শিক্ষা খাত ও বাজেট

আকমল হোসেন

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে এবারে বাজেটে তেমন উচ্চবাচ্চ্য নেই। দেশের ৪ কোটি শিক্ষার্থী ২০ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে গঠিত বৃহৎ শিক্ষা পরিবারের জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৯৪,৮৭৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৫.৭ %, শুধুই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১১.১%। অথচ ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড এডেুকেশন ফোরামে গৃহীত এসডিজিস বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয় বহন করবে সরকার। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৪র্থ লক্ষ্যে “অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা।” ৪র্থ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১০টি টার্গেটও নির্ধারণ করা হয়েছে, যা টার্গেটের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, উচ্চতর শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা তরুণ ও প্রাপ্ত বয়স্কদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, জনসাধারণের স্বাক্ষরতা ও গাণিতিক দক্ষতা শারীরিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে একীভূত ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাজেটের ২০% এবং জিডিপির ৪% শিক্ষায় বরাদ্দ করবে।

২০২০-২১ বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দ ছিল ১৫,১% তার মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যই বরাদ্দ ছিল ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা, যা শিক্ষা খাতে দেখানো হয়েছিল। সেই টাকার হরিলুট দেশবাসী দেখেছে। ৭১৪৪টি একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮০,০০০ শিক্ষক-কর্মচারী এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। এদের ১০/১৫ বছর ধরে বেতন ভাতা চালু না হওয়া, অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের ৫০০০ শিক্ষকের বেতন ভাতা না হওয়া, এই বারের বাজেটে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিও বাবদ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও অদ্যাবদি কোন নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিও করা হয়নি। তবে রমজানের ঈদের পরপর ২৫০০ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও করার কথা সরকার জানিয়েছেন। অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের ৩-৪ বছরের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য কোন বরাদ্দ নেই। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০০০ টাকার বাড়িভাড়া আর ৫০০ টাকার মেডিকেল ভাতা পরিবর্তনের আন্দোলন দীর্ঘ দিনের, এ খাতে কোন কিছু বলা হয়নি। সরকার কোন ধরনের নীতিমালা ছাড়াই প্রতি উপলোয় একটি স্কুল ও একটি কলেজ সরকারিকরণ করেছে, এর আওতায় শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন ও বেতন-ভাতার জন্য কোন বরাদ্দ রাখেনি, ২০১৬ সালে শুরু করা সরকারিকরণের কাজ চূড়ান্ত হয়নি, প্রতিষ্ঠান হয়েছে সরকারি কিন্তু তার শিক্ষক-কর্মচারীরী এখনো বেসরকারি হিসেবে রয়েছেন।

ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি সরকার এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি, ১২ বছর আগে শিক্ষার সংকট ও উত্তোরণের পথ হিসেবে অধ্যাপক কবীর চেীধুরী, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চেীধুরী ৯টি কাজ সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। এই সম্মানিত ৫ জন শিক্ষাবিদের মধ্যে ড. সিরাজুল ইসলাম ছাড়া সবাই দুনিয়া থেকে ইতোমধ্যেই বিদায় নিয়েছেন। ২০১৮ সালে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য নতুন জনবল কাঠামো ঘোষণা করার পর সরকারি দল সমর্থিত গৃহপালিত শিক্ষক নেতারা বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক- কর্মচারীরা শতভাগ বোনাস পাচ্ছেন এ মর্মে সরকারকে ধন্যবাদ জানান, কিছু-কিছু মিডিয়া সেটা প্রচারও করেছিল কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা শতভাগ বোনাস পাননি। এবারের বাজেট দিয়েও মুক্তিযুদ্ধের আলোকে অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞান মনষ্ক সর্বজনীন ও গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়ন সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে।

সর্বজনীন মানবাধিকারের ২৬ ধারা মোতাবেক শিক্ষা জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার এবং বাংলাদেশর সংবিধানের ১৫ ধারা মোতাবেক সব মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষাসহ জীবনধারণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব, বিষয়টি মাথায় রেখে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন, বিগত সময়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শিক্ষায় অর্থায়ন, শিক্ষার দর্শন আর শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে শাসক মহল বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এ বছরের বাজেটের হিসাব-নিকাশ করলে বাজেটের আঙ্গিকটা পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি।

শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রশাসনে দক্ষ, যোগ্য এবং অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। শিক্ষা কারিকুলামকে যুগোপযোগী করা, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিয়োগ ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করা, নিয়োগকৃত জনবলকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, এই কাজগুলো করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংগ্রহ, সংরক্ষণও ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। সে সঙ্গে মহামারি করোণার কারণে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষায় অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান প্রয়োজন তবে পূর্বের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের চিত্র সরকারের পূর্ব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি, আশাকরি এবারের বাজেটে তেমনটি হবে না।

মধ্য আয়ের দেশে হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষায় আমাদের যা বরাদ্দ, তা পার্শ্ববর্তী এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালের চেয়েও অনেক কম। যদিও অন্য খাতের টাকা শিক্ষার মধ্যে দেখিয়ে টাকার অঙ্ককে বাড়িয়ে দেখানো হয়। গত বছরের বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা শিক্ষায় দেখিয়ে যেমন শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হয়েছিল এবার ঠিক একই কাজ করা হয়েছে। গত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় সম্প্রীতিও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাওর এলাকায় জনগণের জীবন মানের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইমামদের প্রশিক্ষণের প্রকল্প দেখানো হয়েছিল শিক্ষা খাতে। তবে সেই টাকার সঠিক ব্যবহার হলে কি নাসির নগর শাল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো মৌলবাদী তা-ব হতো?

স্বাধীনতার পরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির সর্বনিম্নœ ১.৮ এবং সর্বোচ্চ ২.৫, আর বাজেটের সর্বোচ্চ ১৪%। যদিও বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলো শিক্ষা খাতে জিডিপি ৭% (ইউনেস্কো) ৬% (ডাকার) ৫% (কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন) বরাদ্দের সুপারিশ ছিল কিন্তু সেটা না হয়ে ২% বা তার কম এ যাবৎ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়ে আসছে। বরাদ্দকৃত অর্থেরও ১টি অংশ প্রতি বছরই অব্যবহৃত থেকে যায়, একটি অংশ প্রতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়, আরেকটি অংশ অপচয় হয়ে যায়, প্রকল্পের নামে হরিলুট হয়। ফলে শিক্ষা খাতে যেটি বরাদ্দ হয়, সেটিরও শতভাগ ব্যয় হয়না। বাজেটে টাকার অঙ্কে শিক্ষা খাতে যেটি বরাদ্দ থাকে তারও একটি অংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে চলে যায়, আরেকটি অংশ পতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়। এমনতর বাস্তবতায় এসডিজির ৪ নং ধারার “অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার” সুযোগ তৈরি কীভাবে সম্ভব, সেটা বোঝা খুবই কঠিন।

অন্যদিকে প্রকল্পের নামে বরাদ্দকৃত অর্থের অপচয় শিক্ষার উন্নয়নে আরেকটি অন্তরায়। সরকারের আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আর মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকারের প্রতি দৃঢ় অবস্থানই শিক্ষা ক্ষেত্রে শনির দশা কাটতে পারে বলে অনেকেরই বিশ্বাস। বাজেট এখনো চূড়ান্ত হয়নি ফলে রদবদলের সুযোগ আছে, দরকার শুধু সরকারের আন্তরিকতা। করোনার কারণে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাড়তি বরাদ্দ অন্যদিকে নিয়মিত গভর্নিং বডি গঠনের বিপরীতে ৬ মাস পরপর এডহক কামটির নামে ফিস এরং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) একসঙ্গে স্বীকৃতির নীতি বাতিল করে আলাদা আলাদাভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। বিশ^ায়নের প্রতিযোগিতায় টিকার জন্য দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ছাড়া কোন বিকল্প নেই, কারণ বিষযটি কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নয়, বিষযটি দেশের সতেরো কোটি মানুষের। জনগণের পাওয়া-না পাওয়ার বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করছে, সে সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে শিক্ষা খাতে অর্থায়নের ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন। বিষযটি বিবেচনা করে মাননীয় সংসদ সদস্যরা আগামী বাজেট অধিবেশনে সাধারণ মানুষের স্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করি।

[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক,

বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]

রবিবার, ২৯ মে ২০২২ , ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৭ শাওয়াল ১৪৪৩

শিক্ষা খাত ও বাজেট

আকমল হোসেন

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে এবারে বাজেটে তেমন উচ্চবাচ্চ্য নেই। দেশের ৪ কোটি শিক্ষার্থী ২০ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে গঠিত বৃহৎ শিক্ষা পরিবারের জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৯৪,৮৭৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৫.৭ %, শুধুই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১১.১%। অথচ ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড এডেুকেশন ফোরামে গৃহীত এসডিজিস বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয় বহন করবে সরকার। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৪র্থ লক্ষ্যে “অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা।” ৪র্থ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১০টি টার্গেটও নির্ধারণ করা হয়েছে, যা টার্গেটের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, উচ্চতর শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা তরুণ ও প্রাপ্ত বয়স্কদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, জনসাধারণের স্বাক্ষরতা ও গাণিতিক দক্ষতা শারীরিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে একীভূত ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাজেটের ২০% এবং জিডিপির ৪% শিক্ষায় বরাদ্দ করবে।

২০২০-২১ বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দ ছিল ১৫,১% তার মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যই বরাদ্দ ছিল ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা, যা শিক্ষা খাতে দেখানো হয়েছিল। সেই টাকার হরিলুট দেশবাসী দেখেছে। ৭১৪৪টি একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮০,০০০ শিক্ষক-কর্মচারী এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। এদের ১০/১৫ বছর ধরে বেতন ভাতা চালু না হওয়া, অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের ৫০০০ শিক্ষকের বেতন ভাতা না হওয়া, এই বারের বাজেটে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিও বাবদ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও অদ্যাবদি কোন নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিও করা হয়নি। তবে রমজানের ঈদের পরপর ২৫০০ নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও করার কথা সরকার জানিয়েছেন। অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের ৩-৪ বছরের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য কোন বরাদ্দ নেই। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০০০ টাকার বাড়িভাড়া আর ৫০০ টাকার মেডিকেল ভাতা পরিবর্তনের আন্দোলন দীর্ঘ দিনের, এ খাতে কোন কিছু বলা হয়নি। সরকার কোন ধরনের নীতিমালা ছাড়াই প্রতি উপলোয় একটি স্কুল ও একটি কলেজ সরকারিকরণ করেছে, এর আওতায় শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন ও বেতন-ভাতার জন্য কোন বরাদ্দ রাখেনি, ২০১৬ সালে শুরু করা সরকারিকরণের কাজ চূড়ান্ত হয়নি, প্রতিষ্ঠান হয়েছে সরকারি কিন্তু তার শিক্ষক-কর্মচারীরী এখনো বেসরকারি হিসেবে রয়েছেন।

ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি সরকার এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি, ১২ বছর আগে শিক্ষার সংকট ও উত্তোরণের পথ হিসেবে অধ্যাপক কবীর চেীধুরী, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চেীধুরী ৯টি কাজ সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। এই সম্মানিত ৫ জন শিক্ষাবিদের মধ্যে ড. সিরাজুল ইসলাম ছাড়া সবাই দুনিয়া থেকে ইতোমধ্যেই বিদায় নিয়েছেন। ২০১৮ সালে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য নতুন জনবল কাঠামো ঘোষণা করার পর সরকারি দল সমর্থিত গৃহপালিত শিক্ষক নেতারা বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক- কর্মচারীরা শতভাগ বোনাস পাচ্ছেন এ মর্মে সরকারকে ধন্যবাদ জানান, কিছু-কিছু মিডিয়া সেটা প্রচারও করেছিল কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা শতভাগ বোনাস পাননি। এবারের বাজেট দিয়েও মুক্তিযুদ্ধের আলোকে অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞান মনষ্ক সর্বজনীন ও গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়ন সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে।

সর্বজনীন মানবাধিকারের ২৬ ধারা মোতাবেক শিক্ষা জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার এবং বাংলাদেশর সংবিধানের ১৫ ধারা মোতাবেক সব মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষাসহ জীবনধারণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব, বিষয়টি মাথায় রেখে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন, বিগত সময়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শিক্ষায় অর্থায়ন, শিক্ষার দর্শন আর শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে শাসক মহল বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এ বছরের বাজেটের হিসাব-নিকাশ করলে বাজেটের আঙ্গিকটা পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি।

শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রশাসনে দক্ষ, যোগ্য এবং অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। শিক্ষা কারিকুলামকে যুগোপযোগী করা, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিয়োগ ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করা, নিয়োগকৃত জনবলকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, এই কাজগুলো করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংগ্রহ, সংরক্ষণও ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। সে সঙ্গে মহামারি করোণার কারণে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষায় অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান প্রয়োজন তবে পূর্বের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের চিত্র সরকারের পূর্ব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি, আশাকরি এবারের বাজেটে তেমনটি হবে না।

মধ্য আয়ের দেশে হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষায় আমাদের যা বরাদ্দ, তা পার্শ্ববর্তী এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালের চেয়েও অনেক কম। যদিও অন্য খাতের টাকা শিক্ষার মধ্যে দেখিয়ে টাকার অঙ্ককে বাড়িয়ে দেখানো হয়। গত বছরের বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা শিক্ষায় দেখিয়ে যেমন শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হয়েছিল এবার ঠিক একই কাজ করা হয়েছে। গত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় সম্প্রীতিও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাওর এলাকায় জনগণের জীবন মানের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইমামদের প্রশিক্ষণের প্রকল্প দেখানো হয়েছিল শিক্ষা খাতে। তবে সেই টাকার সঠিক ব্যবহার হলে কি নাসির নগর শাল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো মৌলবাদী তা-ব হতো?

স্বাধীনতার পরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির সর্বনিম্নœ ১.৮ এবং সর্বোচ্চ ২.৫, আর বাজেটের সর্বোচ্চ ১৪%। যদিও বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলো শিক্ষা খাতে জিডিপি ৭% (ইউনেস্কো) ৬% (ডাকার) ৫% (কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন) বরাদ্দের সুপারিশ ছিল কিন্তু সেটা না হয়ে ২% বা তার কম এ যাবৎ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়ে আসছে। বরাদ্দকৃত অর্থেরও ১টি অংশ প্রতি বছরই অব্যবহৃত থেকে যায়, একটি অংশ প্রতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়, আরেকটি অংশ অপচয় হয়ে যায়, প্রকল্পের নামে হরিলুট হয়। ফলে শিক্ষা খাতে যেটি বরাদ্দ হয়, সেটিরও শতভাগ ব্যয় হয়না। বাজেটে টাকার অঙ্কে শিক্ষা খাতে যেটি বরাদ্দ থাকে তারও একটি অংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে চলে যায়, আরেকটি অংশ পতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় চলে যায়। এমনতর বাস্তবতায় এসডিজির ৪ নং ধারার “অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার” সুযোগ তৈরি কীভাবে সম্ভব, সেটা বোঝা খুবই কঠিন।

অন্যদিকে প্রকল্পের নামে বরাদ্দকৃত অর্থের অপচয় শিক্ষার উন্নয়নে আরেকটি অন্তরায়। সরকারের আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আর মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকারের প্রতি দৃঢ় অবস্থানই শিক্ষা ক্ষেত্রে শনির দশা কাটতে পারে বলে অনেকেরই বিশ্বাস। বাজেট এখনো চূড়ান্ত হয়নি ফলে রদবদলের সুযোগ আছে, দরকার শুধু সরকারের আন্তরিকতা। করোনার কারণে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাড়তি বরাদ্দ অন্যদিকে নিয়মিত গভর্নিং বডি গঠনের বিপরীতে ৬ মাস পরপর এডহক কামটির নামে ফিস এরং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) একসঙ্গে স্বীকৃতির নীতি বাতিল করে আলাদা আলাদাভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। বিশ^ায়নের প্রতিযোগিতায় টিকার জন্য দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ছাড়া কোন বিকল্প নেই, কারণ বিষযটি কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নয়, বিষযটি দেশের সতেরো কোটি মানুষের। জনগণের পাওয়া-না পাওয়ার বিষয়টি সরকারের ওপর নির্ভর করছে, সে সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে শিক্ষা খাতে অর্থায়নের ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন। বিষযটি বিবেচনা করে মাননীয় সংসদ সদস্যরা আগামী বাজেট অধিবেশনে সাধারণ মানুষের স্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করি।

[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক,

বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]