মরণোত্তর মৃত্যুদিবস ও নৌকাকাণ্ড : ৩

মামুন হুসাইন

মোমেনা খাতুন রাস্তা জুড়ে অদৃশ্য সাপের দুধ ভাবতে চায় না; খোলা আকাশ জুড়ে গাঁয়ের ছায়ামূর্তিদের সংকট দেখে, মধুক্ষরণ কথা শোনে- মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে এবং ভৌতিক বৃক্ষরাজিকে সাক্ষী মেনে অবিরাম ছুটতে থাকে, অথবা কখনো কেবলই বৃক্ষশাখার দিকে চেয়ে থাকে এবং আত্মবিস্মৃত হয়... আমাদের কদাচিৎ বসন্তদিন আসে!

আমাদের কণ্ঠস্বর, হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কে সদা মেঘের ঘনঘটা হয়। মোমেনা খাতুন হয় অচেনা, ক্ষুদ্র ও সুপ্রাচীন এক স্মৃতিচিহ্ন- সকাল-সন্ধ্যায় সে পৌরসভার গার্বেজ ভ্যান দেখে, আগুন রঙের শাড়ি সামলায়, মৃত্যু তিথি দেখে এবং বিপুল ভাগ্যদোষে খুঁজে বেড়ায় নিত্যকাল, কালস্রোত এবং বেলা-অবেলা-কালবেলা! নৌকা সম্পর্কিত লেখক নজিবর রহমান, একদিন দিগন্তব্যাপী এই নীরবতার কালে কঠোর কৃপা বর্ষণ করে এবং কিয়ৎকাল তার অন্নচিন্তা দূর করে। মোমেনা খাতুন ভরা সংসারে ঘুমায়, বেঞ্চের ধারে দাঁড়ায়, পা-ুলিপির ময়লা ঘষে, মূক হয়, বধির হয়, প্রহর গণনাকারী হয় এবং সকল নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে মরণের সুগন্ধ আঁচ করে। মোমেনা খাতুন এক ফাঁকে নগরের আত্মক্ষয়ী নৃত্যকলা দেখে, নজিবর-দম্পতির বিবিধ দৃশ্যের সাক্ষী হয়, ভিজে গামছা মেলে দেয়, জানালা দিয়ে দি গ্রেট সাইকেল স্টোর্স দেখে, গুয়ে মাখামাখি সারিবদ্ধ খবরের কাগজ দেখে আর অচনো হতে হতে ভাবে- ভেজা ঘাস-কুয়াশা-পাড় ভাঙা নদীর জীবন আর কোনদিন স্পর্শ করার সুযোগ তার হবে না। বহুপূর্বে শোকে মুহ্যমান হয়েছিল, এমন কয়েকজনের নাম স্মরণ হচ্ছে- নিজের মৃত্যুদণ্ডের নিচে দাঁড়িয়ে শস্যহীন মাঠে তারা কাবাডি খেলেছিল। মোমেনা খাতুন একটি পাথরের ঘরে একলা বসে শালিক পাখি দেখে এবং ঘাসফুল বৃদ্ধির দীর্ঘায়িত ক্রন্দন শোনে। শালিক পাখির সঙ্গে তার বাক্যালাপ হয়, হয় না। একপ্রকার শূন্যতা ভীষণমূর্ত হয়ে, দ্যুতিচিহ্ন হয়ে তাকে অতিধীরে অজস্র অসুন্দর কথা বলে; মোমেনা খাতুন, রূপান্তরিত নীরবতার রাজ্যে গৃহস্থের গোচরে এবং অগোচরে, কোনো এক মধ্যাহ্নে সবুজ-উজ্জল-মুখর পাতাসমূহ মাড়িয়ে, অবশেষে নতমস্তকে জনৈক সুলতান আহমেদের সান্ন্যিধ্যে উচ্চতর গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে নাম অর্ন্তভুক্ত করে।

গার্মেন্টসের ক্ষমাহীন বারান্দায়, ঘরে এবং সুবৃহৎ ফ্লোরে কোমর, পুট, কলারের মাথা ও কলারের উচ্চতা রপ্ত করে মোমেনা খাতুন। মোমেনা খাতুন চিনতে শেখে- হেলপার, লাইন চিফ, লাইন সুপার ভাইজার ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলার। মোমেনা খাতুনের হস্তাক্ষর সুন্দর এই অজুহাতে তাকে রিপোর্ট কপি করার নির্দেশ দেয় কোয়ালিটি কন্ট্রোলার; মোমেনা খাতুন লিখতে শুরু করে : অদ্য ০১/০৩/২০১৯ ইং তারিখে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে তাহার বিবরণ নিম্নে দেওয়া হইল :

প্রত্যেক লাইনের পকেটের প্লেট ছোট বড় হইতেছে এবং প্রত্যেক লাইনের পকেট আপডাউন হইতেছে। লাইন চিপকে বলা সত্ত্বেও তাহারা কোনো কর্ণপাত করিতেছেন না। মাঝে মাঝে বাটনের সেলাই এক পাশের্^ পড়ে না। ফ্রন্ট ইয়োকের সেলাই ঠিক হইতাছে না। পকেটের সেলাই বেশিরভাগ অল্টার হইতেছে। ফিনিশিং সেকশন এ দেখা যাইতেছে যে ময়লা ও সুতাসহ মাল পলিব্যাগ হইতাছে। তাই ভবিষ্যতে এইভাবে ময়লা ও সুতাসহ মাল যাহাতে আর পলি না হয় তাহার ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি একান্ত কাম্য।...

পুনশ্চ : অদ্য ০৫/০৩/২০১৯ ইং তারিখে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়াছে তাহার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল :

বিগত ০১/০৩/২০১৯ ইং তারিখে আমি কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে জয়েন করার পর থেকে লাইনে যে সমস্ত কাজকর্ম হইতেছে তা থেকে দেখা যায় ৩০% সাট স্পট হইতেছে। এর একমাত্র কারণ প্রতিদিন লাইনে টিফিন খাওয়ার সময় খাদ্য থেকে যায়। এইভাবে যদি সাট গুলি স্পট হয় তাহা হইলে শিপম্যান দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে। কাজেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নিবেদক : কোয়ালিটি কন্ট্রোলার।

মোমেনা খাতুন এইভাবে কখনো লেখক হয়, কখনো চকবাটন-এর বৈশিষ্ট্য শেখে, কখনো অবসন্ন হয়, উন্মত্ত হয় এবং স্মৃতির আকাশ ভাঙা রূপ পর্যবেক্ষণে অন্ধকারে সহসা কান্না করে। আর অজানা এক গভীর শ^াস গোপনে অঙ্কুরিত হয় এবং সঞ্চারিত হয় অন্তরীক্ষে ও সুবৃহৎ জনপদে : অভাবদীর্ণ, নিস্তরঙ্গ একটি গ্রাম্য জীবন, একটি দুঃসময় অতর্কিতে আছড়ে পড়ে। ঘুমের কিনারা ঘেঁষে কেউ কথা বলে- দণ্ডিত অবস্থায় যা আপনার অভিজ্ঞতার অর্ন্তগত নয়, তা স্মৃতিধার্য হয় কিভাবে? পরমাশ্চর্য নিদ্রা আর পরমাশ্চর্য জাগরণের ভেতর কী সুন্দর দেখাচ্ছে মানুষটাকে। আমরা বুঝি আলোচনার সেই পুরনো অংশেই দাঁড়িয়ে আছি। আপনাকে কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক বোধ হচ্ছে। কখনও কি মনে হয়েছে আপনার আচরণ অনৈতিক? অটুট নিদ্রার ভেতর কেউ-কেউ প্রায়শ জগৎ-সংসার পরিভ্রমণ করে : কিছু বাক্যালাপ গহ্বরে পড়ে,

কিছু মৌন হয় এবং কিছু সুনিশ্চিত ভাবে হয় মারণাস্ত্র। নিশানায় কোনো ভুল ছিল না আমার! মোমেনা খাতুন ঘুমচোখে কুন্ঠিত হয় এবং শীতল হয়, ...সাজানো অক্ষর বানান করে : ডাব্লিউডাব্লিউসি; ...ওয়াকার্স ওয়েলফেয়ার কমিটির মিটিং। হাতে ডাব্লিউডাব্লিউসি-এর কাপড় বাঁধা। ...আমাদের ইনক্রিমিন্ট ৫%, অন্যদের ১০%; ...সভায় মৃদু তর্ক হয়; নারী-পুরুষ একই মান, একই বেতন এক সমান- এইরকম এক শ্লোগান লিখে কেউ সমুখে দাঁড়ায়। কাঠমিস্ত্রি ফজলে আলী টেবিল মেরামতের সময় রডের সাহায্যে টেবিলে আঘাত করে এবং সহসা শর্ট-সার্কিট হয়। শর্ট-সার্কিট অর্থ- আগুনে মৃত্যুবরণ ও প্রত্যেকটি নিহত পরিবারে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি।

...গত ৩০শে সেপ্টেম্বর, রিয়াজ গার্মেন্টস থেকে কাজ শেষে ফেরার কালে বরিশুর গ্রামের একটি ছাপড়া ঘরে রেহানা বেগমকে ধর্ষণ করা হয়। মামলা নং নারী নির্যাতন আইন ৪(গ) ধারা, ২(১০) ৯৩। ...শনিবার ৫ই আগস্ট লুসাকা গার্মেন্টসে আবার অগ্নিকাণ্ড; যে ৯ জন মারা গেছে তার মধ্যে পাঁচজন কিশোর এবং চারজন কিশোরী। পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে এসে মারা যায় অপর এক গার্মেন্টস শ্রমিক। এইসব উপহাস, পুরাতন ছবি ও বিশৃঙ্খলতার কথা ধূর্ত-উদার-ভদ্র মালিকপক্ষের কাছে নিবেদিত হলে পরদিন সকাল-দুপুর গার্মেন্টস প্রাঙ্গণে যুদ্ধ হয়, গুলি হয়, অগ্নিসংঘাত হয়, ধ্বস নামে এবং পোড়া-মানুষ ও ক্ষতবিক্ষত মানুষ জমায়েত হয়ে দীর্ঘ এক মরণলেখ তৈরি করে। আপনারা কি আমাদের কথা শুনবেন? আমরা ভারমুক্ত হতে চাই। মিরপুর-শেওড়াপাড়ার রাস্তা বন্ধ করার দায় শুধু আমাদের না- ১৭-১৮ বছরের সালমার অকাল মৃত্যু কেন হবে? ...এরা আমাদের ভাবে অসহায় মেয়ে মানুষ। আমরা তো ভালোভাবে ভালো পরিবেশে ভাড়া থাকতে পারি না। একটা গার্মেন্টস শ্রমিক যখন মা হয়, মাতৃত্বে যায়. তখন তার তিন মাসের ছুটি দরকার হয়। এরা সেই ছুটির পয়সাটা পর্যন্ত দেয় না, এবং সেই মায়েরাই রিজাইন মাসের বেতনটা ঠিকমতো পায় না। আমি অনেকদিন বিনা দোষে সুপারভাইজারের লাথি ও চড়-থাপ্পর খাইছি। এগুলো কি ঠিক? আমরা তো বাংলাদেশেরই মানুষ, আপনাদেরই ভাই বা বোন কেউ। আমাদের দাবিটা মানেন না কেন? ...৩০শে ডিসেম্বর সবার মতো নাইট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে সালমা। ২০০৬ সালের চালের সর্বনিম্ন দাম অনুযায়ী শ্রমিকেরা যদি ৫ মন চাল ন্যূনতম মজুরি হিসেবে দাবি করতো তাহলে টাকার অঙ্কে তা হতো ৪৬০০। তাহলে বর্তমান দাম অনুসারে, আপনারা কি আমাদের সঠিক বেতন-ভাতা দিয়েছেন? ...ওভারটাইম পাঁচ ঘণ্টা করলে টাকা দেয় ২ ঘণ্টার। একবার প্রতিবাদ করার কারণে এক শ্রমিকের চোখ তুইল্লা নিছিল মালিকরা। ...আজ কত বছর থেইক্যা আমরা কাম করি গার্মেন্টসে। মায়ে রান্নার কাম করে মেসে। আব্বা তরকারি বিক্রি করে। ভোর ৪টায় উঠি, রাত ৮টায় বাসায় আসি, রান্নাবান্না খাইতে খাইতে রাত ১২টা বাইজা যায়। বারোটা বাজে ঘুমাই আবার ভোর ৪টায় উঠি, দেখি চুলা খালি নাই। আমাগো বাড়িতে ১১টা ভাড়াটিয়া, তিনটা চুলা, লাইন ধইরা রান্না করতে হয়। আবার বাড়িওয়ালা অনেক সময় পানি আর ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ কইরা দেয়, বিল বেশি আসে বইলা। গোসল না কইরাও অনেক সময় দৌড় দেওন লাগে। যখন হেল্পার ছিলাম, তখন কার্ড নিয়ে গার্মেন্টস-এর বাথরুমে যাইতে হতো। কইতো, ৫ মিনিটের বেশি থাকতে পারবা না। অনেকে অসুস্থ হইলে ভাবত, বাথরুমে যাইয়া একটু জিরাইয়া আসি। কিন্তু পারত না। আবার অনেকে কাজ জইমা যাওয়ার ভয়ে বাথরুমে যায় না। কাজ জমলে বকা শুনতে হয়। এছাড়াও তো মেয়েদের অনেক সমস্যা থাকে। যদি কেউ বলে স্যার আমার সমস্যা, তখন বলে, কী সমস্য? তখন তো আর পুরুষরে বলা যায় না, কিসের সমস্য। তখন বলে প্যাট ব্যথা করে। কিসের প্যাট ব্যথা! প্যাট ব্যথা, চ্যাডের ব্যথা অফিসে চলে না। যাও কাজ কর গা। ...ছুটি চাইলে, ছুটি দেয় না। একবার আমাদের ফ্লোরে সবাই নাইট করার পরের দিন। আমি মেশিন চালাচ্ছি, আমার পাশে হেলপার, মেয়েটির নাম সফুরা। সে ফ্লোরে কাজ করছিল। কাজ করতে করতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, আমি খেয়াল করি নাই। হেলপার মেয়েটি যে ঘুমাচ্ছে, এটা পিএম স্যার দেখে ফেলে। তারপরই আমাকে আর সেই মেয়েকে খুব মারে বেত দিয়ে। আমি কেন দেখলাম না যে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, এইজন্য আমাকে মারল। আমার দুই হাতে কালশিটা পড়ে গেছিল। আমি ঘরে ফিরি। আমার সাথী ভাড়াটিয়া, ওর নাম জ্যোস্না- ঘর ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম। ছয়দিন খোঁজ নাই; বিছানাপত্র ডেকচি-পাতিল আছে... এইসব বিক্রি করলে কয় টাকা পাই? বাড়ি ভাড়ার কথা ভাবতে ভাবতে আবার ফ্যাক্টরিতে যাই। সেইদিন প্রবল শব্দ হয় হঠাৎ। সমস্ত ফ্লোরে ধোঁয়া এবং আগুন। সিঁড়ি খুঁজি। সিঁড়ি পাই না। কখন নিচে নামি জানি না। আবার আগুনে বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ জন মানুষ পুড়ে যায়। দেখি, অর্ধচেতন অবস্থায় নামার সময় শরীরের চামড়া ঘষে যেয়ে রক্ত ঝরছে কেবল। মনে হয় মৃত মানুষের শরীর ও শিপমেন্টের পোড়া কাপড় ওজনহীন ঝুলে আছে এবং অবশিষ্ট মানুষেরা মৃতবৎ শান্ত-শীতল ও সংকুচিত। আর চারপাশে কাপড় পোড়ার গন্ধ, মানুষেরা চামড়া-পোড়ার গন্ধ এবং মৃত-ক্ষ্যাপাটে-ভাসমান অগ্নিশুদ্ধি ও যজ্ঞকু-। নাইট করানোর পরদিন ছুটি দেয়ার নিয়ম থাকলেও আমরা পরদিন রাত ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করছি; গুছাইতে গুছাইতে ১২টা; এই রাত ১২টা বাজে, আমরা কেমনে যামু? তিনারা বলেন- মন চাইলে চাকরি করবা মন না চাইলে যাইবাগা। রাত হইবই, কাজ চলবই। ছেলেরা-মাস্তানরা রাস্তা আটকায়। কয়, বেতন পাইছস, টাকা দিয়া যা। পুলিশ আটকায়- এত রাতে কইত থ্যাকা আইছস? এমডিকে জানাইলাম আমাদের সমস্য। এমডি আমাকে জিজ্ঞাস করলো, আমি কোন সেকশানে কাজ করি। আমি কইলাম; পরের দিন সকালে ফ্যাক্টরিতে যাইয়া দেখি আমারে ঢুকতে দেয় না। বলে তোমার চাকরি নাই।

লোকেদের প্রতীতি হয়- সব মানুষ সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্বেচ্ছায় আগুনে এবং জলে ঝাঁপ দেয় না। অনেকেই বেঁচে থাকে। অদৃশ্য হয়ে বেঁচে থাকে এবং ক্রমেক্রমে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের পরিধি বিস্তৃত করে চূড়ান্ত বিনাশকালের জন্য অপেক্ষারত হয়। তারা খসে পড়া পালকের মতো ভাসে এবং দেওয়াল ধরে-ধরে নিজের ঘরে ফেরে, তারা অন্ধকারের পৃথক-পৃথক যূথবদ্ধ কুণ্ডলী এড়িয়ে উদ্বেগ সংবরণ করে এবং কোথাও ভগ্ন নৌকায় বসে থাকে অধোমুখে... যেন জল থেকে উঠে আসা এক অচিন নরমু- জলে ফিরে গেছে এইমাত্র।

হ্যাপি গার্মেন্টস-এর তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন, শিপমেন্টের পর সামান্য অবসর- এরকম কালে, যখন সে বসেছিল অধোমুখে, শুনতে পায় গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষিত হয়েছে, সম্ভাব্য এক মারণ-ব্যাধির ভয়ে। সে এবং অপর কর্মীরা উদ্বেগ সংবরণ করে- যে চীন দেশের বিবিধ মেশিন তাদের ফ্লোর জুড়ে, সেখান থেকে অদৃশ্য অসুখ ছড়িয়ে যাচ্ছে, নতুন বছরের প্রাক্কালে। তারা গার্মেন্টস ত্যাগ করে গৃহ-অভিমুখী হয় এবং মুহূর্তের প্রজ্ঞাপনে চাকুরি রক্ষার্থে শত-শত মাইল পথ হেঁটে আবার চাকুরিস্থলে ফিরতে বাধ্য হয়; তারপর আবার পুলিশী-নিবর্তনের মুখে গৃহযাত্রা- এই অশ্লীল-বাধ্যতামূলক হাঁটাপথে, লোকেরা এবং মোমেনা খাতুন... অনুমান হয়, নিষিদ্ধ সেই অসুখের সক্রিয়-ছোঁয়া পায়। মোমেনা খাতুন বিচ্ছিন্ন হয়। একদা পরিত্যক্ত ঘরবাড়ির অপেক্ষাকৃত অধিক অগোছালো ঘরের ভেতর তার নির্জন-আশ্রয় চিহ্নিত হয়। জ্বর বাড়ে, জ্ঞান শূন্যতার মেঘছায়া, ঘ্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে, আর শ্বাসকষ্ট! মোমেনা খাতুন হাসপাতালে পৌঁছয়, পৌঁছয় না; লম্বা কিউ পাড়ি দিয়ে পরীক্ষা করে এবং অক্সিজেন টেন্ট-এ সমপির্ত হয় দ্রুত। কবে নৌকা বিষয়ক এক গ্রন্থের ২২নং পৃষ্ঠায় কালো কফির সীলমোহর তৈরি করেছিল, নজিবর রহমানের প্রযতে্ন- সেই ছায়াছায়া কথোপকথন মনে এলো। দলবদ্ধ হয়ে শহর মুখো হয়, শহর-গাঁ করে... এরকম লোকসকলের মুখ ভাসে। নিঃশ্বাস বিভ্রাটে তার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়, ...হাসপাতালের নিভুনিভু বিছানা এবং চাদর জুড়ে হ্যাপি গার্মেন্টসের গুচ্ছ বাটন-আই- বাটন তিন প্রকার, যথা- ওয়ান আই [১টি মাত্র ছিদ্র থাকে] : টু আই [২টি ছিদ্র থাকে] : আর ফোর বাটন [ছিদ্র থাকে ৪ টি]। মোমেনা খাতুন বদল করে-করে ১টি ২টি ও ৪টি বাটন আই দিয়ে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বিদ্রোহ এবং নিঃসঙ্গতা কালের প্রেম বিষয়ে পুরনো পাঠ্যভ্যাস নিয়ে বৈরীতা ও দোলাচলে আটক হয়। দেখে- ...পায়ের নিচে জল, একটি নদীর মতো, ...পৃথিবী পেরিয়ে ভূ-গর্ভস্থ প্রতিবেশ ছেড়ে অপর জগতে পৌঁছানোর উপায় যেন; কোথায় যেন মৃত মানুষের দীর্ঘ পংক্তি, সবার মুখে খেয়া পারাপারের রৌপ্য-মুদ্রা; একজন মাঝি, যার চোখে জ্বর এবং বাদামি-সবুজ! নদীর ভেতর কুয়াশা, আঁধার, হাড়, ভাঙা পুতুল এবং মরা মাছ। লোকেরা বলে, তারা আমাকে ভালোবাসে; আমি কান্না করি- মোমেনা খাতুন অচেনা বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাটন আই গণনার সময় ফিসফিস করে : আমার হাত-কনুই জাপ্টে আপনারা জগত-সংসারের বৈতরণী পার করবেন... এরকমই প্রতিজ্ঞা। আমার এখন প্রভূত আনন্দ। এই কথা আমার মুখমণ্ডল, আমার হৃদয় এবং ইন্দ্রিয়গুচ্ছ শুনলেও, আমার আত্মা এখনও বুঝতে পারে নি। মহান বিকেল-সন্ধ্যা ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে; হাসপাতাল-বিছানা থেকে আমি কি ঘরে ফিরছি? দ্বিধান্বিত পায়ে, গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে, বাড়ি ফেরার পথে হাঁটছি। (ক্রমশ...)

বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১ , ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৪ শাওয়াল ১৪৪২

মরণোত্তর মৃত্যুদিবস ও নৌকাকাণ্ড : ৩

মামুন হুসাইন

image

চিত্র : ইন্টারনেট

মোমেনা খাতুন রাস্তা জুড়ে অদৃশ্য সাপের দুধ ভাবতে চায় না; খোলা আকাশ জুড়ে গাঁয়ের ছায়ামূর্তিদের সংকট দেখে, মধুক্ষরণ কথা শোনে- মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে এবং ভৌতিক বৃক্ষরাজিকে সাক্ষী মেনে অবিরাম ছুটতে থাকে, অথবা কখনো কেবলই বৃক্ষশাখার দিকে চেয়ে থাকে এবং আত্মবিস্মৃত হয়... আমাদের কদাচিৎ বসন্তদিন আসে!

আমাদের কণ্ঠস্বর, হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কে সদা মেঘের ঘনঘটা হয়। মোমেনা খাতুন হয় অচেনা, ক্ষুদ্র ও সুপ্রাচীন এক স্মৃতিচিহ্ন- সকাল-সন্ধ্যায় সে পৌরসভার গার্বেজ ভ্যান দেখে, আগুন রঙের শাড়ি সামলায়, মৃত্যু তিথি দেখে এবং বিপুল ভাগ্যদোষে খুঁজে বেড়ায় নিত্যকাল, কালস্রোত এবং বেলা-অবেলা-কালবেলা! নৌকা সম্পর্কিত লেখক নজিবর রহমান, একদিন দিগন্তব্যাপী এই নীরবতার কালে কঠোর কৃপা বর্ষণ করে এবং কিয়ৎকাল তার অন্নচিন্তা দূর করে। মোমেনা খাতুন ভরা সংসারে ঘুমায়, বেঞ্চের ধারে দাঁড়ায়, পা-ুলিপির ময়লা ঘষে, মূক হয়, বধির হয়, প্রহর গণনাকারী হয় এবং সকল নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে মরণের সুগন্ধ আঁচ করে। মোমেনা খাতুন এক ফাঁকে নগরের আত্মক্ষয়ী নৃত্যকলা দেখে, নজিবর-দম্পতির বিবিধ দৃশ্যের সাক্ষী হয়, ভিজে গামছা মেলে দেয়, জানালা দিয়ে দি গ্রেট সাইকেল স্টোর্স দেখে, গুয়ে মাখামাখি সারিবদ্ধ খবরের কাগজ দেখে আর অচনো হতে হতে ভাবে- ভেজা ঘাস-কুয়াশা-পাড় ভাঙা নদীর জীবন আর কোনদিন স্পর্শ করার সুযোগ তার হবে না। বহুপূর্বে শোকে মুহ্যমান হয়েছিল, এমন কয়েকজনের নাম স্মরণ হচ্ছে- নিজের মৃত্যুদণ্ডের নিচে দাঁড়িয়ে শস্যহীন মাঠে তারা কাবাডি খেলেছিল। মোমেনা খাতুন একটি পাথরের ঘরে একলা বসে শালিক পাখি দেখে এবং ঘাসফুল বৃদ্ধির দীর্ঘায়িত ক্রন্দন শোনে। শালিক পাখির সঙ্গে তার বাক্যালাপ হয়, হয় না। একপ্রকার শূন্যতা ভীষণমূর্ত হয়ে, দ্যুতিচিহ্ন হয়ে তাকে অতিধীরে অজস্র অসুন্দর কথা বলে; মোমেনা খাতুন, রূপান্তরিত নীরবতার রাজ্যে গৃহস্থের গোচরে এবং অগোচরে, কোনো এক মধ্যাহ্নে সবুজ-উজ্জল-মুখর পাতাসমূহ মাড়িয়ে, অবশেষে নতমস্তকে জনৈক সুলতান আহমেদের সান্ন্যিধ্যে উচ্চতর গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে নাম অর্ন্তভুক্ত করে।

গার্মেন্টসের ক্ষমাহীন বারান্দায়, ঘরে এবং সুবৃহৎ ফ্লোরে কোমর, পুট, কলারের মাথা ও কলারের উচ্চতা রপ্ত করে মোমেনা খাতুন। মোমেনা খাতুন চিনতে শেখে- হেলপার, লাইন চিফ, লাইন সুপার ভাইজার ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলার। মোমেনা খাতুনের হস্তাক্ষর সুন্দর এই অজুহাতে তাকে রিপোর্ট কপি করার নির্দেশ দেয় কোয়ালিটি কন্ট্রোলার; মোমেনা খাতুন লিখতে শুরু করে : অদ্য ০১/০৩/২০১৯ ইং তারিখে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে তাহার বিবরণ নিম্নে দেওয়া হইল :

প্রত্যেক লাইনের পকেটের প্লেট ছোট বড় হইতেছে এবং প্রত্যেক লাইনের পকেট আপডাউন হইতেছে। লাইন চিপকে বলা সত্ত্বেও তাহারা কোনো কর্ণপাত করিতেছেন না। মাঝে মাঝে বাটনের সেলাই এক পাশের্^ পড়ে না। ফ্রন্ট ইয়োকের সেলাই ঠিক হইতাছে না। পকেটের সেলাই বেশিরভাগ অল্টার হইতেছে। ফিনিশিং সেকশন এ দেখা যাইতেছে যে ময়লা ও সুতাসহ মাল পলিব্যাগ হইতাছে। তাই ভবিষ্যতে এইভাবে ময়লা ও সুতাসহ মাল যাহাতে আর পলি না হয় তাহার ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি একান্ত কাম্য।...

পুনশ্চ : অদ্য ০৫/০৩/২০১৯ ইং তারিখে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়াছে তাহার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল :

বিগত ০১/০৩/২০১৯ ইং তারিখে আমি কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে জয়েন করার পর থেকে লাইনে যে সমস্ত কাজকর্ম হইতেছে তা থেকে দেখা যায় ৩০% সাট স্পট হইতেছে। এর একমাত্র কারণ প্রতিদিন লাইনে টিফিন খাওয়ার সময় খাদ্য থেকে যায়। এইভাবে যদি সাট গুলি স্পট হয় তাহা হইলে শিপম্যান দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে। কাজেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নিবেদক : কোয়ালিটি কন্ট্রোলার।

মোমেনা খাতুন এইভাবে কখনো লেখক হয়, কখনো চকবাটন-এর বৈশিষ্ট্য শেখে, কখনো অবসন্ন হয়, উন্মত্ত হয় এবং স্মৃতির আকাশ ভাঙা রূপ পর্যবেক্ষণে অন্ধকারে সহসা কান্না করে। আর অজানা এক গভীর শ^াস গোপনে অঙ্কুরিত হয় এবং সঞ্চারিত হয় অন্তরীক্ষে ও সুবৃহৎ জনপদে : অভাবদীর্ণ, নিস্তরঙ্গ একটি গ্রাম্য জীবন, একটি দুঃসময় অতর্কিতে আছড়ে পড়ে। ঘুমের কিনারা ঘেঁষে কেউ কথা বলে- দণ্ডিত অবস্থায় যা আপনার অভিজ্ঞতার অর্ন্তগত নয়, তা স্মৃতিধার্য হয় কিভাবে? পরমাশ্চর্য নিদ্রা আর পরমাশ্চর্য জাগরণের ভেতর কী সুন্দর দেখাচ্ছে মানুষটাকে। আমরা বুঝি আলোচনার সেই পুরনো অংশেই দাঁড়িয়ে আছি। আপনাকে কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক বোধ হচ্ছে। কখনও কি মনে হয়েছে আপনার আচরণ অনৈতিক? অটুট নিদ্রার ভেতর কেউ-কেউ প্রায়শ জগৎ-সংসার পরিভ্রমণ করে : কিছু বাক্যালাপ গহ্বরে পড়ে,

কিছু মৌন হয় এবং কিছু সুনিশ্চিত ভাবে হয় মারণাস্ত্র। নিশানায় কোনো ভুল ছিল না আমার! মোমেনা খাতুন ঘুমচোখে কুন্ঠিত হয় এবং শীতল হয়, ...সাজানো অক্ষর বানান করে : ডাব্লিউডাব্লিউসি; ...ওয়াকার্স ওয়েলফেয়ার কমিটির মিটিং। হাতে ডাব্লিউডাব্লিউসি-এর কাপড় বাঁধা। ...আমাদের ইনক্রিমিন্ট ৫%, অন্যদের ১০%; ...সভায় মৃদু তর্ক হয়; নারী-পুরুষ একই মান, একই বেতন এক সমান- এইরকম এক শ্লোগান লিখে কেউ সমুখে দাঁড়ায়। কাঠমিস্ত্রি ফজলে আলী টেবিল মেরামতের সময় রডের সাহায্যে টেবিলে আঘাত করে এবং সহসা শর্ট-সার্কিট হয়। শর্ট-সার্কিট অর্থ- আগুনে মৃত্যুবরণ ও প্রত্যেকটি নিহত পরিবারে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি।

...গত ৩০শে সেপ্টেম্বর, রিয়াজ গার্মেন্টস থেকে কাজ শেষে ফেরার কালে বরিশুর গ্রামের একটি ছাপড়া ঘরে রেহানা বেগমকে ধর্ষণ করা হয়। মামলা নং নারী নির্যাতন আইন ৪(গ) ধারা, ২(১০) ৯৩। ...শনিবার ৫ই আগস্ট লুসাকা গার্মেন্টসে আবার অগ্নিকাণ্ড; যে ৯ জন মারা গেছে তার মধ্যে পাঁচজন কিশোর এবং চারজন কিশোরী। পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে এসে মারা যায় অপর এক গার্মেন্টস শ্রমিক। এইসব উপহাস, পুরাতন ছবি ও বিশৃঙ্খলতার কথা ধূর্ত-উদার-ভদ্র মালিকপক্ষের কাছে নিবেদিত হলে পরদিন সকাল-দুপুর গার্মেন্টস প্রাঙ্গণে যুদ্ধ হয়, গুলি হয়, অগ্নিসংঘাত হয়, ধ্বস নামে এবং পোড়া-মানুষ ও ক্ষতবিক্ষত মানুষ জমায়েত হয়ে দীর্ঘ এক মরণলেখ তৈরি করে। আপনারা কি আমাদের কথা শুনবেন? আমরা ভারমুক্ত হতে চাই। মিরপুর-শেওড়াপাড়ার রাস্তা বন্ধ করার দায় শুধু আমাদের না- ১৭-১৮ বছরের সালমার অকাল মৃত্যু কেন হবে? ...এরা আমাদের ভাবে অসহায় মেয়ে মানুষ। আমরা তো ভালোভাবে ভালো পরিবেশে ভাড়া থাকতে পারি না। একটা গার্মেন্টস শ্রমিক যখন মা হয়, মাতৃত্বে যায়. তখন তার তিন মাসের ছুটি দরকার হয়। এরা সেই ছুটির পয়সাটা পর্যন্ত দেয় না, এবং সেই মায়েরাই রিজাইন মাসের বেতনটা ঠিকমতো পায় না। আমি অনেকদিন বিনা দোষে সুপারভাইজারের লাথি ও চড়-থাপ্পর খাইছি। এগুলো কি ঠিক? আমরা তো বাংলাদেশেরই মানুষ, আপনাদেরই ভাই বা বোন কেউ। আমাদের দাবিটা মানেন না কেন? ...৩০শে ডিসেম্বর সবার মতো নাইট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে সালমা। ২০০৬ সালের চালের সর্বনিম্ন দাম অনুযায়ী শ্রমিকেরা যদি ৫ মন চাল ন্যূনতম মজুরি হিসেবে দাবি করতো তাহলে টাকার অঙ্কে তা হতো ৪৬০০। তাহলে বর্তমান দাম অনুসারে, আপনারা কি আমাদের সঠিক বেতন-ভাতা দিয়েছেন? ...ওভারটাইম পাঁচ ঘণ্টা করলে টাকা দেয় ২ ঘণ্টার। একবার প্রতিবাদ করার কারণে এক শ্রমিকের চোখ তুইল্লা নিছিল মালিকরা। ...আজ কত বছর থেইক্যা আমরা কাম করি গার্মেন্টসে। মায়ে রান্নার কাম করে মেসে। আব্বা তরকারি বিক্রি করে। ভোর ৪টায় উঠি, রাত ৮টায় বাসায় আসি, রান্নাবান্না খাইতে খাইতে রাত ১২টা বাইজা যায়। বারোটা বাজে ঘুমাই আবার ভোর ৪টায় উঠি, দেখি চুলা খালি নাই। আমাগো বাড়িতে ১১টা ভাড়াটিয়া, তিনটা চুলা, লাইন ধইরা রান্না করতে হয়। আবার বাড়িওয়ালা অনেক সময় পানি আর ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ কইরা দেয়, বিল বেশি আসে বইলা। গোসল না কইরাও অনেক সময় দৌড় দেওন লাগে। যখন হেল্পার ছিলাম, তখন কার্ড নিয়ে গার্মেন্টস-এর বাথরুমে যাইতে হতো। কইতো, ৫ মিনিটের বেশি থাকতে পারবা না। অনেকে অসুস্থ হইলে ভাবত, বাথরুমে যাইয়া একটু জিরাইয়া আসি। কিন্তু পারত না। আবার অনেকে কাজ জইমা যাওয়ার ভয়ে বাথরুমে যায় না। কাজ জমলে বকা শুনতে হয়। এছাড়াও তো মেয়েদের অনেক সমস্যা থাকে। যদি কেউ বলে স্যার আমার সমস্যা, তখন বলে, কী সমস্য? তখন তো আর পুরুষরে বলা যায় না, কিসের সমস্য। তখন বলে প্যাট ব্যথা করে। কিসের প্যাট ব্যথা! প্যাট ব্যথা, চ্যাডের ব্যথা অফিসে চলে না। যাও কাজ কর গা। ...ছুটি চাইলে, ছুটি দেয় না। একবার আমাদের ফ্লোরে সবাই নাইট করার পরের দিন। আমি মেশিন চালাচ্ছি, আমার পাশে হেলপার, মেয়েটির নাম সফুরা। সে ফ্লোরে কাজ করছিল। কাজ করতে করতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, আমি খেয়াল করি নাই। হেলপার মেয়েটি যে ঘুমাচ্ছে, এটা পিএম স্যার দেখে ফেলে। তারপরই আমাকে আর সেই মেয়েকে খুব মারে বেত দিয়ে। আমি কেন দেখলাম না যে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, এইজন্য আমাকে মারল। আমার দুই হাতে কালশিটা পড়ে গেছিল। আমি ঘরে ফিরি। আমার সাথী ভাড়াটিয়া, ওর নাম জ্যোস্না- ঘর ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম। ছয়দিন খোঁজ নাই; বিছানাপত্র ডেকচি-পাতিল আছে... এইসব বিক্রি করলে কয় টাকা পাই? বাড়ি ভাড়ার কথা ভাবতে ভাবতে আবার ফ্যাক্টরিতে যাই। সেইদিন প্রবল শব্দ হয় হঠাৎ। সমস্ত ফ্লোরে ধোঁয়া এবং আগুন। সিঁড়ি খুঁজি। সিঁড়ি পাই না। কখন নিচে নামি জানি না। আবার আগুনে বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ জন মানুষ পুড়ে যায়। দেখি, অর্ধচেতন অবস্থায় নামার সময় শরীরের চামড়া ঘষে যেয়ে রক্ত ঝরছে কেবল। মনে হয় মৃত মানুষের শরীর ও শিপমেন্টের পোড়া কাপড় ওজনহীন ঝুলে আছে এবং অবশিষ্ট মানুষেরা মৃতবৎ শান্ত-শীতল ও সংকুচিত। আর চারপাশে কাপড় পোড়ার গন্ধ, মানুষেরা চামড়া-পোড়ার গন্ধ এবং মৃত-ক্ষ্যাপাটে-ভাসমান অগ্নিশুদ্ধি ও যজ্ঞকু-। নাইট করানোর পরদিন ছুটি দেয়ার নিয়ম থাকলেও আমরা পরদিন রাত ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করছি; গুছাইতে গুছাইতে ১২টা; এই রাত ১২টা বাজে, আমরা কেমনে যামু? তিনারা বলেন- মন চাইলে চাকরি করবা মন না চাইলে যাইবাগা। রাত হইবই, কাজ চলবই। ছেলেরা-মাস্তানরা রাস্তা আটকায়। কয়, বেতন পাইছস, টাকা দিয়া যা। পুলিশ আটকায়- এত রাতে কইত থ্যাকা আইছস? এমডিকে জানাইলাম আমাদের সমস্য। এমডি আমাকে জিজ্ঞাস করলো, আমি কোন সেকশানে কাজ করি। আমি কইলাম; পরের দিন সকালে ফ্যাক্টরিতে যাইয়া দেখি আমারে ঢুকতে দেয় না। বলে তোমার চাকরি নাই।

লোকেদের প্রতীতি হয়- সব মানুষ সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্বেচ্ছায় আগুনে এবং জলে ঝাঁপ দেয় না। অনেকেই বেঁচে থাকে। অদৃশ্য হয়ে বেঁচে থাকে এবং ক্রমেক্রমে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের পরিধি বিস্তৃত করে চূড়ান্ত বিনাশকালের জন্য অপেক্ষারত হয়। তারা খসে পড়া পালকের মতো ভাসে এবং দেওয়াল ধরে-ধরে নিজের ঘরে ফেরে, তারা অন্ধকারের পৃথক-পৃথক যূথবদ্ধ কুণ্ডলী এড়িয়ে উদ্বেগ সংবরণ করে এবং কোথাও ভগ্ন নৌকায় বসে থাকে অধোমুখে... যেন জল থেকে উঠে আসা এক অচিন নরমু- জলে ফিরে গেছে এইমাত্র।

হ্যাপি গার্মেন্টস-এর তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন, শিপমেন্টের পর সামান্য অবসর- এরকম কালে, যখন সে বসেছিল অধোমুখে, শুনতে পায় গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষিত হয়েছে, সম্ভাব্য এক মারণ-ব্যাধির ভয়ে। সে এবং অপর কর্মীরা উদ্বেগ সংবরণ করে- যে চীন দেশের বিবিধ মেশিন তাদের ফ্লোর জুড়ে, সেখান থেকে অদৃশ্য অসুখ ছড়িয়ে যাচ্ছে, নতুন বছরের প্রাক্কালে। তারা গার্মেন্টস ত্যাগ করে গৃহ-অভিমুখী হয় এবং মুহূর্তের প্রজ্ঞাপনে চাকুরি রক্ষার্থে শত-শত মাইল পথ হেঁটে আবার চাকুরিস্থলে ফিরতে বাধ্য হয়; তারপর আবার পুলিশী-নিবর্তনের মুখে গৃহযাত্রা- এই অশ্লীল-বাধ্যতামূলক হাঁটাপথে, লোকেরা এবং মোমেনা খাতুন... অনুমান হয়, নিষিদ্ধ সেই অসুখের সক্রিয়-ছোঁয়া পায়। মোমেনা খাতুন বিচ্ছিন্ন হয়। একদা পরিত্যক্ত ঘরবাড়ির অপেক্ষাকৃত অধিক অগোছালো ঘরের ভেতর তার নির্জন-আশ্রয় চিহ্নিত হয়। জ্বর বাড়ে, জ্ঞান শূন্যতার মেঘছায়া, ঘ্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে, আর শ্বাসকষ্ট! মোমেনা খাতুন হাসপাতালে পৌঁছয়, পৌঁছয় না; লম্বা কিউ পাড়ি দিয়ে পরীক্ষা করে এবং অক্সিজেন টেন্ট-এ সমপির্ত হয় দ্রুত। কবে নৌকা বিষয়ক এক গ্রন্থের ২২নং পৃষ্ঠায় কালো কফির সীলমোহর তৈরি করেছিল, নজিবর রহমানের প্রযতে্ন- সেই ছায়াছায়া কথোপকথন মনে এলো। দলবদ্ধ হয়ে শহর মুখো হয়, শহর-গাঁ করে... এরকম লোকসকলের মুখ ভাসে। নিঃশ্বাস বিভ্রাটে তার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়, ...হাসপাতালের নিভুনিভু বিছানা এবং চাদর জুড়ে হ্যাপি গার্মেন্টসের গুচ্ছ বাটন-আই- বাটন তিন প্রকার, যথা- ওয়ান আই [১টি মাত্র ছিদ্র থাকে] : টু আই [২টি ছিদ্র থাকে] : আর ফোর বাটন [ছিদ্র থাকে ৪ টি]। মোমেনা খাতুন বদল করে-করে ১টি ২টি ও ৪টি বাটন আই দিয়ে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বিদ্রোহ এবং নিঃসঙ্গতা কালের প্রেম বিষয়ে পুরনো পাঠ্যভ্যাস নিয়ে বৈরীতা ও দোলাচলে আটক হয়। দেখে- ...পায়ের নিচে জল, একটি নদীর মতো, ...পৃথিবী পেরিয়ে ভূ-গর্ভস্থ প্রতিবেশ ছেড়ে অপর জগতে পৌঁছানোর উপায় যেন; কোথায় যেন মৃত মানুষের দীর্ঘ পংক্তি, সবার মুখে খেয়া পারাপারের রৌপ্য-মুদ্রা; একজন মাঝি, যার চোখে জ্বর এবং বাদামি-সবুজ! নদীর ভেতর কুয়াশা, আঁধার, হাড়, ভাঙা পুতুল এবং মরা মাছ। লোকেরা বলে, তারা আমাকে ভালোবাসে; আমি কান্না করি- মোমেনা খাতুন অচেনা বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাটন আই গণনার সময় ফিসফিস করে : আমার হাত-কনুই জাপ্টে আপনারা জগত-সংসারের বৈতরণী পার করবেন... এরকমই প্রতিজ্ঞা। আমার এখন প্রভূত আনন্দ। এই কথা আমার মুখমণ্ডল, আমার হৃদয় এবং ইন্দ্রিয়গুচ্ছ শুনলেও, আমার আত্মা এখনও বুঝতে পারে নি। মহান বিকেল-সন্ধ্যা ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে; হাসপাতাল-বিছানা থেকে আমি কি ঘরে ফিরছি? দ্বিধান্বিত পায়ে, গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে, বাড়ি ফেরার পথে হাঁটছি। (ক্রমশ...)