সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

বাজেট জনকল্যাণমূলক

বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা

  • এখন আর কেউ আমাদের ভিক্ষুকের জাত বলতে পারবে না
  • এই বাজেটে সাধারণ মানুষ উপকৃত হচ্ছে কি না, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটকে ‘জনকল্যাণমূলক’ বাজেট আখ্যা দিয়ে এর বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন। তিনি বলেন, এই বাজেট যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়, এ জন্য সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন- যেন বাংলাদেশটাকে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারি। দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করা এবং স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছানোই আমাদের লক্ষ্য। আমি মনে করি, আমরা এক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। আগে বিশ্বদরবারে ভিক্ষুকের জাত বলত, এখন আর কেউ এটা বলতে পারে না। এটাই আমাদের বড় অর্জন। এমন অর্জন সত্ত্বেও সমালোচনা হয়। যারা সমালোচনা করে, করে যাক। ভালো কিছু বললে গ্রহণ করব, মন্দ কিছু বললে ধর্তব্যে নেব না। শুক্রবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় আগামী অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। চক্রবৃদ্ধি সুদের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি দেখা যায় বলে মন্তব্য করেন।

প্রতিবছর বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এবার নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় শুক্রবার বেলা ৩টায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। এসব মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বাজেটের বিভিন্ন দিক ও সরকারের পরিকল্পনার কথা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। পরে বাজেট নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এই বাংলাদেশ সারাবিশ্বে আজ একটা মর্যাদা পেয়েছে এবং বাংলাদেশ যেন এগিয়ে যেতে পারে। সবদিক থেকেই আজ বাংলাদেশ যে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, ওই গতিটা যেন চলমান থাকে- এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশকে জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই আমরা প্রতিষ্ঠা করব। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের স্তর পেরিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সুখী উন্নত-সমৃদ্ধ সোনর বাংলা গড়ার লক্ষ্য সামনে রেখে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। এটি দেশের ৪৮তম এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ স্লোগান সংবলিত এ প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআরবহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।

৩ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, কর্মসংস্থান তৈরির কথা আমরা বলেছি। চাকরি দেয়ার কথা বলিনি। ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রেখেছি। শিক্ষার কথা বলেছিÑ প্রযুক্তি শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা। আমরা চাই, প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষিত হয়ে নিজের কাজ নিজে করা শুরু করুক। মূলত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে। আর আছে বলেই ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না। ধান কাটার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে বলেই ধান কাটার লোকের অভাব হচ্ছে। আমরা কর্মসংস্থানের কথা বললেই অনেকে চাকরির কথা বলেন। ১৬ কোটি মানুষকে কি চাকরি দেয়া যায়? কোন দেশ কি দেয়? মানুষ যেন কাজ করে খেতে পারে, ওই সুযোগটি তৈরি করা।

কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্যের বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধানের গুদাম নির্মাণ হচ্ছে। ধান ক্রয় করার লক্ষ্য আমরা নিয়েছি। প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হয়। কৃষকদের নিজেদের অল্প অর্থই ব্যয় হয়। বলতে গেলে সরকারই সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়ে থাকে। কৃষকের সব সুবিধা আমরা দিয়ে থাকি। আর দিয়েছি বলেই এত ধান উৎপাদন হয়েছে, না হলে এত ধান উৎপাদন হতো না। অতীতেও উৎপাদন হয়নি, এখনও হতো না। কৃষকদের যেটি ভালো-মন্দ, সেটি দেখা আমাদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ। বেশি ধান উৎপাদন করতে পারলে কৃষক বেশি ধান বেচতে পারবেন। সরকার তো ধান ক্রয় করছেই।

ব্যাংকের ঋণখেলাপি সমস্যা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা এখানে পত্রিকায় কাজ করেন, তাদের একটি কথা জিজ্ঞেস করব- আপনারা কি একটি খবর নেবেন যে, আপনাদের পত্রিকার মালিকরা কে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং শোধ দিয়েছেন কি না? আপনারা দয়া করে সব ব্যাংক থেকে এই তথ্যটি বের করেন। যত মিডিয়া এখানে আছেন, যত পত্রিকা... প্রত্যেকেই বলবেন (মালিকদের) যে, এটা আমি অনুরোধ করেছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কোন মালিক কোন ব্যাংকের কত টাকা ঋণ নিয়ে কত টাকা শোধ দেননি বা খেলাপি হয়েছেন, সেটি বের করলে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগবে না। তিনি বলেন, পত্রিকা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকরা কত টাকা ঋণ নিয়েছেন, সেটির একটি হিসাব নেয়া হবে এবং তাদের টাকাটা শোধ দিয়ে তাদের পত্রিকায় লেখবেন- এটি আমার অনুরোধ থাকবে। যেহেতু আমাদের সুদের হার অনেক বেশি, যেহেতু চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হয়। আরেকটি বিষয় রয়ে গেছে- যখন হিসাব দেয়া হয়, তখন চক্রবৃদ্ধি হারে সেটি ধরে হিসাব দেয়া হয়। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বড় দেখায়।

শুক্রবার সকালে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাজেট পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে বলা হয়, দেশের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের মানুষ নয়- যারা ধনী এবং ‘অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী’, তারাই নতুন অর্থবছরের বাজেট থেকে সুবিধা পাবে।

সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশে কিছু লোক থাকেÑ যাদের একটা মানসিক অসুস্থতা থাকে, তাদের কিছুই ভালো লাগে না। আপনি যত ভালো কাজই করেন, তারা কোন কিছু ভালো খুঁজে পায় না। যখন দেশে একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়, সাধারণ মানুষের উন্নতি হয়- তখন তারা কোন কিছুই ভালো দেখে না। সব কিছুতেই কিন্তু খোঁজে। সিপিডি কী গবেষণা করে এবং তারা দেশের জন্য কী আনতে পেরেছে, ওই প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারপরও তাদের একটা কিছু বলতে হবে। তো সেটি ভালো, এত সমালোচনা করেও আবার বলবে, ‘আমরা কথা বলতে পারি না।’ এ রোগটাও আছে। এটা অনেকটা অসুস্থতার মতো।

বাজেট নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমার কথা হচ্ছে, আমার সাধারণ জনগণ খুশি কি না, সাধারণ মানুষ খুশি কি না, সাধারণ মানুষের ভালো করতে পারছি কি নাÑ এটা হচ্ছে বড় কথা।

আওয়ামী লীগ সরকার যে এবার নিয়ে টানা ১১ বারের মতো বাজেট দিল, এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যা করছি, তার সুফলটা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। আর এই ভালো না লাগা পার্টি যারা, তাদের কোনো কিছুতেই ভালো লাগবে না।” সমালোচকদের জবাব দিতে গিয়ে একটি বাংলা কৌতুকের কথাও মনে করিয়ে দেন শেখ হাসিনা। একটা গল্প আছে না, পড়াশোনা করছে ছেলে, পাস করবে না। পাস করার পরে বলল, চাকরি পাবে না। চাকরি পাওয়ার পর বলল, বেতন পাবে না। বেতন পাওয়ার পরে বলল, বেতনের টাকা চলবে না। তো ওনাদের সেই অসুস্থতা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করতে এবং স্বাধীনতার সুফল যেন দেশের মানুষের ঘরে পৌঁছায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সেই লক্ষ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আগে বাইরে গেলে আগে যারা মনে করত আমরা ভিক্ষুকের জাত হিসেবে যাচ্ছি, এখন আর কেউ তা মনে করে না। এটাই হচ্ছে আমাদের সব থেকে বড় অর্জন। শেখ হাসিনা বলেন, যারা সমালোচনা করার তারা করে যাক, ভালো কথা বললে আমরা গ্রহণ করব, মন্দ কথা বললে আমরা ধর্তব্যে নেব না। পরিষ্কার কথা।

ব্যাংকের ঋণের সুদের বিষয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাংকের যে সমস্যাটিÑ আপনারা জানেন যে, আমরা সব সময় চেয়েছি, চেষ্টা করেছি যেন সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার জন্য আমরা কিছু সুযোগ করে দিয়েছি। কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংক সেটি মানেনি। এবার বাজেটে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের এই নিয়মটা মেনে চলতে হবেÑ যেন ঋণটা সিঙ্গেল ডিজিটে হয়। তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ এত বেশি চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়তে থাকলে মানুষ ব্যবসা করতে পারে না। এদিকটা আমরা বিশেষভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা অনেক আইন সংশোধন করব। অনেক আইন সংশোধন করতে হবে, সেই ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। আমরা চাপে নেই। এটা নিয়ে আমরা মিটিং করি। সরকারি ব্যাংক নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানেই অর্থ পাচার হচ্ছে, সেটি ধরা হচ্ছে এবং ধরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে যেটা হয়, কিছু অপ্রদর্শিত টাকা থাকে, হয়তো কোন কারণে টাকা হাতে এসে যায়, যেটা কাজে লাগাতে পারে না। তখন সেই টাকাটা নানাভাবে পাচার করতে চায় বা অন্যভাবে ব্যবহার হয়, সেটি যেন করতে না পারে, সেটি বন্ধ করার জন্য এটি বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। শুধু আমরা নই, এর আগেও সব সরকারই দিয়েছে। আমরাও সেই সুযোগ দিয়েছি। টাকাগুলো যেন কাজে লাগে, এ জন্য আমরা সুযোগ দিচ্ছি।’

শনিবার, ১৫ জুন ২০১৯ , ১ আষাঢ় ১৪২৫, ১১ শাওয়াল ১৪৪০

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

বাজেট জনকল্যাণমূলক

বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

  • এখন আর কেউ আমাদের ভিক্ষুকের জাত বলতে পারবে না
  • এই বাজেটে সাধারণ মানুষ উপকৃত হচ্ছে কি না, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটকে ‘জনকল্যাণমূলক’ বাজেট আখ্যা দিয়ে এর বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন। তিনি বলেন, এই বাজেট যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়, এ জন্য সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন- যেন বাংলাদেশটাকে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারি। দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করা এবং স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছানোই আমাদের লক্ষ্য। আমি মনে করি, আমরা এক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। আগে বিশ্বদরবারে ভিক্ষুকের জাত বলত, এখন আর কেউ এটা বলতে পারে না। এটাই আমাদের বড় অর্জন। এমন অর্জন সত্ত্বেও সমালোচনা হয়। যারা সমালোচনা করে, করে যাক। ভালো কিছু বললে গ্রহণ করব, মন্দ কিছু বললে ধর্তব্যে নেব না। শুক্রবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় আগামী অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। চক্রবৃদ্ধি সুদের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি দেখা যায় বলে মন্তব্য করেন।

প্রতিবছর বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এবার নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় শুক্রবার বেলা ৩টায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। এসব মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বাজেটের বিভিন্ন দিক ও সরকারের পরিকল্পনার কথা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। পরে বাজেট নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এই বাংলাদেশ সারাবিশ্বে আজ একটা মর্যাদা পেয়েছে এবং বাংলাদেশ যেন এগিয়ে যেতে পারে। সবদিক থেকেই আজ বাংলাদেশ যে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, ওই গতিটা যেন চলমান থাকে- এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশকে জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই আমরা প্রতিষ্ঠা করব। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের স্তর পেরিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সুখী উন্নত-সমৃদ্ধ সোনর বাংলা গড়ার লক্ষ্য সামনে রেখে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। এটি দেশের ৪৮তম এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ স্লোগান সংবলিত এ প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআরবহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।

৩ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, কর্মসংস্থান তৈরির কথা আমরা বলেছি। চাকরি দেয়ার কথা বলিনি। ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রেখেছি। শিক্ষার কথা বলেছিÑ প্রযুক্তি শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা। আমরা চাই, প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষিত হয়ে নিজের কাজ নিজে করা শুরু করুক। মূলত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে। আর আছে বলেই ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না। ধান কাটার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে বলেই ধান কাটার লোকের অভাব হচ্ছে। আমরা কর্মসংস্থানের কথা বললেই অনেকে চাকরির কথা বলেন। ১৬ কোটি মানুষকে কি চাকরি দেয়া যায়? কোন দেশ কি দেয়? মানুষ যেন কাজ করে খেতে পারে, ওই সুযোগটি তৈরি করা।

কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্যের বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধানের গুদাম নির্মাণ হচ্ছে। ধান ক্রয় করার লক্ষ্য আমরা নিয়েছি। প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হয়। কৃষকদের নিজেদের অল্প অর্থই ব্যয় হয়। বলতে গেলে সরকারই সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়ে থাকে। কৃষকের সব সুবিধা আমরা দিয়ে থাকি। আর দিয়েছি বলেই এত ধান উৎপাদন হয়েছে, না হলে এত ধান উৎপাদন হতো না। অতীতেও উৎপাদন হয়নি, এখনও হতো না। কৃষকদের যেটি ভালো-মন্দ, সেটি দেখা আমাদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ। বেশি ধান উৎপাদন করতে পারলে কৃষক বেশি ধান বেচতে পারবেন। সরকার তো ধান ক্রয় করছেই।

ব্যাংকের ঋণখেলাপি সমস্যা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা এখানে পত্রিকায় কাজ করেন, তাদের একটি কথা জিজ্ঞেস করব- আপনারা কি একটি খবর নেবেন যে, আপনাদের পত্রিকার মালিকরা কে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং শোধ দিয়েছেন কি না? আপনারা দয়া করে সব ব্যাংক থেকে এই তথ্যটি বের করেন। যত মিডিয়া এখানে আছেন, যত পত্রিকা... প্রত্যেকেই বলবেন (মালিকদের) যে, এটা আমি অনুরোধ করেছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কোন মালিক কোন ব্যাংকের কত টাকা ঋণ নিয়ে কত টাকা শোধ দেননি বা খেলাপি হয়েছেন, সেটি বের করলে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগবে না। তিনি বলেন, পত্রিকা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকরা কত টাকা ঋণ নিয়েছেন, সেটির একটি হিসাব নেয়া হবে এবং তাদের টাকাটা শোধ দিয়ে তাদের পত্রিকায় লেখবেন- এটি আমার অনুরোধ থাকবে। যেহেতু আমাদের সুদের হার অনেক বেশি, যেহেতু চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হয়। আরেকটি বিষয় রয়ে গেছে- যখন হিসাব দেয়া হয়, তখন চক্রবৃদ্ধি হারে সেটি ধরে হিসাব দেয়া হয়। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বড় দেখায়।

শুক্রবার সকালে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাজেট পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে বলা হয়, দেশের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের মানুষ নয়- যারা ধনী এবং ‘অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী’, তারাই নতুন অর্থবছরের বাজেট থেকে সুবিধা পাবে।

সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশে কিছু লোক থাকেÑ যাদের একটা মানসিক অসুস্থতা থাকে, তাদের কিছুই ভালো লাগে না। আপনি যত ভালো কাজই করেন, তারা কোন কিছু ভালো খুঁজে পায় না। যখন দেশে একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়, সাধারণ মানুষের উন্নতি হয়- তখন তারা কোন কিছুই ভালো দেখে না। সব কিছুতেই কিন্তু খোঁজে। সিপিডি কী গবেষণা করে এবং তারা দেশের জন্য কী আনতে পেরেছে, ওই প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারপরও তাদের একটা কিছু বলতে হবে। তো সেটি ভালো, এত সমালোচনা করেও আবার বলবে, ‘আমরা কথা বলতে পারি না।’ এ রোগটাও আছে। এটা অনেকটা অসুস্থতার মতো।

বাজেট নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমার কথা হচ্ছে, আমার সাধারণ জনগণ খুশি কি না, সাধারণ মানুষ খুশি কি না, সাধারণ মানুষের ভালো করতে পারছি কি নাÑ এটা হচ্ছে বড় কথা।

আওয়ামী লীগ সরকার যে এবার নিয়ে টানা ১১ বারের মতো বাজেট দিল, এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যা করছি, তার সুফলটা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। আর এই ভালো না লাগা পার্টি যারা, তাদের কোনো কিছুতেই ভালো লাগবে না।” সমালোচকদের জবাব দিতে গিয়ে একটি বাংলা কৌতুকের কথাও মনে করিয়ে দেন শেখ হাসিনা। একটা গল্প আছে না, পড়াশোনা করছে ছেলে, পাস করবে না। পাস করার পরে বলল, চাকরি পাবে না। চাকরি পাওয়ার পর বলল, বেতন পাবে না। বেতন পাওয়ার পরে বলল, বেতনের টাকা চলবে না। তো ওনাদের সেই অসুস্থতা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করতে এবং স্বাধীনতার সুফল যেন দেশের মানুষের ঘরে পৌঁছায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, সেই লক্ষ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি আমরা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আগে বাইরে গেলে আগে যারা মনে করত আমরা ভিক্ষুকের জাত হিসেবে যাচ্ছি, এখন আর কেউ তা মনে করে না। এটাই হচ্ছে আমাদের সব থেকে বড় অর্জন। শেখ হাসিনা বলেন, যারা সমালোচনা করার তারা করে যাক, ভালো কথা বললে আমরা গ্রহণ করব, মন্দ কথা বললে আমরা ধর্তব্যে নেব না। পরিষ্কার কথা।

ব্যাংকের ঋণের সুদের বিষয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাংকের যে সমস্যাটিÑ আপনারা জানেন যে, আমরা সব সময় চেয়েছি, চেষ্টা করেছি যেন সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার জন্য আমরা কিছু সুযোগ করে দিয়েছি। কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংক সেটি মানেনি। এবার বাজেটে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের এই নিয়মটা মেনে চলতে হবেÑ যেন ঋণটা সিঙ্গেল ডিজিটে হয়। তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ এত বেশি চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়তে থাকলে মানুষ ব্যবসা করতে পারে না। এদিকটা আমরা বিশেষভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা অনেক আইন সংশোধন করব। অনেক আইন সংশোধন করতে হবে, সেই ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। আমরা চাপে নেই। এটা নিয়ে আমরা মিটিং করি। সরকারি ব্যাংক নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানেই অর্থ পাচার হচ্ছে, সেটি ধরা হচ্ছে এবং ধরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে যেটা হয়, কিছু অপ্রদর্শিত টাকা থাকে, হয়তো কোন কারণে টাকা হাতে এসে যায়, যেটা কাজে লাগাতে পারে না। তখন সেই টাকাটা নানাভাবে পাচার করতে চায় বা অন্যভাবে ব্যবহার হয়, সেটি যেন করতে না পারে, সেটি বন্ধ করার জন্য এটি বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। শুধু আমরা নই, এর আগেও সব সরকারই দিয়েছে। আমরাও সেই সুযোগ দিয়েছি। টাকাগুলো যেন কাজে লাগে, এ জন্য আমরা সুযোগ দিচ্ছি।’