টিকার ট্রায়াল ১ ফেব্রুয়ারি

এক সপ্তাহ পর গণপ্রয়োগ

ফেব্রুয়ারির ১ তারিখেই সীমিত পরিসরে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র করোনার টিকার ‘ট্রায়াল’ বা মহড়া শুরু হচ্ছে। প্রথমে ঢাকা শহর এবং একটি গ্রামের (এখনও চূড়ান্ত হয়নি) সীমিতসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেয়া হবে। ট্রায়াল অর্থাৎ পরীক্ষামূলকভাবে টিকা দেয়া ব্যক্তিদের ‘শারীরিক অবস্থা’ এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে টিকার গণপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারের টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দু’জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে জানিয়েছেন, দেশে করোনার টিকার কোন পর্যায়েরই ট্রায়াল হয়নি। তবে পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকার সব পর্যায়ের ট্রায়াল হলেও বড় ধরনের কোন পাশর্^প্রতিক্রিয়া শনাক্ত হয়নি। এরপরও সাতদিনের ট্রায়ালের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র টিকার প্রয়োগ কবে নাগাদ শুরু হতে পারে- জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমেই তা শুরু করতে চাই। সীমিত সংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়ার পর কয়েকদিন তাদের শারীরিক কন্ডিশন পর্যবেক্ষণ করব। এরপর গণপ্রয়োগে যাবো। টিকায় কারও শরীরে কোন পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমে ঢাকা শহরের কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত সরকারি বেসরকারি ও বিশেষায়িত কয়েকটি হাসপাতালের সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সকে করোনার টিকা দেয়া হবে। একইসঙ্গে একটি গ্রামের কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবককে টিকা দেয়া হবে। এরপর সাতদিন পর্যবেক্ষণ করে সব জেলায় একযোগে টিকার গণপ্রয়োগ শুরু হবে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি হওয়ায় রাজধানীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে করোনার ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে, পরিকল্পনাটি এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষাধীন। দেশে করোনা শনাক্তের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও হয়েছে ঢাকা বিভাগে।

করোনায় মোট মারা যাওয়া ৭ হাজার ৯০৬ জনের মধ্যে ৪ হাজার ৩৮৪ জন ঢাকা বিভাগের, ১ হাজার ৪৪৮ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৪৫১ জন রাজশাহী বিভাগের, ৫৪৩ জন খুলনা বিভাগের, ২৪০ জন বরিশাল বিভাগের, ৩০১ জন সিলেট বিভাগের, ৩৫৪ জন রংপুর বিভাগের এবং ১৮৫ জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ করোনার টিকা আগামী ২১-২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আসবে বলে গত ১১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি জানান, প্রথম ধাপে ৫০ লাখ টিকা আসবে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই মানুষ টিকা পাবে।

টিকা দেশে আসার পর দু’দিন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস’র ওয়্যার হাউজে রাখা হবে। এরপর সেখান থেকে ২৭ জানুয়ারির মধ্যে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হবে।

‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র টিকা প্রয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকা দান) প্রফেসর ডা. শামসুল হক সংবাদকে বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে টিকা পাঠানোর বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কোন জেলায় কত টিকা যাবে তাও চূড়ান্ত হয়নি। টিকা আসার পরও সময় পাওয়া যাবে, তখন তা করা হবে। তবে শুধু বেক্সিমকো ফার্মাকে আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি তালিকা ও যোগাযোগের নম্বর দিয়েছি। যাতে করে বেক্সিমকো ওই কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোথায় টিকা রাখা হবে তা ঠিক করতে পারে।’

টিকা প্রয়োগের বিষয়ে এখনই জোড়ালো প্রচারণা নয়

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে প্রতিমাসে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ৫০ লাখ ডোজ করোনা টিকা দেবে বাংলাদেশকে। ছয় ধাপে তিন কোটি ডোজ টিকা দেবে সেরাম ইনস্টিটিউট। এ কারণে একসঙ্গে টিকার প্রয়োগে জোড়ালো প্রচারণায় যাচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রথম পর্যায়ে টিকা গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হবে না। এমনকি অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা কেউ টিকা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেও তাদের বাধ্য করা হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম ইতোমধ্যে বলেছেন, ‘অনেকে হয়তো টিকা নেবে না, যদি কেউ না দেয়, সেটা না হয় থেকে যাবে। আমরা চেষ্টা করব বেশি মানুষকে টিকা দিতে।’

করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচার ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ এবং আইইডিসিআর’র পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘টিকা প্রয়োগের বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রথমেই বড় আকারে প্রচারণার প্রয়োজন নেই। টিকা আসলে ধাপে ধাপে প্রচারণা চলবে। কারণ সবাইকে একসঙ্গে টিকার আওতায় আনা সম্ভব নয়। ব্যাপক আকারে টিকার প্রচারণা হলে টিকা পেতে মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যেতে পারে।’

টিকা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে অনেকেই প্রথমে টিকা নিতে চাইবে না- এ ক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে- জানতে চাইলে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এতে আরও ভালো হবে, যারা নিতে চাইবে তারা পাবেন। কারোর মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকলে তারা পরবর্তীতে টিকা নিতে পারবেন।’

তিনি জানান, ফেব্রুয়ারির শুরুতেই করোনার টিকা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারের পক্ষ্য থেকে প্রচারণ কার্যক্রম শুরু হলে টিকা নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা থাকলেও সেটি দূর হয়ে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যে টিকাদান বিষয়ক প্রশিক্ষণ শুরু জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রশিক্ষণ নির্দেশিকায় টিকার ব্যাপারে ঠিক তথ্য দেয়ার কথা বলা আছে। টিকাবিষয়ক বার্তা সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা শুরু। এছাড়াও ব্যানার, লিফলেট, পোস্টার ব্যবহারের পরিকল্পনাও রয়েছে।

টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ চলছে

টিকা দেয়ার জন্য ৭ হাজার ৩৪৪টি দল তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একটি দলে ছয়জন সদস্য থাকবেন। এর মধ্যে দু’জন টিকাদানকারী (নার্স, স্যাকমো, পরিবারকল্যাণ সহকারী) ও চারজন স্বেচ্ছাসেবক। ইতোমধ্যেই টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। মোট ৪২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণ পাচ্ছে বলে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন। জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের (ডেপুটি সিভিল সার্জন, ইউএইচএফপিও) টিকা বিষয়ক প্রশিক্ষণ আজ ও আগামীকাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের (ট্রেইনার) প্রশিক্ষণ ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি এবং টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ ২৩ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। আর ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি হবে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের ওরিয়েনটেশন। ৩০ জানুয়ারির মধ্যে টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রণয়ন করা প্রশিক্ষণ সহায়িকার আলোকেই টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। অনলাইন প্রশিক্ষণ, মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ও বাজেট চূড়ান্তকরণের কাজও এই প্রশিক্ষণ নির্দেশিকার আলোকে হচ্ছে। এই নির্দেশিকা সব জেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মোবাইল অ্যাপে ৫ মিনিটেই টিকার নিবন্ধন

২৬ জানুয়ারিই টিকা গ্রহীতাদের নিবন্ধন শুরু হচ্ছে। মাত্র পাঁচ মিনিটেই টিকা নেয়ার বিন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। অ্যান্ড্রয়েড ও অ্যাপল দুই স্টোরেই অ্যাপটি পাওয়া যাবে। যেকোন স্মার্টফোনেই এটি ডাউনলোড করা যাবে। অ্যাপ ডাউনলোডের পর টিকা নিতে আগ্রহীরা মোবাইল ফোন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ব্যক্তিদেরও নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেককে নাম, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, পেশা, শারীরিক জটিলতাসহ বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি দুটি করে ডোজ পাবেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের বিস্তারিত তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। কোন মাসে কার কার বা কোন শ্রেণীপেশার মানুষ টিকা পাবেন তা প্রতি মাসে জানিয়ে দেয়া হবে। এরপর মোবাইল অ্যাপে নিবন্ধন করতে পারবেন আগ্রহী ব্যক্তিরা। নিবন্ধিত ব্যক্তিদের তালিকা অনুযায়ী কবে ও কখন কাকে টিকা দেয়া হবে, কোথায় ও কোন সময় তারা টিকা পাবেন, সবকিছু এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে।

টিকার অগ্রাধিকারের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এ কারণে টিকায়ও অগ্রাধিকার পাচ্ছেন রাজধানীবাসী।

প্রথম পর্যায়ে আসা ৫০ লাখ ডোজ ‘সেরাম’র টিকা থেকে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডোজ পাবেন ঢাকার বাসিন্দারা। বিভাগভিত্তিক হিসাবে মোট তিন কোটি ডোজ টিকার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫০ লাখ, চট্টগ্রামে ৩০ লাখ, রাজশাহীতে ২০ লাখ, রংপুরে সাড়ে ১৬ লাখ, খুলনায় ১৬ লাখ, সিলেটে সাড়ে ১০ লাখ, বরিশালে সাড়ে আট এবং ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচ লাখ মানুষ টিকা পাবেন।

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২১ , ৪ মাঘ ১৪২৭, ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪২

টিকার ট্রায়াল ১ ফেব্রুয়ারি

এক সপ্তাহ পর গণপ্রয়োগ

রাকিব উদ্দিন

ফেব্রুয়ারির ১ তারিখেই সীমিত পরিসরে ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র করোনার টিকার ‘ট্রায়াল’ বা মহড়া শুরু হচ্ছে। প্রথমে ঢাকা শহর এবং একটি গ্রামের (এখনও চূড়ান্ত হয়নি) সীমিতসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেয়া হবে। ট্রায়াল অর্থাৎ পরীক্ষামূলকভাবে টিকা দেয়া ব্যক্তিদের ‘শারীরিক অবস্থা’ এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে টিকার গণপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারের টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দু’জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল সংবাদকে জানিয়েছেন, দেশে করোনার টিকার কোন পর্যায়েরই ট্রায়াল হয়নি। তবে পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকার সব পর্যায়ের ট্রায়াল হলেও বড় ধরনের কোন পাশর্^প্রতিক্রিয়া শনাক্ত হয়নি। এরপরও সাতদিনের ট্রায়ালের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র টিকার প্রয়োগ কবে নাগাদ শুরু হতে পারে- জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমেই তা শুরু করতে চাই। সীমিত সংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়ার পর কয়েকদিন তাদের শারীরিক কন্ডিশন পর্যবেক্ষণ করব। এরপর গণপ্রয়োগে যাবো। টিকায় কারও শরীরে কোন পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমে ঢাকা শহরের কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত সরকারি বেসরকারি ও বিশেষায়িত কয়েকটি হাসপাতালের সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সকে করোনার টিকা দেয়া হবে। একইসঙ্গে একটি গ্রামের কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবককে টিকা দেয়া হবে। এরপর সাতদিন পর্যবেক্ষণ করে সব জেলায় একযোগে টিকার গণপ্রয়োগ শুরু হবে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি হওয়ায় রাজধানীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে করোনার ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে, পরিকল্পনাটি এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষাধীন। দেশে করোনা শনাক্তের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও হয়েছে ঢাকা বিভাগে।

করোনায় মোট মারা যাওয়া ৭ হাজার ৯০৬ জনের মধ্যে ৪ হাজার ৩৮৪ জন ঢাকা বিভাগের, ১ হাজার ৪৪৮ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৪৫১ জন রাজশাহী বিভাগের, ৫৪৩ জন খুলনা বিভাগের, ২৪০ জন বরিশাল বিভাগের, ৩০১ জন সিলেট বিভাগের, ৩৫৪ জন রংপুর বিভাগের এবং ১৮৫ জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ করোনার টিকা আগামী ২১-২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আসবে বলে গত ১১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি জানান, প্রথম ধাপে ৫০ লাখ টিকা আসবে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই মানুষ টিকা পাবে।

টিকা দেশে আসার পর দু’দিন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস’র ওয়্যার হাউজে রাখা হবে। এরপর সেখান থেকে ২৭ জানুয়ারির মধ্যে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হবে।

‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র টিকা প্রয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকা দান) প্রফেসর ডা. শামসুল হক সংবাদকে বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে টিকা পাঠানোর বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কোন জেলায় কত টিকা যাবে তাও চূড়ান্ত হয়নি। টিকা আসার পরও সময় পাওয়া যাবে, তখন তা করা হবে। তবে শুধু বেক্সিমকো ফার্মাকে আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি তালিকা ও যোগাযোগের নম্বর দিয়েছি। যাতে করে বেক্সিমকো ওই কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোথায় টিকা রাখা হবে তা ঠিক করতে পারে।’

টিকা প্রয়োগের বিষয়ে এখনই জোড়ালো প্রচারণা নয়

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে প্রতিমাসে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ৫০ লাখ ডোজ করোনা টিকা দেবে বাংলাদেশকে। ছয় ধাপে তিন কোটি ডোজ টিকা দেবে সেরাম ইনস্টিটিউট। এ কারণে একসঙ্গে টিকার প্রয়োগে জোড়ালো প্রচারণায় যাচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রথম পর্যায়ে টিকা গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হবে না। এমনকি অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা কেউ টিকা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেও তাদের বাধ্য করা হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম ইতোমধ্যে বলেছেন, ‘অনেকে হয়তো টিকা নেবে না, যদি কেউ না দেয়, সেটা না হয় থেকে যাবে। আমরা চেষ্টা করব বেশি মানুষকে টিকা দিতে।’

করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচার ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ এবং আইইডিসিআর’র পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘টিকা প্রয়োগের বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রথমেই বড় আকারে প্রচারণার প্রয়োজন নেই। টিকা আসলে ধাপে ধাপে প্রচারণা চলবে। কারণ সবাইকে একসঙ্গে টিকার আওতায় আনা সম্ভব নয়। ব্যাপক আকারে টিকার প্রচারণা হলে টিকা পেতে মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যেতে পারে।’

টিকা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে অনেকেই প্রথমে টিকা নিতে চাইবে না- এ ক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে- জানতে চাইলে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এতে আরও ভালো হবে, যারা নিতে চাইবে তারা পাবেন। কারোর মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকলে তারা পরবর্তীতে টিকা নিতে পারবেন।’

তিনি জানান, ফেব্রুয়ারির শুরুতেই করোনার টিকা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারের পক্ষ্য থেকে প্রচারণ কার্যক্রম শুরু হলে টিকা নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা থাকলেও সেটি দূর হয়ে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যে টিকাদান বিষয়ক প্রশিক্ষণ শুরু জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রশিক্ষণ নির্দেশিকায় টিকার ব্যাপারে ঠিক তথ্য দেয়ার কথা বলা আছে। টিকাবিষয়ক বার্তা সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা শুরু। এছাড়াও ব্যানার, লিফলেট, পোস্টার ব্যবহারের পরিকল্পনাও রয়েছে।

টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ চলছে

টিকা দেয়ার জন্য ৭ হাজার ৩৪৪টি দল তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একটি দলে ছয়জন সদস্য থাকবেন। এর মধ্যে দু’জন টিকাদানকারী (নার্স, স্যাকমো, পরিবারকল্যাণ সহকারী) ও চারজন স্বেচ্ছাসেবক। ইতোমধ্যেই টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। মোট ৪২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণ পাচ্ছে বলে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন। জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের (ডেপুটি সিভিল সার্জন, ইউএইচএফপিও) টিকা বিষয়ক প্রশিক্ষণ আজ ও আগামীকাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের (ট্রেইনার) প্রশিক্ষণ ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি এবং টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ ২৩ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। আর ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি হবে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের ওরিয়েনটেশন। ৩০ জানুয়ারির মধ্যে টিকাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রণয়ন করা প্রশিক্ষণ সহায়িকার আলোকেই টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। অনলাইন প্রশিক্ষণ, মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ও বাজেট চূড়ান্তকরণের কাজও এই প্রশিক্ষণ নির্দেশিকার আলোকে হচ্ছে। এই নির্দেশিকা সব জেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মোবাইল অ্যাপে ৫ মিনিটেই টিকার নিবন্ধন

২৬ জানুয়ারিই টিকা গ্রহীতাদের নিবন্ধন শুরু হচ্ছে। মাত্র পাঁচ মিনিটেই টিকা নেয়ার বিন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। অ্যান্ড্রয়েড ও অ্যাপল দুই স্টোরেই অ্যাপটি পাওয়া যাবে। যেকোন স্মার্টফোনেই এটি ডাউনলোড করা যাবে। অ্যাপ ডাউনলোডের পর টিকা নিতে আগ্রহীরা মোবাইল ফোন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ব্যক্তিদেরও নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেককে নাম, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, পেশা, শারীরিক জটিলতাসহ বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি দুটি করে ডোজ পাবেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের বিস্তারিত তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। কোন মাসে কার কার বা কোন শ্রেণীপেশার মানুষ টিকা পাবেন তা প্রতি মাসে জানিয়ে দেয়া হবে। এরপর মোবাইল অ্যাপে নিবন্ধন করতে পারবেন আগ্রহী ব্যক্তিরা। নিবন্ধিত ব্যক্তিদের তালিকা অনুযায়ী কবে ও কখন কাকে টিকা দেয়া হবে, কোথায় ও কোন সময় তারা টিকা পাবেন, সবকিছু এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে।

টিকার অগ্রাধিকারের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এ কারণে টিকায়ও অগ্রাধিকার পাচ্ছেন রাজধানীবাসী।

প্রথম পর্যায়ে আসা ৫০ লাখ ডোজ ‘সেরাম’র টিকা থেকে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডোজ পাবেন ঢাকার বাসিন্দারা। বিভাগভিত্তিক হিসাবে মোট তিন কোটি ডোজ টিকার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫০ লাখ, চট্টগ্রামে ৩০ লাখ, রাজশাহীতে ২০ লাখ, রংপুরে সাড়ে ১৬ লাখ, খুলনায় ১৬ লাখ, সিলেটে সাড়ে ১০ লাখ, বরিশালে সাড়ে আট এবং ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচ লাখ মানুষ টিকা পাবেন।