তদন্ত চলছে, ট্র্যাজেডির মূলহোতা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে

স্পিডবোট দুর্ঘটনায় শিবচরের কাঁঠালবাড়ীতে দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় গতকাল মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটির দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে। এর আগে ঘটনার দিনও তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সাক্ষ্য প্রদানকারীদের অনেকেই অভিযোগ করেন দুর্ঘটনা পাড়ে তদন্ত কার্যক্রম জোরালোভাবে চললেও ঘটনার সূত্রপাত অর্থাৎ শিমুলিয়া পাড়ে তেমন কোন কার্যক্রম নেই।

তদন্ত কমিটির প্রধানও এ ব্যাপারে সীমানা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন। এই ট্র্যাজেডির মূল হোতা, প্রশ্রয়দাতা, দায়িত্বে অবহেলাকারীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকার শঙ্কা রয়েছে। সাক্ষ্য প্রদানকারীদের অভিযোগ শিমুলিয়া পাড়ে আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন খানের মদদেই এসব স্পিডবোটগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদিকে মামলার আসামিরা এখনো রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

সরেজমিনে একাধিক সূত্রে জানা যায়, শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটির দল গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রথম তারা দুর্ঘটনা কবলিত স্থান ঘুরে দেখেন। পরে কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদে প্রত্যক্ষদর্শী, ঘাট কর্তৃপক্ষ, উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া বিভিন্ন দপ্তরের কর্মরতদের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার মাদারীপুরের উপ-পরিচালক আজহারুল ইসলাম, শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান, শিবচর থানার ওসি (তদন্ত) মো. আমির হোসেন সেরনিয়াবাত, কাঁঠালবাড়ী নৌপুলিশ ফাঁড়ির ওসি আবদুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড নারায়ণগঞ্জের স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট আসমাদুল ইসলাম।

তদন্তকারী দলটি মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত হওয়ায় সীমানা সংক্রান্ত কারণে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়ায় কাজ করতে পারবে না বলে জানায়। এতে কাদের মদদে শিমুলিয়া ঘাটের নির্ধারিত পন্টুন থেকে স্পিডবোটটি ৩১ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে এলো, ঘাটে কর্তবরত নৌ-পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ’র ভূমিকা কী ছিল তা তদন্তে বের হয়ে আসা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

লকডাউনের মধ্যেই ওই ভোরে যাত্রীদের জড়ো করায় কাউন্টার বা সিরিয়াল ম্যান কারা ছিল, দেড়শ টাকার ভাড়া ৩শ’ টাকা আদায় করল কারা তাও কিভাবে, বাড়তি টাকা পৌঁছাবে কোথায় কোথায় তার উৎসর সন্ধান কিভাবে তদন্ত দলের হাতে আসবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় শিমুলিয়া পাড়ের ইজারাদার শাহ আলম খান (আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন খানের নিকটাত্মীয়), স্পিডবোট মালিক চান্দু মোল্লা, রেজাউল মিয়া ও চালক শাহ আলম ও কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নৌ-পুলিশ শিবচর থানায় মামলা করলেও এখনও আসামিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

স্পিডবোট ও ঘাট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া পাড়ের স্পিডবোটসহ ঘাট সংলগ্ন এলাকার একচ্ছত্র আধিপত্য আওয়ামী লীগ নেতা লৌহজংয়ের মেদেনীমন্ডল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আশরাফ আলী খানের। আর বাংলাবাজার স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি পাচ্চর ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হাওলাদার। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আশরাফ আলী খানের বিশ^স্ত লোকেরা ২ ভাগ হয়ে এক দিন পর পর শিমুলিয়ায় স্পিডবোটের কাউন্টার নিয়ন্ত্রণ করে। লকডাউনের মাঝেও প্রকাশ্যেই চলেছে স্পিডবোট চলাচল। এক একটি স্পিডবোট ৪০ সিসি থেকে ২শ’ সিসি পর্যন্ত রয়েছে।

সঙ্গে লকডাউনে যোগ হয়েছে অবৈধ ট্রলার পারাপার। সন্ধ্যার পর নিষেধ থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত চলে স্পিডবোট। স্পিডবোট ঘাটে আশরাফ খানের নিকটাত্মীয় ডিজিটাল মাতিম ও ওয়াহিদ দুই ভাগ হয়ে একদিন পর পর কাউন্টার বা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তার ভাইয়ের নামে ইজারা এ ঘাটের। দুর্ঘটনাকবলিত স্পিডবোটেও যাত্রী প্রতি টিকিট দিয়ে ৩শ’ টাকা আদায় করা হয় বলে তদন্ত দল নিশ্চিত হয়েছে। অথচ প্রশাসন নির্ধারিত ভাড়া ১শ’ ৫০ টাকা। প্রায় ২শ’ স্পিডবোট চললেও কোনটিরই নেই কোন বৈধ কাগজ বা রুট পারমিট। চালকদেরও নেই কোন প্রশিক্ষণ। ওস্তাদ ধরে তারা স্পিডবোট চালানো শিখে থাকে। তাই প্রতিবছরই দুর্ঘটনায় নিহত হয় বহু মানুষ। এরপরও অবাধে চলে দ্রুতগতির এ নৌযান।

স্পিডবোট চালক সোনা মিয়া বলেন, লকডাউনে বাংলাবাজার ঘাটে যত কড়াকড়ি শিমুলিয়ায় তা না। ওখানে আশরাফ খানই সব। তার লোকজন বসা থাকে পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ’র সামনেই যাত্রী উঠায়। যাত্রীপ্রতি ৩শ’ টাকা সাড়ে ৩শ’ টাকা ভাড়া নিলেও আমাগো বোট নির্ধারিত ভাড়া যাত্রীপ্রতি ১শ’ টাকা করেই দেয়।

আরেক চালক কুটি মিয়া বলেন, ওই পাড়ে কারও কোন মাদবরি নাই আশরাফ খানই সব। দেখেন না যত ঝামেলা এই পাড়ে হইতাছে। ওই পাড়ে সে সব টাকা দিয়া ম্যানেজ করব। তার বাহিনীও অনেক বড়। কারও কোন কথা কওয়ার সাহস নাই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সৈয়দ বেপারি বলেন, লকডাউনে ২৬ জন মানুষ মারা গেল অথচ এখনও কোন আসামি ধরা হলো না। এরমধ্যেই নিশ্চয়ই কোন কিছু আছে। আসামি ধরা পড়লে অনেকে ফেঁসে যেতে পারেন।

সাক্ষ্য দিতে আসা বাংলাবাজার স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার হাওলাদার বলেন, লকডাউনের পর থেকে এ পর্যন্ত একটি স্পিডবোটও বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছাড়েনি। আমাদের এই পাড়ে দুর্ঘটনা হলেও যাত্রীরা কিভাবে ওই পাড়ে পন্টুন থেকে উঠতে পারল। নৌ-পুলিশ বা বিআইডব্লিউটিএ কি করছিল। তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ফলে মূল দোষীরা পার পেয়ে যেতে পারে। ওই ঘাটের সব নিয়ন্ত্রণ আশরাফ খান করে। পরিস্থিতি উন্নয়নে আমি তাকে বারবার অনুরোধ করেও তার কোন সাড়া পাইনি।

বাংলাবাজার নৌ-ফাঁড়ির ওসি আ. রাজ্জাক বলেন, আসামিদের ঠিকানা বের করতেই সময় বেশি চলে গেছে। গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান স্থানীয় সরকার মাদারীপুরের উপ-পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, সীমানা সংক্রান্ত কারণে আমাদের ওপাড়ে তদন্ত করার সুযোগ নেই। মন্ত্রণায়ল থেকে তদন্ত কমিটি করে থাকলে তারা সেটা করে থাকবে। তদন্তে আমরা পেয়েছি শিমুলিয়ায় দুর্ঘটনাকবলিত স্পিডবোটটি পন্টুন থেকে টিকেট দিয়ে যাত্রীপ্রতি ৩শ’ টাকা ভাড়া দিয়ে রওনা করেছিল। স্পিডবোট চলাচলে সিন্ডিকেটের তথ্যও আমাদের হাতে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে আমরা বের করতে কাজ করছি। যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি তা বিশ্লেষণ করে আমরা এর কারণ বের করব। পাশাপাশি এমন নৌ-দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য স্পিডবোট রেজিস্ট্রেশন এবং চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স ছাড়া কোন চালক যাতে এখানে না থাকে সেই ব্যাপারে আমাদের কিছু সুপারিশ থাকবে।’

এ ব্যাপাওে আওয়ামী লীগ নেতা লৌহজংয়ের মেদেনীমন্ডল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আশরাফ আলী খানের মোবাইল নাম্বারে (০১৮১৫৭৫৭৪০৪) বারবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

উল্লেখ্য, সোমবার ভোরে ঘাটে নোঙর করে রাখা বালুবোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে শিমুলিয়া থেকে আসা একটি দ্রুতগতির স্পিডবোটের ধাক্কা লাগলে ঘটনাস্থলেই ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল জেলা প্রশাসনের ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১ , ২৪ বৈশাখ ১৪২৮ ২৪ রমজান ১৪৪২

শিবচরে স্পিডবোট দুর্ঘটনা

তদন্ত চলছে, ট্র্যাজেডির মূলহোতা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে

শিব শংকর রবিদাস, শিবচর (মাদারীপুর)

স্পিডবোট দুর্ঘটনায় শিবচরের কাঁঠালবাড়ীতে দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় গতকাল মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটির দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে। এর আগে ঘটনার দিনও তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সাক্ষ্য প্রদানকারীদের অনেকেই অভিযোগ করেন দুর্ঘটনা পাড়ে তদন্ত কার্যক্রম জোরালোভাবে চললেও ঘটনার সূত্রপাত অর্থাৎ শিমুলিয়া পাড়ে তেমন কোন কার্যক্রম নেই।

তদন্ত কমিটির প্রধানও এ ব্যাপারে সীমানা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন। এই ট্র্যাজেডির মূল হোতা, প্রশ্রয়দাতা, দায়িত্বে অবহেলাকারীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকার শঙ্কা রয়েছে। সাক্ষ্য প্রদানকারীদের অভিযোগ শিমুলিয়া পাড়ে আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন খানের মদদেই এসব স্পিডবোটগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদিকে মামলার আসামিরা এখনো রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

সরেজমিনে একাধিক সূত্রে জানা যায়, শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটির দল গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রথম তারা দুর্ঘটনা কবলিত স্থান ঘুরে দেখেন। পরে কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদে প্রত্যক্ষদর্শী, ঘাট কর্তৃপক্ষ, উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া বিভিন্ন দপ্তরের কর্মরতদের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার মাদারীপুরের উপ-পরিচালক আজহারুল ইসলাম, শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান, শিবচর থানার ওসি (তদন্ত) মো. আমির হোসেন সেরনিয়াবাত, কাঁঠালবাড়ী নৌপুলিশ ফাঁড়ির ওসি আবদুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড নারায়ণগঞ্জের স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট আসমাদুল ইসলাম।

তদন্তকারী দলটি মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত হওয়ায় সীমানা সংক্রান্ত কারণে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়ায় কাজ করতে পারবে না বলে জানায়। এতে কাদের মদদে শিমুলিয়া ঘাটের নির্ধারিত পন্টুন থেকে স্পিডবোটটি ৩১ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে এলো, ঘাটে কর্তবরত নৌ-পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ’র ভূমিকা কী ছিল তা তদন্তে বের হয়ে আসা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

লকডাউনের মধ্যেই ওই ভোরে যাত্রীদের জড়ো করায় কাউন্টার বা সিরিয়াল ম্যান কারা ছিল, দেড়শ টাকার ভাড়া ৩শ’ টাকা আদায় করল কারা তাও কিভাবে, বাড়তি টাকা পৌঁছাবে কোথায় কোথায় তার উৎসর সন্ধান কিভাবে তদন্ত দলের হাতে আসবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় শিমুলিয়া পাড়ের ইজারাদার শাহ আলম খান (আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন খানের নিকটাত্মীয়), স্পিডবোট মালিক চান্দু মোল্লা, রেজাউল মিয়া ও চালক শাহ আলম ও কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নৌ-পুলিশ শিবচর থানায় মামলা করলেও এখনও আসামিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

স্পিডবোট ও ঘাট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া পাড়ের স্পিডবোটসহ ঘাট সংলগ্ন এলাকার একচ্ছত্র আধিপত্য আওয়ামী লীগ নেতা লৌহজংয়ের মেদেনীমন্ডল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আশরাফ আলী খানের। আর বাংলাবাজার স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি পাচ্চর ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হাওলাদার। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আশরাফ আলী খানের বিশ^স্ত লোকেরা ২ ভাগ হয়ে এক দিন পর পর শিমুলিয়ায় স্পিডবোটের কাউন্টার নিয়ন্ত্রণ করে। লকডাউনের মাঝেও প্রকাশ্যেই চলেছে স্পিডবোট চলাচল। এক একটি স্পিডবোট ৪০ সিসি থেকে ২শ’ সিসি পর্যন্ত রয়েছে।

সঙ্গে লকডাউনে যোগ হয়েছে অবৈধ ট্রলার পারাপার। সন্ধ্যার পর নিষেধ থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত চলে স্পিডবোট। স্পিডবোট ঘাটে আশরাফ খানের নিকটাত্মীয় ডিজিটাল মাতিম ও ওয়াহিদ দুই ভাগ হয়ে একদিন পর পর কাউন্টার বা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তার ভাইয়ের নামে ইজারা এ ঘাটের। দুর্ঘটনাকবলিত স্পিডবোটেও যাত্রী প্রতি টিকিট দিয়ে ৩শ’ টাকা আদায় করা হয় বলে তদন্ত দল নিশ্চিত হয়েছে। অথচ প্রশাসন নির্ধারিত ভাড়া ১শ’ ৫০ টাকা। প্রায় ২শ’ স্পিডবোট চললেও কোনটিরই নেই কোন বৈধ কাগজ বা রুট পারমিট। চালকদেরও নেই কোন প্রশিক্ষণ। ওস্তাদ ধরে তারা স্পিডবোট চালানো শিখে থাকে। তাই প্রতিবছরই দুর্ঘটনায় নিহত হয় বহু মানুষ। এরপরও অবাধে চলে দ্রুতগতির এ নৌযান।

স্পিডবোট চালক সোনা মিয়া বলেন, লকডাউনে বাংলাবাজার ঘাটে যত কড়াকড়ি শিমুলিয়ায় তা না। ওখানে আশরাফ খানই সব। তার লোকজন বসা থাকে পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ’র সামনেই যাত্রী উঠায়। যাত্রীপ্রতি ৩শ’ টাকা সাড়ে ৩শ’ টাকা ভাড়া নিলেও আমাগো বোট নির্ধারিত ভাড়া যাত্রীপ্রতি ১শ’ টাকা করেই দেয়।

আরেক চালক কুটি মিয়া বলেন, ওই পাড়ে কারও কোন মাদবরি নাই আশরাফ খানই সব। দেখেন না যত ঝামেলা এই পাড়ে হইতাছে। ওই পাড়ে সে সব টাকা দিয়া ম্যানেজ করব। তার বাহিনীও অনেক বড়। কারও কোন কথা কওয়ার সাহস নাই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সৈয়দ বেপারি বলেন, লকডাউনে ২৬ জন মানুষ মারা গেল অথচ এখনও কোন আসামি ধরা হলো না। এরমধ্যেই নিশ্চয়ই কোন কিছু আছে। আসামি ধরা পড়লে অনেকে ফেঁসে যেতে পারেন।

সাক্ষ্য দিতে আসা বাংলাবাজার স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার হাওলাদার বলেন, লকডাউনের পর থেকে এ পর্যন্ত একটি স্পিডবোটও বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছাড়েনি। আমাদের এই পাড়ে দুর্ঘটনা হলেও যাত্রীরা কিভাবে ওই পাড়ে পন্টুন থেকে উঠতে পারল। নৌ-পুলিশ বা বিআইডব্লিউটিএ কি করছিল। তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ফলে মূল দোষীরা পার পেয়ে যেতে পারে। ওই ঘাটের সব নিয়ন্ত্রণ আশরাফ খান করে। পরিস্থিতি উন্নয়নে আমি তাকে বারবার অনুরোধ করেও তার কোন সাড়া পাইনি।

বাংলাবাজার নৌ-ফাঁড়ির ওসি আ. রাজ্জাক বলেন, আসামিদের ঠিকানা বের করতেই সময় বেশি চলে গেছে। গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান স্থানীয় সরকার মাদারীপুরের উপ-পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, সীমানা সংক্রান্ত কারণে আমাদের ওপাড়ে তদন্ত করার সুযোগ নেই। মন্ত্রণায়ল থেকে তদন্ত কমিটি করে থাকলে তারা সেটা করে থাকবে। তদন্তে আমরা পেয়েছি শিমুলিয়ায় দুর্ঘটনাকবলিত স্পিডবোটটি পন্টুন থেকে টিকেট দিয়ে যাত্রীপ্রতি ৩শ’ টাকা ভাড়া দিয়ে রওনা করেছিল। স্পিডবোট চলাচলে সিন্ডিকেটের তথ্যও আমাদের হাতে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে আমরা বের করতে কাজ করছি। যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি তা বিশ্লেষণ করে আমরা এর কারণ বের করব। পাশাপাশি এমন নৌ-দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য স্পিডবোট রেজিস্ট্রেশন এবং চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স ছাড়া কোন চালক যাতে এখানে না থাকে সেই ব্যাপারে আমাদের কিছু সুপারিশ থাকবে।’

এ ব্যাপাওে আওয়ামী লীগ নেতা লৌহজংয়ের মেদেনীমন্ডল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আশরাফ আলী খানের মোবাইল নাম্বারে (০১৮১৫৭৫৭৪০৪) বারবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

উল্লেখ্য, সোমবার ভোরে ঘাটে নোঙর করে রাখা বালুবোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে শিমুলিয়া থেকে আসা একটি দ্রুতগতির স্পিডবোটের ধাক্কা লাগলে ঘটনাস্থলেই ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল জেলা প্রশাসনের ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।