আল-আকসায় ইসরায়েলি নৃশংসতার সুলুক সন্ধানে

মার্ক মুহান্নাদ আয়াশ

আবারও পবিত্র রমজান মাসে দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের মসজিদুল আকসায় ইবাদতরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংস হামলা হয়েছে। এবারই যে প্রথম আল-আকসায় নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা হলো তা কিন্তু নয়। বরং প্রতি রমজানেই আমরা প্রায় একই ধরনের দৃশ্য দেখতে পাই। এবারের ইসরাইলের হামলার ব্যাখ্যায় পশ্চিমা রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই কাছাকাছি সময়ে তিনটি ধর্মের বড় উৎসব এবং ইসরায়েলের চারটি শহরে ‘জঙ্গি’ হামলাকে দায়ী করছেন।

ফিলিস্তিনিরা অবশ্য এ ধরনের বিকৃত এবং আংশিক সত্য ব্যাখ্যা শুনে অভ্যস্ত। কারণ এসব বিশ্লেষণে ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকারের পরিবর্তে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং বিদ্বেষের ওপরই বেশি জোর দেয়া হয় এবং ফিলিস্তিনি জনগণ যারা দশকের পর দশক, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নিজেদের ভূমি রক্ষায় লড়াই করছে তাদের আবেগপ্রবণ, হিংস্র ও জঙ্গি হিসেবে সর্বদা আখ্যায়িত করা হয়।

একপেশে ইতিহাস, ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অস্বীকার এবং জায়োনিজমের মন্ত্রে উজ্জীবিত ইসরায়েলি রাষ্ট্রটির কর্মকা- শুধু ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরায়েল দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন নৃশংসতা চালিয়েই যাচ্ছে। সর্বশেষ যে আক্রমণটি হয়েছে তার কারণ এবং পূর্বেকার সব আক্রমণের কারণগুলোও একই সুতোয় গাঁথা। আর তা হচ্ছে, যে কোন উপায়ে ইসরায়েলের এই উপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখা।

ইসরায়েলে যে রাজনৈতিক জোট বা দল ক্ষমতায় থাকুক না কেন জেরুজালেমে ইসরায়েলের নীতির কোন পরিবর্তন হবে না কারণ ইসরায়েল রাষ্ট্রটি গঠিতই হয়েছে কথিত ঐতিহাসিক পুণ্যভূমিতে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং তা সম্প্রসারণ করার ওপর। এবং যতদিন তা না হবে কিংবা ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব মেনে নিবে, ততদিন পর্যন্ত সংঘাত চলতেই থাকবে।

মূলত ইউরোপে ইহুদিদের ওপর সংঘঠিত নির্যাতন- নিপীড়নের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার উদ্দেশ্য থেকেই জায়োনিজমের জন্ম। এককালে যারা ছিল নির্যাতিত, বিংশ শতাব্দীতে এসে তারাই হয়ে গেল নির্যাতনকারী। এক সময়ে যারা ছিল উপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট, তারাই এখন শুধু উপনিবেশ স্থাপন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না ফিলিস্তিনিদের ন্যূনতম মানবাধিকারগুলোও কেড়ে নিচ্ছে।

আমি আমার (লেখক) একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছি যে, ইসরায়েলি পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্য কিংবা রাজনীতিবিদ সবাই এটা বিশ্বাস করেন যে, তারা শুধু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা এবং পবিত্র তীর্থস্থানগুলোতে সহাবস্থান রক্ষার জন্যই ‘মাঝেমধ্যে’ কঠোর পদক্ষেপ নেন।

তর্কের খাতিরে তাদের কথা মেনে নিলেও আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। তাদের কথিত ‘শান্তি’ বজায় রাখতে পুলিশ কর্তৃক একজন বয়স্ক মহিলাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া কি খুব জরুরি? কিংবা একজন শিশুকে এক ডজন পুলিশ কর্তৃক নির্মম প্রহার করা, আল-আকসার ভেতর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ এবং এর কারণে শতাধিক আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্সকে বাধা প্রদান এগুলোও কি তাদের কথিত সহাবস্থান নিশ্চিত করার পন্থা? একটু পেছনে ফিরলে আমরা দেখব ফটো সাংবাদিক, চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী, শিশু, নারী ও বৃদ্ধ কাউকেই পাষা- ইসরায়েলি বাহিনী ছাড় দেয়নি। মহাসমারোহে দিনের পর দিন, দশকের পর দশক ধরে চালাচ্ছে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইসরায়েলি বাহিনীর এমন বর্বরতা ঘুণাক্ষরেও নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নয়। বরং এটি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জঘন্যতম একটি পন্থা। ভাবখানা এমন, এসব সহিংসতার মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে বার্তাটি দিতে চায় যে ‘তোমাদের জীবন-মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হলেও দেশ-বিদেশে আমাদের কিছু হবে না।’

প্রায় এক বছর আগে (১০ মে ২০২১) ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ধ্বংসাত্মক সামরিক আক্রমণ শুরু করেছিল। ১১ দিন যাবৎ চলা সে আক্রমণে ৬৬ জন শিশুসহ ২৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন ২০০০-এর অধিক মানুষ। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, শিল্পকারখানা ও মিডিয়াও ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ থেকে রেহাই পায়নি। এতকিছুর পরও আমরা কি ধরে নেব ইসরায়েল শুধু তার কথিত নিরাপত্তার স্বার্থে এমনটি করছে? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে সমগ্র গাজা উপত্যকায় নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে?

পাঠকের কাছেই প্রশ্নটি তোলা রইল।

মূল ধারার পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো দিন দিন ফিলিস্তিনিদের ওপর এ নৃশংসতাকে স্বাভাবিক করে ফেলেছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ গতবার যখন গাজায় লাগাতার বোমাবর্ষণ চলতে থাকে, তখন নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসরায়েলি নিজেদের “নিরাপত্তার” স্বার্থে হামাসের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় চায়।’ এমন একপেশে খবর প্রচার করে একশ্রেণীর গণমাধ্যম পরোক্ষভাবে দশকের পর দশক ধরে একটি জাতির ওপর চলা গণহত্যাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। এমন প্রাচ্যবাদী (অরিয়েন্টাল) পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যমগুলোই গাজায় অবৈধভাবে বসতি স্থাপন, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে আড়ালে রেখে শুধু কথিত ইসরায়েলের নিরাপত্তাহীনতার কথা প্রচার করে থাকে। যার কারণে আমরা এখনো সেই জায়গাতেই আছি যেখানে আমরা কয়েক দশক আগে ছিলাম। এখনো আন্তর্জাতিক মূল ধারার গণমাধ্যমে ইসরায়েলের পরিকল্পিত গণহত্যাকে আড়াল করে ফিলিস্তিনিদের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকেই খবরের শিরোনাম করে মানুষের দৃষ্টি ভিন্নদিকে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের এ চরিত্রের সঙ্গে ইহুদি ধর্মের মূল বার্তার সঙ্গে দূরতম সম্পর্কও নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে যে নব্য উপনিবেশবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ইসরাইলের কর্মপন্থা সেই নব্য উপনিবেশবাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ। যেখানে পশ্চিমাদের কথাই সর্বশেষ কথা, তাদের নীতিই চূড়ান্ত নীতি। যদিও পশ্চিমাদের কারণে এবং ক্ষেত্র বিশেষ সমর্থনে ফিলিস্তিনে, আফগানিস্তানে, ইরাকে, সিরিয়ায়, লিবিয়ায়, ইয়ামেনে, আফ্রিকায় দিনের পর দিন শত শত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অসহায়।

আল-আকসা চত্বরে সর্বশেষ হামলার সঙ্গে ধর্মীয় কারণ তথা ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। বরং তার পরিবর্তে আছে শক্তিধর একটি দেশের ছত্রছায়ায় ইসরায়েলের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা এবং ধীরে ধীরে সমগ্র ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করার ঘৃণ্য কর্মসূচি। যতদিন না যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বিনা প্রশ্নে সমর্থন দেয়া বন্ধ করবে, যত দিন না যুক্তরাষ্টের নব্য উপনিবেশবাদের জটিল সমীকরণ শেষ হবে, যত দিন না ইসরাইল তার ঘৃণিত কর্মসূচি প্রত্যাহার করছে, যত দিন না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একজোট হয়ে ইসরাইলকে রাশিয়ার মত বয়কট করছে ততদিন আমরা ইবাদতরত ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন হামলা, আল আকসা প্রাঙ্গণে অসহায়ের এমন করুণ আর্তনাদ, ফিলিস্তিনের ধূলিময় প্রান্তরে পড়ে থাকা নাম না জানা শিশুর নিথর দেহ দেখতেই থাকব।

(আল-জাজিরা থেকে অনূদিত)

অনুবাদ : এনামুল হাসান আরিফ, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মাউন্ট রয়্যাল ইউনিভার্সিটি, কানাডা]

সোমবার, ২৫ এপ্রিল ২০২২ , ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ২৩ রমাদ্বান ১৪৪৩

আল-আকসায় ইসরায়েলি নৃশংসতার সুলুক সন্ধানে

মার্ক মুহান্নাদ আয়াশ

আবারও পবিত্র রমজান মাসে দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের মসজিদুল আকসায় ইবাদতরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংস হামলা হয়েছে। এবারই যে প্রথম আল-আকসায় নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা হলো তা কিন্তু নয়। বরং প্রতি রমজানেই আমরা প্রায় একই ধরনের দৃশ্য দেখতে পাই। এবারের ইসরাইলের হামলার ব্যাখ্যায় পশ্চিমা রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই কাছাকাছি সময়ে তিনটি ধর্মের বড় উৎসব এবং ইসরায়েলের চারটি শহরে ‘জঙ্গি’ হামলাকে দায়ী করছেন।

ফিলিস্তিনিরা অবশ্য এ ধরনের বিকৃত এবং আংশিক সত্য ব্যাখ্যা শুনে অভ্যস্ত। কারণ এসব বিশ্লেষণে ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকারের পরিবর্তে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং বিদ্বেষের ওপরই বেশি জোর দেয়া হয় এবং ফিলিস্তিনি জনগণ যারা দশকের পর দশক, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নিজেদের ভূমি রক্ষায় লড়াই করছে তাদের আবেগপ্রবণ, হিংস্র ও জঙ্গি হিসেবে সর্বদা আখ্যায়িত করা হয়।

একপেশে ইতিহাস, ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অস্বীকার এবং জায়োনিজমের মন্ত্রে উজ্জীবিত ইসরায়েলি রাষ্ট্রটির কর্মকা- শুধু ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরায়েল দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন নৃশংসতা চালিয়েই যাচ্ছে। সর্বশেষ যে আক্রমণটি হয়েছে তার কারণ এবং পূর্বেকার সব আক্রমণের কারণগুলোও একই সুতোয় গাঁথা। আর তা হচ্ছে, যে কোন উপায়ে ইসরায়েলের এই উপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখা।

ইসরায়েলে যে রাজনৈতিক জোট বা দল ক্ষমতায় থাকুক না কেন জেরুজালেমে ইসরায়েলের নীতির কোন পরিবর্তন হবে না কারণ ইসরায়েল রাষ্ট্রটি গঠিতই হয়েছে কথিত ঐতিহাসিক পুণ্যভূমিতে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং তা সম্প্রসারণ করার ওপর। এবং যতদিন তা না হবে কিংবা ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব মেনে নিবে, ততদিন পর্যন্ত সংঘাত চলতেই থাকবে।

মূলত ইউরোপে ইহুদিদের ওপর সংঘঠিত নির্যাতন- নিপীড়নের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার উদ্দেশ্য থেকেই জায়োনিজমের জন্ম। এককালে যারা ছিল নির্যাতিত, বিংশ শতাব্দীতে এসে তারাই হয়ে গেল নির্যাতনকারী। এক সময়ে যারা ছিল উপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট, তারাই এখন শুধু উপনিবেশ স্থাপন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না ফিলিস্তিনিদের ন্যূনতম মানবাধিকারগুলোও কেড়ে নিচ্ছে।

আমি আমার (লেখক) একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছি যে, ইসরায়েলি পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্য কিংবা রাজনীতিবিদ সবাই এটা বিশ্বাস করেন যে, তারা শুধু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা এবং পবিত্র তীর্থস্থানগুলোতে সহাবস্থান রক্ষার জন্যই ‘মাঝেমধ্যে’ কঠোর পদক্ষেপ নেন।

তর্কের খাতিরে তাদের কথা মেনে নিলেও আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। তাদের কথিত ‘শান্তি’ বজায় রাখতে পুলিশ কর্তৃক একজন বয়স্ক মহিলাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া কি খুব জরুরি? কিংবা একজন শিশুকে এক ডজন পুলিশ কর্তৃক নির্মম প্রহার করা, আল-আকসার ভেতর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ এবং এর কারণে শতাধিক আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্সকে বাধা প্রদান এগুলোও কি তাদের কথিত সহাবস্থান নিশ্চিত করার পন্থা? একটু পেছনে ফিরলে আমরা দেখব ফটো সাংবাদিক, চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী, শিশু, নারী ও বৃদ্ধ কাউকেই পাষা- ইসরায়েলি বাহিনী ছাড় দেয়নি। মহাসমারোহে দিনের পর দিন, দশকের পর দশক ধরে চালাচ্ছে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইসরায়েলি বাহিনীর এমন বর্বরতা ঘুণাক্ষরেও নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নয়। বরং এটি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জঘন্যতম একটি পন্থা। ভাবখানা এমন, এসব সহিংসতার মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে বার্তাটি দিতে চায় যে ‘তোমাদের জীবন-মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হলেও দেশ-বিদেশে আমাদের কিছু হবে না।’

প্রায় এক বছর আগে (১০ মে ২০২১) ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ধ্বংসাত্মক সামরিক আক্রমণ শুরু করেছিল। ১১ দিন যাবৎ চলা সে আক্রমণে ৬৬ জন শিশুসহ ২৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন ২০০০-এর অধিক মানুষ। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, শিল্পকারখানা ও মিডিয়াও ইসরায়েলের বোমা বর্ষণ থেকে রেহাই পায়নি। এতকিছুর পরও আমরা কি ধরে নেব ইসরায়েল শুধু তার কথিত নিরাপত্তার স্বার্থে এমনটি করছে? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে সমগ্র গাজা উপত্যকায় নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে?

পাঠকের কাছেই প্রশ্নটি তোলা রইল।

মূল ধারার পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো দিন দিন ফিলিস্তিনিদের ওপর এ নৃশংসতাকে স্বাভাবিক করে ফেলেছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ গতবার যখন গাজায় লাগাতার বোমাবর্ষণ চলতে থাকে, তখন নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসরায়েলি নিজেদের “নিরাপত্তার” স্বার্থে হামাসের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় চায়।’ এমন একপেশে খবর প্রচার করে একশ্রেণীর গণমাধ্যম পরোক্ষভাবে দশকের পর দশক ধরে একটি জাতির ওপর চলা গণহত্যাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। এমন প্রাচ্যবাদী (অরিয়েন্টাল) পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যমগুলোই গাজায় অবৈধভাবে বসতি স্থাপন, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে আড়ালে রেখে শুধু কথিত ইসরায়েলের নিরাপত্তাহীনতার কথা প্রচার করে থাকে। যার কারণে আমরা এখনো সেই জায়গাতেই আছি যেখানে আমরা কয়েক দশক আগে ছিলাম। এখনো আন্তর্জাতিক মূল ধারার গণমাধ্যমে ইসরায়েলের পরিকল্পিত গণহত্যাকে আড়াল করে ফিলিস্তিনিদের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকেই খবরের শিরোনাম করে মানুষের দৃষ্টি ভিন্নদিকে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের এ চরিত্রের সঙ্গে ইহুদি ধর্মের মূল বার্তার সঙ্গে দূরতম সম্পর্কও নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে যে নব্য উপনিবেশবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ইসরাইলের কর্মপন্থা সেই নব্য উপনিবেশবাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ। যেখানে পশ্চিমাদের কথাই সর্বশেষ কথা, তাদের নীতিই চূড়ান্ত নীতি। যদিও পশ্চিমাদের কারণে এবং ক্ষেত্র বিশেষ সমর্থনে ফিলিস্তিনে, আফগানিস্তানে, ইরাকে, সিরিয়ায়, লিবিয়ায়, ইয়ামেনে, আফ্রিকায় দিনের পর দিন শত শত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অসহায়।

আল-আকসা চত্বরে সর্বশেষ হামলার সঙ্গে ধর্মীয় কারণ তথা ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। বরং তার পরিবর্তে আছে শক্তিধর একটি দেশের ছত্রছায়ায় ইসরায়েলের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা এবং ধীরে ধীরে সমগ্র ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করার ঘৃণ্য কর্মসূচি। যতদিন না যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বিনা প্রশ্নে সমর্থন দেয়া বন্ধ করবে, যত দিন না যুক্তরাষ্টের নব্য উপনিবেশবাদের জটিল সমীকরণ শেষ হবে, যত দিন না ইসরাইল তার ঘৃণিত কর্মসূচি প্রত্যাহার করছে, যত দিন না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একজোট হয়ে ইসরাইলকে রাশিয়ার মত বয়কট করছে ততদিন আমরা ইবাদতরত ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন হামলা, আল আকসা প্রাঙ্গণে অসহায়ের এমন করুণ আর্তনাদ, ফিলিস্তিনের ধূলিময় প্রান্তরে পড়ে থাকা নাম না জানা শিশুর নিথর দেহ দেখতেই থাকব।

(আল-জাজিরা থেকে অনূদিত)

অনুবাদ : এনামুল হাসান আরিফ, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মাউন্ট রয়্যাল ইউনিভার্সিটি, কানাডা]