নববধূকে সাইফুলের দেয়া হলো না ঈদের শাড়ি

তৌফিকা আর তোবা ঈদ পোশাক নয় পেল বাবার লাশ

মাত্র ৩ মাস আগে নিজের পছন্দে পারিবারিকভাবে একই এলাকার তামান্নাকে বিয়ে করে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের পূর্বষাট্ট্রি গ্রামের মৃত সাদেক বেপারীর সেঝো ছেলে সাইফুল (২৮)। বিয়ের পর খুশিতেই চলছিল দিন। সামনে মাত্র কয়েকদিন পরে পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসব। ভালোবাসার স্ত্রী তামান্নাকে দিতে হবে ঈদের শাড়ি। বিয়ের পর প্রথম এই ঈদে স্ত্রীর জন্য একটু ভালো শাড়ি কোথা থেকে কিনবে তাই ভাবছিল সাইফুল।

এরই মাঝে সুযোগও চলে আসে। চার ভাই আজাদ, রিয়াজ, সাইফুল ও ফিরোজ স্থানীয় বাজারে বাবার নিজ হাতে গড়া গার্মেন্টস ব্যবসা করতো। সেই ব্যবসার সুবাদে দোকানের নতুন মালামাল ক্রয়ের জন্য রোববার দুই ভাই রিয়াজ (৩১) ও সাইফুল (২৮) মেহেন্দীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে মালামাল ক্রয় করে তারা। সেই সঙ্গে সাইফুল স্ত্রী তামান্নার জন্য নিজে পছন্দ করে ঈদের শাড়িও কিনে।

আর রিয়াজ দুই মেয়ে তৌফিকা ও তোবার জন্য কিনে পছন্দের পোশাক। সেই সঙ্গে দুই ভাই পরিবারের সবার জন্যই ঈদের কেনাকাটা করে। রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় রাতে তারা ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় থাকে। লকডাউনে লঞ্চ ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা সেই বাসা থেকে সোমবার ভোর ৪টার দিক মেহেন্দীগঞ্জের উদ্দেশে সদরঘাট থেকে ট্রলারে চড়ে রওনা দেয়। কিছুদূর আসার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে নৌপুলিশ ট্রলারের সব যাত্রীদের পাড়ে নামিয়ে দেয়।

এরপর তারা বাড়ি যাওয়ার রুট পরিবর্তন করে হালকা যানবাহনে চড়ে মুন্সীগঞ্জের শিমুলীয়া ঘাটে আসে। সেখান থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে আসতে অন্য প্রায় ৩১ যাত্রীদের সঙ্গে তারা একটি স্পিডবোটে চড়ে। স্পিডবোটটি কাঁঠালবাড়ী (পুরাতন) ঘাটের কাছাকাছি এলে নদীর পাড়ে নোঙ্গর করে রাখা একটি বাল্কহেডের (বালু টানার কার্গো) সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে স্পিডবোটটি দুমড়ে মুচড়ে যায়।

এতে ২৬ যাত্রী নিহত হয়। নিহত যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে আপন দুই ভাই সাইফুল ও রিয়াজের মৃতদেহ। সাইফুলের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল নববধূ তামান্নার জীবনের সবকিছু। আর রিয়াজের ছোট দুটি মেয়ে তৌফিকা ও তোবা সারাদিন ঈদের নতুন পোশাকের আশায় থেকে রাতে পেল বাবার লাশ। দুর্ঘটনায় সব যাত্রী মাথায় বুকে গুরুতর আঘাত পেয়ে পদ্মায় পড়ে নিখোঁজ হয়।

৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা পাড়ে তুলতে সামর্থ্য হয়। খবর পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই নৌপুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। পরে সেনাবাহিনী সদস্য, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করে। দুপুরের মধ্যেই উদ্ধার কর্মীরা শিশুসহ ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত লাশগুলো শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের দোতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে রাখা হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও নাম পরিচয় থেকে স্বজনরা দুই ভাইয়ের লাশ শনাক্তে বিকেলে বড় ভাই আজাদ, কাকা ফয়সালসহ স্বজনরা শিবচরের কাঁঠালবাড়ির দোতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে পৌঁছান। এ সময় রক্তের ছোট দুই ভাইয়ের মৃতদেহ দেখে বড় ভাই আজাদসহ স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। গভীর রাতে গাড়িতে দুই ভাইয়ের লাশ তুলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন আজাদ।

আজাদ বেপারি বলেন, আমরা চারটি ভাই ছিলাম। বাবার মৃত্যুর পর ছোট তিন ভাইকে আমি দেখে রেখেছি। ওরা আজ পর্যন্ত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলেনি। এতটাই সম্মান করতো আমায়। সবাই বিয়ে করলেও আজো একই সংসারে বসবাস করি আমরা। ওরা ঢাকায় গিয়েছিল দোকানের মালামাল কিনতে।

সেই সঙ্গে সাইফুলের নতুন বউয়ের জন্য শাড়ি, রিয়াজের দুই মেয়ের জন্য ড্রেসসহ পরিবারের সকলের জন্যই ঈদের কেনাকাটা করে ফিরছিল। স্পিডবোট দুর্ঘটনায় আমার কলিজার দুই ভাইকে কেড়ে নিলো।

মৃত সাইফুলের কাকা ফয়সাল বলেন, ফেইসবুকে এলাকার একজন সাইফুল ও রিয়াজের ছবি ও নাম পরিচয় দেখে আমাকে ফোন দিয়ে জানায়।

প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি পরে নিজ চোখে ছবি দেখে নিশ্চিত হই। পরে এখানে এসে লাশ শনাক্ত করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। স্পিডবোটের চালক নেশাগ্রস্থ হয়ে ছিল বলে শুনেছি। আর লকডাউনের মধ্যে স্পিডবোট বন্ধ রাখার কথা থাকলেও প্রশাসনের সামনে কিভাবে স্পিডবোট চলে তা বুঝি না। স্পিডবোট বন্ধ থাকলে হয়তো এমন হতো না।

শিবচর থানার ওসি মিরাজ হোসেন বলেন, নিহত ২৬ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতের মধ্যে একাধিক পরিবারের একাধিক সদস্যর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।

বুধবার, ০৫ মে ২০২১ , ২৩ বৈশাখ ১৪২৮ ২৩ রমজান ১৪৪২

নববধূকে সাইফুলের দেয়া হলো না ঈদের শাড়ি

তৌফিকা আর তোবা ঈদ পোশাক নয় পেল বাবার লাশ

শিব শংকর রবিদাস, শিবচর (মাদারীপুর)

মাত্র ৩ মাস আগে নিজের পছন্দে পারিবারিকভাবে একই এলাকার তামান্নাকে বিয়ে করে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের পূর্বষাট্ট্রি গ্রামের মৃত সাদেক বেপারীর সেঝো ছেলে সাইফুল (২৮)। বিয়ের পর খুশিতেই চলছিল দিন। সামনে মাত্র কয়েকদিন পরে পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসব। ভালোবাসার স্ত্রী তামান্নাকে দিতে হবে ঈদের শাড়ি। বিয়ের পর প্রথম এই ঈদে স্ত্রীর জন্য একটু ভালো শাড়ি কোথা থেকে কিনবে তাই ভাবছিল সাইফুল।

এরই মাঝে সুযোগও চলে আসে। চার ভাই আজাদ, রিয়াজ, সাইফুল ও ফিরোজ স্থানীয় বাজারে বাবার নিজ হাতে গড়া গার্মেন্টস ব্যবসা করতো। সেই ব্যবসার সুবাদে দোকানের নতুন মালামাল ক্রয়ের জন্য রোববার দুই ভাই রিয়াজ (৩১) ও সাইফুল (২৮) মেহেন্দীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে মালামাল ক্রয় করে তারা। সেই সঙ্গে সাইফুল স্ত্রী তামান্নার জন্য নিজে পছন্দ করে ঈদের শাড়িও কিনে।

আর রিয়াজ দুই মেয়ে তৌফিকা ও তোবার জন্য কিনে পছন্দের পোশাক। সেই সঙ্গে দুই ভাই পরিবারের সবার জন্যই ঈদের কেনাকাটা করে। রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় রাতে তারা ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় থাকে। লকডাউনে লঞ্চ ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা সেই বাসা থেকে সোমবার ভোর ৪টার দিক মেহেন্দীগঞ্জের উদ্দেশে সদরঘাট থেকে ট্রলারে চড়ে রওনা দেয়। কিছুদূর আসার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে নৌপুলিশ ট্রলারের সব যাত্রীদের পাড়ে নামিয়ে দেয়।

এরপর তারা বাড়ি যাওয়ার রুট পরিবর্তন করে হালকা যানবাহনে চড়ে মুন্সীগঞ্জের শিমুলীয়া ঘাটে আসে। সেখান থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে আসতে অন্য প্রায় ৩১ যাত্রীদের সঙ্গে তারা একটি স্পিডবোটে চড়ে। স্পিডবোটটি কাঁঠালবাড়ী (পুরাতন) ঘাটের কাছাকাছি এলে নদীর পাড়ে নোঙ্গর করে রাখা একটি বাল্কহেডের (বালু টানার কার্গো) সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে স্পিডবোটটি দুমড়ে মুচড়ে যায়।

এতে ২৬ যাত্রী নিহত হয়। নিহত যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে আপন দুই ভাই সাইফুল ও রিয়াজের মৃতদেহ। সাইফুলের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল নববধূ তামান্নার জীবনের সবকিছু। আর রিয়াজের ছোট দুটি মেয়ে তৌফিকা ও তোবা সারাদিন ঈদের নতুন পোশাকের আশায় থেকে রাতে পেল বাবার লাশ। দুর্ঘটনায় সব যাত্রী মাথায় বুকে গুরুতর আঘাত পেয়ে পদ্মায় পড়ে নিখোঁজ হয়।

৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা পাড়ে তুলতে সামর্থ্য হয়। খবর পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই নৌপুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। পরে সেনাবাহিনী সদস্য, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করে। দুপুরের মধ্যেই উদ্ধার কর্মীরা শিশুসহ ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত লাশগুলো শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের দোতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে রাখা হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও নাম পরিচয় থেকে স্বজনরা দুই ভাইয়ের লাশ শনাক্তে বিকেলে বড় ভাই আজাদ, কাকা ফয়সালসহ স্বজনরা শিবচরের কাঁঠালবাড়ির দোতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে পৌঁছান। এ সময় রক্তের ছোট দুই ভাইয়ের মৃতদেহ দেখে বড় ভাই আজাদসহ স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। গভীর রাতে গাড়িতে দুই ভাইয়ের লাশ তুলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন আজাদ।

আজাদ বেপারি বলেন, আমরা চারটি ভাই ছিলাম। বাবার মৃত্যুর পর ছোট তিন ভাইকে আমি দেখে রেখেছি। ওরা আজ পর্যন্ত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলেনি। এতটাই সম্মান করতো আমায়। সবাই বিয়ে করলেও আজো একই সংসারে বসবাস করি আমরা। ওরা ঢাকায় গিয়েছিল দোকানের মালামাল কিনতে।

সেই সঙ্গে সাইফুলের নতুন বউয়ের জন্য শাড়ি, রিয়াজের দুই মেয়ের জন্য ড্রেসসহ পরিবারের সকলের জন্যই ঈদের কেনাকাটা করে ফিরছিল। স্পিডবোট দুর্ঘটনায় আমার কলিজার দুই ভাইকে কেড়ে নিলো।

মৃত সাইফুলের কাকা ফয়সাল বলেন, ফেইসবুকে এলাকার একজন সাইফুল ও রিয়াজের ছবি ও নাম পরিচয় দেখে আমাকে ফোন দিয়ে জানায়।

প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি পরে নিজ চোখে ছবি দেখে নিশ্চিত হই। পরে এখানে এসে লাশ শনাক্ত করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। স্পিডবোটের চালক নেশাগ্রস্থ হয়ে ছিল বলে শুনেছি। আর লকডাউনের মধ্যে স্পিডবোট বন্ধ রাখার কথা থাকলেও প্রশাসনের সামনে কিভাবে স্পিডবোট চলে তা বুঝি না। স্পিডবোট বন্ধ থাকলে হয়তো এমন হতো না।

শিবচর থানার ওসি মিরাজ হোসেন বলেন, নিহত ২৬ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতের মধ্যে একাধিক পরিবারের একাধিক সদস্যর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।