বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত দেশ : পরিত্রাণ মিলবে কি

মনিরুল হক রনি

পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য বায়ু অপরিহার্য। কিন্তু সেই বায়ুই যদি মৃত্যু কিংবা স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে বিষয়টি ভাবনার তো বটেই, যথেষ্ট উদ্বেগেরও। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে কমে যাচ্ছে মানুষের আয়ু এবং তা কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অকাল মৃত্যুর। বলা হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়, তার অধিকাংশই ঘটে বায়ুদূষণজনিত কারণে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। অর্থাৎ বায়ুদূষণ এখন শুধু এক পরিবেশগত আতঙ্কের নামই নয়, এক মরণঘাতকও। পৃথিবীব্যাপী বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক হারে বাড়লেও বাংলাদেশে এটির অবস্থা আরও ভয়ানক। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউ এয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন-২০২১’ বলছে বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর রাজধানী শহর হিসেবে তিলোত্তমা ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে। বিশ্বের ১১৭টি দেশ ও অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংস্থাটি। এবার নিয়ে পরপর দুই বছর শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশের স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের বায়ুদূষণের অবস্থা যে কত ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়।

আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের বাতাসে অতি ক্ষুদ্রকণা বা পিএম ২.৫-এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৭৬.৯ মাইক্রো গ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ছিল ১০-এর কম। অন্যদিকে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুম-ল দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। এ জরিপের তথ্য বলছে, সর্বোচ্চ বায়ুদূষণপ্রবণ জেলা গাজীপুর। এর পরেই আছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ। এসব জেলায় বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। আর সর্বনিম্ন বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে মাদারীপুরে।

অতিমাত্রায় বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া হৃদরোগ, ফুসফুসজনিত সমস্যা, পেটের সমস্যা, ত্বকের সমস্যা, হাঁপানি বা এলার্জিজনিত সমস্যা, চোখের সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে এর কারণে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ দূষণ আরও বেশি প্রভাব ফেলছে। আর এসব রোগের কারণে আমাদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে; বাড়ছে অকাল মৃত্যুর হার। গত বছরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’-এর তথ্য বলছে, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকাতে যা প্রায় সাত বছর সাত মাস। ভয়ংকর সংবাদ বটে!

বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের প্রজনন স্বাস্থ্যও। বিশেষজ্ঞদের মতে গর্ভপাত, প্রজনন ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে মারাত্মকভাবে। এমনকি গাছের খাদ্য তৈরি বা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। এতে উদ্ভিদ নিজেও সংকটের মুখে পড়ছে এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরাও হচ্ছে বিপদের সম্মুখীন। তাছাড়া বায়ু দূষণের সঙ্গে অপরাধপ্রবণতার একটি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা বলছে, যেসব শহরে বায়ুদূষণ বেশি, সেসব শহরে অপরাধ বেশি। দূষিত বায়ু মানুষকে অনৈতিক কাজে প্ররোচিত করে বলে এ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ দূষিত বায়ু আমাদের সমাজ, পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত এবং এর ফলে যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে তা অপরিমেয় ও অপূরণীয়।

বাংলাদেশে এ অস্বাভাবিক বায়ুদূষণের পেছনে কোন একক কারণ নয়, বরং বহুমুখী কারণ বিদ্যমান। তবে বিভিন্ন গবেষণাগুলোতে যে কারণগুলো সর্বাধিক প্রতিভাত হয়েছে তার মধ্যে তিনটি কারণ অন্যতম- ইটভাটার ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালা ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ও সমন্বয়হীন সংস্কারকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মেগা প্রকল্প, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা, অতিরিক্ত ট্রাফিক জ্যাম, এসির ব্যবহার বৃদ্ধি, রান্নার চুলায় পোড়ানো কাঠ ও কয়লার ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে বায়ু সবচেয়ে বেশি দূষণ হয় বলে গবেষণাগুলোতে উঠে এসেছে। ক্যাপস- এর ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখে গেছে, ঢাকায় বায়ুদূষণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩০ শতাংশ দূষণ হয় অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তা কাটা ও নির্মাণকাজের কারণে। এরপর ইটভাটা ও কলকারখানার ধোঁয়ায় ২৯ শতাংশ এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে ১৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়েছে। অথচ এগুলো কমানো বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন কার্যকরী উদ্যোগ চোখে পড়ে না বললেই চলে। গবেষকরা বায়ুদূষণকে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় বললেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক তেমন কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে পরিবেশবিদরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন। অথচ দুই দুইবার শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশের তকমা পাওয়া বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে যেন কোন হেলদোলই নেই।

বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্ট ২০২০ সালে ৯ দফা নির্দেশনা দেয়। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরে মাটি, বালু বা বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা; নির্মাণকাজ চলা এলাকায় মাটি, বালু, সিমেন্ট, পাথর ঢেকে রাখা; সিটি করপোরেশন কর্তৃক নিয়মিত রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটানো; রাস্তা, কালভার্ট, কার্পেটিং, খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করা; সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও সময়সীমার পরে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা; পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা; বিপণিবিতান অথবা দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা ও বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ নেয়া। তবে এগুলো পরিপালনে বাস্তবসম্মত কোন উদ্যোগ দেখা যায় না।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বিশ্বের এক নম্বর দূষিত বায়ুর শহর নয়া দিল্লিকে দূষণমুক্ত করার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে আশানুরূপ ফল মিলেছে। ২০১১ সালে বায়ুদূষণ রোধে তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর। অথচ বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে ইট ভাটাগুলোর একটি বড় অবদান রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। অথচ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে দিনের পর দিন অনুমোদন ছাড়াই শত শত ইটভাটা গড়ে উঠলেও যেন দেখার কেউ নেই। এগুলো বন্ধ করতে হবে। বৈধ ইটভাটাগুলোকে পরিবেশসম্মত উপায়ে ইট তৈরিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় আইনভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্টের ব্লক ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে যাতে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়, তা তদারকির পাশাপাশি সমন্বয়হীন, অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত সংস্কার কাজ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অতি জরুরি। ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে বায়ুর আদর্শ মাত্রার মধ্যে থাকা জেলাগুলোতে ইটভাটা, নির্মাণ ও সংস্কারকাজ কম থাকাসহ প্রচুর পরিমাণে গাছপালা ও পুকুর-জলাশয় লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ গাছপালায় পরিপূর্ণ সবুজের সমারোহ, প্রচুর খাল-বিল, জলাশয়, নদী ইত্যাদি বায়ু দূষণ রোধের ক্ষেত্রে এসব জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এজন্য খাল-বিল, নদ-নদী, জলাশয় রক্ষার পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ ও ছাদ বাগানে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে নির্মল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি বায়ুদূষণ রোধে কার্যকরী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্থায়ীভাবে শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে পরিচিতি পেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সাভার সরকারি কলেজ]

মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল ২০২২ , ২৯ চৈত্র ১৪২৮ ১০ রমাদ্বান ১৪৪৩

বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত দেশ : পরিত্রাণ মিলবে কি

মনিরুল হক রনি

পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য বায়ু অপরিহার্য। কিন্তু সেই বায়ুই যদি মৃত্যু কিংবা স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে বিষয়টি ভাবনার তো বটেই, যথেষ্ট উদ্বেগেরও। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে কমে যাচ্ছে মানুষের আয়ু এবং তা কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অকাল মৃত্যুর। বলা হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়, তার অধিকাংশই ঘটে বায়ুদূষণজনিত কারণে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। অর্থাৎ বায়ুদূষণ এখন শুধু এক পরিবেশগত আতঙ্কের নামই নয়, এক মরণঘাতকও। পৃথিবীব্যাপী বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক হারে বাড়লেও বাংলাদেশে এটির অবস্থা আরও ভয়ানক। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউ এয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন-২০২১’ বলছে বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর রাজধানী শহর হিসেবে তিলোত্তমা ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে। বিশ্বের ১১৭টি দেশ ও অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংস্থাটি। এবার নিয়ে পরপর দুই বছর শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশের স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের বায়ুদূষণের অবস্থা যে কত ভয়াবহ, তা সহজেই অনুমেয়।

আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের বাতাসে অতি ক্ষুদ্রকণা বা পিএম ২.৫-এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৭৬.৯ মাইক্রো গ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ছিল ১০-এর কম। অন্যদিকে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুম-ল দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। এ জরিপের তথ্য বলছে, সর্বোচ্চ বায়ুদূষণপ্রবণ জেলা গাজীপুর। এর পরেই আছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ। এসব জেলায় বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। আর সর্বনিম্ন বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে মাদারীপুরে।

অতিমাত্রায় বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া হৃদরোগ, ফুসফুসজনিত সমস্যা, পেটের সমস্যা, ত্বকের সমস্যা, হাঁপানি বা এলার্জিজনিত সমস্যা, চোখের সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে এর কারণে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ দূষণ আরও বেশি প্রভাব ফেলছে। আর এসব রোগের কারণে আমাদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে; বাড়ছে অকাল মৃত্যুর হার। গত বছরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’-এর তথ্য বলছে, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকাতে যা প্রায় সাত বছর সাত মাস। ভয়ংকর সংবাদ বটে!

বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের প্রজনন স্বাস্থ্যও। বিশেষজ্ঞদের মতে গর্ভপাত, প্রজনন ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে মারাত্মকভাবে। এমনকি গাছের খাদ্য তৈরি বা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। এতে উদ্ভিদ নিজেও সংকটের মুখে পড়ছে এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরাও হচ্ছে বিপদের সম্মুখীন। তাছাড়া বায়ু দূষণের সঙ্গে অপরাধপ্রবণতার একটি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা বলছে, যেসব শহরে বায়ুদূষণ বেশি, সেসব শহরে অপরাধ বেশি। দূষিত বায়ু মানুষকে অনৈতিক কাজে প্ররোচিত করে বলে এ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ দূষিত বায়ু আমাদের সমাজ, পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত এবং এর ফলে যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে তা অপরিমেয় ও অপূরণীয়।

বাংলাদেশে এ অস্বাভাবিক বায়ুদূষণের পেছনে কোন একক কারণ নয়, বরং বহুমুখী কারণ বিদ্যমান। তবে বিভিন্ন গবেষণাগুলোতে যে কারণগুলো সর্বাধিক প্রতিভাত হয়েছে তার মধ্যে তিনটি কারণ অন্যতম- ইটভাটার ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালা ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ও সমন্বয়হীন সংস্কারকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মেগা প্রকল্প, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা, অতিরিক্ত ট্রাফিক জ্যাম, এসির ব্যবহার বৃদ্ধি, রান্নার চুলায় পোড়ানো কাঠ ও কয়লার ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে বায়ু সবচেয়ে বেশি দূষণ হয় বলে গবেষণাগুলোতে উঠে এসেছে। ক্যাপস- এর ২০১৬ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখে গেছে, ঢাকায় বায়ুদূষণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩০ শতাংশ দূষণ হয় অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তা কাটা ও নির্মাণকাজের কারণে। এরপর ইটভাটা ও কলকারখানার ধোঁয়ায় ২৯ শতাংশ এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে ১৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়েছে। অথচ এগুলো কমানো বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন কার্যকরী উদ্যোগ চোখে পড়ে না বললেই চলে। গবেষকরা বায়ুদূষণকে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় বললেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক তেমন কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে পরিবেশবিদরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন। অথচ দুই দুইবার শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশের তকমা পাওয়া বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে যেন কোন হেলদোলই নেই।

বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্ট ২০২০ সালে ৯ দফা নির্দেশনা দেয়। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরে মাটি, বালু বা বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা; নির্মাণকাজ চলা এলাকায় মাটি, বালু, সিমেন্ট, পাথর ঢেকে রাখা; সিটি করপোরেশন কর্তৃক নিয়মিত রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটানো; রাস্তা, কালভার্ট, কার্পেটিং, খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করা; সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও সময়সীমার পরে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা; পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা; বিপণিবিতান অথবা দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা ও বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ নেয়া। তবে এগুলো পরিপালনে বাস্তবসম্মত কোন উদ্যোগ দেখা যায় না।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বিশ্বের এক নম্বর দূষিত বায়ুর শহর নয়া দিল্লিকে দূষণমুক্ত করার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে আশানুরূপ ফল মিলেছে। ২০১১ সালে বায়ুদূষণ রোধে তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর। অথচ বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে ইট ভাটাগুলোর একটি বড় অবদান রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। অথচ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে দিনের পর দিন অনুমোদন ছাড়াই শত শত ইটভাটা গড়ে উঠলেও যেন দেখার কেউ নেই। এগুলো বন্ধ করতে হবে। বৈধ ইটভাটাগুলোকে পরিবেশসম্মত উপায়ে ইট তৈরিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় আইনভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্টের ব্লক ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে যাতে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়, তা তদারকির পাশাপাশি সমন্বয়হীন, অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত সংস্কার কাজ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অতি জরুরি। ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে বায়ুর আদর্শ মাত্রার মধ্যে থাকা জেলাগুলোতে ইটভাটা, নির্মাণ ও সংস্কারকাজ কম থাকাসহ প্রচুর পরিমাণে গাছপালা ও পুকুর-জলাশয় লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ গাছপালায় পরিপূর্ণ সবুজের সমারোহ, প্রচুর খাল-বিল, জলাশয়, নদী ইত্যাদি বায়ু দূষণ রোধের ক্ষেত্রে এসব জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এজন্য খাল-বিল, নদ-নদী, জলাশয় রক্ষার পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ ও ছাদ বাগানে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে নির্মল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি বায়ুদূষণ রোধে কার্যকরী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্থায়ীভাবে শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে পরিচিতি পেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সাভার সরকারি কলেজ]