ওরিয়নকে কাজ দিয়ে বিপাকে বিদ্যুৎ বিভাগ

বেসরকারি খাতে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের একচেটিয়া কাজ নিয়ে এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না ওরিয়ন গ্রুপ। প্রায় ১৭শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০১২-১৩ সালে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পায় এই প্রতিষ্ঠান। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ইতোমধ্যে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও একটিও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এরমধ্যে সাড়ে ১১শ মেগাওয়াটের দুটি প্রকল্পের মাটি ভরাটই হয়নি। অথচ তিন বছর আগে সেগুলো উৎপাদনে আসার কথা। বিদ্যুৎ প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানতে গঠিত বিদ্যুৎ বিভাগের কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি কোম্পানি ওরিয়ন গ্রুপ মুন্সীগঞ্জে ৫২২ মেগাওয়াট ক্ষমতার (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র (ঢাকা -১), মুন্সীগঞ্জের চরবলাকি মেঘনা ঘাট এলাকায় ৬৩৫ মেগাওয়াট (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র (ঢাকা-২) এবং মুন্সীগঞ্জের চর বলাকিয়া মেঘনাঘাট ২৮২ মেগাওয়াট এবং চট্টগ্রামে একই ক্ষমতার আরেকটি আইপিপি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন পায়। কিন্তু দীর্ঘ ছয়-সাত বছরেও ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি না থাকায় বিদ্যুৎ বিভাগ হতাশা ব্যাক্ত করে। দফায় দফায় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আনতে ব্যর্থ হয় বিদ্যুৎ বিভাগ।

পরে ওরিয়ন গ্রুপের অনুমোদন পাওয়া বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে সরকার বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব এটিএম মোস্তফা কামালকে আহ্বায়ক করে সম্প্রতি তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পক্ষে আইপিপি সেল-১ এর পরিচালক মো. ফজলুল হক এবং সদস্য সচিব হলেন বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা লিমিটেড কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সর্বশেষ অবস্থা যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে সম্প্রতি ওই কমিটি বিদ্যুৎ বিভাগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যানুযায়ী, মুন্সীগঞ্জের মাওয়াঘাট এলাকায় ৫২২ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওরিয়ন কোম্পানির সঙ্গে ২০১২ সালের ২৭ জুন পাওয়ার পারচেস এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) বা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি এবং ইম্পিøমেনটেশন এগ্রিমেন্ট (আইএ) বা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ওরিয়ন কোম্পানিকে ৯ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২৭ মার্চের মধ্যে ফাইন্যান্সিয়াল ক্লোজিং করার কথা ছিল। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার কথা ছিল ২০১৫ সালের ২৭ জুন। কিন্তু আজ অবধি ওরিয়ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে নিয়ে আসতে পারেনি। এমনকি প্রকল্প এলাকায় এখনও মাটি ভরাট পর্যন্ত শেষ হয়নি।

কমিটির সদস্যরা তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে এতদিনেও কোম্পানিটি চুক্তি অনুযায়ী তাদের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি এবং অর্থায়নের পক্ষে কমিটির কাছে কোন তথ্য দিতে পারেনি। এদিকে কোম্পানিটির ‘পারফরমেন্স সিকিউরিটি ডিপোজিটের বিপরীতে কোম্পানি কর্তৃক ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদও শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কোম্পানিকে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বলা হয়। একই সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংককে চিঠি দিয়ে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে পিডিবির অনুকূলে ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ নগদায়ন করতে বলা হয়। কিন্তু ওরিয়ন কোম্পানি ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধি করেনি। এমনকি অগ্রণী ব্যাংক পিডিবির অনুকূলে ব্যাংক গ্যারান্টি অর্থ নগদায়ন পর্যন্ত করেনি। কমিটি বলছে, বিদ্যুৎ বিভাগের তাগাদার পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রণী ব্যাংক ওরিন কোম্পানিকে গ্যারান্টি মার্জিনের অবশিষ্ট টাকা ব্যাংকে জমা প্রদানের জন্য কোম্পানিকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল একটি চিঠি দিলে কোম্পানির পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয় আরও দুই মাস পরে ব্যাংক গ্যারান্টি আপটেড করা হবে।

ওরিয়নের আরেকটি প্রকল্প হলো মুন্সীগঞ্জ এলাকায় ৬৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ বিদ্যুৎ প্রকল্পটি স্থাপন লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট-২ ঢাকা লিমিটেড কোম্পানির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটির ফাইন্যান্সিয়াল ক্লোজিংয়ের সময় ছিল ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি। কিন্তু অদ্যবধি কোম্পানিটি এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আর্থিক জোগান নিশ্চিত করতে পারেনি।

মন্ত্রণালয়ের কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলছে, প্রকল্পের অধীনে ১৩০ একর জমির কাগজপত্র দালিখ করা হলেও আংশিক মাটি ভরাট করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ছয় হাজার ৫০১ কোটি টাকা দরকার হবে। কিন্তু এ অর্থায়নের বিষয়টি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। এছাড়া এ প্রকল্পের জন্য পারফরমেন্স সিকিউরিটি ডিপোজিটের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল শেষ হয়ে গেছে। ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কোম্পানিকে মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বলা হলেও তারা করেনি। এছড়া জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পিডিবির পক্ষে নগদায়নের কথা বলা হলেও জনতা ব্যাংক তা করেনি।

প্রকল্প হলো চট্টগ্রাম ও ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলাদা আলাদা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকার ওরিয়ন পাওয়ার অ্যাসোসিয়েটের অনুকূলে ২০১৩ সালে এলওআই (লেটার অফ ইন্ডেন্ট) ইস্যু করে। এলওআই ইস্যুর শর্ত অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে অনুস্বাক্ষর প্রজেক্ট এগ্রিমেন্টসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট পিডিবির কাছে দাখিল করার কথা ছিল। পিডিবি বলছে, অনেক তাগাদা সত্ত্বেও কোম্পানি তা দাখিল করেনি।

ওরিয়নের অন্য প্রকল্প হলো- চট্টগ্রাম ও ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার পৃথক দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকার ওরিয়ন পাওয়ার এসোসিয়েট এর অনূকূলে ২০১৩ সালে এলওআই (লেটার অফ ইন্ডেন্ট) ইস্যু করে। এলওআই ইস্যুর শর্ত অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে অনুস্বাক্ষরকৃত প্রজেক্ট এগ্রিমেন্টসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট পিডিবির নিকট দাখিল করার কথা ছিলো। পিডিবি বলছে, অনেক তাগাদা সত্ত্বেও কোম্পানি তা দাখিল করেনি।

কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলছে এ প্রকল্প দুটির ‘বিড সিকিউরিটি’ সমূহের মেয়াদ গত বছরের ৪ জানুয়ারি শেষ হয়। বিড সিকিউরিটির মেয়াদ শেয় হওয়ার আগে কোম্পানিকে মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বললেও তারা করেনি। এদিকে বিড সিউকিউরিটি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে পিডিবির পক্ষ থেকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নগদায়ন করতে বলা হলেও তা করেনি।

কমিটি বলছে সর্বশেষ ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংককে চিঠির মাধ্যমে তাগাদা দিলে তারা স্পন্সর কোম্পানি চলতি বছরের ৪ জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে। চলতি বছরের ১৫ ই জুনের মধ্যে পিপিএ এবং আইএ স্বাক্ষর করবে বলে স্পন্সর কোম্পানি মৌখিকভাবে জানিয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলাদা আলাদা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিকে একসঙ্গে করতে ওরিয়ন কোম্পানি হতে আবেদন করা হলেও বিদ্যুৎ বিভাগ সেটা নাকচ করে দেয়। গত বছরের ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ বিভাগের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ওরিয়ন কোম্পানিকে গত বছরের ৭ নভেম্বর তা জানিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে ওরিয়ন গ্রুপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলেও বিদ্যুৎ বিভাগ ব্যবস্থা তো নিতে পারছেই না উল্টো ওরিয়ন গ্রুপের ইচ্ছেমতো কাজ করতে হচ্ছে। যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় নিময় অনুযায়ী ব্যাংকে জমা দেয়া ব্যাংক গ্যারান্টিও নগদায়ন করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র সর্ম্পকে বলেন, প্রাইভেট সেক্টরে কয়লা ভিত্তিকবিদ্যুৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় সব কাজ ওরিয়নের দখলে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নজির নেই। ওরিয়ন তেলভিত্তিক অল্পকিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

এক কর্মকর্তা বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান দিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার কয়লার উপর নির্ভরশীলাতা বাড়ানোর চেষ্টা করেও ওরিয়নের মতো কোম্পানির জন্য সফলতা পায়নি। তাই এখনো ব্যয়বহুল তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যহত রয়েছে।

ওরিয়ন গ্রুপ তাদের ‘ওয়েভ সাইটে’ বলছে, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নির্মিতব্য প্রায় ৬৩০ মেগাওয়াটের কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদনে আসবে; সে সময়ও এখন পেরিয়ে গেছে। ওরিয়ন গ্রুপের তথ্যানুযায়ী, তারা বর্তমানে প্রায় ৩শ’ মেগাওয়াট তেলভিত্তিক উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের প্রায় ১৩শ’ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানাধীন রয়েছে এবং তারা আরো প্রায় ১৬শ’ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক এবং সাড়ে ৮শ’ মেগাওয়াট এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি পেয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজেদের পথিকৃৎ দাবি করছে ওরিয়ন গ্রুপ।

শুক্রবার, ৩১ মে ২০১৯ , ১৭ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ২৫ রমজান ১৪৪০

ওরিয়নকে কাজ দিয়ে বিপাকে বিদ্যুৎ বিভাগ

ফয়েজ আহমেদ তুষার |

image

বেসরকারি খাতে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের একচেটিয়া কাজ নিয়ে এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না ওরিয়ন গ্রুপ। প্রায় ১৭শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০১২-১৩ সালে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পায় এই প্রতিষ্ঠান। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ইতোমধ্যে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও একটিও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এরমধ্যে সাড়ে ১১শ মেগাওয়াটের দুটি প্রকল্পের মাটি ভরাটই হয়নি। অথচ তিন বছর আগে সেগুলো উৎপাদনে আসার কথা। বিদ্যুৎ প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানতে গঠিত বিদ্যুৎ বিভাগের কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি কোম্পানি ওরিয়ন গ্রুপ মুন্সীগঞ্জে ৫২২ মেগাওয়াট ক্ষমতার (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র (ঢাকা -১), মুন্সীগঞ্জের চরবলাকি মেঘনা ঘাট এলাকায় ৬৩৫ মেগাওয়াট (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র (ঢাকা-২) এবং মুন্সীগঞ্জের চর বলাকিয়া মেঘনাঘাট ২৮২ মেগাওয়াট এবং চট্টগ্রামে একই ক্ষমতার আরেকটি আইপিপি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন পায়। কিন্তু দীর্ঘ ছয়-সাত বছরেও ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি না থাকায় বিদ্যুৎ বিভাগ হতাশা ব্যাক্ত করে। দফায় দফায় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আনতে ব্যর্থ হয় বিদ্যুৎ বিভাগ।

পরে ওরিয়ন গ্রুপের অনুমোদন পাওয়া বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে সরকার বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব এটিএম মোস্তফা কামালকে আহ্বায়ক করে সম্প্রতি তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পক্ষে আইপিপি সেল-১ এর পরিচালক মো. ফজলুল হক এবং সদস্য সচিব হলেন বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা লিমিটেড কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সর্বশেষ অবস্থা যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে সম্প্রতি ওই কমিটি বিদ্যুৎ বিভাগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যানুযায়ী, মুন্সীগঞ্জের মাওয়াঘাট এলাকায় ৫২২ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওরিয়ন কোম্পানির সঙ্গে ২০১২ সালের ২৭ জুন পাওয়ার পারচেস এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) বা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি এবং ইম্পিøমেনটেশন এগ্রিমেন্ট (আইএ) বা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ওরিয়ন কোম্পানিকে ৯ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২৭ মার্চের মধ্যে ফাইন্যান্সিয়াল ক্লোজিং করার কথা ছিল। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার কথা ছিল ২০১৫ সালের ২৭ জুন। কিন্তু আজ অবধি ওরিয়ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে নিয়ে আসতে পারেনি। এমনকি প্রকল্প এলাকায় এখনও মাটি ভরাট পর্যন্ত শেষ হয়নি।

কমিটির সদস্যরা তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে এতদিনেও কোম্পানিটি চুক্তি অনুযায়ী তাদের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি এবং অর্থায়নের পক্ষে কমিটির কাছে কোন তথ্য দিতে পারেনি। এদিকে কোম্পানিটির ‘পারফরমেন্স সিকিউরিটি ডিপোজিটের বিপরীতে কোম্পানি কর্তৃক ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদও শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কোম্পানিকে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বলা হয়। একই সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংককে চিঠি দিয়ে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে পিডিবির অনুকূলে ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ নগদায়ন করতে বলা হয়। কিন্তু ওরিয়ন কোম্পানি ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধি করেনি। এমনকি অগ্রণী ব্যাংক পিডিবির অনুকূলে ব্যাংক গ্যারান্টি অর্থ নগদায়ন পর্যন্ত করেনি। কমিটি বলছে, বিদ্যুৎ বিভাগের তাগাদার পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রণী ব্যাংক ওরিন কোম্পানিকে গ্যারান্টি মার্জিনের অবশিষ্ট টাকা ব্যাংকে জমা প্রদানের জন্য কোম্পানিকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল একটি চিঠি দিলে কোম্পানির পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয় আরও দুই মাস পরে ব্যাংক গ্যারান্টি আপটেড করা হবে।

ওরিয়নের আরেকটি প্রকল্প হলো মুন্সীগঞ্জ এলাকায় ৬৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ বিদ্যুৎ প্রকল্পটি স্থাপন লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট-২ ঢাকা লিমিটেড কোম্পানির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটির ফাইন্যান্সিয়াল ক্লোজিংয়ের সময় ছিল ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি। কিন্তু অদ্যবধি কোম্পানিটি এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আর্থিক জোগান নিশ্চিত করতে পারেনি।

মন্ত্রণালয়ের কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলছে, প্রকল্পের অধীনে ১৩০ একর জমির কাগজপত্র দালিখ করা হলেও আংশিক মাটি ভরাট করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ছয় হাজার ৫০১ কোটি টাকা দরকার হবে। কিন্তু এ অর্থায়নের বিষয়টি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। এছাড়া এ প্রকল্পের জন্য পারফরমেন্স সিকিউরিটি ডিপোজিটের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল শেষ হয়ে গেছে। ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কোম্পানিকে মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বলা হলেও তারা করেনি। এছড়া জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ব্যাংক গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পিডিবির পক্ষে নগদায়নের কথা বলা হলেও জনতা ব্যাংক তা করেনি।

প্রকল্প হলো চট্টগ্রাম ও ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলাদা আলাদা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকার ওরিয়ন পাওয়ার অ্যাসোসিয়েটের অনুকূলে ২০১৩ সালে এলওআই (লেটার অফ ইন্ডেন্ট) ইস্যু করে। এলওআই ইস্যুর শর্ত অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে অনুস্বাক্ষর প্রজেক্ট এগ্রিমেন্টসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট পিডিবির কাছে দাখিল করার কথা ছিল। পিডিবি বলছে, অনেক তাগাদা সত্ত্বেও কোম্পানি তা দাখিল করেনি।

ওরিয়নের অন্য প্রকল্প হলো- চট্টগ্রাম ও ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার পৃথক দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকার ওরিয়ন পাওয়ার এসোসিয়েট এর অনূকূলে ২০১৩ সালে এলওআই (লেটার অফ ইন্ডেন্ট) ইস্যু করে। এলওআই ইস্যুর শর্ত অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে অনুস্বাক্ষরকৃত প্রজেক্ট এগ্রিমেন্টসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট পিডিবির নিকট দাখিল করার কথা ছিলো। পিডিবি বলছে, অনেক তাগাদা সত্ত্বেও কোম্পানি তা দাখিল করেনি।

কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলছে এ প্রকল্প দুটির ‘বিড সিকিউরিটি’ সমূহের মেয়াদ গত বছরের ৪ জানুয়ারি শেষ হয়। বিড সিকিউরিটির মেয়াদ শেয় হওয়ার আগে কোম্পানিকে মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বললেও তারা করেনি। এদিকে বিড সিউকিউরিটি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে পিডিবির পক্ষ থেকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নগদায়ন করতে বলা হলেও তা করেনি।

কমিটি বলছে সর্বশেষ ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংককে চিঠির মাধ্যমে তাগাদা দিলে তারা স্পন্সর কোম্পানি চলতি বছরের ৪ জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে। চলতি বছরের ১৫ ই জুনের মধ্যে পিপিএ এবং আইএ স্বাক্ষর করবে বলে স্পন্সর কোম্পানি মৌখিকভাবে জানিয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার আলাদা আলাদা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিকে একসঙ্গে করতে ওরিয়ন কোম্পানি হতে আবেদন করা হলেও বিদ্যুৎ বিভাগ সেটা নাকচ করে দেয়। গত বছরের ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ বিভাগের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ওরিয়ন কোম্পানিকে গত বছরের ৭ নভেম্বর তা জানিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে ওরিয়ন গ্রুপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলেও বিদ্যুৎ বিভাগ ব্যবস্থা তো নিতে পারছেই না উল্টো ওরিয়ন গ্রুপের ইচ্ছেমতো কাজ করতে হচ্ছে। যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় নিময় অনুযায়ী ব্যাংকে জমা দেয়া ব্যাংক গ্যারান্টিও নগদায়ন করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র সর্ম্পকে বলেন, প্রাইভেট সেক্টরে কয়লা ভিত্তিকবিদ্যুৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় সব কাজ ওরিয়নের দখলে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নজির নেই। ওরিয়ন তেলভিত্তিক অল্পকিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

এক কর্মকর্তা বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান দিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার কয়লার উপর নির্ভরশীলাতা বাড়ানোর চেষ্টা করেও ওরিয়নের মতো কোম্পানির জন্য সফলতা পায়নি। তাই এখনো ব্যয়বহুল তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যহত রয়েছে।

ওরিয়ন গ্রুপ তাদের ‘ওয়েভ সাইটে’ বলছে, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় নির্মিতব্য প্রায় ৬৩০ মেগাওয়াটের কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদনে আসবে; সে সময়ও এখন পেরিয়ে গেছে। ওরিয়ন গ্রুপের তথ্যানুযায়ী, তারা বর্তমানে প্রায় ৩শ’ মেগাওয়াট তেলভিত্তিক উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের প্রায় ১৩শ’ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানাধীন রয়েছে এবং তারা আরো প্রায় ১৬শ’ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক এবং সাড়ে ৮শ’ মেগাওয়াট এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি পেয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজেদের পথিকৃৎ দাবি করছে ওরিয়ন গ্রুপ।