সুফিয়া কামাল : অনন্যতার মূর্ত প্রতীক

গৌতম রায়

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে গণআন্দোলন যখন দানা বাঁধতে শুরু করে আটের দশকের একদম শেষ আর নয়ের দশকের শুরুর ক্রান্তিলগ্নে, তখন মানুষের দাবি ছিলÑ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিনজননী সুফিয়া কামাল। মানুষের দাবিতে সাড়া দিয়ে খালাম্মা ‘গণতদন্ত কমিশনের’ নেতৃত্ব দিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে এ গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্ব ঐতিহাসিক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনের দায়িত্বভার গ্রহণের আবেদন যখন সুফিয়া কামালের কাছে এলো, তখন তিনি সবিনয়ে এ দায়িত্বভার শহিদ জননী জাহানারা ইমামের হাতে ন্যস্ত করবার প্রস্তাব রাখলেন। শহিদ জননীর শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি হবেন এ আন্দোলনের যোগ্যতম নেত্রী, আমরা সবাই থাকব তার পাশেÑ এটাই ছিল জননী সুফিয়া কামালের সুষ্পষ্ট অভিমত।

তারপরের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। এই নেতৃত্বভার সুফিয়া কামাল যখন জাহানারা ইমামের হাতে তুলে দেন, তখন কিন্তু শহিদ জননীর থেকে বয়সে প্রবীণ হলেও সুফিয়া জাহানারার থেকে শারীরিকভাবে অনেকটাই শক্ত ছিলেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস করে শারীরিক শক্তি তখন খুবই ম্রিয়মাণ।

এই যে আরেকটি স্তরের নেতৃত্বকে তৈরি করাÑ এটাও সুফিয়া কামালের বর্ণময় জীবনের অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পাক হানাদার বাহিনী যেভাবে শহিদ জননীর অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, পুত্র রুমিকে হারানো, সেই আঘাতই তার স্বামীর চলে যাওয়ার প্রধান কারণ, এমন দুর্যোগের ঘনঘটার ভিতর দিয়ে কিন্তু সুফিয়া কামালের জীবনও কেটেছিল। সেই দুর্যোগের ঘনঘটায় তার পরিবারের কাঠামোও তছনছ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়, ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব, সেই নেতৃত্ব নিজের কুক্ষিগত হয়ে থাকুক, এটা কখনো চাইলেন না সুফিয়া কামাল। তিনি চাইলেন, জাহানারা ইমামের ভিতর দিয়ে সেই নেতৃত্বের প্রবাহমানতা আরও সুদূর বিস্তৃত হোক। বস্তুতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন, ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই আন্দোলনে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সংযুক্ত করে যেভাবে জাহানারা ইমাম গোটা পর্যায় টিকে ঐতিহাসিক রূপ দিতে পেরেছিলেন, তার পেছনেও কিন্তু একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচনে সুফিয়া কামালের ঐতিহাসিক পরামর্শ একটা হিমালয়সদৃশ ভূমিকা পালন করেছিল।

বদরুদ্দিন উমরের মতো মানুষেরা যেভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি ব্যক্তি আক্রোশবশত চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হানাদার পাকিস্তানকে সাহায্য করতেই উন্মুখ ছিলেন। সেসব মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়েও যুদ্ধাপরাধীদের ঘিরে কঠোর অবস্থান নিলেও বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি সেই ব্যক্তি বিদ্বেষের জায়গা থেকে বিশ শতকের নয়ের দশকে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সেই নারকীয় পটভূমি অতিক্রম করেও সরে আসেননি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেÑ যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকাÑ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন বদরুদ্দিন উমরকেও শেখ হাসিনার সঙ্গে এক মঞ্চে নিয়ে আসার এই কৃতিত্ব স্থাপন করেছিলেন জাহানারা ইমাম, তার পটভূমিকা তৈরির মূল কারিগরও ছিলেন সুফিয়া কামাল। যোগ্য উত্তরসূরি নির্বাচনের এই যে অসামান্য সাফল্যের কারিগর ছিলেন সুফিয়া কামাল, তেমন সাফল্যের অংশীদার দুইপারের খুব কম বাঙালিই হয়েছেন।

নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির যে নবজাগরণ, সেই জাগ্রতবোধের উন্মীলনের প্রধান ঋত্ত্বিকই ছিলেন সুফিয়া কামাল। ভারতে পাঁচের দশকে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে জয়প্রকাশ নারায়ণ সঙ্গী করেছিলেন গান্ধীজীর হত্যাকারী আরএসএসকে। জয়প্রকাশের সেই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত ভারতবাসীকে আজও দিতে হচ্ছে। সুফিয়া কামাল কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনরুদ্ধারের তাগিদে কখনও কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করেননি।

কোনটা হীরে আর কোনটা নিছকই চটকদার কাঁচ, সেটা বোঝবার অসামান্য ক্ষমতা ছিল বলেই সুফিয়া কামাল এক কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। নয়ের দশকের সূচনাপর্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ যখন উত্তাল, তখন যুদ্ধাপরাধীদের, হানাদার পাকিস্তান এবং তাদের সমর্থকেরাই এসব অপরাধীদের আড়াল করতে খ্রিস্টান মৌলবাদের দালাল হিসেবে বাজারজাত করে তসলিমা নাসরিনকে। এপার বাংলার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ফুলানো বেলুন হিসেবে তসলিমা তার ক্যারিয়ারের প্রায় প্রথম ভাগেই সুফিয়া, জাহানারাকে ‘গৃহবধূ’ বলে খারিজ করে দিলেন। কলকাতারই একটি খবরের কাগজে তসলিমার এ মন্তব্যের কেবল প্রতিবাদই করলেন না শামসুর রাহমান, খুব স্পষ্ট ভাষাতেই তিনি বললেনÑ তসলিমা নারী আন্দোলনের ক্ষতিই করেছেন। হয়ত এ কারণেই পরবর্তীতে তসলিমার তথাকথিত লেখনিতে তার দ্বারা শামসুর রাহমানের চরিত্র হনন করতেও সেই লেখিকাকে আমরা অতি তৎপর দেখি।

সুফিয়া যখন লড়াই করছেন নারীর চলার পথ সুগম করতে রাস্তায় ইট বিছানোর, তসলিমা তখন নারী মুক্তি খুঁজতে চাইছেন, আটই মার্চের মিছিলে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে। ‘লজ্জা’ লিখে একই সঙ্গে জামায়াত-বিএনপি, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গেই ভারতে আরএসএস-বিজেপির হাতে যখন নিরন্তর রশদ জুগিয়ে চলেছেন তসলিমা, সুফিয়া তখন লড়াই সংগঠিত করছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধাপরাধীরাই পাকিস্তানপ্রেমী বাংলাদেশের সেই সময়ের সরকারের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সবরকম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই অত্যাচারের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘ধর্মে’ থেকে হাজার গুণ বেশি কার্যকর যে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার- এ সহজ সত্যটা তসলিমা সেদিনও যেমন উচ্চারণ করেননি, আজও করেন না।

সুফিয়া কামাল কিন্তু তসলিমাকে তার লেখালেখির সূচনাপর্বে সম্মান, মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যথেষ্টই। তসলিমা কিন্তু সুফিয়ার আহ্বানকে বিন্দুমাত্র মর্যাদা দেননি। তসলিমা যখন ঢাকার শান্তিনগরে থাকতেন, সুফিয়া কামাল সেই সময়ে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তসলিমা প্রয়োজনই বোধ করেননি সুফিয়া কামালের সঙ্গে দেখা করবার। দেখা না করবার যুক্তি হিসেবে অনেককাল পরে সে এই নিবন্ধকারকে বলেছিল, তার শান্তিনগরের বাসায় তখন টেলিফোন ছিল না। তাই লোকমুখে সুফিয়া কামালের আমন্ত্রণটা অনেক দেরিতে তিনি পেয়েছিলেন।

প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার বাসায় ফোন না থাকতে পারে, আপনার পরিচিত কারোর বাসায় কি ফোন ছিল না? ঢাকা শহরে তো তখন পাবলিক টেলিফোন বুথের অভাব ছিল না। সেখান থেকেও তো আপনি খালাম্মাকে ফোন করতে পারতেন। বলাবাহুল্য কোনো উত্তর পাইনি।

সুফিয়া কামালের সমসায়িক কালে মুক্তবুদ্ধির অনেক মানুষ ও সুফিয়া উচ্চতার কেশাগ্র স্পর্শ করতে না পারবার হীনমন্যতা থেকে সুফিয়া কামালকে অগ্রাহ্য করবার হীনচেষ্টা চালাতেন। সুফিয়া কামাল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে?ন বলেই তাকে সর্বার্থক প্রগতিশীল বলতে রাজি ছিলেন না ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে। অবশ্য অমলেন্দু বাবুর কাছে মুসলমান সমাজের একমাত্র প্রগতিশীল ছিলেন তার শ্বশুরকুল, শেরেবাংলা ফজলুল হকের পরিবার।

চিত্তের দৃঢ়তা এবং ঋজুতা- সুফিয়া কামালের এই যে বৈশিষ্ট্য তা বাঙালি মেয়েদের কাছে চিরকালের অনুকরণ, অনুসরণযোগ্য বিষয় হয়ে থাকবে। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক জীবনে যে দুই নারী একটা বিশাল পরিম-ল নিয়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, তারা হলেনÑ তার জননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, আর তার ফুফু জননী সুফিয়া কামাল। প্রয়াণের প্রায় দুই যুগ পরেও বাঙালির চিত্তে চিরভাস্বর দীপশিখা জননী সুফিয়া কামাল।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

রবিবার, ২০ নভেম্বর ২০২২ , ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৪

সুফিয়া কামাল : অনন্যতার মূর্ত প্রতীক

গৌতম রায়

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে গণআন্দোলন যখন দানা বাঁধতে শুরু করে আটের দশকের একদম শেষ আর নয়ের দশকের শুরুর ক্রান্তিলগ্নে, তখন মানুষের দাবি ছিলÑ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিনজননী সুফিয়া কামাল। মানুষের দাবিতে সাড়া দিয়ে খালাম্মা ‘গণতদন্ত কমিশনের’ নেতৃত্ব দিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে এ গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্ব ঐতিহাসিক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনের দায়িত্বভার গ্রহণের আবেদন যখন সুফিয়া কামালের কাছে এলো, তখন তিনি সবিনয়ে এ দায়িত্বভার শহিদ জননী জাহানারা ইমামের হাতে ন্যস্ত করবার প্রস্তাব রাখলেন। শহিদ জননীর শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি হবেন এ আন্দোলনের যোগ্যতম নেত্রী, আমরা সবাই থাকব তার পাশেÑ এটাই ছিল জননী সুফিয়া কামালের সুষ্পষ্ট অভিমত।

তারপরের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। এই নেতৃত্বভার সুফিয়া কামাল যখন জাহানারা ইমামের হাতে তুলে দেন, তখন কিন্তু শহিদ জননীর থেকে বয়সে প্রবীণ হলেও সুফিয়া জাহানারার থেকে শারীরিকভাবে অনেকটাই শক্ত ছিলেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস করে শারীরিক শক্তি তখন খুবই ম্রিয়মাণ।

এই যে আরেকটি স্তরের নেতৃত্বকে তৈরি করাÑ এটাও সুফিয়া কামালের বর্ণময় জীবনের অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পাক হানাদার বাহিনী যেভাবে শহিদ জননীর অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, পুত্র রুমিকে হারানো, সেই আঘাতই তার স্বামীর চলে যাওয়ার প্রধান কারণ, এমন দুর্যোগের ঘনঘটার ভিতর দিয়ে কিন্তু সুফিয়া কামালের জীবনও কেটেছিল। সেই দুর্যোগের ঘনঘটায় তার পরিবারের কাঠামোও তছনছ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়, ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব, সেই নেতৃত্ব নিজের কুক্ষিগত হয়ে থাকুক, এটা কখনো চাইলেন না সুফিয়া কামাল। তিনি চাইলেন, জাহানারা ইমামের ভিতর দিয়ে সেই নেতৃত্বের প্রবাহমানতা আরও সুদূর বিস্তৃত হোক। বস্তুতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন, ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই আন্দোলনে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সংযুক্ত করে যেভাবে জাহানারা ইমাম গোটা পর্যায় টিকে ঐতিহাসিক রূপ দিতে পেরেছিলেন, তার পেছনেও কিন্তু একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচনে সুফিয়া কামালের ঐতিহাসিক পরামর্শ একটা হিমালয়সদৃশ ভূমিকা পালন করেছিল।

বদরুদ্দিন উমরের মতো মানুষেরা যেভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি ব্যক্তি আক্রোশবশত চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হানাদার পাকিস্তানকে সাহায্য করতেই উন্মুখ ছিলেন। সেসব মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়েও যুদ্ধাপরাধীদের ঘিরে কঠোর অবস্থান নিলেও বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি সেই ব্যক্তি বিদ্বেষের জায়গা থেকে বিশ শতকের নয়ের দশকে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সেই নারকীয় পটভূমি অতিক্রম করেও সরে আসেননি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেÑ যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকাÑ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন বদরুদ্দিন উমরকেও শেখ হাসিনার সঙ্গে এক মঞ্চে নিয়ে আসার এই কৃতিত্ব স্থাপন করেছিলেন জাহানারা ইমাম, তার পটভূমিকা তৈরির মূল কারিগরও ছিলেন সুফিয়া কামাল। যোগ্য উত্তরসূরি নির্বাচনের এই যে অসামান্য সাফল্যের কারিগর ছিলেন সুফিয়া কামাল, তেমন সাফল্যের অংশীদার দুইপারের খুব কম বাঙালিই হয়েছেন।

নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির যে নবজাগরণ, সেই জাগ্রতবোধের উন্মীলনের প্রধান ঋত্ত্বিকই ছিলেন সুফিয়া কামাল। ভারতে পাঁচের দশকে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে জয়প্রকাশ নারায়ণ সঙ্গী করেছিলেন গান্ধীজীর হত্যাকারী আরএসএসকে। জয়প্রকাশের সেই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত ভারতবাসীকে আজও দিতে হচ্ছে। সুফিয়া কামাল কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনরুদ্ধারের তাগিদে কখনও কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করেননি।

কোনটা হীরে আর কোনটা নিছকই চটকদার কাঁচ, সেটা বোঝবার অসামান্য ক্ষমতা ছিল বলেই সুফিয়া কামাল এক কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। নয়ের দশকের সূচনাপর্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ যখন উত্তাল, তখন যুদ্ধাপরাধীদের, হানাদার পাকিস্তান এবং তাদের সমর্থকেরাই এসব অপরাধীদের আড়াল করতে খ্রিস্টান মৌলবাদের দালাল হিসেবে বাজারজাত করে তসলিমা নাসরিনকে। এপার বাংলার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ফুলানো বেলুন হিসেবে তসলিমা তার ক্যারিয়ারের প্রায় প্রথম ভাগেই সুফিয়া, জাহানারাকে ‘গৃহবধূ’ বলে খারিজ করে দিলেন। কলকাতারই একটি খবরের কাগজে তসলিমার এ মন্তব্যের কেবল প্রতিবাদই করলেন না শামসুর রাহমান, খুব স্পষ্ট ভাষাতেই তিনি বললেনÑ তসলিমা নারী আন্দোলনের ক্ষতিই করেছেন। হয়ত এ কারণেই পরবর্তীতে তসলিমার তথাকথিত লেখনিতে তার দ্বারা শামসুর রাহমানের চরিত্র হনন করতেও সেই লেখিকাকে আমরা অতি তৎপর দেখি।

সুফিয়া যখন লড়াই করছেন নারীর চলার পথ সুগম করতে রাস্তায় ইট বিছানোর, তসলিমা তখন নারী মুক্তি খুঁজতে চাইছেন, আটই মার্চের মিছিলে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে। ‘লজ্জা’ লিখে একই সঙ্গে জামায়াত-বিএনপি, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গেই ভারতে আরএসএস-বিজেপির হাতে যখন নিরন্তর রশদ জুগিয়ে চলেছেন তসলিমা, সুফিয়া তখন লড়াই সংগঠিত করছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধাপরাধীরাই পাকিস্তানপ্রেমী বাংলাদেশের সেই সময়ের সরকারের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সবরকম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই অত্যাচারের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘ধর্মে’ থেকে হাজার গুণ বেশি কার্যকর যে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার- এ সহজ সত্যটা তসলিমা সেদিনও যেমন উচ্চারণ করেননি, আজও করেন না।

সুফিয়া কামাল কিন্তু তসলিমাকে তার লেখালেখির সূচনাপর্বে সম্মান, মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যথেষ্টই। তসলিমা কিন্তু সুফিয়ার আহ্বানকে বিন্দুমাত্র মর্যাদা দেননি। তসলিমা যখন ঢাকার শান্তিনগরে থাকতেন, সুফিয়া কামাল সেই সময়ে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তসলিমা প্রয়োজনই বোধ করেননি সুফিয়া কামালের সঙ্গে দেখা করবার। দেখা না করবার যুক্তি হিসেবে অনেককাল পরে সে এই নিবন্ধকারকে বলেছিল, তার শান্তিনগরের বাসায় তখন টেলিফোন ছিল না। তাই লোকমুখে সুফিয়া কামালের আমন্ত্রণটা অনেক দেরিতে তিনি পেয়েছিলেন।

প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার বাসায় ফোন না থাকতে পারে, আপনার পরিচিত কারোর বাসায় কি ফোন ছিল না? ঢাকা শহরে তো তখন পাবলিক টেলিফোন বুথের অভাব ছিল না। সেখান থেকেও তো আপনি খালাম্মাকে ফোন করতে পারতেন। বলাবাহুল্য কোনো উত্তর পাইনি।

সুফিয়া কামালের সমসায়িক কালে মুক্তবুদ্ধির অনেক মানুষ ও সুফিয়া উচ্চতার কেশাগ্র স্পর্শ করতে না পারবার হীনমন্যতা থেকে সুফিয়া কামালকে অগ্রাহ্য করবার হীনচেষ্টা চালাতেন। সুফিয়া কামাল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে?ন বলেই তাকে সর্বার্থক প্রগতিশীল বলতে রাজি ছিলেন না ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে। অবশ্য অমলেন্দু বাবুর কাছে মুসলমান সমাজের একমাত্র প্রগতিশীল ছিলেন তার শ্বশুরকুল, শেরেবাংলা ফজলুল হকের পরিবার।

চিত্তের দৃঢ়তা এবং ঋজুতা- সুফিয়া কামালের এই যে বৈশিষ্ট্য তা বাঙালি মেয়েদের কাছে চিরকালের অনুকরণ, অনুসরণযোগ্য বিষয় হয়ে থাকবে। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক জীবনে যে দুই নারী একটা বিশাল পরিম-ল নিয়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, তারা হলেনÑ তার জননী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, আর তার ফুফু জননী সুফিয়া কামাল। প্রয়াণের প্রায় দুই যুগ পরেও বাঙালির চিত্তে চিরভাস্বর দীপশিখা জননী সুফিয়া কামাল।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]