দুর্নীতিতে ডুবছে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

মাছুম বিল্লাহ

আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়, আর সরকারিগুলোর কথা তো আমরা সবাই জানি, যেটি নিয়ে আর কথা বলতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে অনেক আশা ছিল, কিন্তু সেটিও এখন আর বিশ্বস্ততার জায়গায় নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনে ‘অলাভজনক’ হলেও কোন কোন বিশ্ববিদ্যয় অর্থ আয়ের মেশিনে পরিণত হয়েছে। তবে, অলাভজনক কথাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি থাকা উচিত নয়। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবশ্যই কিছু উপার্জন করবে, তবে তার অর্থ এই নয় যে, অর্থ নিয়ে মহা লুটপাট চলবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এখানেও রাজনীতি চলে এসেছে, আর ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লাইলেন্স পাচ্ছেন, কাজেই এ ঘটনা ঘটারই কথা। সিন্ডিকেট-একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে চলার কথা এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত অফিসের মতো চালাচ্ছেন কেউ কেউ। এমন নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ২৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কিছু অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আর কিছু সরাসরি ইউজিসিতে জমা পড়ে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে চিঠি পাওয়া গেছে। সেগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটির তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বেশির ভাগই অর্থিক। এ ছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দ্বন্দ্ব, অবৈধভাবে চাকরিচ্যুতি, উপাচার্যসহ কর্মকর্তাদের বেতনভাতা না দেয়ার ঘটনাও আছে। শিক্ষক সংকট, এমনকি সনদ বাণিজ্যের মতো অভিযোগ আছে। অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ার হতে পারত যদি সেভাবে এগুলো পরিচালিত হতো। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থী আসা শুরু করেছিল এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে, বর্তমানে সেভাবে আসছে না, যারা আসছে তারা এসব দেখে তাদের দেশগুলোতে নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতির খবর পৌঁছে দেবে।

দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮টি। কিন্তু বর্তমানে ৯৯টির কার্যক্রম চলছে, এর মধ্যে ২০১০ সালের আগের আইনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫২টি। এগুলোর মধ্যে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ আদালতে এক মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে সরকার বন্ধ করে দেয়। অবশিষ্ট ৫১টির মধ্যে ২৮টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করেছে। বাকি ২৩টি স্থায়ী ক্যাম্পাস বানায়নি। এই ২৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা হচ্ছে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করতে হবে। তা না হলে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্থায়ী ক্যম্পাসের বাইরে সরকার বা কমিশন অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যান্য ভবন বা ক্যাম্পাসগুলো অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ সময় সব প্রোগ্রামে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখতে হবে। এ নির্দেশনাগুলো প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৩৫(৭) ধারা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে কমিশনের সভায় সিন্ধান্ত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০-এর ৩৫(৭) ধারায় বল হয়েছে, কোন কারনে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দেখা দিলে কিংবা স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে চ্যান্সেলর, কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারবেন। এ বিষয়ে চ্যান্সেলরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

বর্তমানে ২৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চতুর্থ দফা আলটিমেটার দেয়া হলো। এতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ভাড়া বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে না গেলে অস্থায়ী ক্যাম্পাস অবৈধ ঘোষণা করা হবে। এগুলোকে তৃতীয় দফার আলটিমেটামে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন বলা হয়েছিল-নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হবে। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভর্তি বন্ধের কথা ছিল। কিন্তু ওই আলটিমেটাম উপেক্ষিত হয়েছে। এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি ৪ বছরে কোন মিটিং পর্যন্ত হয়নি। আবার কয়েকটি কোন ধরনেরই পদক্ষেপ নেয়নি। এমন বাস্তবতায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করতে ২০১০ সালের পর থেকে সরকার আলটিমেটার দিয়ে আসছে। এর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের জন্য ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সময় বেঁধে দিয়েছিল কমিশন। এর ব্যত্যয় ঘটলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ থাকবে বলে হুশিয়ারি দেয়া হয়। যদিও ওই সময়ের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই পূর্ণাঙ্গভাবে স্থানান্তরে ব্যর্থ হয়। তবে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা কমিশনকে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ধরে রাখতে নিজেরাই উপাচার্য হতে চান। উপাচার্য প্যানেলে তিনটি নাম দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য নিজেদের নামের সঙ্গে অনেক সময় ‘ডামি’ প্রার্থী হিসেবে আরও দুটি নাম দেয়া হয়। অনেক ট্রাস্টিকে নিজের নাম অনুমোদন করিয়ে আনতে বেশ দৌড়ঝাঁপ করতেও দেখা যায়। শেষমেশ নিজের নাম অনুমোদন করিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের কাছ থেকে নিয়োগের আগেই পদত্যাগপত্র গ্রহণের ঘটনাও ঘটেছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়া ব্যক্তিকে যোগদান করতে দিলেও দৈনন্দিন প্রায় সব বিষয়েই উপাচার্যের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন ট্রাস্টিরা। সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকছে ট্রাস্টিদের হাতে। এ যেন বেসমরকারি স্কুল কলেজের কমিটি! তারাও একই কাজ করেন। পুরো বিষয়টিই আসলে দুষ্ট রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। তারা আইন কেন মানবেন না, নিশ্চয়ই পেছনে খুঁটির জোর আছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের কাজের ক্ষেত্র আলাদা করে দেয়া আছে। আইন অনুযায়ী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলে উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের কাজটি তিনিই করেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বোর্ড অব ট্রাস্টির সঙ্গে বড় ভূমিকা রাখেন উপাচার্য। প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে উপাচার্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছেন না কিছু কিছু ট্রাস্টি বোর্ড। এমনকি পছন্দসই ‘ডামি’ উপাচার্য বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে রাখার অভিযোগও রয়েছে কোন কোন ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটা অঙ্কের সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি কিনে তা ব্যবহার, সমালোচনার মুখে পড়ে তা আবার ফেরত দেয়ার মতো অভিযোগও আছে। তা ছাড়া ভর্তিবাণিজ্যের কথাও শোনা যাচ্ছে দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচার করার অভিযোগ আছে, আছে শিক্ষকদের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির অভিযোগ, যেটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি বেশি ঘটছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হওয়ার কথা ছিল জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত ক্ষেত্র। উন্নত গবেষণা হবে যেগুলো দেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। এখান থেকে তৈরি হবে আদর্শ মানুষ, প্রকৃত বিজ্ঞানী, গবেষক, উঁচু মানের শিক্ষক আর এগুলোর জন্য প্রয়োজন জ্ঞানচর্চার বিস্তৃত আর অবারিত সুযোগ। কিন্তু কী হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে?

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]

সোমবার, ০৯ মে ২০২২ , ২৬ বৈশাখ ১৪২৮ ০৬ শাওয়াল ১৪৪৩

দুর্নীতিতে ডুবছে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

মাছুম বিল্লাহ

আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়, আর সরকারিগুলোর কথা তো আমরা সবাই জানি, যেটি নিয়ে আর কথা বলতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে অনেক আশা ছিল, কিন্তু সেটিও এখন আর বিশ্বস্ততার জায়গায় নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনে ‘অলাভজনক’ হলেও কোন কোন বিশ্ববিদ্যয় অর্থ আয়ের মেশিনে পরিণত হয়েছে। তবে, অলাভজনক কথাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি থাকা উচিত নয়। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবশ্যই কিছু উপার্জন করবে, তবে তার অর্থ এই নয় যে, অর্থ নিয়ে মহা লুটপাট চলবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এখানেও রাজনীতি চলে এসেছে, আর ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লাইলেন্স পাচ্ছেন, কাজেই এ ঘটনা ঘটারই কথা। সিন্ডিকেট-একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে চলার কথা এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত অফিসের মতো চালাচ্ছেন কেউ কেউ। এমন নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ২৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কিছু অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আর কিছু সরাসরি ইউজিসিতে জমা পড়ে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে চিঠি পাওয়া গেছে। সেগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটির তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বেশির ভাগই অর্থিক। এ ছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দ্বন্দ্ব, অবৈধভাবে চাকরিচ্যুতি, উপাচার্যসহ কর্মকর্তাদের বেতনভাতা না দেয়ার ঘটনাও আছে। শিক্ষক সংকট, এমনকি সনদ বাণিজ্যের মতো অভিযোগ আছে। অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ার হতে পারত যদি সেভাবে এগুলো পরিচালিত হতো। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থী আসা শুরু করেছিল এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে, বর্তমানে সেভাবে আসছে না, যারা আসছে তারা এসব দেখে তাদের দেশগুলোতে নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতির খবর পৌঁছে দেবে।

দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৮টি। কিন্তু বর্তমানে ৯৯টির কার্যক্রম চলছে, এর মধ্যে ২০১০ সালের আগের আইনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫২টি। এগুলোর মধ্যে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ আদালতে এক মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে সরকার বন্ধ করে দেয়। অবশিষ্ট ৫১টির মধ্যে ২৮টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করেছে। বাকি ২৩টি স্থায়ী ক্যাম্পাস বানায়নি। এই ২৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা হচ্ছে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করতে হবে। তা না হলে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্থায়ী ক্যম্পাসের বাইরে সরকার বা কমিশন অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যান্য ভবন বা ক্যাম্পাসগুলো অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ সময় সব প্রোগ্রামে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখতে হবে। এ নির্দেশনাগুলো প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৩৫(৭) ধারা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে কমিশনের সভায় সিন্ধান্ত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০-এর ৩৫(৭) ধারায় বল হয়েছে, কোন কারনে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা দেখা দিলে কিংবা স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে চ্যান্সেলর, কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারবেন। এ বিষয়ে চ্যান্সেলরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

বর্তমানে ২৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চতুর্থ দফা আলটিমেটার দেয়া হলো। এতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ভাড়া বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে না গেলে অস্থায়ী ক্যাম্পাস অবৈধ ঘোষণা করা হবে। এগুলোকে তৃতীয় দফার আলটিমেটামে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন বলা হয়েছিল-নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হবে। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভর্তি বন্ধের কথা ছিল। কিন্তু ওই আলটিমেটাম উপেক্ষিত হয়েছে। এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি ৪ বছরে কোন মিটিং পর্যন্ত হয়নি। আবার কয়েকটি কোন ধরনেরই পদক্ষেপ নেয়নি। এমন বাস্তবতায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করতে ২০১০ সালের পর থেকে সরকার আলটিমেটার দিয়ে আসছে। এর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের জন্য ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সময় বেঁধে দিয়েছিল কমিশন। এর ব্যত্যয় ঘটলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ থাকবে বলে হুশিয়ারি দেয়া হয়। যদিও ওই সময়ের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই পূর্ণাঙ্গভাবে স্থানান্তরে ব্যর্থ হয়। তবে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা কমিশনকে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ধরে রাখতে নিজেরাই উপাচার্য হতে চান। উপাচার্য প্যানেলে তিনটি নাম দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য নিজেদের নামের সঙ্গে অনেক সময় ‘ডামি’ প্রার্থী হিসেবে আরও দুটি নাম দেয়া হয়। অনেক ট্রাস্টিকে নিজের নাম অনুমোদন করিয়ে আনতে বেশ দৌড়ঝাঁপ করতেও দেখা যায়। শেষমেশ নিজের নাম অনুমোদন করিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের কাছ থেকে নিয়োগের আগেই পদত্যাগপত্র গ্রহণের ঘটনাও ঘটেছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দেয়া ব্যক্তিকে যোগদান করতে দিলেও দৈনন্দিন প্রায় সব বিষয়েই উপাচার্যের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন ট্রাস্টিরা। সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকছে ট্রাস্টিদের হাতে। এ যেন বেসমরকারি স্কুল কলেজের কমিটি! তারাও একই কাজ করেন। পুরো বিষয়টিই আসলে দুষ্ট রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। তারা আইন কেন মানবেন না, নিশ্চয়ই পেছনে খুঁটির জোর আছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের কাজের ক্ষেত্র আলাদা করে দেয়া আছে। আইন অনুযায়ী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলে উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের কাজটি তিনিই করেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বোর্ড অব ট্রাস্টির সঙ্গে বড় ভূমিকা রাখেন উপাচার্য। প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে উপাচার্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছেন না কিছু কিছু ট্রাস্টি বোর্ড। এমনকি পছন্দসই ‘ডামি’ উপাচার্য বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে রাখার অভিযোগও রয়েছে কোন কোন ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটা অঙ্কের সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি কিনে তা ব্যবহার, সমালোচনার মুখে পড়ে তা আবার ফেরত দেয়ার মতো অভিযোগও আছে। তা ছাড়া ভর্তিবাণিজ্যের কথাও শোনা যাচ্ছে দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচার করার অভিযোগ আছে, আছে শিক্ষকদের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির অভিযোগ, যেটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি বেশি ঘটছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হওয়ার কথা ছিল জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত ক্ষেত্র। উন্নত গবেষণা হবে যেগুলো দেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। এখান থেকে তৈরি হবে আদর্শ মানুষ, প্রকৃত বিজ্ঞানী, গবেষক, উঁচু মানের শিক্ষক আর এগুলোর জন্য প্রয়োজন জ্ঞানচর্চার বিস্তৃত আর অবারিত সুযোগ। কিন্তু কী হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে?

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]