কবি জসীমউদ্দীনের রাখাল ভাবনার বিবর্তন ও বহুমাত্রিকতা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

হাজার বছরের বাংলা কবিতার বিকাশের ধারায় কবি জসীমউদ্দীন একটি উজ্জ্বল ও বিশিষ্ট নাম। রবীন্দ্রযুগের কবি হয়েও রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে পল্লীজীবনকে অবলম্বন করে জসীমউদ্দীন নির্মাণ করেছেন স্বকীয় এক কাব্যভুবন। তার সাধনায় খুলে গেছে বাংলা কবিতার নতুন এক দুয়ার। বাংলা গীতিকা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জসীমউদ্দীন আধুনিক দৃষ্টি দিয়ে চোখ ফেরালেন পল্লীজীবনের দিকে, পল্লীর সহজ জীবন-প্যাটার্নের দিকে, বাংলার লোকজীবনের বৃহত্তর আঙ্গিনায়থ অবারিত গ্রামীণ জনপদে তিনি খুঁজে পেলেন তার শিল্পবৃক্ষের প্রত্নবীজ। বাংলার গ্রামীণ-প্রকৃতি আর পল্লীর সাধারণ মানুষ নিয়েই গড়ে উঠেছে জসীমউদ্দীনের কবিতালোক। গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক বিস্ময়কর এক কবি ভাষায় হাজার বছরের বাংলার পল্লী নতুন প্রাণ নিয়ে জেগে উঠল জসীমউদ্দীনের কবিতায়। জসীমউদ্দীনের কবিতায় যেসব মানুষের ছবি পাই, যাদের অবলম্বন করে তিনি নির্মাণ করেছেন তার কবি-আত্মার পরম আকাক্সক্ষার কথা, তাদের অন্যতম হচ্ছে ‘রাখাল’। জসীমউদ্দীনের কবিতায় বিচিত্র অনুষঙ্গে এবং বহুমাত্রিক পরিচয়ে রাখালের উপস্থিতি সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। তবু এতকাল জসীমউদ্দীনের এ রাখাল সমালোচকের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে গেছে, ধরা পড়েনি তার রূপ আর রূপান্তরের ব্যঞ্জনা। জসীমউদ্দীনের কাব্যে উপেক্ষিত এই রাখাল নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করব, জানতে চাইব তার ‘রাখাল’-এর মৌল স্বরূপ আর রাখালকে কেন্দ্র করে তার পরম আকাক্সক্ষার কথা।

জসীমউদ্দীনের প্রথম পর্বের কবিতায়, প্রধানত রাখালী কাব্যে, পল্লীজীবনের অন্তরঙ্গ আত্মীয় গ্রামীণ রাখালের একটি সহজ নিরাভরণ রূপ অঙ্কিত হয়েছে। রাখাল আর পল্লীজীবন যেন একসূত্রে গাঁথা রাখালের সোহাগ আর শুশ্রষাতেই সুশ্রী হয়, ঋদ্ধিময় হয় গ্রামীণ জনপদ। ফসলের মাঠে দিনভর কাজ আর কাজ, হঠাৎ সামান্য অবসর পেলেই বাঁশি নিয়ে বিভোর হয়ে যাওয়া গ্রামীণ রাখালের এই পরিচয় আমাদের অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল। ‘রাখাল ছেলে’ কবিতায় আমরা পেয়ে যাই কর্মব্যস্ত পরমাত্মীয় সেই রাখালের সাক্ষাৎ-

‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,/ এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।’

বর্তমানের গ্রামীণ রাখালকে জসীমউদ্দীন কখনও কখনও তার কবিতায় নিয়ে গেছেন পুরাণের আর এক রাখালের কাছে, নাম যার কৃষ্ণ। গ্রামীণ রাখাল আর পুরাণের রাখাল জসীমউদ্দীনের কবি-আত্মার আন্তর-বাসনায় পরিণত হয়েছে এক অখন্ড সত্তায়- পল্লীর রাখাল ছেলেই হয়ে ওঠে কৃষ্ণ, জলীর বিলের কোনো এক গাঁয়ের রূপাই বৃন্দাবনের কৃষ্ণ হয়ে বাজায় বেদনার পৌরাণিক বাঁশি, আর তার মায়ের অবয়বে হঠাৎ করেই হেসে ওঠে দূর-অতীতের ধাত্রীমাতা যশোদা-

তরুণ কিশোর ছেলে/ আমরা আজিকে ভাবিয়া না পাই তুমি হেথা কেন এলে?/ তুমি ভাই সেই ব্রজের রাখাল, পাতার মুকুট পরি,/ তোমাদের রাজা আজো নাকি খেলে গেঁয়ো মাঠখানি ভরি।/ আজো নাকি সেই বাঁশির রাজাটি তমাল-লতার ফাঁদে, চরণ জড়ায়ে নূপুর হারায়ে পথের ধুলায় কাঁদে।/ কে এলে তবে ভাই,/ সোনার গোকুল আঁধার করিয়া এই মথুরার ঠাঁই [‘তরুণ কিশোর’/রাখালী]

এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,/ কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!/.কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,/ কালো দোতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লেখি।/ জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়;/ চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করছে জয়।/কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,/ তারির পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।/ সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ,/ কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক।/ যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও!/ সেই কালোতে সিনান্-করি উজল তাহার গাঁও। [নকশি কাঁথার মাঠ]

রাখালের রাজা! আমাদের ফেলি কোথা গেলে ভাই চলে,/ বুক হতে খুলি সোনালতাগুলি কেন গেলে পায়ে দলে?/ ...হাজার কৃষাণ কাঁদিছে অঝোরে কোথা তুমি মহারাজ?/ ব্রজের আকাশ ফাড়িয়া ফাড়িয়া হাঁকিছে বিরহ-বাজ।/...পষ্ট করিয়া কহিছি কানাই, এখনও সময় আছে,/ গাঁয়ে ফিরে চল, নতুবা তোমায় কাঁদিতে হইবে পাছে।/ জনম-দুখিনী পল্লী-যশোদা আশায় রয়েছে বাঁচি,/ পাতায় পাতায় লতায় লতায় লতিয়ে স্নেহের সাজি।/ আঁধা, পুকুরের পচা কালো জলে মরছে কমল-রাধা,/ কৃষাণ বধূরা সিনান করিতে শুনে যায় তারি কাঁদা। [‘রাখালের রাজগী’/ধানখেত]

প্রথম উদ্ধৃতিতে গ্রামের রাখাল ছেলে সহসাই হয়ে যায় ব্রজের রাখাল কৃষ্ণ, আর মুহূর্তেই তার হাতে ওঠে অবিস্মরণীয় সেই বাঁশি, যার সুরে মোহিত ছিল রাধা। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে কৃষ্ণবর্ণের রাখালের সঙ্গে শ্যামবর্ণ কৃষ্ণের সাযুজ্যচিত্র অঙ্কিত হয়েছে, অঙ্কিত হয়েছে বৃন্দাবনে সবার মন-ভোলানো কৃষ্ণরূপী রূপাই-এর ছবি, সে-ও জলীর ধারের ‘বৃন্দাবন’কে তার শক্তি আর সাহস আর সৌন্দর্য দিয়ে করে তুলেছে মাতোয়ারা। দুই যুগের দুই নায়কের সাযুজ্যবন্ধন, কিংবা বলি আন্তরমিল দেখানোর জন্য জসীমউদ্দীন অসামান্য তাৎপর্যে এখানে ব্যবহার করেছেন ‘কালো’ রঙ-এর ব্যঞ্জনা। কৃষ্ণও ছিল কালো, কালো জলীর বিলের রূপাইও। তৃতীয় উদ্ধৃতিতে গ্রামের রাখাল আর পুরাণের কৃষ্ণ, পল্লি-জননী আর যশোদা, কৃষাণ-বধূ আর রাধা, বাংলাদেশের নাম-না-জানা কোনো-এক অখ্যাত গাঁও আর স্মৃতিলোকের বৃন্দাবন- সবকিছু মিলেমিশে একাকার।

গ্রামের রাখাল আর ব্রজের রাখাল- উভয়ের মধ্যে সাযুজ্যচিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে জসীমউদ্দীন পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহার করেছেন ‘বাঁশি’ অনুষঙ্গ। জসীমউদ্দীনের কবিতায় ভালোবাসা আর বেদনা, আহ্বান আর আনন্দ, মিলন আর বিরহের সমার্থক হয়ে গেছে ‘বাঁশি’ শব্দটি। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে ‘বাঁশি’ জসীমউদ্দীনের কবিতায় সঙ্কেত-এ উন্নীত হয়েছে। গ্রামের রাখালের বাঁশি মুহূর্তেই ওঠে কৃষ্ণের অধরে- সোজনের বাঁশির সুর দুলীর কাছে মুহূর্তেই মনে হয় যেন রাধাকে ঘর-ছাড়া করা কৃষ্ণের বাঁশির সুর-

আহা! ওই শোন, বেদে নাও হতে কেমন বাজিছে বাঁশি,/ আহারে কাহার বুক ভাঙিয়াছে লয়ে কি দুখের রাশি!

[সোজন বাদিয়ার ঘাট]

কখনও-বা মাঠের রাখাল রূপাইয়ের বেদনা আর রাধাকে পেতে উদ্গ্রীব কৃষ্ণের আকুলতা একাকার হয়ে সৃষ্টি হয় যন্ত্রণার চিরায়ত এক সুরধ্বনি-

মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি?/ মিছেই মোদের সুখ-দুঃখ দিয়ে তার সুখ-দুঃখ খুঁজি।

[সোজন বাদিয়ার ঘাট]

বৃন্দাবনে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে বিভোর হয়েছিল রাধা, আর শিমুলতলীতে সোজনের বাঁশির সুরে আত্মহারা হলো দুলী- দু’যুগের দুই নারীকে ঘরছাড়া করল যে পুরুষ- সেই কৃষ্ণ সেই সোজন-তো এভাবেও, নারীর বেদনাসম্ভব-সূত্রে, হয়ে ওঠে এক সত্তা। বাঁশিতে আত্মহারা রাধা আর দুলীও যেন এক-প্রাণ। পল্লীর রাখাল আর পুরাণের কৃষ্ণের নানামাত্রিক সাযুজ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি জসীমউদ্দীন তার কবিতায় রাখালের মনোলোক উন্মোচনের জন্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য এবং বৈষ্ণব পদাবলীর নানা শব্দ ও অনুষঙ্গও সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। শাঁখের করাত, বৃন্দাবন, কৃষ্ণ, কানাই, মথুরা, বাঁশি, যশোদা, সিনান, উজল, কালীদহ, ঘন-দেয়া-সম্পাদ, গোকুল, কালিন্দী, তমালতল, ব্রজের দুলাল, ব্রজধূলি, সুদূর কৃষাণ-পুর, কালো যমুনার জল বেণুবন, কমল-রাধা, কদম্ব-রেণু, নিঠুর বংশীয়াল, মৃদঙ্গ, মোহন বাঁশি, রাধিকা, কৈশোর যৌবন দুহু মেলি গেল, কংস-কারা, গোপী- এসব শব্দ-ব্যবহার থেকেও অনুধাবন করা যায় রাখাল-প্রসঙ্গে জসীমউদ্দীনের কাব্য-প্রত্যয়ের মৌল সুরটি।

উপর্যুক্ত আলোচনায় একথা উপস্থাপিত হয়েছে যে, পল্লীর রাখাল ছেলে জসীমউদ্দীনের কবিতায় পুরাণের কৃষ্ণ-অবয়ব পেয়ে নতুন তাৎপর্যে অভিষিক্ত হয়েছে। পল্লীর রাখাল ছেলে বিরামহীন কাজ করে নির্মাণ করে সভ্যতা-সৌধ, বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মথুরায় গিয়ে কংসকে হত্যা করে রক্ষা করে মানবসভ্যতা, আর এমনি আরেক রাখাল- রাজনীতির রাখাল- হানাদার-শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আকাশে তুলে ধরেন স্বাধীনতার পতাকা। ত্রিমাত্রিক এই রাখালের তৃতীয় রাখাল, রাজনীতির এই রাখালের ছবি অঙ্কন করে জসীমউদ্দীন সম্পন্ন করেন তার রাখাল-ভাবনা। রাজনীতির এই রাখাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে জসীমউদ্দীন লিখেছেন অসাধারণ এক কবিতা ‘বঙ্গবন্ধু’, যেখানে তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর গৌরবান্বিত সংগ্রামের ইতিহাস চিত্রিত করেছেন- মুজিবর রহমান!

ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।/...বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ,/ প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।/ তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার/ অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছেথ স্তব্ধ হুকুমদার।/...আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,/ দিকে দিগন্তে বাজিল যেদিন বাঙালির জয়ভেরী।/ মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার,/ বঙ্গ-বন্ধু শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।/ আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা,/ জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এ দেশ সীমিত-বসুন্ধরা।/ মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,/ বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকশিকাঁথার ছবি। [‘বঙ্গবন্ধু’/ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে]

এইভাবে দেখা যায়, গ্রামের রাখাল ছেলে, পুরাণের কৃষ্ণ আর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অবিস্মরণীয় রাখাল বঙ্গবন্ধু জসীমউদ্দীনের কবিতায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়- তিন রাখাল মিলে সৃষ্টি হয় একটি একক সত্তা-স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি আর মানবকল্যাণই যার কেন্দ্রীয় অভীপ্সা। তিন প্রান্তের তিন রাখাল মিলে পূর্ণ হয় জসীমউদ্দীনের রাখাল-ভাবনা। পল্লী জীবনের রূপকার হিসেবে জসীমউদ্দীনের স্বকীয়তার পাশাপাশি এ রাখাল-প্রত্যয়ও তার প্রাগ্রসর কাব্য-ভাবনার ফল। জসীমউদ্দীনের এ ত্রিমাত্রিক রাখাল-সত্তা থেকে আমরা তার মানবকল্যাণকামী কাব্যবিশ্বাসকেই আবিষ্কার করতে পারি।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি ]

শুক্রবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২২ , ২৩ পৌষ ১৪২৮ ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

কবি জসীমউদ্দীনের রাখাল ভাবনার বিবর্তন ও বহুমাত্রিকতা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

হাজার বছরের বাংলা কবিতার বিকাশের ধারায় কবি জসীমউদ্দীন একটি উজ্জ্বল ও বিশিষ্ট নাম। রবীন্দ্রযুগের কবি হয়েও রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে পল্লীজীবনকে অবলম্বন করে জসীমউদ্দীন নির্মাণ করেছেন স্বকীয় এক কাব্যভুবন। তার সাধনায় খুলে গেছে বাংলা কবিতার নতুন এক দুয়ার। বাংলা গীতিকা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জসীমউদ্দীন আধুনিক দৃষ্টি দিয়ে চোখ ফেরালেন পল্লীজীবনের দিকে, পল্লীর সহজ জীবন-প্যাটার্নের দিকে, বাংলার লোকজীবনের বৃহত্তর আঙ্গিনায়থ অবারিত গ্রামীণ জনপদে তিনি খুঁজে পেলেন তার শিল্পবৃক্ষের প্রত্নবীজ। বাংলার গ্রামীণ-প্রকৃতি আর পল্লীর সাধারণ মানুষ নিয়েই গড়ে উঠেছে জসীমউদ্দীনের কবিতালোক। গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক বিস্ময়কর এক কবি ভাষায় হাজার বছরের বাংলার পল্লী নতুন প্রাণ নিয়ে জেগে উঠল জসীমউদ্দীনের কবিতায়। জসীমউদ্দীনের কবিতায় যেসব মানুষের ছবি পাই, যাদের অবলম্বন করে তিনি নির্মাণ করেছেন তার কবি-আত্মার পরম আকাক্সক্ষার কথা, তাদের অন্যতম হচ্ছে ‘রাখাল’। জসীমউদ্দীনের কবিতায় বিচিত্র অনুষঙ্গে এবং বহুমাত্রিক পরিচয়ে রাখালের উপস্থিতি সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। তবু এতকাল জসীমউদ্দীনের এ রাখাল সমালোচকের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে গেছে, ধরা পড়েনি তার রূপ আর রূপান্তরের ব্যঞ্জনা। জসীমউদ্দীনের কাব্যে উপেক্ষিত এই রাখাল নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করব, জানতে চাইব তার ‘রাখাল’-এর মৌল স্বরূপ আর রাখালকে কেন্দ্র করে তার পরম আকাক্সক্ষার কথা।

জসীমউদ্দীনের প্রথম পর্বের কবিতায়, প্রধানত রাখালী কাব্যে, পল্লীজীবনের অন্তরঙ্গ আত্মীয় গ্রামীণ রাখালের একটি সহজ নিরাভরণ রূপ অঙ্কিত হয়েছে। রাখাল আর পল্লীজীবন যেন একসূত্রে গাঁথা রাখালের সোহাগ আর শুশ্রষাতেই সুশ্রী হয়, ঋদ্ধিময় হয় গ্রামীণ জনপদ। ফসলের মাঠে দিনভর কাজ আর কাজ, হঠাৎ সামান্য অবসর পেলেই বাঁশি নিয়ে বিভোর হয়ে যাওয়া গ্রামীণ রাখালের এই পরিচয় আমাদের অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল। ‘রাখাল ছেলে’ কবিতায় আমরা পেয়ে যাই কর্মব্যস্ত পরমাত্মীয় সেই রাখালের সাক্ষাৎ-

‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,/ এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।’

বর্তমানের গ্রামীণ রাখালকে জসীমউদ্দীন কখনও কখনও তার কবিতায় নিয়ে গেছেন পুরাণের আর এক রাখালের কাছে, নাম যার কৃষ্ণ। গ্রামীণ রাখাল আর পুরাণের রাখাল জসীমউদ্দীনের কবি-আত্মার আন্তর-বাসনায় পরিণত হয়েছে এক অখন্ড সত্তায়- পল্লীর রাখাল ছেলেই হয়ে ওঠে কৃষ্ণ, জলীর বিলের কোনো এক গাঁয়ের রূপাই বৃন্দাবনের কৃষ্ণ হয়ে বাজায় বেদনার পৌরাণিক বাঁশি, আর তার মায়ের অবয়বে হঠাৎ করেই হেসে ওঠে দূর-অতীতের ধাত্রীমাতা যশোদা-

তরুণ কিশোর ছেলে/ আমরা আজিকে ভাবিয়া না পাই তুমি হেথা কেন এলে?/ তুমি ভাই সেই ব্রজের রাখাল, পাতার মুকুট পরি,/ তোমাদের রাজা আজো নাকি খেলে গেঁয়ো মাঠখানি ভরি।/ আজো নাকি সেই বাঁশির রাজাটি তমাল-লতার ফাঁদে, চরণ জড়ায়ে নূপুর হারায়ে পথের ধুলায় কাঁদে।/ কে এলে তবে ভাই,/ সোনার গোকুল আঁধার করিয়া এই মথুরার ঠাঁই [‘তরুণ কিশোর’/রাখালী]

এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,/ কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!/.কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,/ কালো দোতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লেখি।/ জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়;/ চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করছে জয়।/কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,/ তারির পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।/ সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ,/ কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক।/ যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও!/ সেই কালোতে সিনান্-করি উজল তাহার গাঁও। [নকশি কাঁথার মাঠ]

রাখালের রাজা! আমাদের ফেলি কোথা গেলে ভাই চলে,/ বুক হতে খুলি সোনালতাগুলি কেন গেলে পায়ে দলে?/ ...হাজার কৃষাণ কাঁদিছে অঝোরে কোথা তুমি মহারাজ?/ ব্রজের আকাশ ফাড়িয়া ফাড়িয়া হাঁকিছে বিরহ-বাজ।/...পষ্ট করিয়া কহিছি কানাই, এখনও সময় আছে,/ গাঁয়ে ফিরে চল, নতুবা তোমায় কাঁদিতে হইবে পাছে।/ জনম-দুখিনী পল্লী-যশোদা আশায় রয়েছে বাঁচি,/ পাতায় পাতায় লতায় লতায় লতিয়ে স্নেহের সাজি।/ আঁধা, পুকুরের পচা কালো জলে মরছে কমল-রাধা,/ কৃষাণ বধূরা সিনান করিতে শুনে যায় তারি কাঁদা। [‘রাখালের রাজগী’/ধানখেত]

প্রথম উদ্ধৃতিতে গ্রামের রাখাল ছেলে সহসাই হয়ে যায় ব্রজের রাখাল কৃষ্ণ, আর মুহূর্তেই তার হাতে ওঠে অবিস্মরণীয় সেই বাঁশি, যার সুরে মোহিত ছিল রাধা। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে কৃষ্ণবর্ণের রাখালের সঙ্গে শ্যামবর্ণ কৃষ্ণের সাযুজ্যচিত্র অঙ্কিত হয়েছে, অঙ্কিত হয়েছে বৃন্দাবনে সবার মন-ভোলানো কৃষ্ণরূপী রূপাই-এর ছবি, সে-ও জলীর ধারের ‘বৃন্দাবন’কে তার শক্তি আর সাহস আর সৌন্দর্য দিয়ে করে তুলেছে মাতোয়ারা। দুই যুগের দুই নায়কের সাযুজ্যবন্ধন, কিংবা বলি আন্তরমিল দেখানোর জন্য জসীমউদ্দীন অসামান্য তাৎপর্যে এখানে ব্যবহার করেছেন ‘কালো’ রঙ-এর ব্যঞ্জনা। কৃষ্ণও ছিল কালো, কালো জলীর বিলের রূপাইও। তৃতীয় উদ্ধৃতিতে গ্রামের রাখাল আর পুরাণের কৃষ্ণ, পল্লি-জননী আর যশোদা, কৃষাণ-বধূ আর রাধা, বাংলাদেশের নাম-না-জানা কোনো-এক অখ্যাত গাঁও আর স্মৃতিলোকের বৃন্দাবন- সবকিছু মিলেমিশে একাকার।

গ্রামের রাখাল আর ব্রজের রাখাল- উভয়ের মধ্যে সাযুজ্যচিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে জসীমউদ্দীন পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহার করেছেন ‘বাঁশি’ অনুষঙ্গ। জসীমউদ্দীনের কবিতায় ভালোবাসা আর বেদনা, আহ্বান আর আনন্দ, মিলন আর বিরহের সমার্থক হয়ে গেছে ‘বাঁশি’ শব্দটি। বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে ‘বাঁশি’ জসীমউদ্দীনের কবিতায় সঙ্কেত-এ উন্নীত হয়েছে। গ্রামের রাখালের বাঁশি মুহূর্তেই ওঠে কৃষ্ণের অধরে- সোজনের বাঁশির সুর দুলীর কাছে মুহূর্তেই মনে হয় যেন রাধাকে ঘর-ছাড়া করা কৃষ্ণের বাঁশির সুর-

আহা! ওই শোন, বেদে নাও হতে কেমন বাজিছে বাঁশি,/ আহারে কাহার বুক ভাঙিয়াছে লয়ে কি দুখের রাশি!

[সোজন বাদিয়ার ঘাট]

কখনও-বা মাঠের রাখাল রূপাইয়ের বেদনা আর রাধাকে পেতে উদ্গ্রীব কৃষ্ণের আকুলতা একাকার হয়ে সৃষ্টি হয় যন্ত্রণার চিরায়ত এক সুরধ্বনি-

মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি?/ মিছেই মোদের সুখ-দুঃখ দিয়ে তার সুখ-দুঃখ খুঁজি।

[সোজন বাদিয়ার ঘাট]

বৃন্দাবনে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে বিভোর হয়েছিল রাধা, আর শিমুলতলীতে সোজনের বাঁশির সুরে আত্মহারা হলো দুলী- দু’যুগের দুই নারীকে ঘরছাড়া করল যে পুরুষ- সেই কৃষ্ণ সেই সোজন-তো এভাবেও, নারীর বেদনাসম্ভব-সূত্রে, হয়ে ওঠে এক সত্তা। বাঁশিতে আত্মহারা রাধা আর দুলীও যেন এক-প্রাণ। পল্লীর রাখাল আর পুরাণের কৃষ্ণের নানামাত্রিক সাযুজ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি জসীমউদ্দীন তার কবিতায় রাখালের মনোলোক উন্মোচনের জন্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য এবং বৈষ্ণব পদাবলীর নানা শব্দ ও অনুষঙ্গও সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। শাঁখের করাত, বৃন্দাবন, কৃষ্ণ, কানাই, মথুরা, বাঁশি, যশোদা, সিনান, উজল, কালীদহ, ঘন-দেয়া-সম্পাদ, গোকুল, কালিন্দী, তমালতল, ব্রজের দুলাল, ব্রজধূলি, সুদূর কৃষাণ-পুর, কালো যমুনার জল বেণুবন, কমল-রাধা, কদম্ব-রেণু, নিঠুর বংশীয়াল, মৃদঙ্গ, মোহন বাঁশি, রাধিকা, কৈশোর যৌবন দুহু মেলি গেল, কংস-কারা, গোপী- এসব শব্দ-ব্যবহার থেকেও অনুধাবন করা যায় রাখাল-প্রসঙ্গে জসীমউদ্দীনের কাব্য-প্রত্যয়ের মৌল সুরটি।

উপর্যুক্ত আলোচনায় একথা উপস্থাপিত হয়েছে যে, পল্লীর রাখাল ছেলে জসীমউদ্দীনের কবিতায় পুরাণের কৃষ্ণ-অবয়ব পেয়ে নতুন তাৎপর্যে অভিষিক্ত হয়েছে। পল্লীর রাখাল ছেলে বিরামহীন কাজ করে নির্মাণ করে সভ্যতা-সৌধ, বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মথুরায় গিয়ে কংসকে হত্যা করে রক্ষা করে মানবসভ্যতা, আর এমনি আরেক রাখাল- রাজনীতির রাখাল- হানাদার-শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আকাশে তুলে ধরেন স্বাধীনতার পতাকা। ত্রিমাত্রিক এই রাখালের তৃতীয় রাখাল, রাজনীতির এই রাখালের ছবি অঙ্কন করে জসীমউদ্দীন সম্পন্ন করেন তার রাখাল-ভাবনা। রাজনীতির এই রাখাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে জসীমউদ্দীন লিখেছেন অসাধারণ এক কবিতা ‘বঙ্গবন্ধু’, যেখানে তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর গৌরবান্বিত সংগ্রামের ইতিহাস চিত্রিত করেছেন- মুজিবর রহমান!

ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।/...বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ,/ প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।/ তোমার একটি আঙ্গুল হেলনে অচল যে সরকার/ অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছেথ স্তব্ধ হুকুমদার।/...আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,/ দিকে দিগন্তে বাজিল যেদিন বাঙালির জয়ভেরী।/ মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার,/ বঙ্গ-বন্ধু শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।/ আরো একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যেতে ভরা,/ জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এ দেশ সীমিত-বসুন্ধরা।/ মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,/ বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকশিকাঁথার ছবি। [‘বঙ্গবন্ধু’/ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে]

এইভাবে দেখা যায়, গ্রামের রাখাল ছেলে, পুরাণের কৃষ্ণ আর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অবিস্মরণীয় রাখাল বঙ্গবন্ধু জসীমউদ্দীনের কবিতায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়- তিন রাখাল মিলে সৃষ্টি হয় একটি একক সত্তা-স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি আর মানবকল্যাণই যার কেন্দ্রীয় অভীপ্সা। তিন প্রান্তের তিন রাখাল মিলে পূর্ণ হয় জসীমউদ্দীনের রাখাল-ভাবনা। পল্লী জীবনের রূপকার হিসেবে জসীমউদ্দীনের স্বকীয়তার পাশাপাশি এ রাখাল-প্রত্যয়ও তার প্রাগ্রসর কাব্য-ভাবনার ফল। জসীমউদ্দীনের এ ত্রিমাত্রিক রাখাল-সত্তা থেকে আমরা তার মানবকল্যাণকামী কাব্যবিশ্বাসকেই আবিষ্কার করতে পারি।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি ]