বিএনপির নজর মেয়র পদে আ’লীগ কাউন্সিলর প্রার্থীরা ব্যস্ত বিদ্রোহী ঠেকাতে

ঢাকার দুই (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি নির্বাচনে প্রচারণা জমে উঠেছে। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার প্রার্থী সমানতালে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। দুই দলের সমর্থিত কাউন্সিলররাও দিন-রাত এক করে ফেলছেন ভোটের প্রচারণায়। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলররা নিজ ওয়ার্ডের বিদ্রোহী মোকাবিলা করে নিজের জয় নিশ্চিত করার দিকেই বেশি মনোযোগী। নৌকার মেয়র প্রার্থীর বিষয়ে অধিকাংশই উদাসীন। তবে বিএনপির চিত্র ভিন্ন। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি, থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের পাশাপাশি সমর্থিত কাউন্সিলররাও ধানের শীষের মেয়রকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। আগামী ৩০ জানুয়ারি দুই সিটিতে পছন্দের মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন অর্ধ কোটিরও বেশি ভোটার। দলীয়ভাবে (প্রতীকে) ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ (ডিএসসিসি) সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন হলেও নির্দলীয় কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে এবারই প্রথম নিজ নিজ প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই সিটিতে মোট ১২৯টি সাধারণ ও ৪৩টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে ৫৪টি সাধারণ ও ১৮টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড; ডিএসসিসিতে ৭৫টি সাধারণ ও ২৫টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড। ইতোমধ্যে ডিএসসিসি’র ২জন কাউন্সিলর ও ২ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

দুই সিটির ৩০টি ওয়ার্ডে আ’লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী : নির্বাচন কমিশনের তথ্য, সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুই সিটিতে ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের অন্তত ৪০ জন ‘স্বতন্ত্র’ বা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে ১৩টি ওয়ার্ডে ১৬ জন এবং ডিএসসিসিতে ১৭টি ওয়ার্ডে ২৪ জন দলীয় সমর্থনের বাইরে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারাই মূলত দলীয় সমর্থনবঞ্চিত হয়ে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থিতার আড়ালে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অনেকেও। এই প্রেক্ষাপটে এসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় নিজেদের জয় নিশ্চিত করার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে মেয়রের বিষয়টি অনেকটাই উপেক্ষিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় শেষ হলে বিদ্রোহীদের বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার বদ্ধপরিকর। জয়-পরাজয় যাই হোক আওয়ামী লীগ মেনে নেবে।

গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ছাড়াও ১৭২টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দল সমর্থিত প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরও প্রায় ৩০০ বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩ ও ৪ জানুয়ারি দলের নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনা পেয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পৃথক বর্ধিত সভা করে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ জানান। এরপর দুই সিটির ওয়ার্ডভিত্তিক বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকা তৈরি করে তাদের প্রার্থিতা থেকে বিরত করতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ জানুয়ারির মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের তাগিদ দেন। সর্বশেষ ৮ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের চিঠি পাঠিয়ে দল সমর্থিত প্রার্থীদের সমর্থন করে নিজ নিজ মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।

গত ৯ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন অনেকেই প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন। কেউ প্রত্যাহার করেন দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে, কেউ বা দলীয় পদ খোয়ানোর ভয়ে। তবে নির্বাচনী মাঠে তাদের নিয়ে রয়েছে ভিন্ন আলোচনা। জানা গেছে, অনেকে নিজস্ব সমর্থক বলয় নিয়ে নীরব আছেন। অনেকে দলীয় প্রচারণা থেকেই সরে গেছেন। তবে কেন্দ্রীয় অনুরোধ, সাংগঠনিক শাস্তির কড়া হুঁশিয়ারির পরও যাদের দমানো যায়নি, তারা ইতোমধ্যে প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে জোরেশোরে প্রচারে নেমেছেন।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের অভিযোগ, মাঠ বা জনমত যাচাই না করে দলীয় সমর্থন দেয়ায় বিদ্রোহ বেড়েছে। বিদ্রোহী অনেক প্রার্থীরই দাবি, স্থানীয়ভাবে বিতর্কিত, সন্ত্রাসীদের দলীয় সমর্থন দেয়া, দলের পদ-পদবিধারী বড় নেতাদের কাছে আত্মীয়দের সমর্থন দেয়া, জনবিচ্ছিন্ন এবং স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তানদের সমর্থন দেয়ার কারণে তাদের বিদ্রোহী হতে হয়েছে। তবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতাদের আশা দলের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শেষ মুহূর্তে হলেও বিদ্রোহীরা নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে যাবেন।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহাম্মেদ মন্নাফি সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্র থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেই প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন, তাদের বোঝানো হয়েছে। এতে অনেকেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন করবেন, পরবর্তিতে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঢাকা মহানগর উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি সাংবাদিকদের বলেন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলার স্বার্থে আমি মনে করি বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরে যাওয়া উচিত। অন্যথায় দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

দুই সিটির ২৫টি ওয়ার্ডে বিএনপির বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী : বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ১৭২টি ওয়ার্ডে দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী চূড়ান্ত করে গত ৩০ ডিসেম্বর ও ৮ জানুয়ারি এসব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের তৎপরতায় অনেকে আবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারও করে নেন। এরপরও উত্তর ও দক্ষিণ সিটির কমপক্ষে ২৫টি সাধারণ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়ে গেছেন। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ১২ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে ১৩ জন বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় একটি সূত্র বলছে, উত্তর ও দক্ষিণে দলীয় মেয়র প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করাই এবারের সিটি নির্বাচনে বিএনপির মিশন। তাই কাউন্সিলরদের বিষয়ে কেন্দ্র একটু উদাসীন। সূত্রমতে, বেশিরভাগ ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলররা নিজেদের চেয়ে মেয়র পদে নির্বাচনী প্রচারণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ রয়েছে, আগে মেয়র পরে কাউন্সিলর এই নীতিতে কাজ করে যেতে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় সূত্র বলছে, তাবিথ আউয়াল এবং প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন দু’জনই দলের শক্তিশালী প্রার্থী। দু’জনই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিসম্পন্ন, শিক্ষিত, ভদ্র। মনোনয়নের শুরুতে দলের কেন্দ্রীয় একটি অংশের অনাস্থা থাকলেও এখন সবাই ঐক্যবদ্ধ। নগর, থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছেও এই দুই প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বী। বিএপির একাধিক নগর নেতার মতে, বিগত সময়ের চেয়ে বিএনপি এবার অনেক বেশি সংগঠিত। ঐক্যবদ্ধ এ প্রয়াস ভোটের মাঠে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তারা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্র বলছে, নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিএনপির প্রার্থী, জনমত; সার্বিক বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই আতিকুল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের কাছে দু’জনেরই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ক্ষমতানীদের আশা নগরবাসীও তাদের প্রার্থীদের ওপর আস্থা রাখবেন।

ডিএনসিসিতে মেয়র পদে ৬ জন প্রার্থী এবং ডিএসসিসিতে ৭ জন প্রার্থী (সবাই দলীয়) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ডিএনসিসি’র মেয়র প্রার্থীরা হলেন- মো. আতিকুল ইসলাম (আওয়ামী লীগ/নৌকা), তাবিথ আউয়াল (বিএনপি/ধানের শীষ), আহাম্মদ সাজেদুল হক (সিপিবি/কাস্তে), শাহীন খান (পিডিপি/বাঘ), শেখ মো. ফজলে বারী মাসউদ (ইসলামী আন্দোলন/হাতপাখা) এবং মো. আনিসুর রহমান দেওয়ান (এনপিপি/আম)। ডিএসসিসি’র মেয়র প্রার্থীরা হলেন- শেখ ফজলে নূর তাপস (আওয়ামী লীগ/নৌকা), ইশরাক হোসেন (বিএনপি/ধানের শীষ), মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন মিলন (জাতীয় পার্টি/লাঙ্গল), মো. আবদুর রহমান (ইসলামী আন্দোলন/হাতপাখা), মো. বাহরনে সুলতান বাহার (এনপিপি/আম), মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ (বাংলাদেশ কংগ্রেস/ডাব) এবং আবদুস সামাদ সুজন (গণফ্রন্ট/মাছ)।

বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২০ , ১ মাঘ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ঢাকা সিটি নির্বাচন

বিএনপির নজর মেয়র পদে আ’লীগ কাউন্সিলর প্রার্থীরা ব্যস্ত বিদ্রোহী ঠেকাতে

ফয়েজ আহমেদ তুষার |

ঢাকার দুই (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি নির্বাচনে প্রচারণা জমে উঠেছে। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার প্রার্থী সমানতালে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। দুই দলের সমর্থিত কাউন্সিলররাও দিন-রাত এক করে ফেলছেন ভোটের প্রচারণায়। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলররা নিজ ওয়ার্ডের বিদ্রোহী মোকাবিলা করে নিজের জয় নিশ্চিত করার দিকেই বেশি মনোযোগী। নৌকার মেয়র প্রার্থীর বিষয়ে অধিকাংশই উদাসীন। তবে বিএনপির চিত্র ভিন্ন। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি, থানা ও ওয়ার্ড নেতাদের পাশাপাশি সমর্থিত কাউন্সিলররাও ধানের শীষের মেয়রকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। আগামী ৩০ জানুয়ারি দুই সিটিতে পছন্দের মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন অর্ধ কোটিরও বেশি ভোটার। দলীয়ভাবে (প্রতীকে) ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ (ডিএসসিসি) সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন হলেও নির্দলীয় কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে এবারই প্রথম নিজ নিজ প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই সিটিতে মোট ১২৯টি সাধারণ ও ৪৩টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে ৫৪টি সাধারণ ও ১৮টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড; ডিএসসিসিতে ৭৫টি সাধারণ ও ২৫টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড। ইতোমধ্যে ডিএসসিসি’র ২জন কাউন্সিলর ও ২ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

দুই সিটির ৩০টি ওয়ার্ডে আ’লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী : নির্বাচন কমিশনের তথ্য, সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুই সিটিতে ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের অন্তত ৪০ জন ‘স্বতন্ত্র’ বা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে ১৩টি ওয়ার্ডে ১৬ জন এবং ডিএসসিসিতে ১৭টি ওয়ার্ডে ২৪ জন দলীয় সমর্থনের বাইরে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারাই মূলত দলীয় সমর্থনবঞ্চিত হয়ে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থিতার আড়ালে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অনেকেও। এই প্রেক্ষাপটে এসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় নিজেদের জয় নিশ্চিত করার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে মেয়রের বিষয়টি অনেকটাই উপেক্ষিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় শেষ হলে বিদ্রোহীদের বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার বদ্ধপরিকর। জয়-পরাজয় যাই হোক আওয়ামী লীগ মেনে নেবে।

গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ছাড়াও ১৭২টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দল সমর্থিত প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরও প্রায় ৩০০ বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩ ও ৪ জানুয়ারি দলের নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনা পেয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পৃথক বর্ধিত সভা করে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ জানান। এরপর দুই সিটির ওয়ার্ডভিত্তিক বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকা তৈরি করে তাদের প্রার্থিতা থেকে বিরত করতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ জানুয়ারির মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের তাগিদ দেন। সর্বশেষ ৮ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের চিঠি পাঠিয়ে দল সমর্থিত প্রার্থীদের সমর্থন করে নিজ নিজ মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।

গত ৯ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন অনেকেই প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন। কেউ প্রত্যাহার করেন দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে, কেউ বা দলীয় পদ খোয়ানোর ভয়ে। তবে নির্বাচনী মাঠে তাদের নিয়ে রয়েছে ভিন্ন আলোচনা। জানা গেছে, অনেকে নিজস্ব সমর্থক বলয় নিয়ে নীরব আছেন। অনেকে দলীয় প্রচারণা থেকেই সরে গেছেন। তবে কেন্দ্রীয় অনুরোধ, সাংগঠনিক শাস্তির কড়া হুঁশিয়ারির পরও যাদের দমানো যায়নি, তারা ইতোমধ্যে প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে জোরেশোরে প্রচারে নেমেছেন।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের অভিযোগ, মাঠ বা জনমত যাচাই না করে দলীয় সমর্থন দেয়ায় বিদ্রোহ বেড়েছে। বিদ্রোহী অনেক প্রার্থীরই দাবি, স্থানীয়ভাবে বিতর্কিত, সন্ত্রাসীদের দলীয় সমর্থন দেয়া, দলের পদ-পদবিধারী বড় নেতাদের কাছে আত্মীয়দের সমর্থন দেয়া, জনবিচ্ছিন্ন এবং স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তানদের সমর্থন দেয়ার কারণে তাদের বিদ্রোহী হতে হয়েছে। তবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতাদের আশা দলের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শেষ মুহূর্তে হলেও বিদ্রোহীরা নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে যাবেন।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহাম্মেদ মন্নাফি সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্র থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেই প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন, তাদের বোঝানো হয়েছে। এতে অনেকেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন করবেন, পরবর্তিতে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঢাকা মহানগর উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি সাংবাদিকদের বলেন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলার স্বার্থে আমি মনে করি বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরে যাওয়া উচিত। অন্যথায় দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

দুই সিটির ২৫টি ওয়ার্ডে বিএনপির বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী : বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ১৭২টি ওয়ার্ডে দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী চূড়ান্ত করে গত ৩০ ডিসেম্বর ও ৮ জানুয়ারি এসব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের তৎপরতায় অনেকে আবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারও করে নেন। এরপরও উত্তর ও দক্ষিণ সিটির কমপক্ষে ২৫টি সাধারণ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়ে গেছেন। এর মধ্যে উত্তর সিটিতে ১২ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে ১৩ জন বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় একটি সূত্র বলছে, উত্তর ও দক্ষিণে দলীয় মেয়র প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করাই এবারের সিটি নির্বাচনে বিএনপির মিশন। তাই কাউন্সিলরদের বিষয়ে কেন্দ্র একটু উদাসীন। সূত্রমতে, বেশিরভাগ ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলররা নিজেদের চেয়ে মেয়র পদে নির্বাচনী প্রচারণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ রয়েছে, আগে মেয়র পরে কাউন্সিলর এই নীতিতে কাজ করে যেতে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় সূত্র বলছে, তাবিথ আউয়াল এবং প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন দু’জনই দলের শক্তিশালী প্রার্থী। দু’জনই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিসম্পন্ন, শিক্ষিত, ভদ্র। মনোনয়নের শুরুতে দলের কেন্দ্রীয় একটি অংশের অনাস্থা থাকলেও এখন সবাই ঐক্যবদ্ধ। নগর, থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছেও এই দুই প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বী। বিএপির একাধিক নগর নেতার মতে, বিগত সময়ের চেয়ে বিএনপি এবার অনেক বেশি সংগঠিত। ঐক্যবদ্ধ এ প্রয়াস ভোটের মাঠে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তারা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্র বলছে, নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিএনপির প্রার্থী, জনমত; সার্বিক বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই আতিকুল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের কাছে দু’জনেরই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ক্ষমতানীদের আশা নগরবাসীও তাদের প্রার্থীদের ওপর আস্থা রাখবেন।

ডিএনসিসিতে মেয়র পদে ৬ জন প্রার্থী এবং ডিএসসিসিতে ৭ জন প্রার্থী (সবাই দলীয়) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

ডিএনসিসি’র মেয়র প্রার্থীরা হলেন- মো. আতিকুল ইসলাম (আওয়ামী লীগ/নৌকা), তাবিথ আউয়াল (বিএনপি/ধানের শীষ), আহাম্মদ সাজেদুল হক (সিপিবি/কাস্তে), শাহীন খান (পিডিপি/বাঘ), শেখ মো. ফজলে বারী মাসউদ (ইসলামী আন্দোলন/হাতপাখা) এবং মো. আনিসুর রহমান দেওয়ান (এনপিপি/আম)। ডিএসসিসি’র মেয়র প্রার্থীরা হলেন- শেখ ফজলে নূর তাপস (আওয়ামী লীগ/নৌকা), ইশরাক হোসেন (বিএনপি/ধানের শীষ), মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন মিলন (জাতীয় পার্টি/লাঙ্গল), মো. আবদুর রহমান (ইসলামী আন্দোলন/হাতপাখা), মো. বাহরনে সুলতান বাহার (এনপিপি/আম), মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ (বাংলাদেশ কংগ্রেস/ডাব) এবং আবদুস সামাদ সুজন (গণফ্রন্ট/মাছ)।