সৈকতের আলোকচিত্রী, পর্যটকদের অপেক্ষায়

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে হোটেল ছেড়ে সৈকতের দিকে পা বাড়ালাম। লোকজন তেমন একটা না থাকলেও গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে, লাল টিশার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন ১০-১২ জন ফটোগ্রাফার। নোনা জলে পা ভেজানোর ইচ্ছেটা জলাঞ্জলি দিলাম। সভাবসুলভ অনুসন্ধিৎসু আচরণ আমাকে ওদের কাছে টেনে নিয়ে গেল।

কাছে গিয়ে বললাম, ‘এই যে ভাই, একটু কথা শুনবেন?’ আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এলেন কয়েকজন। ‘ছবি ওঠাবেন, স্যার? সকালে কিন্তু ছবি খুব ক্লিয়ার হয়’Ñজিজ্ঞেস করলেন একজন।

‘কী নাম আপনার?’ জানাতে চাইলে বললেন, ‘মো. আজম। আসেন ছবি তুলে দিই।’

‘এখন ছবি ওঠাব না, আপনাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’ আমার কথায় একে অন্যের দিকে চোখাচোখি করতে লাগলো ওরা। একজন বলে উঠল, ‘কী জানতে চান?’

বললাম, ‘এই তো- কেমন ইনকাম এখন, করোনার কারণে তো সৈকত বন্ধ ছিল, পর্যটক কম ছিল। এখন তো সরকার পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছে। আপনাদের কী অবস্থা, এসব আর কী।’

নাঈম নামে একজন বলে উঠলেন, ‘আপনি কি সাংবাদিক?’ উত্তর দিলাম, ‘জি’। ‘কোন চ্যানেলের?’ তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘আমি পত্রিকায় কাজ করি। দৈনিক ‘সংবাদ’-এর রিপোর্টার আমি। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি।’

‘না না! সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। কী লিখতে কী লিখে দেয়, পরে আমাদের কাজ করতে সমস্যা হবে।’ কাঠখোট্টা জবাব তার।

বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘আরে ভাই খারাপ কেন লিখতে যাব। আপনাদের ভালোর জন্য লিখব। আগে কত টাকা ইনকাম হতো? করোনার কারণে পর্যটক কমে গেছে, এখন দৈনিক কত টাকা আয় হয়? আপনাদের দুঃখ-সুখের কথা লিখব।’ বললাম, ‘পর্যটক আসা শুরু হয়েছে, এমন খবর দেখলে তো আরও মানুষ আসতে আগ্রহী হবে। আপনাদের আয়ের সুযোগ বাড়বে।’

নাঈম ছাড়া অন্যরা কিছুটা আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলো। একজন বলে উঠলেন, ‘নাস্তা খাওয়ান আগে’। ঠাট্টা নাকি সত্যি খেতে চাইলেন, সেটা বুঝতে পারিনি।

সবার উদ্দেশে বললাম, ‘এখানে কে সবচেয়ে সিনিয়র (কাজের ক্ষেত্রে), কে সবার আগে এখানে কাজ শুরু করেছেন?’

এরপর কথা বলা শুরু করলেন আজম। বললেন, ‘১৩ বছর ধরে এখানে কাজ করি। আগে স্টুডিওর আন্ডারে কাজ করতাম। এখন নিজের ক্যামেরা আছে।’

‘এখন কামাই কেমন?’ উত্তরে বললেন, ‘আগের মতো কামাই নেই। ট্যুরিস্ট কম। তবে ইদানীং একটু বেড়েছে। লোকজন আসছে। মাঝখানে বন্ধ থাকায়, বেকার হয়ে পড়েছিলাম। এখন টুকটাক ইনকাম হচ্ছে।’ সবাই তার সঙ্গে তাল মেলালেন।

‘যাক ভালো।’ আমিও তাল মেলালাম। লাল ড্রেস আর পরিচয়পত্র প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবারও আজমই উত্তর দিল। বললো, ‘আমরা নিবন্ধিত আলোকচিত্রী। এই পোশাক ছাড়া এখন কাজ করা যায় না। গলায় আইডি কার্ড থাকতে হয়। নয়তো পুলিশ সমস্যা করে।’

ইউনিফর্ম, আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক করায় কোন সমস্যা হচ্ছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে সবাই একযোগ বলে উঠলেন, ‘এটা ভালো হইছে, স্যার।’ ‘ভালো কেন?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেন, ‘আগে বিভিন্ন এলাকা থেইকা নতুন লোক আইসা একটা ক্যামেরা জোগাইতো। এরপর ছবি তোলার কাজ শুরু করতো। এতে নানা বিশৃঙ্খলা হইতো। অহন আর এইডা পারে না।’ ‘কতজন আছেন নিবন্ধিত?’ উত্তরে তারা জানালেন, ‘হবে ৬শ’র মতো।’

নতুন কেউ কার্ড করতে চাইলে পাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বললেন, ‘না। নতুন কার্ড আপাতত দেয়া হয় না।’ একজন বললেন, ‘এমনিতেই ফটোগ্রাফার অনেক। কাজ পেতে কষ্ট হয়। এর ওপর আবার ট্যুরিস্টদের হাতে হাতে এখন দামি ফোন। বেশির ভাগই মোবাইলে ছবি তোলে, আর সেল্ফি তোলে।’

এই কার্ড কতদিনের জন্য দেয়া হয়? প্রশ্নের উত্তরে একজন জানালেন, প্রতি বছর কার্ড নবায়ন করতে হয়। এ জন্য কোন টাকা লাগে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিলেও একজন বললেন, ‘টাকা ছাড়া কি এখন কিছু হয়!’

কথা শেষে উপস্থিত সবাইকে পাশপাশি দাড়ানোর অনুরোধ জানালাম ছবি নেয়ার জন্য। বেশ কয়েকজন দাঁড়ালেন। একে একে তাদের পরিচয় জানলাম। কেউ চকরিয়ার, কেউ ইনানীর। আবার অনেকে সদরের। তবে সবাই কক্সবাজারের।

ছবি তোলার সময় একজন বললেন, ‘আমাদের ছবি কি পেপারে ছাপা হইব?’ সম্মতিসূচক ইশারা পেতেই তৌহিদ নামের একজন বললেন, ‘আমরা মানুষের ফটো তুলি। আজ আমরাই ক্যামেরাবন্দী হইলাম। ছবিটা পাঠায় দিয়েন, স্যার। আমার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা নিয়ে যান।’ বললাম, নিশ্চই। ঢাকা গিয়ে নিউজ করব। ছাপা হলে পাঠিয়ে দেব। মোবাইলে টুকে নিলাম তার নাম্বার।

বিদায়বেলা আজমের হাতে আমার ‘ভিজিটিং কার্ড’ দিলাম। সবাই হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় জানালো আমাকে। দুই একজন আওয়াজ দিল, ‘আবার আসবেন, স্যার।’

image

বাঁ দিক থেকে মুন্না, আজম, তৌহিদ, নাঈম, রানা। ছবিটি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে তোলা - সংবাদ

আরও খবর
ইভ্যালিতে বিনিয়োগকারীর অর্থ কোথায় গেল, জানতে গোয়েন্দারা মাঠে
দুর্নীতিবাজরা যাতে শাস্তি পায় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ রাষ্ট্রপতির
এসআই মামুন হত্যা, ফারিয়ার আত্মসমর্পণ
স্কুল-কলেজ খোলার পর সংক্রমণের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি : শিক্ষামন্ত্রী
কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের নিয়ে বিএনপির বৈঠক
জঙ্গি উদ্বুদ্ধকারী বই প্রকাশ ‘এটিবি সদস্য’ গ্রেপ্তার
পাবনায় সরকারি জমি দখল ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলায় ইউপি চেয়ারম্যানকে সাবেক এমপির হত্যার হুমকি
সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজার চর্চা নিশ্চিতে নীতিমালা প্রণয়নে হাইকোর্টের রুল
মিটফোর্ডে নকল-ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ি, অভিযানেও থামছে না
পাবনায় হালাল উপার্জনের প্রলোভনে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, স্কুল শিক্ষিকা গ্রেপ্তার

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৫ আশ্বিন ১৪২৮ ১১ সফর ১৪৪৩

সৈকতের আলোকচিত্রী, পর্যটকদের অপেক্ষায়

ফয়েজ আহমেদ তুষার, কক্সবাজার থেকে ফিরে

image

বাঁ দিক থেকে মুন্না, আজম, তৌহিদ, নাঈম, রানা। ছবিটি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে তোলা - সংবাদ

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে হোটেল ছেড়ে সৈকতের দিকে পা বাড়ালাম। লোকজন তেমন একটা না থাকলেও গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে, লাল টিশার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন ১০-১২ জন ফটোগ্রাফার। নোনা জলে পা ভেজানোর ইচ্ছেটা জলাঞ্জলি দিলাম। সভাবসুলভ অনুসন্ধিৎসু আচরণ আমাকে ওদের কাছে টেনে নিয়ে গেল।

কাছে গিয়ে বললাম, ‘এই যে ভাই, একটু কথা শুনবেন?’ আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এলেন কয়েকজন। ‘ছবি ওঠাবেন, স্যার? সকালে কিন্তু ছবি খুব ক্লিয়ার হয়’Ñজিজ্ঞেস করলেন একজন।

‘কী নাম আপনার?’ জানাতে চাইলে বললেন, ‘মো. আজম। আসেন ছবি তুলে দিই।’

‘এখন ছবি ওঠাব না, আপনাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’ আমার কথায় একে অন্যের দিকে চোখাচোখি করতে লাগলো ওরা। একজন বলে উঠল, ‘কী জানতে চান?’

বললাম, ‘এই তো- কেমন ইনকাম এখন, করোনার কারণে তো সৈকত বন্ধ ছিল, পর্যটক কম ছিল। এখন তো সরকার পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছে। আপনাদের কী অবস্থা, এসব আর কী।’

নাঈম নামে একজন বলে উঠলেন, ‘আপনি কি সাংবাদিক?’ উত্তর দিলাম, ‘জি’। ‘কোন চ্যানেলের?’ তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘আমি পত্রিকায় কাজ করি। দৈনিক ‘সংবাদ’-এর রিপোর্টার আমি। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি।’

‘না না! সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। কী লিখতে কী লিখে দেয়, পরে আমাদের কাজ করতে সমস্যা হবে।’ কাঠখোট্টা জবাব তার।

বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘আরে ভাই খারাপ কেন লিখতে যাব। আপনাদের ভালোর জন্য লিখব। আগে কত টাকা ইনকাম হতো? করোনার কারণে পর্যটক কমে গেছে, এখন দৈনিক কত টাকা আয় হয়? আপনাদের দুঃখ-সুখের কথা লিখব।’ বললাম, ‘পর্যটক আসা শুরু হয়েছে, এমন খবর দেখলে তো আরও মানুষ আসতে আগ্রহী হবে। আপনাদের আয়ের সুযোগ বাড়বে।’

নাঈম ছাড়া অন্যরা কিছুটা আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলো। একজন বলে উঠলেন, ‘নাস্তা খাওয়ান আগে’। ঠাট্টা নাকি সত্যি খেতে চাইলেন, সেটা বুঝতে পারিনি।

সবার উদ্দেশে বললাম, ‘এখানে কে সবচেয়ে সিনিয়র (কাজের ক্ষেত্রে), কে সবার আগে এখানে কাজ শুরু করেছেন?’

এরপর কথা বলা শুরু করলেন আজম। বললেন, ‘১৩ বছর ধরে এখানে কাজ করি। আগে স্টুডিওর আন্ডারে কাজ করতাম। এখন নিজের ক্যামেরা আছে।’

‘এখন কামাই কেমন?’ উত্তরে বললেন, ‘আগের মতো কামাই নেই। ট্যুরিস্ট কম। তবে ইদানীং একটু বেড়েছে। লোকজন আসছে। মাঝখানে বন্ধ থাকায়, বেকার হয়ে পড়েছিলাম। এখন টুকটাক ইনকাম হচ্ছে।’ সবাই তার সঙ্গে তাল মেলালেন।

‘যাক ভালো।’ আমিও তাল মেলালাম। লাল ড্রেস আর পরিচয়পত্র প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবারও আজমই উত্তর দিল। বললো, ‘আমরা নিবন্ধিত আলোকচিত্রী। এই পোশাক ছাড়া এখন কাজ করা যায় না। গলায় আইডি কার্ড থাকতে হয়। নয়তো পুলিশ সমস্যা করে।’

ইউনিফর্ম, আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক করায় কোন সমস্যা হচ্ছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে সবাই একযোগ বলে উঠলেন, ‘এটা ভালো হইছে, স্যার।’ ‘ভালো কেন?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে একজন বললেন, ‘আগে বিভিন্ন এলাকা থেইকা নতুন লোক আইসা একটা ক্যামেরা জোগাইতো। এরপর ছবি তোলার কাজ শুরু করতো। এতে নানা বিশৃঙ্খলা হইতো। অহন আর এইডা পারে না।’ ‘কতজন আছেন নিবন্ধিত?’ উত্তরে তারা জানালেন, ‘হবে ৬শ’র মতো।’

নতুন কেউ কার্ড করতে চাইলে পাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বললেন, ‘না। নতুন কার্ড আপাতত দেয়া হয় না।’ একজন বললেন, ‘এমনিতেই ফটোগ্রাফার অনেক। কাজ পেতে কষ্ট হয়। এর ওপর আবার ট্যুরিস্টদের হাতে হাতে এখন দামি ফোন। বেশির ভাগই মোবাইলে ছবি তোলে, আর সেল্ফি তোলে।’

এই কার্ড কতদিনের জন্য দেয়া হয়? প্রশ্নের উত্তরে একজন জানালেন, প্রতি বছর কার্ড নবায়ন করতে হয়। এ জন্য কোন টাকা লাগে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিলেও একজন বললেন, ‘টাকা ছাড়া কি এখন কিছু হয়!’

কথা শেষে উপস্থিত সবাইকে পাশপাশি দাড়ানোর অনুরোধ জানালাম ছবি নেয়ার জন্য। বেশ কয়েকজন দাঁড়ালেন। একে একে তাদের পরিচয় জানলাম। কেউ চকরিয়ার, কেউ ইনানীর। আবার অনেকে সদরের। তবে সবাই কক্সবাজারের।

ছবি তোলার সময় একজন বললেন, ‘আমাদের ছবি কি পেপারে ছাপা হইব?’ সম্মতিসূচক ইশারা পেতেই তৌহিদ নামের একজন বললেন, ‘আমরা মানুষের ফটো তুলি। আজ আমরাই ক্যামেরাবন্দী হইলাম। ছবিটা পাঠায় দিয়েন, স্যার। আমার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা নিয়ে যান।’ বললাম, নিশ্চই। ঢাকা গিয়ে নিউজ করব। ছাপা হলে পাঠিয়ে দেব। মোবাইলে টুকে নিলাম তার নাম্বার।

বিদায়বেলা আজমের হাতে আমার ‘ভিজিটিং কার্ড’ দিলাম। সবাই হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় জানালো আমাকে। দুই একজন আওয়াজ দিল, ‘আবার আসবেন, স্যার।’