ধনীরা বেশি সুবিধা পাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত

ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ অপশাসন সমাধানের সুনির্দিষ্টি পরিকল্পনা নেই : সিপিডি

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ পর্যালোচনা’ করে জানিয়েছে, এবারের বাজেটে ধনীরা বেশি সুবিধা পাবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সিপিডির মতে, দেশের ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন খাতে অপশাসন চলছে। এগুলো সমাধানে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রাখা হয়নি বাজেটে। তাই এসব অপশাসনে যারা সুবিধা ভোগ করেন, এবারের বাজেট তাদের পক্ষেই গেছে। গতকাল সকালে রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন এসব মন্তব্য করেন সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট উম্মে শেফা রেজবানা, মোস্তফা আমির সাব্বিহ, সারাহ সাবিন খানসহ অন্য কর্মকর্তারা। সিপিডির ফেলো বাজেট পর্যালোচনা করে বলেন, বাজেট অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে গেছে। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো বাজেটে তুলে ধরা হয়নি এবং সমাধানের আভাসও নেই। ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে বাজেটে আলোচনা আছে। কিন্তু কর্মপরিকল্পনা নেই। এই খাতের সমস্যাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বাজেটে। খাতওয়ারি বরাদ্দের দিক থেকে বাজেট ভারসাম্যহীন ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে স্বচ্ছল ও উচ্চবিত্তকে বেশি সুবিধা দেয়া হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের জন্য রয়েছে প্রান্তিক সুবিধা। তবে মধ্যবিত্তের জন্য খুব বেশি সুবিধা হবে না। সরকারি টাকায় অবকাঠামো নির্মাণ করে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা। এটা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি করছে। বাজেটে ধনীদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারচার্জের জন্য ধনীদের মোট সম্পদের সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা থাকলে সারচার্জ দিতে হতো। এবার তা ৭৫ লাখ বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ধনীদের করমুক্ত সম্পদের সীমা বাড়ছে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। অর্থাৎ যারা আয় করেন, তাদের জন্য সুবিধা বা প্রণোদনা দেয়া হয়নি। ধনীদের এই সুবিধা কেন দেয়া হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। এটি সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গেও মেলে না। অন্যদিকে যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, এর স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি। সংস্থাটি জানিয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থমন্ত্রণালয়Ñ এ দুটি সংস্থার কাছে দুই ধরনের তথ্য রয়েছে। এক সংস্থার তথ্যের সঙ্গে অন্য সংস্থার তথ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অপেক্ষাকৃত ভালো ফল দেখানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, আসলে কোন সংস্থার তথ্য সঠিক।

কিছু খাতের চলমান সমস্যার সমাধানে স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, বর্তমানে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিপূর্ণ খাত হলো ব্যাংক ও পুঁজিবাজার। কিন্তু এই খাতের চলমান সমস্যা সমধানের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এই সমস্যা সমাধান করতে গেলে অপশাসনের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে যাবে। তাই যারা অপশাসনের সুবিধা ভোগ করছে, তারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, আগে শেয়ারবাজার থেকে প্রাপ্ত আয়ের করমুক্ত সীমা ছিল ২৫ হাজার টাকা। এবার তা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্টক ডিভিডেন্ড কমিয়ে ক্যাশ (নগদ) ডিভিডেন্ড প্রদানে উৎসাহ দেয়া হয়েছে বাজেটে। স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলে এবার থেকে দিতে হবে ১৫ শতাংশ কর। কিন্তু ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত বা যে প্রভাবশালী মহল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রাখা হয়নি।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে সম্পদ কর আইন কার্যকর নেই। সম্পদ করের পরিবর্তে ব্যক্তিশ্রেণির বিত্তশালী করদাতা প্রদেয় আয়করের একটি নির্দিষ্ট হারে সারচার্জ দিয়ে থাকেন। গত কয়েক বছর এ বিধানটি কার্যকর আছে। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, অনেক বিত্তশালী করদাতার বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। কিন্তু তারা তেমন কোন আয় প্রদর্শন করেন না। ফলে প্রদেয় আয়কর কম হওয়ায় তাদের তেমন সারচার্জও প্রদান করতে হয় না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ৫০ কোটি বা এর অধিক নেট সম্পদ রয়েছেÑ এমন করদাতাদের নেট সম্পদের ওপর দশমিক ১ শতাংশ অথবা প্রদেয় করের ৩০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি, ওই পরিমাণ সারচার্জ আরোপের প্রস্তাব করছি। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তা আগের বছর একই ছিল। কিন্তু বিভিন্ন ব্যবসায়িক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবি করা হয়েছিল। বাজেট আওয়ামী লীগের ইশতেহার অনুযায়ী হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বাজেট নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী হয়নি। তথ্য ও উপাত্তের গরমিল রয়ে গেছে। বর্তমানে অর্থনৈতিক যে চাপ চলছে, বাজেটে এর স্বীকৃতি নেই। বাজেট দেয়ার সময় যে অভিনব কায়দা ছিল, বাজেটের তথ্য-উপাত্তে তা পাওয়া যায়নি। উদাহরণ হিসেবে তিনি তথ্যের উৎস হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কথা উল্লেখ্য করেন।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে মধ্যে প্রচুর গরমিল রয়েছে। তাই এই গরমিল তথ্যে ওপর ভিত্তি করে বাজেট নির্ধারণ করা হলে বাজেটও গরমিলে হবে। এই বাজেটে বৈষম্য আরও বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, যেই সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়Ñ ওই সমাজ আজ হোক, কাল হোক টেকে না। ওই সমাজের পতন ঘটে। যেভাবে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে, এতে ৯ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টেকানো কঠিন হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই হয়েছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ওই বৈষম্য দেশে বাড়তে থাকলে কীভাবে আগামী দিনে ওই জায়গায় পৌঁছাবেন?

সপ্তম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা, নির্বাচনী ইশতেহার, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ও বর্তমান অর্থনৈতিক উত্তেজনাÑ এ চারটি বিষয় কেন্দ্র করে সিপিডির এই বাজেট পর্যালোচনা করা হয়। বৈশ্যিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাসের আইএমএফের আশঙ্কা উল্লেখ করে বলা হয়, বৈশ্যিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৮ সালে ৩.৬ ও ২০১৯ সালে কমেছে ৩.৩ শতাংশ। তেলের দাম কমছে। অপরদিকে সারের দাম বাড়ছে। এতে প্রভাবশালী মুদ্রা যেমন চীনের ইউয়ান, ভারতের রুপি, ভিয়েতনামের ডংয়ের দাম কমতে পারে। এসব পরিস্থিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়েও চরম শঙ্কা রয়েছে। শিক্ষা খাতে বাজেট মূলত বাড়েনি উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, এবার বলা হচ্ছে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃত এই খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। এর মূল কৌশল হিসেবে শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি খাত জুড়ে দেয়া হয়েছে। আর বাজেট মূলত বেড়েছে প্রযুক্তি খাতে। শতকরা হিসাবে মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ২ শতাংশ বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের জন্য। তা চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এমন বাড়তি বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হিসাব করলে দেখা যায়, এই খাতে বাজেট ধরা হয়েছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। তা জিডিপির মাত্র ২.১ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির ২.০৯ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল শিক্ষা খাতে। এদিক থেকে আগামী বছরের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে দশমিক ০১ (০.০১) শতাংশ। এই বিষয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিসাব টেনে তিনি বলেন, প্রকৃত শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়েনি। প্রযুক্তি খাতে বাজেট বাড়িয়ে এ দুটি খাতকে এক সঙ্গে দেখিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষা খাতে বাজেট বেড়েছে।

নারী ও শিশুদের বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি সাধুবাদ জানানো হয়েছে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, গত অর্থবছরে শিশুদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ৮০ হাজার ২০০ কোটি প্রস্তাব করা হয়েছে। তা জাতীয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এটি অবশ্যই ভালো দিক। কৃষি বাজেট প্রস্তাবে শস্য ঋণকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু যেসব কৃষক ধানের নায্যমূল্য না পেয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাদের জন্য নগদ প্রণোদনা দেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। সিপিডি কার্ডধারী প্রত্যেক কৃষককে ৫ হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেছে।

জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর সংগ্রহ করবে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তা মোট বাজেটের ৬২ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।

শনিবার, ১৫ জুন ২০১৯ , ১ আষাঢ় ১৪২৫, ১১ শাওয়াল ১৪৪০

প্রতিক্রিয়া

ধনীরা বেশি সুবিধা পাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত

ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ অপশাসন সমাধানের সুনির্দিষ্টি পরিকল্পনা নেই : সিপিডি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ পর্যালোচনা’ করে জানিয়েছে, এবারের বাজেটে ধনীরা বেশি সুবিধা পাবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সিপিডির মতে, দেশের ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন খাতে অপশাসন চলছে। এগুলো সমাধানে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রাখা হয়নি বাজেটে। তাই এসব অপশাসনে যারা সুবিধা ভোগ করেন, এবারের বাজেট তাদের পক্ষেই গেছে। গতকাল সকালে রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন এসব মন্তব্য করেন সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট উম্মে শেফা রেজবানা, মোস্তফা আমির সাব্বিহ, সারাহ সাবিন খানসহ অন্য কর্মকর্তারা। সিপিডির ফেলো বাজেট পর্যালোচনা করে বলেন, বাজেট অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে গেছে। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো বাজেটে তুলে ধরা হয়নি এবং সমাধানের আভাসও নেই। ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে বাজেটে আলোচনা আছে। কিন্তু কর্মপরিকল্পনা নেই। এই খাতের সমস্যাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বাজেটে। খাতওয়ারি বরাদ্দের দিক থেকে বাজেট ভারসাম্যহীন ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে স্বচ্ছল ও উচ্চবিত্তকে বেশি সুবিধা দেয়া হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের জন্য রয়েছে প্রান্তিক সুবিধা। তবে মধ্যবিত্তের জন্য খুব বেশি সুবিধা হবে না। সরকারি টাকায় অবকাঠামো নির্মাণ করে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা। এটা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি করছে। বাজেটে ধনীদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারচার্জের জন্য ধনীদের মোট সম্পদের সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা থাকলে সারচার্জ দিতে হতো। এবার তা ৭৫ লাখ বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ধনীদের করমুক্ত সম্পদের সীমা বাড়ছে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। অর্থাৎ যারা আয় করেন, তাদের জন্য সুবিধা বা প্রণোদনা দেয়া হয়নি। ধনীদের এই সুবিধা কেন দেয়া হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। এটি সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গেও মেলে না। অন্যদিকে যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, এর স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি। সংস্থাটি জানিয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থমন্ত্রণালয়Ñ এ দুটি সংস্থার কাছে দুই ধরনের তথ্য রয়েছে। এক সংস্থার তথ্যের সঙ্গে অন্য সংস্থার তথ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অপেক্ষাকৃত ভালো ফল দেখানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, আসলে কোন সংস্থার তথ্য সঠিক।

কিছু খাতের চলমান সমস্যার সমাধানে স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, বর্তমানে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিপূর্ণ খাত হলো ব্যাংক ও পুঁজিবাজার। কিন্তু এই খাতের চলমান সমস্যা সমধানের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এই সমস্যা সমাধান করতে গেলে অপশাসনের সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে যাবে। তাই যারা অপশাসনের সুবিধা ভোগ করছে, তারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, আগে শেয়ারবাজার থেকে প্রাপ্ত আয়ের করমুক্ত সীমা ছিল ২৫ হাজার টাকা। এবার তা করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্টক ডিভিডেন্ড কমিয়ে ক্যাশ (নগদ) ডিভিডেন্ড প্রদানে উৎসাহ দেয়া হয়েছে বাজেটে। স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলে এবার থেকে দিতে হবে ১৫ শতাংশ কর। কিন্তু ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত বা যে প্রভাবশালী মহল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রাখা হয়নি।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে সম্পদ কর আইন কার্যকর নেই। সম্পদ করের পরিবর্তে ব্যক্তিশ্রেণির বিত্তশালী করদাতা প্রদেয় আয়করের একটি নির্দিষ্ট হারে সারচার্জ দিয়ে থাকেন। গত কয়েক বছর এ বিধানটি কার্যকর আছে। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, অনেক বিত্তশালী করদাতার বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। কিন্তু তারা তেমন কোন আয় প্রদর্শন করেন না। ফলে প্রদেয় আয়কর কম হওয়ায় তাদের তেমন সারচার্জও প্রদান করতে হয় না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ৫০ কোটি বা এর অধিক নেট সম্পদ রয়েছেÑ এমন করদাতাদের নেট সম্পদের ওপর দশমিক ১ শতাংশ অথবা প্রদেয় করের ৩০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি, ওই পরিমাণ সারচার্জ আরোপের প্রস্তাব করছি। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তা আগের বছর একই ছিল। কিন্তু বিভিন্ন ব্যবসায়িক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবি করা হয়েছিল। বাজেট আওয়ামী লীগের ইশতেহার অনুযায়ী হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বাজেট নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী হয়নি। তথ্য ও উপাত্তের গরমিল রয়ে গেছে। বর্তমানে অর্থনৈতিক যে চাপ চলছে, বাজেটে এর স্বীকৃতি নেই। বাজেট দেয়ার সময় যে অভিনব কায়দা ছিল, বাজেটের তথ্য-উপাত্তে তা পাওয়া যায়নি। উদাহরণ হিসেবে তিনি তথ্যের উৎস হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কথা উল্লেখ্য করেন।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে মধ্যে প্রচুর গরমিল রয়েছে। তাই এই গরমিল তথ্যে ওপর ভিত্তি করে বাজেট নির্ধারণ করা হলে বাজেটও গরমিলে হবে। এই বাজেটে বৈষম্য আরও বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, যেই সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়Ñ ওই সমাজ আজ হোক, কাল হোক টেকে না। ওই সমাজের পতন ঘটে। যেভাবে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে, এতে ৯ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টেকানো কঠিন হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই হয়েছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ওই বৈষম্য দেশে বাড়তে থাকলে কীভাবে আগামী দিনে ওই জায়গায় পৌঁছাবেন?

সপ্তম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা, নির্বাচনী ইশতেহার, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ও বর্তমান অর্থনৈতিক উত্তেজনাÑ এ চারটি বিষয় কেন্দ্র করে সিপিডির এই বাজেট পর্যালোচনা করা হয়। বৈশ্যিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাসের আইএমএফের আশঙ্কা উল্লেখ করে বলা হয়, বৈশ্যিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৮ সালে ৩.৬ ও ২০১৯ সালে কমেছে ৩.৩ শতাংশ। তেলের দাম কমছে। অপরদিকে সারের দাম বাড়ছে। এতে প্রভাবশালী মুদ্রা যেমন চীনের ইউয়ান, ভারতের রুপি, ভিয়েতনামের ডংয়ের দাম কমতে পারে। এসব পরিস্থিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়েও চরম শঙ্কা রয়েছে। শিক্ষা খাতে বাজেট মূলত বাড়েনি উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, এবার বলা হচ্ছে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃত এই খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। এর মূল কৌশল হিসেবে শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি খাত জুড়ে দেয়া হয়েছে। আর বাজেট মূলত বেড়েছে প্রযুক্তি খাতে। শতকরা হিসাবে মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ২ শতাংশ বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের জন্য। তা চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এমন বাড়তি বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হিসাব করলে দেখা যায়, এই খাতে বাজেট ধরা হয়েছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। তা জিডিপির মাত্র ২.১ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির ২.০৯ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল শিক্ষা খাতে। এদিক থেকে আগামী বছরের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে দশমিক ০১ (০.০১) শতাংশ। এই বিষয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিসাব টেনে তিনি বলেন, প্রকৃত শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়েনি। প্রযুক্তি খাতে বাজেট বাড়িয়ে এ দুটি খাতকে এক সঙ্গে দেখিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষা খাতে বাজেট বেড়েছে।

নারী ও শিশুদের বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি সাধুবাদ জানানো হয়েছে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, গত অর্থবছরে শিশুদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ৮০ হাজার ২০০ কোটি প্রস্তাব করা হয়েছে। তা জাতীয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এটি অবশ্যই ভালো দিক। কৃষি বাজেট প্রস্তাবে শস্য ঋণকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু যেসব কৃষক ধানের নায্যমূল্য না পেয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাদের জন্য নগদ প্রণোদনা দেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। সিপিডি কার্ডধারী প্রত্যেক কৃষককে ৫ হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেছে।

জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর সংগ্রহ করবে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তা মোট বাজেটের ৬২ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।