জয়পুরহাটের কাজীপাড়া পাখির কলকাকলিতে মুখরিত

জয়পুরহাট শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ক্ষেতলাল উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামে বিভিন্ন গাছে বাসা বেঁধে হাজার হাজার পাখি। গাছের ডালে ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে বক, শামুকখৈলসহ নানা প্রজাতির পাখি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত থাকে গোটা গ্রাম। পাখিগুলোকে গভীর মমতা দিয়ে আগলে রেখেছে গ্রামবাসী। মানুষের ভালোবাসা আর নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে প্রজননের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাখির সংখ্যা। দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করা এই গ্রামে পাখির সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানান।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পাখি রক্ষা ও পাখিদের নিরাপত্তায় কাজীপাড়া গ্রামকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হোক। প্রতিদিন পাখি দেখতে আশপাশের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলা সদর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে ক্ষেতলাল-বগুড়া সড়কের পাশেই অবস্থিত কাজীপাড়া গ্রাম। প্রকৃতির অপরূপ খেয়ালে কয়েক যুগ থেকে এ গ্রামের গাছ-গছালিতে বাসা বেঁধে আছে বক, পানকৌড়ি, শামুকখৈল, রাতচোরা ও ভেলাসহ নানা প্রজাতির হাজার হাজার পাখি। গ্রামবাসীও তাদের আগলে রেখেছে। পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে এ গ্রামের মানুষদের। গ্রাম পার্শ্ববর্তী খাল-বিল আর ফসলের মাঠ থেকে পোকা-মাকড়, মাছ ও শামুক ঝিনুক খেয়ে জীবন বাঁচে পাখিগুলোর। নিরাপদ আশ্রয় আর ভালোবাসায় বাসা বেঁধে প্রজননও করছে তারা। ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এর সংখ্যাও। বহিরাগত আক্রমণ রোধে সতর্ক থাকা ছাড়াও দর্শনার্থীদের সহযোগিতা এবং পাখির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা গ্রামবাসীই রয়েছে এদের নিরাপত্তার দায়িত্বে। যে কোন আগন্তক পাখি শিকার করতে এলে তাদের বাধা দেয়া হয়। পাখিদের গাছে বাস করতে যেন কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য মাটির পাত্র বসিয়ে গাছে গাছে বাসাও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এ গ্রামে পাখি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। ভোর বেলায় পাখিগুলো খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে যায় আর পড়ন্ত বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই বাসায় ফিরে। এ সময়ে পাখির কলকাকলিতে পুরো গ্রাম মুখরিত থাকে। উদ্দীপন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ‘কাজীপাড়া পাখি পল্লী’ লিখা একটি সাইনবোর্ড গ্রামের প্রবেশ মুখে টানানো হলেও পাখি সংরক্ষণে সরকারিভাবে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

কাজীপাড়া গ্রামের কাজী চপল বলেন, ‘জন্মের পর থেকে দেখে আসছি গ্রামে বসবাসরত পাখিগুলোকে। আগে হাজার হাজার সাদা বক থাকতো। এখন বকের পাশাপাশি শামুকখৈল, পানকৌড়ি, রাতচোরা ও ভেলা পাখি গ্রামের বিভিন্ন গাছ-গছালিতে একসঙ্গে বাসা বেঁধে আছে। পাখির দুর্গন্ধে কোন সমস্যা হয় কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোন সমস্যা হয় না। গোটা গ্রামের মানুষই পাখিগুলোকে ভালোবাসে।

স্থানীয় কাজী রিয়াজুল কবির বলেন, ‘এই পাখিগুলো আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য। এলাকায় সবাই জানে কাজীপাড়া গ্রামে হাজার হাজার পাখি বসবাস করছে। এটাই আমাদের গর্ব। বলতে গেলে এখন পাখির সঙ্গেই আমাদের বসবাস। যদিও গ্রামবাসী কাউকেই পাখি শিকার করতে দেয় না, তারপরও প্রশাসনের উদ্যোগে সরকারিভাবে গ্রামটিকে পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষণা দিয়ে এর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিলে অত্রাঞ্চলে কাজীপাড়া গ্রামটি পাখির গ্রাম হিসেবে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে।

ক্ষেতলাল পৌর সদরের থানাপাড়া মহল্লার আজিজুল হক বলেন, ‘কাজীপাড়া গ্রামে ঢুকলেই গাছে গাছে দেখা মিলবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির। কোথাও বসে থেকে পাখা ঝাপটাচ্ছে সাদা বক, আবার কোথাও বসে চেচামেচি করছে শামুকখৈল, রাতচোরা অথবা পানকৌড়ি। শব্দ পেলেই উড়াল দেয় চতুর পাখি পানকৌড়ি। কিছুক্ষণ পর পর ঝাঁকে ঝাঁকে বক, শামুকখৈল অথবা পানকৌড়ির দল এসে বসছে গাছের ডালে ডালে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। যা চোখে না দেখলে অনুভব করা কঠিন।

স্থানীয় বেলগাড়ি গ্রামের পাখিপ্রেমিক আবদুল আলিম বলেন, ‘বিকেলে ওই গ্রামের পাখিগুলোকে দেখতে খুব ভালো লাগে। পাখিরা ওই সময় ডানা মেলে ঝাঁক ধরে নীড়ে ফিরে। হাজার হাজার পাখি সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসে। আবার ভোরে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। মোট কথা পাখিদের জন্যই কাজীপাড়া গ্রামটি এ এলাকায় বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।

ক্ষেতলাল উপজেলা সদরের শিক্ষক আজিজার রহমান জানান, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে সবাইকে পাখিসহ জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা প্রয়োজন। পাখিদের অভয়ারণ্য করতে এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দাবি এ গ্রামকে পাখির অভায়ারণ্য ঘোষণা করে পাখিগুলো রক্ষা করা হোক।

শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১ , ৩১ আশ্বিন ১৪২৮ ০৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

জয়পুরহাটের কাজীপাড়া পাখির কলকাকলিতে মুখরিত

বাকী বিল্লাহ ঢাকা ও নন্দকিশোর আগরওয়ালা, জয়পুরহাট

image

জয়পুরহাট শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ক্ষেতলাল উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামে বিভিন্ন গাছে বাসা বেঁধে হাজার হাজার পাখি। গাছের ডালে ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে বক, শামুকখৈলসহ নানা প্রজাতির পাখি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত থাকে গোটা গ্রাম। পাখিগুলোকে গভীর মমতা দিয়ে আগলে রেখেছে গ্রামবাসী। মানুষের ভালোবাসা আর নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে প্রজননের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাখির সংখ্যা। দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করা এই গ্রামে পাখির সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানান।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পাখি রক্ষা ও পাখিদের নিরাপত্তায় কাজীপাড়া গ্রামকে পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হোক। প্রতিদিন পাখি দেখতে আশপাশের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলা সদর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে ক্ষেতলাল-বগুড়া সড়কের পাশেই অবস্থিত কাজীপাড়া গ্রাম। প্রকৃতির অপরূপ খেয়ালে কয়েক যুগ থেকে এ গ্রামের গাছ-গছালিতে বাসা বেঁধে আছে বক, পানকৌড়ি, শামুকখৈল, রাতচোরা ও ভেলাসহ নানা প্রজাতির হাজার হাজার পাখি। গ্রামবাসীও তাদের আগলে রেখেছে। পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে এ গ্রামের মানুষদের। গ্রাম পার্শ্ববর্তী খাল-বিল আর ফসলের মাঠ থেকে পোকা-মাকড়, মাছ ও শামুক ঝিনুক খেয়ে জীবন বাঁচে পাখিগুলোর। নিরাপদ আশ্রয় আর ভালোবাসায় বাসা বেঁধে প্রজননও করছে তারা। ফলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এর সংখ্যাও। বহিরাগত আক্রমণ রোধে সতর্ক থাকা ছাড়াও দর্শনার্থীদের সহযোগিতা এবং পাখির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা গ্রামবাসীই রয়েছে এদের নিরাপত্তার দায়িত্বে। যে কোন আগন্তক পাখি শিকার করতে এলে তাদের বাধা দেয়া হয়। পাখিদের গাছে বাস করতে যেন কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য মাটির পাত্র বসিয়ে গাছে গাছে বাসাও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এ গ্রামে পাখি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। ভোর বেলায় পাখিগুলো খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে যায় আর পড়ন্ত বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই বাসায় ফিরে। এ সময়ে পাখির কলকাকলিতে পুরো গ্রাম মুখরিত থাকে। উদ্দীপন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ‘কাজীপাড়া পাখি পল্লী’ লিখা একটি সাইনবোর্ড গ্রামের প্রবেশ মুখে টানানো হলেও পাখি সংরক্ষণে সরকারিভাবে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

কাজীপাড়া গ্রামের কাজী চপল বলেন, ‘জন্মের পর থেকে দেখে আসছি গ্রামে বসবাসরত পাখিগুলোকে। আগে হাজার হাজার সাদা বক থাকতো। এখন বকের পাশাপাশি শামুকখৈল, পানকৌড়ি, রাতচোরা ও ভেলা পাখি গ্রামের বিভিন্ন গাছ-গছালিতে একসঙ্গে বাসা বেঁধে আছে। পাখির দুর্গন্ধে কোন সমস্যা হয় কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোন সমস্যা হয় না। গোটা গ্রামের মানুষই পাখিগুলোকে ভালোবাসে।

স্থানীয় কাজী রিয়াজুল কবির বলেন, ‘এই পাখিগুলো আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য। এলাকায় সবাই জানে কাজীপাড়া গ্রামে হাজার হাজার পাখি বসবাস করছে। এটাই আমাদের গর্ব। বলতে গেলে এখন পাখির সঙ্গেই আমাদের বসবাস। যদিও গ্রামবাসী কাউকেই পাখি শিকার করতে দেয় না, তারপরও প্রশাসনের উদ্যোগে সরকারিভাবে গ্রামটিকে পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষণা দিয়ে এর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিলে অত্রাঞ্চলে কাজীপাড়া গ্রামটি পাখির গ্রাম হিসেবে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে।

ক্ষেতলাল পৌর সদরের থানাপাড়া মহল্লার আজিজুল হক বলেন, ‘কাজীপাড়া গ্রামে ঢুকলেই গাছে গাছে দেখা মিলবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির। কোথাও বসে থেকে পাখা ঝাপটাচ্ছে সাদা বক, আবার কোথাও বসে চেচামেচি করছে শামুকখৈল, রাতচোরা অথবা পানকৌড়ি। শব্দ পেলেই উড়াল দেয় চতুর পাখি পানকৌড়ি। কিছুক্ষণ পর পর ঝাঁকে ঝাঁকে বক, শামুকখৈল অথবা পানকৌড়ির দল এসে বসছে গাছের ডালে ডালে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। যা চোখে না দেখলে অনুভব করা কঠিন।

স্থানীয় বেলগাড়ি গ্রামের পাখিপ্রেমিক আবদুল আলিম বলেন, ‘বিকেলে ওই গ্রামের পাখিগুলোকে দেখতে খুব ভালো লাগে। পাখিরা ওই সময় ডানা মেলে ঝাঁক ধরে নীড়ে ফিরে। হাজার হাজার পাখি সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসে। আবার ভোরে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। মোট কথা পাখিদের জন্যই কাজীপাড়া গ্রামটি এ এলাকায় বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।

ক্ষেতলাল উপজেলা সদরের শিক্ষক আজিজার রহমান জানান, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে সবাইকে পাখিসহ জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা প্রয়োজন। পাখিদের অভয়ারণ্য করতে এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দাবি এ গ্রামকে পাখির অভায়ারণ্য ঘোষণা করে পাখিগুলো রক্ষা করা হোক।