নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন করে যারা প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাবে, অন্তরে যাদের যুদ্ধ জয়ের আনন্দ, সেই মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিমিষেই শহীদ হয়ে গেলেন ৫ শতাধিক যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য এ ঘটনার দেশবাসী ও রাষ্ট্রের কাছে কোন হিসাব নেই। এর চেয়ে বড় দুঃখজনক ঘটনা আর কি হতে পারে। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল। এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করার নামে এই সূর্য সন্তানদের হয়রানি করা হচ্ছে।
গতকাল সকালে দিনাজপুর প্রেসক্লাবে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধারা এসব কথা বলেন। স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারের সন্তান মো. সফিকুল হক ছুটু’র সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব সুলতান কামাল উদ্দিন বাচ্চুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান, এসকে এম ইলিয়াস আলী, অধ্যাপক জলিল আহমেদ, অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বিশ্বাস, দিনাজপুর নাট্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান রেজু, স্মৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আজহারুল আজাদ জুয়েল, দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গোলাম নবী দুলাল, দিনাজপুর কলামিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক টিপু, সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক সায়েদ আলী, নুরে আলম সিদ্দিকি, তুষার শুভ্র বসাক, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তারিকুজ্জামান তারেক, দৈনিক আজকের দেশবার্তা’র সম্পাদক চিত্ত ঘোষ প্রমুখ।
দিনব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকালে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে চেহেলগাজী মাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, দুর্ঘটনাস্থল মহারাজা গিরিজানাথ হাইস্কুল প্রাঙ্গণের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্র্মীরা।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর মহারাজা স্যার গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে রিপোর্ট করেন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জয়পুরহাটসহ আশপাশের জেলাসমুহের মুক্তিযোদ্ধা, যারা এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তরঙ্গপুর ৭ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারের অধীনে হামজাপুর, পতিরাম ও বাঙ্গালবাড়ী, শিববাটি, প্রাণসাগর, অ্যালুন্দর, ডালিমগাঁও ক্যাম্পের তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই ট্রানজিট ক্যাম্পে প্রায় ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন।
৬ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। প্রতিদিনের মতো মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদ, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে ট্রানজিট ক্যাম্পে ফেরেন। সেদিন বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, ঘোড়ঘাট ও হাকিমপুর থানা হতে ৫টি ট্রাক বোঝাই করে বিপুল সংখ্যক গোলাবারুদ উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রানজিট ক্যাম্পে ফিরে আসেন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। একের পর এক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক হতে তা খালাস করা হচ্ছিল। প্রথম ট্রাকটির মালামাল নামানো শেষ। ঠিক সন্ধ্যা, দ্বিতীয় ট্রাক হতে নামানোর সময় অসতর্ক মুহূর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে সম্ভবত একটি অ্যান্টি ট্যাংক মাইন পড়ে গিয়ে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাংকারের অস্ত্রভা-ার বিকট বিস্ফোরণে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিধ্বনিত ও প্রকম্পিত হয়। শহরের অনেক ভবনের ফাটল সৃস্টি হয়।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭শ’ ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার আগে আনুমানিক ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। দুর্ঘটনায় প্রায় সাড়ে ৪শ’ মুক্তিযোদ্ধা তাৎক্ষণিক নিহত হন। অনেক মুক্তিযোদ্ধার শরীর হতে হাত-পা, মাথা অনেক দূরে ছিটকে যায়। দুর্ঘটনার পর পরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিনসেন্ট মিশন হাসপাতাল ও তৎকালীন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। এদের মধ্যে পরে ২৯ জন মারা যান। শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় উত্তরবালুবাড়ী কুমারপাড়া মহল্লায় আরও ১৫ জন বাসিন্দাও মৃত্যুবরণ করেন। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় মহারাজা স্কুলের দৃষ্টিনন্দন ভবনটি চোখের নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে আশপাশের অনেক ঘরবাড়ি, দালানকোঠা।
দিনাজপুরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর গোর-এ শহীদ ময়দানে জনসভায় ৬ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ঘটনাস্থলে শহীদদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতি দীর্ঘ ২৩ বছর অতিবাহিত হলেও তা আজও বাস্তবায়ন না হওয়ায় জেলার মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
বৃহস্পতিবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২১ , ২৩ পৌষ ১৪২৭, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২
চিত্ত ঘোষ, দিনাজপুর
নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন করে যারা প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাবে, অন্তরে যাদের যুদ্ধ জয়ের আনন্দ, সেই মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিমিষেই শহীদ হয়ে গেলেন ৫ শতাধিক যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য এ ঘটনার দেশবাসী ও রাষ্ট্রের কাছে কোন হিসাব নেই। এর চেয়ে বড় দুঃখজনক ঘটনা আর কি হতে পারে। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল। এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করার নামে এই সূর্য সন্তানদের হয়রানি করা হচ্ছে।
গতকাল সকালে দিনাজপুর প্রেসক্লাবে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধারা এসব কথা বলেন। স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারের সন্তান মো. সফিকুল হক ছুটু’র সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব সুলতান কামাল উদ্দিন বাচ্চুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান, এসকে এম ইলিয়াস আলী, অধ্যাপক জলিল আহমেদ, অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বিশ্বাস, দিনাজপুর নাট্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান রেজু, স্মৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আজহারুল আজাদ জুয়েল, দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গোলাম নবী দুলাল, দিনাজপুর কলামিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক টিপু, সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক সায়েদ আলী, নুরে আলম সিদ্দিকি, তুষার শুভ্র বসাক, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তারিকুজ্জামান তারেক, দৈনিক আজকের দেশবার্তা’র সম্পাদক চিত্ত ঘোষ প্রমুখ।
দিনব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকালে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে চেহেলগাজী মাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, দুর্ঘটনাস্থল মহারাজা গিরিজানাথ হাইস্কুল প্রাঙ্গণের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্র্মীরা।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর মহারাজা স্যার গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে রিপোর্ট করেন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জয়পুরহাটসহ আশপাশের জেলাসমুহের মুক্তিযোদ্ধা, যারা এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তরঙ্গপুর ৭ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারের অধীনে হামজাপুর, পতিরাম ও বাঙ্গালবাড়ী, শিববাটি, প্রাণসাগর, অ্যালুন্দর, ডালিমগাঁও ক্যাম্পের তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই ট্রানজিট ক্যাম্পে প্রায় ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন।
৬ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। প্রতিদিনের মতো মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদ, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে ট্রানজিট ক্যাম্পে ফেরেন। সেদিন বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, ঘোড়ঘাট ও হাকিমপুর থানা হতে ৫টি ট্রাক বোঝাই করে বিপুল সংখ্যক গোলাবারুদ উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রানজিট ক্যাম্পে ফিরে আসেন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। একের পর এক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক হতে তা খালাস করা হচ্ছিল। প্রথম ট্রাকটির মালামাল নামানো শেষ। ঠিক সন্ধ্যা, দ্বিতীয় ট্রাক হতে নামানোর সময় অসতর্ক মুহূর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে সম্ভবত একটি অ্যান্টি ট্যাংক মাইন পড়ে গিয়ে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাংকারের অস্ত্রভা-ার বিকট বিস্ফোরণে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিধ্বনিত ও প্রকম্পিত হয়। শহরের অনেক ভবনের ফাটল সৃস্টি হয়।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭শ’ ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার আগে আনুমানিক ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। দুর্ঘটনায় প্রায় সাড়ে ৪শ’ মুক্তিযোদ্ধা তাৎক্ষণিক নিহত হন। অনেক মুক্তিযোদ্ধার শরীর হতে হাত-পা, মাথা অনেক দূরে ছিটকে যায়। দুর্ঘটনার পর পরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিনসেন্ট মিশন হাসপাতাল ও তৎকালীন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। এদের মধ্যে পরে ২৯ জন মারা যান। শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় উত্তরবালুবাড়ী কুমারপাড়া মহল্লায় আরও ১৫ জন বাসিন্দাও মৃত্যুবরণ করেন। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় মহারাজা স্কুলের দৃষ্টিনন্দন ভবনটি চোখের নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে আশপাশের অনেক ঘরবাড়ি, দালানকোঠা।
দিনাজপুরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর গোর-এ শহীদ ময়দানে জনসভায় ৬ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ঘটনাস্থলে শহীদদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতি দীর্ঘ ২৩ বছর অতিবাহিত হলেও তা আজও বাস্তবায়ন না হওয়ায় জেলার মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ দুঃখ প্রকাশ করেছেন।