর্তিত হয়ে পুনরায় এটি ২২ মে নির্ধারিত হয়। ২০১০ সালকে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ ঘোষণা করা হয়। প্রতি বছর এ দিবসের জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়। ২০২১ সনের জন্য প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘আমরা সমাধানের অংশ # প্রকৃতির জন্য’।

৪.

আসলেই আমরা মানে প্রজাতি হিসেবে মানুষই প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় প্রধান সহযোগী। কারণ মানুষই এই প্রাণ-প্রকৃতির নির্মম হন্তারক। একক প্রজাতি হিসেবে মানুষের লাগাতার ভোগবিলাসিতা, লুণ্ঠন আর খবরদারির জন্যই আজ প্রাণ-প্রকৃতির মুমূর্ষু অবস্থা। আজ যুদ্ধবোমায় ঝলসে দেয়া হচ্ছে ফিলিস্তিন, অঙ্গার হয়েছে আমাজন অরণ্য, রেস্টুরেন্টের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ। দুনিয়াজুড়ে প্রাণ-প্রকৃতির এই নিদান একেবারেই মানুষের তৈরি। মানুষ কেবল একা নিজে জিততে চায়, নিজের বাহাদুরিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একা নিজের খাবার ফলাতে গিয়ে মাটি পানি সব বিষাক্ত করে ফেলতে পারে, অণুজীব থেকে পতঙ্গ সব মেরে ফেলতে পারে। গত ২০ বছরের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও নানা কৃষি বাস্তুসংস্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছি গ্রীষ্মকালেই দেশে প্রাণবৈচিত্র্যের বহুল মৃত্যু ঘটে। কারণ এ ঋতুতেই বোরো মওসুমের ধান কাটা হয় আর ধান বাঁচাতে মানুষ বাবুই, চড়–ই, শালিখ পাখিদের বিষ দিয়ে মারে। এছাড়া বোরো মৌসুমে ব্যবহৃত বিষ ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মাটি ও জলজ প্রাণবৈচিত্র্য নিশ্চিহ্ন করে অন্য মৌসুমের চেয়ে বেশি। এছাড়া এই ‘মধু মাসে’ আম-লিচু ফল বাগানে নির্দয়ভাবে পাখিদের হত্যা করা হয়। এ সময়টাতে উপকূলে বিষ দিয়ে মাছেদেরও মৃত্যু ঘটে। অথচ এটাই আমাদের মানে মানুষের খাদ্য জোগানের এক প্রধান ঋতু। আমাদের এই জোগান, উৎপাদন আর উন্নয়নের পেছনে কত প্রাণ ঝরে যায়, হারিয়ে যায় তার খতিয়ানও আজ আমাদের নেয়া জরুরি। চলমান করোনা মহামারি প্রমাণ করে প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই এই সবুজগ্রহ আমাদের কারোর জন্যই নিরাপদ নয়। তাহলে আমরা করবোটা কি? সংকট যেহেতু আমাদের তৈরি করা, তাই সমাধানও আমাদেরই খুঁজতে হবে। জনে জনে, গ্রামে গ্রামে, পাহাড় থেকে সমতলে, হাওর থেকে অরণ্যে, বরেন্দ্র থেকে বিলে, গড় থেকে অববাহিকায়, শহর থেকে ময়দানে সর্বত্র। মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়নচিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বেঁচে থাকার কায়দা রপ্ত করতে হবে। একটা পাখি কী একটা বনরুই, মৌমাছি কী বৃক্ষ সবাই এই গ্রহে মানুষের মতোই প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির কোনো বাসিন্দাকে হটিয়ে দিয়ে, নিখোঁজ করে কোনোভাবেই মানুষ আনন্দ নিয়ে বাঁচতে পারে না। আর তাই প্রাণবৈচিত্র্যের যে নিদারুণ সংকট আজ মানুষ তৈরি করেছে মানুষকেই এর সমাধানে জানবাজি রেখে দাঁড়াতে হবে।

[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংক্ষণ।]

animistbangla@gmail.com

শনিবার, ২২ মে ২০২১ , ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৯ শাওয়াল ১৪৪২

আমরাই সংকট, আমরাই সমাধান

পাভেল পার্থ

বৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ ন্যায়বিচার নিয়ে কাজের সুবাদে প্রায়ই অনেকে একটা প্রশ্ন করেন, দেশে প্রাণবৈচিত্র্যের কী অবস্থা? অবশ্য তাদের অধিকাংশই ‘জীববৈচিত্র্য’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। এর ভেতর আবার বড় অংশটিই ‘জীববৈচিত্র্য’ বলতে শুধু বন্যপ্রাণী বোঝেন। এর ভেতর বড় দলটি বন্যপ্রাণী বলতে বাঘ, বানর, হাতি কিংবা কুমিরকে সামনে রাখেন। তো, অধিকাংশ সময় আমি এই মৌলিক প্রশ্নটির কোনো যুতসই উত্তর দাঁড় করাতে পারি না। কারণ এ প্রশ্নটি শুনলে বারবার আমার মনে হয়, প্রশ্নটি তো আমাকেও করা হয়েছে। কারণ শুধু বাঘ বা হাতি তো নয়, গাছ কী পাখি বা শামুক কী মানুষ এই দুনিয়ার আমরা সবাই মিলেই তো প্রাণের বৈচিত্র্য। প্রাণবৈচিত্র্য। কিন্তু দেশে প্রকাশিত পাঠ্য কী পাঠ্যের বাইরের তথাকথিত মূলধারার পুস্তকগুলো বরাবর প্রাণবৈচিত্র্য বলতে ‘জীববৈচিত্র্যই’ বোঝাচ্ছে আর ‘জীববৈচিত্র্য’ বলতে মূলত বৃহৎ মেরুদণ্ডী বন্য জন্তুকে চেনাচ্ছে। যারা প্রাণবৈচিত্র্যের এমন একতরফা ও খন্ডিত মানে দাঁড় করিয়েছেন তারা এ বিষয়ে যে অনভিজ্ঞ বা উদাসীন এমন নয়; বরং হিসাবটা অন্য জায়গা। এ এক গভীর রাজনীতি। বৈষম্য এবং চক্রান্তও বলা যায়। কারণ প্রাণবৈচিত্র্যর সদস্য হিসেবে মানুষকে বাদ রেখে চিন্তা করলে যারা এই চিন্তা চাপিয়ে দিচ্ছেন তাদের বেশ ফায়দা হয়। তারা মনে করেন এই দুনিয়া তাদের মতো কিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার তরুলতা, পাখপাখালি, শামুক-ঝিনুক, বাঘ-ভাল্লুক সব মানুষের পদানত হয়েই তো থাকবে। এই দুনিয়ায় তাই এককভাবে মানুষের টিকে থাকবার জন্য আর সব প্রাণকেই শেষ করে দেয়া যায়। লুট, গুম, ধর্ষণ ও হত্যা করা যায়। লাগাতার একতরফা বাণিজ্য করা যায়। আর তাই প্রাণবৈচিত্র্যের তথাকথিত মূলধারার সংজ্ঞা ও উদাহরণে আমরা কখনোই মানুষের প্রতিকৃতি দেখি না। আমাদের দেখানো হয় বাঘ, হাতি বা সিংহের ছবি। কোনো এলাকায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প চাপিয়ে দেয়ার আগে এখন রাষ্ট্রও বলে ‘জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি হবে না, জীববৈচিত্র্য সংক্ষণ করা হবে’। রাষ্ট্রের কাছেও জীববৈচিত্র্য মানে শুধু বন্যপ্রাণী। প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যায়তন, সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, গণমাধ্যম কী রাষ্ট্র এমন এক ভীষণ বৈষম্যমূলক ধারণাকে অনিবার্য করে তুলছে যা দেশের প্রাণবৈচিত্র্যের ধারাকে অবিরাম দম চেপে ধরছে। অথচ বাংলাদেশের গ্রামীণ নি¤œবর্গ হাজার বছর ধরে মনে করে, প্রাণবৈচিত্র্য মানে দুনিয়ার দেখা-অদেখা জানা-অজানা দৃশ্য কি অদৃশ্যমান সব প্রাণের বহুপাক্ষিক বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য। আমাদের সংকট হলো আমরা দেশের মানুষের চিন্তা, জ্ঞান ও দর্শনকে বুঝতে চাইনি, পাত্তা দিইনি, আস্থা রাখিনি। আর তাই আজ তলিয়ে যাওয়া হাওরে মাছ বা ধান মরলে মানুষের কিছু যায় আসে না, নির্বিচারে মানুষ মরলেও তা কীভাবে বন্যপ্রাণকে প্রভাবিত করতে পারে তা আন্দাজ করা হয় না। প্রজাতি হিসেবে মানুষের ভেতর এক অসহনীয় বৈচিত্র্যবিমুখতা তৈরি হয়েছে। আর তাই নিরাপদে প্রশ্নহীনভাবে প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে প্রাণের বৈচিত্র্য, এক সহিংস জোরজুলুমের ভেতর টিকে থাকবার আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু বিবর্তনবিদ্যার নিয়মে এটি প্রজাতির টিকে থাকবার প্রাকৃতিক সংগ্রাম নয়।

২.

প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় এবং বিদ্যায়তনিক পরিসরে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের খতিয়ান বর্ণনা করতে বরাবরই বাংলাদেশের গাছ-পাখি-মাছ এর প্রজাতি সংখ্যা তুলে ধরা হয়। দেশে ভিন্ন ভিন্ন ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলে এখনও অসংখ্য প্রজাতির ধানজাত চাষ হলেও ধান বিজ্ঞানী ড. হেক্টর দেখিয়েছেন একটা সময় এদেশে প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি ধানের চাষ হতো। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষির উন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের ধানের বৈচিত্র্য আজ নিরুদ্দেশ হয়েছে। দেশের সবচে বড় হাওর হাকালুকি, যেখানে প্রতি শীত মওসুমে পরিযায়ী পাখিদের খুন করা হয়। সুন্দরবনের বাঘ আজ মাত্র ১০৬। এক শিঙা গণ্ডার আর হাতি বাণিজ্যের কারণে আগেই প্রাকৃতিক বন থেকে উধাও হয়েছে। রাজা-বাদশাহ কি ব্রিটিশ শোষণ গেলেও এখনও স্বাধীন রাষ্ট্রে হরিণ ও বুনো পাখির মাংশ প্রভাবশালীরাই খায়। দেশের টিকে থাকা একমাত্র জলাবন রাতারগুলকে প্রজাতিশূন্য করবার চেষ্টা চলছে। ভালো নেই শালবন, বর্ষারণ্য, পাহাড়ি বন, গর্জন বন, ঘাসবন, গ্রামীণ বন কী বাদাবন। দেশের সব বাস্তুসংস্থানসহ সামগ্রিক প্রতিবেশ এক জটিল সংকটের মুখোমুখি। মানুষসহ প্রাণের সব বৈচিত্র্যকে আজ শুধু খাদ্য বা আবাস নয়, নিরাপত্তার জন্যও লড়তে হচ্ছে। কিছু মুনাফাভোগী লুটেরা দুর্বৃত্ত লোভী মানুষের জন্যই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুধু তৈরি হয়নি, এটি বহাল আছে এবং এটিই যেন চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রাণবৈচিত্র্যর প্রতি এই যে অবিরাম নিষ্ঠুরতা আর সহিংসতা এর বিরুদ্ধে কী তবে জাগবে না বাংলাদেশ? স্ন্দুরবনের বাঘ, মহানন্দার ঘড়িয়াল, টাঙ্গুয়ার হাওরের বুনো গোলাপ, পদ্মার ইলিশ, লাউয়াছড়ার উল্লুক, শ্যালা নদীর ইরাবতী ডলফিন, হাকালুকির কালিম, উপকূল দ্বীপের চামচ-ঠুঁটো বাটান কী মল্লিকপুরের বিশ্ববট এদের পাশে কী দাঁড়াবে না মানুষ? মানুষের পাশেই তো এরা জীবনভর দাঁড়িয়েছে, জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মানুষ কী করেছে? হাতি মেরে দাঁতের দোকান দিয়েছে। বাঘের চামড়া দেয়ালে ঝুলিয়ে ব্যাটাগিরি প্রমাণ করছে। গরম জামার জন্য ভাল্লুক খুন করছে। কারখানা আর ইটভাটার জন্য গাছেদের নির্মূল করছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর এমন নির্দয় সহিংসতাকে রুখে দাঁড়ায়নি। বরং নানাভাবে তা উসকে দিচ্ছে। রাষ্ট্র যেন আজ প্রাণের দেশ নয়, নির্মম বহুজাতিক বিষ কোম্পানি। শুধু নিজের মুনাফাই গুনছে। ধান জমিনের পোকা দমনে বিষ দিতে গিয়ে মরছে জলের মাছ, মাটির কেঁচো। প্রতিদিন এমন লাগাতার মৃত্যুর নেই কোনো পরিসংখ্যান, নেই ন্যায়বিচার।

৩.

প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ নানা আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হলেও এসবের কোনো প্রয়োগ নেই। প্রাণবৈচিত্র্যের আন্তর্জাতিক সনদের রূপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা এ্যাডহক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করে। ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ সালের সম্মেলনের ভেতর দিয়ে ২২ শে মে ১৯৯২ সালে আফ্রিকার নাইরোবিতে প্রাণবৈচিত্র্য সনদের মূল সনদ অনুমোদনের ভেতর দিয়ে কমিটির কাজ শেষ হয়। ১৯৯২ সালের ৫ জুন ব্রাজিলের রাজধানী রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে স্বাক্ষরের জন্য সনদটি উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯৩ সালের ৪ জুন পর্যন্ত তা স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং ১৬৮টি দেশ তাতে স্বাক্ষর করে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ৫ জুন এ সনদটি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালের ৩ মে অনুসমর্থন দান করে। উক্ত সনদের আলোকে বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে “Biodiversity and community knowledge protection act’’ নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছিল। যদিও এই খসড়াকে বাদ দিয়ে পরবর্তীতে ‘জীববৈচিত্র্য আইন’ চূড়ান্ত হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ সভার দ্বিতীয় কমিটিতে প্রথম উত্থাপিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের’ কথা। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি পালিত হয় প্রতি বছরের ২৯ ডিসেম্বর। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের তারিখটি পরিবর্তিত হয়ে পুনরায় এটি ২২ মে নির্ধারিত হয়। ২০১০ সালকে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ ঘোষণা করা হয়। প্রতি বছর এ দিবসের জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়। ২০২১ সনের জন্য প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘আমরা সমাধানের অংশ # প্রকৃতির জন্য’।

৪.

আসলেই আমরা মানে প্রজাতি হিসেবে মানুষই প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় প্রধান সহযোগী। কারণ মানুষই এই প্রাণ-প্রকৃতির নির্মম হন্তারক। একক প্রজাতি হিসেবে মানুষের লাগাতার ভোগবিলাসিতা, লুণ্ঠন আর খবরদারির জন্যই আজ প্রাণ-প্রকৃতির মুমূর্ষু অবস্থা। আজ যুদ্ধবোমায় ঝলসে দেয়া হচ্ছে ফিলিস্তিন, অঙ্গার হয়েছে আমাজন অরণ্য, রেস্টুরেন্টের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ। দুনিয়াজুড়ে প্রাণ-প্রকৃতির এই নিদান একেবারেই মানুষের তৈরি। মানুষ কেবল একা নিজে জিততে চায়, নিজের বাহাদুরিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একা নিজের খাবার ফলাতে গিয়ে মাটি পানি সব বিষাক্ত করে ফেলতে পারে, অণুজীব থেকে পতঙ্গ সব মেরে ফেলতে পারে। গত ২০ বছরের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও নানা কৃষি বাস্তুসংস্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছি গ্রীষ্মকালেই দেশে প্রাণবৈচিত্র্যের বহুল মৃত্যু ঘটে। কারণ এ ঋতুতেই বোরো মওসুমের ধান কাটা হয় আর ধান বাঁচাতে মানুষ বাবুই, চড়–ই, শালিখ পাখিদের বিষ দিয়ে মারে। এছাড়া বোরো মৌসুমে ব্যবহৃত বিষ ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মাটি ও জলজ প্রাণবৈচিত্র্য নিশ্চিহ্ন করে অন্য মৌসুমের চেয়ে বেশি। এছাড়া এই ‘মধু মাসে’ আম-লিচু ফল বাগানে নির্দয়ভাবে পাখিদের হত্যা করা হয়। এ সময়টাতে উপকূলে বিষ দিয়ে মাছেদেরও মৃত্যু ঘটে। অথচ এটাই আমাদের মানে মানুষের খাদ্য জোগানের এক প্রধান ঋতু। আমাদের এই জোগান, উৎপাদন আর উন্নয়নের পেছনে কত প্রাণ ঝরে যায়, হারিয়ে যায় তার খতিয়ানও আজ আমাদের নেয়া জরুরি। চলমান করোনা মহামারি প্রমাণ করে প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই এই সবুজগ্রহ আমাদের কারোর জন্যই নিরাপদ নয়। তাহলে আমরা করবোটা কি? সংকট যেহেতু আমাদের তৈরি করা, তাই সমাধানও আমাদেরই খুঁজতে হবে। জনে জনে, গ্রামে গ্রামে, পাহাড় থেকে সমতলে, হাওর থেকে অরণ্যে, বরেন্দ্র থেকে বিলে, গড় থেকে অববাহিকায়, শহর থেকে ময়দানে সর্বত্র। মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়নচিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বেঁচে থাকার কায়দা রপ্ত করতে হবে। একটা পাখি কী একটা বনরুই, মৌমাছি কী বৃক্ষ সবাই এই গ্রহে মানুষের মতোই প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির কোনো বাসিন্দাকে হটিয়ে দিয়ে, নিখোঁজ করে কোনোভাবেই মানুষ আনন্দ নিয়ে বাঁচতে পারে না। আর তাই প্রাণবৈচিত্র্যের যে নিদারুণ সংকট আজ মানুষ তৈরি করেছে মানুষকেই এর সমাধানে জানবাজি রেখে দাঁড়াতে হবে।

[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংক্ষণ।]

animistbangla@gmail.com