বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা : স্থপতি স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা

মোস্তাফা জব্বার

শেখ হাসিনার মুকুটে শেষ পালকটি হলো পদ্মা সেতু। বিশ্বের উন্নয়ন কর্মকা-ে এটি এক অসাধারণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের কাছে এই অসাধারণ অর্জন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদা ও উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বনেতারা তো বটেই এমনকি আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র পদ্মা সেতুর জন্য শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশকে অভিনন্দিত করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা এখন শুধু বাংলাদেশের মানুষের, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো বা দেশটির শত্রু মিত্রদের কাছেই পরিচিত নন।

তিনি এখন সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অসাধারণভাবে পরিচিত ও অনুকরণীয়। আমি তাকে শুধু বিশ্বের ক্ষমতাধর মানুষদের তালিকার লোক হিসেবে দেখি না, তাকে দেখি বাংলার স্বর্ণকন্যা হিসেবে। সারা দুনিয়ার জন্য তিনি কি করেছেন সেটির চাইতে জরুরি হচ্ছে তিনি তার নিজের দেশের মানুষের জন্য কি করেছেন সেটি। তার কাজের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সম্পকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেনিয়াবাসীদের বাংলাদেশ থেকে শেখার কথা বলেছেন। তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডিজিটাল ইন্ডিয়া গড়তে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলেছেন। তার জীবন ও কর্ম নিয়ে এখন মহাকাব্য লেখা যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশটির জন্ম দিয়েছেন এই দেশটিকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। এই মানুষটি ৯৬ সালে পাচ বছর ও ২০০৯ সাল থেকে এখনও দেশটি শাসন করছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোন শাসক এত দীর্ঘ সময় দেশ পরিচালনা করার সুযোগ পাননি। তার সুদীর্ঘকালের অর্জন একটি ছোট প্রবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমি বরং নিজের আবেগ-অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাগুলো এখানে কিছুটা তুলে ধরবো। দিনে দিনে এর পরিধিও বাড়বে। চেষ্টা করব সেই অভিজ্ঞতাগুলোও ক্রমশ যুক্ত করতে।

আমি শেখ হাসিনাকে শুধু প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলের প্রধান কিংবা আমার নীতি আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতীক হিসেবেই দেখি না, তাকে চিনি আমি অর্ধ শতকের বেশি সময় ১৯৭০ সাল থেকে। আমার নিজের সঙ্গে-আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে তার অসাধারণ সব স্মৃতি আছে। ব্যক্তিগত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা তিনি তখনই কাটিয়েছেন। এখন মাঝেমধ্যে ভাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দোতালায় প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো সেই মেয়েটির হাতে এক দিন বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টি করা বাঙালির রাষ্ট্রটিকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার সুমহান দায়িত্ব পড়বে তা-কি তখন একবারও ভেবেছি? লেখাপড়ার পাশাপাশি ঘর সংসার করে, লেখাপড়া চালিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার যে অসাধারণ মানুষটি আমাদের সহপাঠিনী ছিলেন এবং আমরা, এমনকি আমাদের শিক্ষকরাও যার আচার-আচরণে ভাবতেই পারতেন না যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা সেই মানুষটি এখনো সেদিনের মতোই আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলেন, মুখের সেই হাসিটা এখনও অমলিন এবং আত্মপ্রত্যয়ে সুদৃঢ় এই মানুষটি এই জাতিকে খাদের নিচ থেকে তুলে আনার যে সুকঠিন দায়িত্ব পালন করছেন, তার বিবরণ দু-চারটি অনুচ্ছেদ বা কয়েক শ পাতায় তুলে ধরা যাবে না। আশা করি কেউ না কেউ তার জীবনালেখ্য রচনা করে তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করবেন। আমি নিজে যদি পারতাম তবে অনেক খুশি হতাম। কিন্তু তার কর্মকা- নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা করতে হবে, তা হয়তো আমার দ্বারা হয়ে ওঠবে না।

শেখ হাসিনাবিষয়ক তথ্যাদি পাওয়া ও তার ১৮ বছরের শাসন কালের একটি রূপরেখা তুলে ধরা একটি অসাধ্য বিষয়। একই অবস্থা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। তাকে নিয়ে গবেষণা, তার জীবন চর্চা ইত্যাদির সঙ্গে কোন বাঙালির কোন প্রকারের তুলনা হবে না। এবার মুজিব বর্ষে আমরা তার সম্পর্কে আরও যেসব তথ্যাদি পাচ্ছি তাতে তিনি আরও অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছাড়াও শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনার বিষয়গুলোর পরিধিও ব্যাপক। বাংলার বড় বড় রাজনীতিক যেমন শেরে বাংলা, সোহরোয়ার্দী, ভাসানী বা আরও অনেকের সঙ্গে আর যারই হোক শেখ হাসিনার তূলনা করার উপায় নেই। সেই মহান রাজনীতিবিদদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই যে শেখ হাসিনা নিজে যা অর্জন করেছেন তারা বা তাদের সমসাময়িক বা তার পরেরও কোন রাজনীতিক কোনভাবেই শেখ হাসিনার সঙ্গে তুলনীয় নন। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ে সরকারপ্রধান থাকা ছাড়াও দেশটির যে সার্বিক রূপান্তর করেছেন তার কোন তুলনা কোথাও নেই। একবাক্যে বলতে পারি, লাঙল-জোয়ালের বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বানিয়েছেন তিনি। বিশ্বে এমন নজির আর নেই যে একটি লাঙল জোয়ালের দেশকে এভাবে ডিজিটাল করা যায়।

আমার এই অক্ষমতা রয়েছে যে তার দৈনন্দিন জীবনের সবটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয় না। অতীতের কিছু স্মৃতি এবং তৃতীয় সূত্রে পাওয়া কিছু তথ্যের বাইরেও গত সাড়ে চার বছরে সরকারে থেকে তাকে যতটা দেখেছি তাতে একটি মহাগ্রন্থ লিখেও সব বিষয় যথাযথভাবে বিস্তারিত উপায়ে প্রকাশ করা যাবে না। তবুও একটি আলোচনার মুখবন্ধ হিসেবে আমি এটুকু বলতে চাই যে, পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশটাকেই খুন করে পাকিস্তান বানানোর যে জঘন্য ষড়যন্ত্র নগ্নভাবে করা হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে এই জাতির ঘুরে দাঁড়ানো বা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা কেবল দুঃসাধ্য ছিল না বা অসম্ভব ছিল না দুঃসাধ্য ছিল। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বানানোর প্রতীকটি এখন তিনি।

জাতি হিসেবে আমরা ভাগ্যবান যে পঁচাত্তরের ঘাতকরা ১৫ আগস্ট নাগালের মধ্যে না পাওয়ার পরও ৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনাকে ২১ বার চেষ্টা করেও হত্যা করতে পারেনি। তবে শেখ হাসিনা যে তাদের পাকিস্তানিকরণ চক্রান্তের প্রধান শত্রু, তা এরই মধ্যে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পঁচাত্তরে তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে হত্যা করা আর এখন তাদের গর্হিত লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে হত্যা করা। ওরা বুঝেছে যে, বঙ্গবন্ধু বাঙালি শোষিত জনগোষ্ঠীর জন্য যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তাকে পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলছেন শেখ হাসিনা। তাদের এই গাত্রদাহ এমন যে এখনো পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও তাদের বাংলাদেশি দোসরদের ষড়যন্ত্র বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কূটচক্র বিস্তার করছে। আমার ভয়টা আরও একটু বাড়ছে এজন্য যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন প্রায়ই বাঙালি জাতির অগ্রগতির ইশতেহার হিসেবে জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা-বাকশালের কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রথম কারণটি ছিল বাংলাদেশকে পকিস্তান বানানো এবং বাড়তি কারণ ছিল তিনি শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন-তিনি চেয়েছিলেন একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ যাকে আমরা সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বলি। তবে এই সমাজতন্ত্র চীন রাশিয়ার সমাজতন্ত্র নয় শেখ মুজিবের সমাজতন্ত্র। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দায়ে তাদের হত্যা তালিকায় ছিলেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদেরও চক্ষুকূল হয়ে ওঠেন।

প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়িত করতে পারলে আজকের বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। এর ফলে বাংলাদেশ বিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে সাম্র্রাজ্যবাদীরা বা তাদের সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় সহযোগীরাও আরও যুক্ত হয়েছে। আমরা যখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করলাম তখন একটু হিসেবে করতেই হচ্ছে যে, স্বাধীনতার পরপরই যে দেশটাকে তলাহীন ঝুড়ির দেশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই দেশটিকে কি অসাধারণ দক্ষতা ও দূরদর্শিতায় একটি উন্নয়নমুখী দেশে রূপান্তরের পথে যাত্রা শুরু করিয়েছিলেন। ভাবুন তার হাতে আইটিইউ-ইউপিইউ এর সদস্যপদ লাভের কথা। স্মরণ করুন বিটিটিবি গড়ার কথা। স্মরণ করুন ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূকেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন। কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশন গঠন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফ, ১০০ বিঘা জমির সিলিং নির্ধারণ ইত্যাদি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না।

তবে একটি কথা বলতেই হবে যে জাতির পিতা সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করে দেশটির প্রকৃত গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়ে গেছেন। বস্তুত তিনিই ডিজিটাল বাংলাদেশ এর বীজ বপন করেন। যারা মনে করেন যে ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, রোবোটিক্স, আইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি বা পঞ্চম-ষষ্ঠ শিল্পবিপ্লব তারা ভুল করছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা-মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় সুখী, সমৃদ্ধ উন্নত, দারিদ্র্যমুক্ত ও বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু এই সোনার বাংলার স্বপ্নটা এই জাতিকে দিয়ে গেছেন। খুব সরলভাবেও আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে অংশ নিতে না পারা বাংলাদেশকে একটি বিজ্ঞানমনস্ক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার বীজটা বঙ্গবন্ধুরই বপন করা। তিনি কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে দেশটাকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি শিল্পায়নেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের সূচনাও তার হাতেই। ভাবুন তো আমরা যে স্যাটেলাইট ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ করেছি, তার উপগ্রহ ভূকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু সেই ৭৫ সালে উদ্বোধন করেন। একবার ভাবুন যে, টেলিকম খাত এখন বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মহাসড়ক সেই টেলিকম খাতের ভিত্তি হিসেবে টিএন্ডটি বোর্ড তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী]

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২ , ০৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ২০ জিলহজ ১৪৪৩

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা : স্থপতি স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা

মোস্তাফা জব্বার

শেখ হাসিনার মুকুটে শেষ পালকটি হলো পদ্মা সেতু। বিশ্বের উন্নয়ন কর্মকা-ে এটি এক অসাধারণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের কাছে এই অসাধারণ অর্জন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদা ও উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বনেতারা তো বটেই এমনকি আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র পদ্মা সেতুর জন্য শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশকে অভিনন্দিত করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা এখন শুধু বাংলাদেশের মানুষের, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো বা দেশটির শত্রু মিত্রদের কাছেই পরিচিত নন।

তিনি এখন সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অসাধারণভাবে পরিচিত ও অনুকরণীয়। আমি তাকে শুধু বিশ্বের ক্ষমতাধর মানুষদের তালিকার লোক হিসেবে দেখি না, তাকে দেখি বাংলার স্বর্ণকন্যা হিসেবে। সারা দুনিয়ার জন্য তিনি কি করেছেন সেটির চাইতে জরুরি হচ্ছে তিনি তার নিজের দেশের মানুষের জন্য কি করেছেন সেটি। তার কাজের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সম্পকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেনিয়াবাসীদের বাংলাদেশ থেকে শেখার কথা বলেছেন। তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডিজিটাল ইন্ডিয়া গড়তে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলেছেন। তার জীবন ও কর্ম নিয়ে এখন মহাকাব্য লেখা যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশটির জন্ম দিয়েছেন এই দেশটিকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। এই মানুষটি ৯৬ সালে পাচ বছর ও ২০০৯ সাল থেকে এখনও দেশটি শাসন করছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোন শাসক এত দীর্ঘ সময় দেশ পরিচালনা করার সুযোগ পাননি। তার সুদীর্ঘকালের অর্জন একটি ছোট প্রবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমি বরং নিজের আবেগ-অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাগুলো এখানে কিছুটা তুলে ধরবো। দিনে দিনে এর পরিধিও বাড়বে। চেষ্টা করব সেই অভিজ্ঞতাগুলোও ক্রমশ যুক্ত করতে।

আমি শেখ হাসিনাকে শুধু প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলের প্রধান কিংবা আমার নীতি আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতীক হিসেবেই দেখি না, তাকে চিনি আমি অর্ধ শতকের বেশি সময় ১৯৭০ সাল থেকে। আমার নিজের সঙ্গে-আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে তার অসাধারণ সব স্মৃতি আছে। ব্যক্তিগত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা তিনি তখনই কাটিয়েছেন। এখন মাঝেমধ্যে ভাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দোতালায় প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো সেই মেয়েটির হাতে এক দিন বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টি করা বাঙালির রাষ্ট্রটিকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার সুমহান দায়িত্ব পড়বে তা-কি তখন একবারও ভেবেছি? লেখাপড়ার পাশাপাশি ঘর সংসার করে, লেখাপড়া চালিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার যে অসাধারণ মানুষটি আমাদের সহপাঠিনী ছিলেন এবং আমরা, এমনকি আমাদের শিক্ষকরাও যার আচার-আচরণে ভাবতেই পারতেন না যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা সেই মানুষটি এখনো সেদিনের মতোই আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলেন, মুখের সেই হাসিটা এখনও অমলিন এবং আত্মপ্রত্যয়ে সুদৃঢ় এই মানুষটি এই জাতিকে খাদের নিচ থেকে তুলে আনার যে সুকঠিন দায়িত্ব পালন করছেন, তার বিবরণ দু-চারটি অনুচ্ছেদ বা কয়েক শ পাতায় তুলে ধরা যাবে না। আশা করি কেউ না কেউ তার জীবনালেখ্য রচনা করে তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করবেন। আমি নিজে যদি পারতাম তবে অনেক খুশি হতাম। কিন্তু তার কর্মকা- নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা করতে হবে, তা হয়তো আমার দ্বারা হয়ে ওঠবে না।

শেখ হাসিনাবিষয়ক তথ্যাদি পাওয়া ও তার ১৮ বছরের শাসন কালের একটি রূপরেখা তুলে ধরা একটি অসাধ্য বিষয়। একই অবস্থা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। তাকে নিয়ে গবেষণা, তার জীবন চর্চা ইত্যাদির সঙ্গে কোন বাঙালির কোন প্রকারের তুলনা হবে না। এবার মুজিব বর্ষে আমরা তার সম্পর্কে আরও যেসব তথ্যাদি পাচ্ছি তাতে তিনি আরও অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছাড়াও শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনার বিষয়গুলোর পরিধিও ব্যাপক। বাংলার বড় বড় রাজনীতিক যেমন শেরে বাংলা, সোহরোয়ার্দী, ভাসানী বা আরও অনেকের সঙ্গে আর যারই হোক শেখ হাসিনার তূলনা করার উপায় নেই। সেই মহান রাজনীতিবিদদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই যে শেখ হাসিনা নিজে যা অর্জন করেছেন তারা বা তাদের সমসাময়িক বা তার পরেরও কোন রাজনীতিক কোনভাবেই শেখ হাসিনার সঙ্গে তুলনীয় নন। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ে সরকারপ্রধান থাকা ছাড়াও দেশটির যে সার্বিক রূপান্তর করেছেন তার কোন তুলনা কোথাও নেই। একবাক্যে বলতে পারি, লাঙল-জোয়ালের বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বানিয়েছেন তিনি। বিশ্বে এমন নজির আর নেই যে একটি লাঙল জোয়ালের দেশকে এভাবে ডিজিটাল করা যায়।

আমার এই অক্ষমতা রয়েছে যে তার দৈনন্দিন জীবনের সবটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয় না। অতীতের কিছু স্মৃতি এবং তৃতীয় সূত্রে পাওয়া কিছু তথ্যের বাইরেও গত সাড়ে চার বছরে সরকারে থেকে তাকে যতটা দেখেছি তাতে একটি মহাগ্রন্থ লিখেও সব বিষয় যথাযথভাবে বিস্তারিত উপায়ে প্রকাশ করা যাবে না। তবুও একটি আলোচনার মুখবন্ধ হিসেবে আমি এটুকু বলতে চাই যে, পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশটাকেই খুন করে পাকিস্তান বানানোর যে জঘন্য ষড়যন্ত্র নগ্নভাবে করা হয়েছিলো তার বিরুদ্ধে এই জাতির ঘুরে দাঁড়ানো বা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা কেবল দুঃসাধ্য ছিল না বা অসম্ভব ছিল না দুঃসাধ্য ছিল। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বানানোর প্রতীকটি এখন তিনি।

জাতি হিসেবে আমরা ভাগ্যবান যে পঁচাত্তরের ঘাতকরা ১৫ আগস্ট নাগালের মধ্যে না পাওয়ার পরও ৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনাকে ২১ বার চেষ্টা করেও হত্যা করতে পারেনি। তবে শেখ হাসিনা যে তাদের পাকিস্তানিকরণ চক্রান্তের প্রধান শত্রু, তা এরই মধ্যে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পঁচাত্তরে তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে হত্যা করা আর এখন তাদের গর্হিত লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে হত্যা করা। ওরা বুঝেছে যে, বঙ্গবন্ধু বাঙালি শোষিত জনগোষ্ঠীর জন্য যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তাকে পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলছেন শেখ হাসিনা। তাদের এই গাত্রদাহ এমন যে এখনো পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও তাদের বাংলাদেশি দোসরদের ষড়যন্ত্র বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কূটচক্র বিস্তার করছে। আমার ভয়টা আরও একটু বাড়ছে এজন্য যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন প্রায়ই বাঙালি জাতির অগ্রগতির ইশতেহার হিসেবে জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা-বাকশালের কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রথম কারণটি ছিল বাংলাদেশকে পকিস্তান বানানো এবং বাড়তি কারণ ছিল তিনি শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন-তিনি চেয়েছিলেন একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ যাকে আমরা সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বলি। তবে এই সমাজতন্ত্র চীন রাশিয়ার সমাজতন্ত্র নয় শেখ মুজিবের সমাজতন্ত্র। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দায়ে তাদের হত্যা তালিকায় ছিলেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদেরও চক্ষুকূল হয়ে ওঠেন।

প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়িত করতে পারলে আজকের বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। এর ফলে বাংলাদেশ বিরোধী পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে সাম্র্রাজ্যবাদীরা বা তাদের সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় সহযোগীরাও আরও যুক্ত হয়েছে। আমরা যখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করলাম তখন একটু হিসেবে করতেই হচ্ছে যে, স্বাধীনতার পরপরই যে দেশটাকে তলাহীন ঝুড়ির দেশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই দেশটিকে কি অসাধারণ দক্ষতা ও দূরদর্শিতায় একটি উন্নয়নমুখী দেশে রূপান্তরের পথে যাত্রা শুরু করিয়েছিলেন। ভাবুন তার হাতে আইটিইউ-ইউপিইউ এর সদস্যপদ লাভের কথা। স্মরণ করুন বিটিটিবি গড়ার কথা। স্মরণ করুন ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূকেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন। কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশন গঠন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফ, ১০০ বিঘা জমির সিলিং নির্ধারণ ইত্যাদি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না।

তবে একটি কথা বলতেই হবে যে জাতির পিতা সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করে দেশটির প্রকৃত গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়ে গেছেন। বস্তুত তিনিই ডিজিটাল বাংলাদেশ এর বীজ বপন করেন। যারা মনে করেন যে ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, রোবোটিক্স, আইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি বা পঞ্চম-ষষ্ঠ শিল্পবিপ্লব তারা ভুল করছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা-মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় সুখী, সমৃদ্ধ উন্নত, দারিদ্র্যমুক্ত ও বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু এই সোনার বাংলার স্বপ্নটা এই জাতিকে দিয়ে গেছেন। খুব সরলভাবেও আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে অংশ নিতে না পারা বাংলাদেশকে একটি বিজ্ঞানমনস্ক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার বীজটা বঙ্গবন্ধুরই বপন করা। তিনি কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে দেশটাকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি শিল্পায়নেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের সূচনাও তার হাতেই। ভাবুন তো আমরা যে স্যাটেলাইট ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ করেছি, তার উপগ্রহ ভূকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু সেই ৭৫ সালে উদ্বোধন করেন। একবার ভাবুন যে, টেলিকম খাত এখন বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মহাসড়ক সেই টেলিকম খাতের ভিত্তি হিসেবে টিএন্ডটি বোর্ড তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী]