অরবিন্দ পোদ্দার স্মরণে

গৌতম রায়

‘যার করো নিন্দে, সেই রয় পিন্দে’- শ্রীহট্টের এই আঞ্চলিক শ্লোকটি বড় প্রিয় ছিল সদ্য প্রয়াত অরবিন্দ পোদ্দারের। অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টে জন্ম তাঁর। বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনীন্দ্র রায় সশস্ত্র পথে ব্রিটিশ বিতারণের প্রথম ভাবনা জুগিয়েছিলেন স্কুল পড়ুয়া অরবিন্দের ভিতর। তাঁর মাধ্যমেই অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সংযোগ। মনীন্দ্রের পুত্র নীহাররঞ্জন রায় ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক।

ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লববাদী মানসিকতার বিকাশে রাজনৈতিক প্রবন্ধের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন সেকথা প্রথম যাঁরা তুলে ধরেছিলেন সদ্যপ্রয়াত অরবিন্দ পোদ্দার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অনুশীলন সমিতির সক্রিয় কর্মী হিশেবে ব্রিটিশবিরোধী বেশ কিছু সশস্ত্র অভিযানে অংশ নেন অরবিন্দ। এই পর্যায়ে সংযোগ এবং সম্পর্ক তৈরি হয় মহারাজ ত্রৈলক্য চক্রবর্তী, তারাপদ লাহিড়ীদের সঙ্গে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জেরে ধরা পড়েন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। একটানা সাত বছর কারারুদ্ধ থাকেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকলেও পড়াশোনার ক্ষেত্রটিকে কখনো অবহেলা করেননি অরবিন্দ। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গেই চলছিল লেখালেখির কাজও। ‘গণবার্তা’ পত্রিকাটি তখন দৈনিক ছিল। সেই পত্রিকার সর্বক্ষণের কর্মী হিশেবে কাজ করে অপর দুটি পত্রিকাতেও গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদে। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করবার পর বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের জোড়াজুড়িতেই প্রথাগত গবেষণা শুরু করেন অরবিন্দ। গবেষণাতে নাম নথিভুক্তের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ করে এনে দিয়েছিলেন স্বয়ং নীহাররঞ্জন। তিনি তখন থাকতেন পূর্ণদাস রোডে। নিজের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিকে অরবিন্দের ব্যবহারের সম্পূর্ণ সুযোগই কেবলমাত্র তিনি করেননি, অরবিন্দের খাওয়া-দাওয়ারও সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন নীহাররঞ্জনের পতœী।

মার্কসীয় চেতনায় গবেষণা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম করেছিলেন অরবিন্দ পোদ্দারই। বঙ্কিমকে মার্কসীয় চেতনার নিরিখে বিশ্লেষণের মাধ্যমে উনিশ শতকের নবজাগরণের বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক ধারার বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে সমকালের ইতিহাসচর্চার এক নয়া দিগন্তের উন্মোচন অরবিন্দ পোদ্দার ঘটিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক কাল যে কখনো ‘স্বয়ম্ভু’ হতে পারে না- এই বোধের উপর ভিত্তি করে নির্মোহ অথচ বিবেচনাপ্রসূত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উনিশ শতককে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ- এমনটা ইতিহাসের মানুষজন সেই পাঁচের দশকে বাঙালি সমাজে কতোজন করেছিলেন- সে ঘিরে বিতর্ক আছে। কোনো কালকে জানতে গেলে তার জাতপত্র জানবার প্রয়োজনীয়তার যে দিকনির্দেশ অরবিন্দ পোদ্দার করেছিলেন তাই এইচ কারের ইতিহাস দর্শনের নব্যায়তনের অভিবেশনের অঙ্কুরোদগম ও দূরের কথা, বীজ বপনের কালেই দিকচিহ্ন নির্ণয় করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার। ইতিহাস বিজ্ঞানে যখনই এইচ কার যুগ সেভাবে শুরুই হয় নি, প্রবল পরাক্রমে রাজ করে চলেছেন টয়েনবী, এমন একটা সময়ে, ‘কালান্তরের প্রবেশের মুখে ইতিহাস কোন্ কোন্ শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হইতেছে, ইহার গতিপথের স্বরূপ কী, তাহা নিরুপণ করিতে পারিলে নূতন কালের বিকাশ ধারা এবং ইহার যুগ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন ও উপলব্ধি করা যায়। আবার কাল প্রবাহের অমোঘ অনুশাসনে যখন এই কালের ও অন্তর্ধানের সময় আসিবে, তখন তিরোধানের লগ্নে যে কোন্ নূতন কালকে সৃষ্টি করিয়া যাইবে, কালের বর্তমান স্বরূপের মধ্যে তাহার সাক্ষাৎ পাওয়াও সম্ভব।” (বঙ্কিমমানস, বঙ্কিম ঐতিহ্য ও বন্দেমাতরম- অরবিন্দ পোদ্দার। পৃষ্ঠা-১৩)। এই সন্দর্ভ কি ই এইচ কারের ‘কাকে বলে ইতিহাসে’র আগমন বার্তার ঘোষণাই করছে না?

১৯৫১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি ফিল উপাধি অর্জনের পর নীহাররঞ্জন রায়ের নির্দেশেই অরবিন্দবাবু বর্ধমান উইমেন্স কলেজে অধ্যাপনা করতে যান। সেই যুগে কলেজ শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থার গতিপ্রকৃতিতেই দীর্ঘদিন কার্যত পকেটের পয়সা খরচ করে কলকাতা থেকে বর্ধমান যাতায়াত করে অধ্যাপনার কাজ করতেন তিনি। শেষে একদিন নিদারুণ অর্থকষ্টে বিষয়টি নীহাররঞ্জন রায়কে জানালেন অরবিন্দ বাবু। প্রাথমিকভাবে নীহাররঞ্জন ব্যক্তিগত স্তরে কিছু সহায়তা করলেন অরবিন্দবাবুকে। শেষ পর্যন্ত নীহাররঞ্জনের হস্তক্ষেপে সেই কলেজ থেকে প্রাপ্য অর্থের কিছুটা পেয়েছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার।

এই সময়েই কলকাতার আশুতোষ কলেজ বিজ্ঞাপন দেয় একজন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকের জন্যে। নীহাররঞ্জন অনতিবিলম্বে আশুতোষ কলেজে দরখাস্ত করতে বলেন অরবিন্দকে। দেখা গেল ইন্টারভিউ বোর্ডে রয়েছেন প্রখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। তিনি অরবিন্দের নিয়োগের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও ইন্টারভিউ বোর্ডের এক সভ্য অরবিন্দ বাবুর নামটি দেখে জানতে চান- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কসীয় আঙ্গিকে যে বঙ্কিম গবেষণা সন্দর্ভটি অনুমোদিত হয়েছে, সেটি এই অরবিন্দ পোদ্দারেরই করা কিনা। অরবিন্দ বাবু সম্মতি জানালে আবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কি কমিউনিস্ট? অরবিন্দ পোদ্দার দ্বিধাহীনভাবে সম্মতি জানান। বোর্ডের সভাপতি রমারঞ্জনবাবু অরবিন্দবাবুকে নিয়োগ করতে চাইলেও বোর্ডের অপর দুই সভ্য একজন কমিউনিস্টকে কলেজ শিক্ষক হিশেবে চাকরি দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। চাকরি হয় না অরবিন্দের। পরবর্তীতে সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড্ স্টাডিতে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন অরবিন্দ পোদ্দার। তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন।

সুশোভন সরকারেরা মার্কসীয় ধারায় উনিশ শতকের নবজাগরণকে বিচার বিশ্লেষণ করলেও বাংলার নবজাগরণের দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অরবিন্দ পোদ্দারকে পথিকৃৎ বলতে হয়। বাংলার নবজাগরণের ঔপনিবেশিক বিশেষত্ব আর তার সাথে সাথেই মৌল বৈপরীত্যের দিকে সারস্বত সমাজের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ অরবিন্দ পোদ্দারই করিয়েছিলেন। সঙ্কীর্ণতাবাদী রাজনীতিকেরা যখন গত শতকের সাতের দশককে তথাকথিত মুক্তির দশক বলে দেগে দিয়ে হত্যার রাজনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে উনিশ শতকের নবজাগরণকে বিকৃতভাবে তুলে ধরতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে সংশোধনবাদী রাজনীতিকদের বাংলার নবজাগরণ সম্পর্কে মূল্যায়ন ওই সঙ্কীর্ণতাবাদীদের থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না। মজার কথা হল; এই পর্যায়ের ইতিহাস গত বিশ্লেষণে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে উগ্রতার প্রশ্নে সঙ্কীর্ণতাবাদী আর সংশোধনবাদীদের ভিতরে ছিল অসাধারণ চিন্তার সাযুজ্য।

এই পর্বে বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক চেতনার উপরে নবজাগরণের ইতিহাসগত দিকগুলিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে অরবিন্দ পোদ্দার অত্যন্ত ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই জায়গা থেকেই রসিকচূড়ামণি অরবিন্দ বাবু মজা করে একজন বিশেষ রাজনীতিক সম্পর্কে বলতেন; একটি বিশেষ খবরের কাগজ গোষ্ঠী যদি পর পর তিন দিন ওঁর ছবি ছাপা বন্ধ করে, তাহলে অবসাদে উনি আত্মহত্যাই করে বসবেন।

পরিশেষের একটি ঘটনা; পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁকে বিদ্যাসাগরের উপর বক্তৃতা দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে নবোতিপর অরবিন্দবাবু টানা দেড় ঘণ্টা ইংরেজিতে বক্তৃতা করলেন। কর্তৃপক্ষ যখন ওঁকে সম্মানী চেকটা দিলেন, উনি সেটা নিয়ে আবার কর্তৃপক্ষের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন; চেকটা রাজ্যপালের ত্রাণ তহবিলে জমা করে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে নয়!

রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষা নিতে গেলে স্বামী তেজসানন্দের লেখা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী পড়তে হয়। তেজসানন্দজী যখন বেলুড় বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষ ছিলেন, অরবিন্দ পোদ্দার সেখানে অধ্যাপনা করতেন।

রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার জন্যে তেজসানন্দজী মিশন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সমস্যা মিটে যায়। উনি আবার মিশনে ফিরে আসেন।

অবসরের বহু পরে এরিয়ারের কিছু টাকা পান অরবিন্দবাবু। পুরো সেই টাকাটা তিনি রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়ে দেন তেজসানন্দীর স্মৃতিতে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়ার জন্যে।

অরবিন্দ পোদ্দারের এই দিকগুলি আমরা অনেকেই জানি না।

বহু বছর আগে সমাজতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের ভবিষ্যত দৃষ্টি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অরবিন্দ পোদ্দার ১৩৬৬ সালে লিখেছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক, “আমরা আজ যারা ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছি তাদের কাম্য বোধ হয় এমন এক সমাজ, যেখানে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিক্রয়যোগ্য পণ্যের মতো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে চাই না, অথবা ব্যক্তিক উদ্যোগহীন মৌমাছির সমাজতন্ত্রও আমাদের কাম্য নয়, আমরা নিজ নিজ সত্তার বিকাশে, আপন মহিমায় পরস্পরের সঙ্গে সাধারণ মানব-অভিজ্ঞতার সাগরসঙ্গমে মিলিত হতে চাই। মুনাফার অংশীদার রূপে নয়, মানব ইতিহাসের অভিজ্ঞতার অংশীদার রূপে। একমাত্র এই শর্তেই ব্যক্তি তার আপন ঐশ্বর্য ও সত্যতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্র যদি তাকে মৌমাছির মতো সহজ করে দিতে চায় তো পারে- তাতে রাষ্ট্র হয়ত বাঁচবে, কিন্তু মানবতার মৃত্যু হবে। মানুষের মৃত্যু হবে। তাই আমরা যেন না ভুলি, ব্যক্তি নিষ্প্রাণ জড় বস্তু নয়, একান্ত সজীব ক্রিয়াশীল স্বাধীন সত্তা। সেই সত্তার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল বলেই মূল্যবোধের ওপর আমি গুরুত্ব আরোপ করছি।” (স্বাধীনতা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ। এই প্রবন্ধটি অরবিন্দবাবু পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে লিখেছিলেন)।

ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বেপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষে রবীন্দ্রনাথের নীরব, নিভৃত ভূমিকাটির উন্মোচনে অরবিন্দ পোদ্দারের বিশেষ ভূমিকা আছে। চিন্মোহন সেহানবীশ, নেপাল মজুমদারদের সঙ্গেই বাংলায় রবীন্দ্রনাথের লেখা রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলি কীভাবে সশস্ত্র উপায়ে ব্রিটিশ বিতাড়নের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিল তা দেখিয়েছেন অরবিন্দ পোদ্দার। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিনে রবীন্দ্রনাথের লেখা, “শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে / অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে / অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী ভয়ঙ্করী।” -এই কবিতাটিকে রবীন্দ্রমানসলোক উন্মোচনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন অরবিন্দবাবু।

মননলোকের উদ্ভাসনে যে মুক্তচিন্তার ধারাবাহিকতা অরবিন্দবাবু বহন করতেন, সেই চিন্তাকে উনিশ শতকের যুক্তিবাদ, বিশ শতকের দুইয়ের দশকের মুসলিম সাহিত্য সমাজ, শিখা গোষ্ঠীর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এবং কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর, সুফিয়া কামালদের মুক্তচিন্তার উত্তরাধিকার বলেই চিহ্নিত করতে হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অরবিন্দ পোদ্দার তাঁর সমাজসচেতন মননলোকের উদ্ভাষণে অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রভাবের কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে গিয়েছেন।

অরবিন্দ পোদ্দার দেশভাগের বীভৎসতা দেখেছিলেন। তাই হিন্দু-মুসলমানের ভিতরে এতোটুকু সংঘাত-সংঘর্ষের মানসিকতা দেখলে সহজেই অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়তেন। তত্ত্বকথার বিরোধের শৌখিন মজদুরি অতিক্রম করাটাই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকদের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত- এটা ছিল তাঁর অন্তরের অন্তস্থলের বিশ্বাস। নিন্দাকারীকেও ভালোবেসে অন্তরে ঠাঁই দেওয়ার দেশজ প্রবাদকে জীবন দিয়ে মেনে চলাটাই ছিল তাঁর জীবনধর্ম। কারো নিন্দা করা হচ্ছে বলেই সেই নিন্দাকারীকে চিরপরিত্যাজ্য করতে হবে- এমন কোনো চরম পন্থায় আস্থা ছিল না অরবিন্দবাবুর। নিন্দাকারী বা নিন্দিত মানুষ- যে কেউ নিজের ভুল বুঝে লজ্জা নিবারণের কাপড়ের মতোই একদিন না একদিন একেবারে শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকবে, থাকবেই- এটাই ছিল অরবিন্দবাবুর অন্তরের অন্তস্থলে উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে অরবিন্দ পোদ্দার যেন নিজের ভিতর থেকেই একটা ডাক শুনেছিলেন।

সময়ের ঘূর্ণাবর্তেও বিশ শতকের মূল্যবোধকে একমুহূর্তের জন্যে বর্জন করতে পারেননি অরবিন্দ পোদ্দার। এমনকি সেই মূল্যবোধের প্রশ্নে কখনো কোনো রকম আপোশের তিনি ধার ধারতেন না। চেনা দুনিয়াটা বদলে যাচ্ছিল চোখের উপরে। সেই চিরচেনার ধীরে ধীরে অচেনার পানে অভিযোজন ঘিরে মনে মনে ব্যথা তিনি অবশ্যই পেতেন কিন্তু কখনোই সেই ব্যথার এতোটুকু বহিঃপ্রকাশ ছিল না। কাউকে বুঝতেও দিতেন না বিদীর্ণ বুকের যন্ত্রণাকে। সব দুঃখকষ্টকে ভুলিয়ে রাখতেন শিশুর মতো ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে। শতবর্ষ উত্তীর্ণ হয়েও বয়সের অনুপাতে সুস্থ ই ছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার। স্ত্রী বিয়োগের পর উত্তর কলকাতার সিঁথি ছেড়ে চলে এসেছিলেন পুত্রের কাছেই এম বাইপাসের ধারে। বাড়ির ল্যাব্রাডর পোষ্যের সঙ্গে শতবর্ষীয় অরবিন্দ পোদ্দারের সখ্য দেখার মতো ছিল। কেবলমাত্র শ্রবণশক্তির কিছুটা সমস্যা ছিল। হেয়ারিং এইড দিয়ে সেই সমস্যারও সমাধান হয়ে যাচ্ছিল। অল্প কদিন আগে কোভিড কেড়ে নেয় আদরের নাতিকে। সেই চরম দুঃসংবাদ অনেক চেষ্টা করেও বাড়ির মানুষেরা তাঁর কাছ থেকে গোপন করতে পারেন নি। নাতির অকাল মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারলেন শতবর্ষজীবী অরবিন্দ পোদ্দার। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হলেন। বেসরকারী হাসপাতালে যমে-মানুষে কটা দিনের লড়াই। অবশেষে ২০ জুন দুপুর ১টা নাগাদ চিরশান্ত হলেন।

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১ , ১০ আষাঢ় ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪২

অরবিন্দ পোদ্দার স্মরণে

গৌতম রায়

image

অরবিন্দ পোদ্দার / জন্ম: ৩ নভেম্বর ১৯২০; মৃত্যু : ২০ জুন, ২০২১)

‘যার করো নিন্দে, সেই রয় পিন্দে’- শ্রীহট্টের এই আঞ্চলিক শ্লোকটি বড় প্রিয় ছিল সদ্য প্রয়াত অরবিন্দ পোদ্দারের। অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টে জন্ম তাঁর। বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনীন্দ্র রায় সশস্ত্র পথে ব্রিটিশ বিতারণের প্রথম ভাবনা জুগিয়েছিলেন স্কুল পড়ুয়া অরবিন্দের ভিতর। তাঁর মাধ্যমেই অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সংযোগ। মনীন্দ্রের পুত্র নীহাররঞ্জন রায় ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক।

ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লববাদী মানসিকতার বিকাশে রাজনৈতিক প্রবন্ধের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন সেকথা প্রথম যাঁরা তুলে ধরেছিলেন সদ্যপ্রয়াত অরবিন্দ পোদ্দার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অনুশীলন সমিতির সক্রিয় কর্মী হিশেবে ব্রিটিশবিরোধী বেশ কিছু সশস্ত্র অভিযানে অংশ নেন অরবিন্দ। এই পর্যায়ে সংযোগ এবং সম্পর্ক তৈরি হয় মহারাজ ত্রৈলক্য চক্রবর্তী, তারাপদ লাহিড়ীদের সঙ্গে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জেরে ধরা পড়েন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। একটানা সাত বছর কারারুদ্ধ থাকেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকলেও পড়াশোনার ক্ষেত্রটিকে কখনো অবহেলা করেননি অরবিন্দ। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গেই চলছিল লেখালেখির কাজও। ‘গণবার্তা’ পত্রিকাটি তখন দৈনিক ছিল। সেই পত্রিকার সর্বক্ষণের কর্মী হিশেবে কাজ করে অপর দুটি পত্রিকাতেও গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদে। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করবার পর বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের জোড়াজুড়িতেই প্রথাগত গবেষণা শুরু করেন অরবিন্দ। গবেষণাতে নাম নথিভুক্তের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ করে এনে দিয়েছিলেন স্বয়ং নীহাররঞ্জন। তিনি তখন থাকতেন পূর্ণদাস রোডে। নিজের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিকে অরবিন্দের ব্যবহারের সম্পূর্ণ সুযোগই কেবলমাত্র তিনি করেননি, অরবিন্দের খাওয়া-দাওয়ারও সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন নীহাররঞ্জনের পতœী।

মার্কসীয় চেতনায় গবেষণা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম করেছিলেন অরবিন্দ পোদ্দারই। বঙ্কিমকে মার্কসীয় চেতনার নিরিখে বিশ্লেষণের মাধ্যমে উনিশ শতকের নবজাগরণের বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক ধারার বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে সমকালের ইতিহাসচর্চার এক নয়া দিগন্তের উন্মোচন অরবিন্দ পোদ্দার ঘটিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক কাল যে কখনো ‘স্বয়ম্ভু’ হতে পারে না- এই বোধের উপর ভিত্তি করে নির্মোহ অথচ বিবেচনাপ্রসূত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে উনিশ শতককে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ- এমনটা ইতিহাসের মানুষজন সেই পাঁচের দশকে বাঙালি সমাজে কতোজন করেছিলেন- সে ঘিরে বিতর্ক আছে। কোনো কালকে জানতে গেলে তার জাতপত্র জানবার প্রয়োজনীয়তার যে দিকনির্দেশ অরবিন্দ পোদ্দার করেছিলেন তাই এইচ কারের ইতিহাস দর্শনের নব্যায়তনের অভিবেশনের অঙ্কুরোদগম ও দূরের কথা, বীজ বপনের কালেই দিকচিহ্ন নির্ণয় করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার। ইতিহাস বিজ্ঞানে যখনই এইচ কার যুগ সেভাবে শুরুই হয় নি, প্রবল পরাক্রমে রাজ করে চলেছেন টয়েনবী, এমন একটা সময়ে, ‘কালান্তরের প্রবেশের মুখে ইতিহাস কোন্ কোন্ শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হইতেছে, ইহার গতিপথের স্বরূপ কী, তাহা নিরুপণ করিতে পারিলে নূতন কালের বিকাশ ধারা এবং ইহার যুগ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন ও উপলব্ধি করা যায়। আবার কাল প্রবাহের অমোঘ অনুশাসনে যখন এই কালের ও অন্তর্ধানের সময় আসিবে, তখন তিরোধানের লগ্নে যে কোন্ নূতন কালকে সৃষ্টি করিয়া যাইবে, কালের বর্তমান স্বরূপের মধ্যে তাহার সাক্ষাৎ পাওয়াও সম্ভব।” (বঙ্কিমমানস, বঙ্কিম ঐতিহ্য ও বন্দেমাতরম- অরবিন্দ পোদ্দার। পৃষ্ঠা-১৩)। এই সন্দর্ভ কি ই এইচ কারের ‘কাকে বলে ইতিহাসে’র আগমন বার্তার ঘোষণাই করছে না?

১৯৫১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি ফিল উপাধি অর্জনের পর নীহাররঞ্জন রায়ের নির্দেশেই অরবিন্দবাবু বর্ধমান উইমেন্স কলেজে অধ্যাপনা করতে যান। সেই যুগে কলেজ শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থার গতিপ্রকৃতিতেই দীর্ঘদিন কার্যত পকেটের পয়সা খরচ করে কলকাতা থেকে বর্ধমান যাতায়াত করে অধ্যাপনার কাজ করতেন তিনি। শেষে একদিন নিদারুণ অর্থকষ্টে বিষয়টি নীহাররঞ্জন রায়কে জানালেন অরবিন্দ বাবু। প্রাথমিকভাবে নীহাররঞ্জন ব্যক্তিগত স্তরে কিছু সহায়তা করলেন অরবিন্দবাবুকে। শেষ পর্যন্ত নীহাররঞ্জনের হস্তক্ষেপে সেই কলেজ থেকে প্রাপ্য অর্থের কিছুটা পেয়েছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার।

এই সময়েই কলকাতার আশুতোষ কলেজ বিজ্ঞাপন দেয় একজন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষকের জন্যে। নীহাররঞ্জন অনতিবিলম্বে আশুতোষ কলেজে দরখাস্ত করতে বলেন অরবিন্দকে। দেখা গেল ইন্টারভিউ বোর্ডে রয়েছেন প্রখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। তিনি অরবিন্দের নিয়োগের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও ইন্টারভিউ বোর্ডের এক সভ্য অরবিন্দ বাবুর নামটি দেখে জানতে চান- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কসীয় আঙ্গিকে যে বঙ্কিম গবেষণা সন্দর্ভটি অনুমোদিত হয়েছে, সেটি এই অরবিন্দ পোদ্দারেরই করা কিনা। অরবিন্দ বাবু সম্মতি জানালে আবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কি কমিউনিস্ট? অরবিন্দ পোদ্দার দ্বিধাহীনভাবে সম্মতি জানান। বোর্ডের সভাপতি রমারঞ্জনবাবু অরবিন্দবাবুকে নিয়োগ করতে চাইলেও বোর্ডের অপর দুই সভ্য একজন কমিউনিস্টকে কলেজ শিক্ষক হিশেবে চাকরি দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। চাকরি হয় না অরবিন্দের। পরবর্তীতে সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড্ স্টাডিতে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন অরবিন্দ পোদ্দার। তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন।

সুশোভন সরকারেরা মার্কসীয় ধারায় উনিশ শতকের নবজাগরণকে বিচার বিশ্লেষণ করলেও বাংলার নবজাগরণের দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অরবিন্দ পোদ্দারকে পথিকৃৎ বলতে হয়। বাংলার নবজাগরণের ঔপনিবেশিক বিশেষত্ব আর তার সাথে সাথেই মৌল বৈপরীত্যের দিকে সারস্বত সমাজের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ অরবিন্দ পোদ্দারই করিয়েছিলেন। সঙ্কীর্ণতাবাদী রাজনীতিকেরা যখন গত শতকের সাতের দশককে তথাকথিত মুক্তির দশক বলে দেগে দিয়ে হত্যার রাজনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে উনিশ শতকের নবজাগরণকে বিকৃতভাবে তুলে ধরতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে সংশোধনবাদী রাজনীতিকদের বাংলার নবজাগরণ সম্পর্কে মূল্যায়ন ওই সঙ্কীর্ণতাবাদীদের থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না। মজার কথা হল; এই পর্যায়ের ইতিহাস গত বিশ্লেষণে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে উগ্রতার প্রশ্নে সঙ্কীর্ণতাবাদী আর সংশোধনবাদীদের ভিতরে ছিল অসাধারণ চিন্তার সাযুজ্য।

এই পর্বে বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক চেতনার উপরে নবজাগরণের ইতিহাসগত দিকগুলিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে অরবিন্দ পোদ্দার অত্যন্ত ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই জায়গা থেকেই রসিকচূড়ামণি অরবিন্দ বাবু মজা করে একজন বিশেষ রাজনীতিক সম্পর্কে বলতেন; একটি বিশেষ খবরের কাগজ গোষ্ঠী যদি পর পর তিন দিন ওঁর ছবি ছাপা বন্ধ করে, তাহলে অবসাদে উনি আত্মহত্যাই করে বসবেন।

পরিশেষের একটি ঘটনা; পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁকে বিদ্যাসাগরের উপর বক্তৃতা দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে নবোতিপর অরবিন্দবাবু টানা দেড় ঘণ্টা ইংরেজিতে বক্তৃতা করলেন। কর্তৃপক্ষ যখন ওঁকে সম্মানী চেকটা দিলেন, উনি সেটা নিয়ে আবার কর্তৃপক্ষের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন; চেকটা রাজ্যপালের ত্রাণ তহবিলে জমা করে দেবেন। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে নয়!

রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষা নিতে গেলে স্বামী তেজসানন্দের লেখা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী পড়তে হয়। তেজসানন্দজী যখন বেলুড় বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষ ছিলেন, অরবিন্দ পোদ্দার সেখানে অধ্যাপনা করতেন।

রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার জন্যে তেজসানন্দজী মিশন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সমস্যা মিটে যায়। উনি আবার মিশনে ফিরে আসেন।

অবসরের বহু পরে এরিয়ারের কিছু টাকা পান অরবিন্দবাবু। পুরো সেই টাকাটা তিনি রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়ে দেন তেজসানন্দীর স্মৃতিতে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়ার জন্যে।

অরবিন্দ পোদ্দারের এই দিকগুলি আমরা অনেকেই জানি না।

বহু বছর আগে সমাজতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের ভবিষ্যত দৃষ্টি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অরবিন্দ পোদ্দার ১৩৬৬ সালে লিখেছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক, “আমরা আজ যারা ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছি তাদের কাম্য বোধ হয় এমন এক সমাজ, যেখানে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিক্রয়যোগ্য পণ্যের মতো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে চাই না, অথবা ব্যক্তিক উদ্যোগহীন মৌমাছির সমাজতন্ত্রও আমাদের কাম্য নয়, আমরা নিজ নিজ সত্তার বিকাশে, আপন মহিমায় পরস্পরের সঙ্গে সাধারণ মানব-অভিজ্ঞতার সাগরসঙ্গমে মিলিত হতে চাই। মুনাফার অংশীদার রূপে নয়, মানব ইতিহাসের অভিজ্ঞতার অংশীদার রূপে। একমাত্র এই শর্তেই ব্যক্তি তার আপন ঐশ্বর্য ও সত্যতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্র যদি তাকে মৌমাছির মতো সহজ করে দিতে চায় তো পারে- তাতে রাষ্ট্র হয়ত বাঁচবে, কিন্তু মানবতার মৃত্যু হবে। মানুষের মৃত্যু হবে। তাই আমরা যেন না ভুলি, ব্যক্তি নিষ্প্রাণ জড় বস্তু নয়, একান্ত সজীব ক্রিয়াশীল স্বাধীন সত্তা। সেই সত্তার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল বলেই মূল্যবোধের ওপর আমি গুরুত্ব আরোপ করছি।” (স্বাধীনতা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ। এই প্রবন্ধটি অরবিন্দবাবু পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে লিখেছিলেন)।

ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বেপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষে রবীন্দ্রনাথের নীরব, নিভৃত ভূমিকাটির উন্মোচনে অরবিন্দ পোদ্দারের বিশেষ ভূমিকা আছে। চিন্মোহন সেহানবীশ, নেপাল মজুমদারদের সঙ্গেই বাংলায় রবীন্দ্রনাথের লেখা রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলি কীভাবে সশস্ত্র উপায়ে ব্রিটিশ বিতাড়নের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিল তা দেখিয়েছেন অরবিন্দ পোদ্দার। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিনে রবীন্দ্রনাথের লেখা, “শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে / অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে / অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী ভয়ঙ্করী।” -এই কবিতাটিকে রবীন্দ্রমানসলোক উন্মোচনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন অরবিন্দবাবু।

মননলোকের উদ্ভাসনে যে মুক্তচিন্তার ধারাবাহিকতা অরবিন্দবাবু বহন করতেন, সেই চিন্তাকে উনিশ শতকের যুক্তিবাদ, বিশ শতকের দুইয়ের দশকের মুসলিম সাহিত্য সমাজ, শিখা গোষ্ঠীর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এবং কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর, সুফিয়া কামালদের মুক্তচিন্তার উত্তরাধিকার বলেই চিহ্নিত করতে হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অরবিন্দ পোদ্দার তাঁর সমাজসচেতন মননলোকের উদ্ভাষণে অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রভাবের কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে গিয়েছেন।

অরবিন্দ পোদ্দার দেশভাগের বীভৎসতা দেখেছিলেন। তাই হিন্দু-মুসলমানের ভিতরে এতোটুকু সংঘাত-সংঘর্ষের মানসিকতা দেখলে সহজেই অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়তেন। তত্ত্বকথার বিরোধের শৌখিন মজদুরি অতিক্রম করাটাই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকদের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত- এটা ছিল তাঁর অন্তরের অন্তস্থলের বিশ্বাস। নিন্দাকারীকেও ভালোবেসে অন্তরে ঠাঁই দেওয়ার দেশজ প্রবাদকে জীবন দিয়ে মেনে চলাটাই ছিল তাঁর জীবনধর্ম। কারো নিন্দা করা হচ্ছে বলেই সেই নিন্দাকারীকে চিরপরিত্যাজ্য করতে হবে- এমন কোনো চরম পন্থায় আস্থা ছিল না অরবিন্দবাবুর। নিন্দাকারী বা নিন্দিত মানুষ- যে কেউ নিজের ভুল বুঝে লজ্জা নিবারণের কাপড়ের মতোই একদিন না একদিন একেবারে শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকবে, থাকবেই- এটাই ছিল অরবিন্দবাবুর অন্তরের অন্তস্থলে উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে অরবিন্দ পোদ্দার যেন নিজের ভিতর থেকেই একটা ডাক শুনেছিলেন।

সময়ের ঘূর্ণাবর্তেও বিশ শতকের মূল্যবোধকে একমুহূর্তের জন্যে বর্জন করতে পারেননি অরবিন্দ পোদ্দার। এমনকি সেই মূল্যবোধের প্রশ্নে কখনো কোনো রকম আপোশের তিনি ধার ধারতেন না। চেনা দুনিয়াটা বদলে যাচ্ছিল চোখের উপরে। সেই চিরচেনার ধীরে ধীরে অচেনার পানে অভিযোজন ঘিরে মনে মনে ব্যথা তিনি অবশ্যই পেতেন কিন্তু কখনোই সেই ব্যথার এতোটুকু বহিঃপ্রকাশ ছিল না। কাউকে বুঝতেও দিতেন না বিদীর্ণ বুকের যন্ত্রণাকে। সব দুঃখকষ্টকে ভুলিয়ে রাখতেন শিশুর মতো ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে। শতবর্ষ উত্তীর্ণ হয়েও বয়সের অনুপাতে সুস্থ ই ছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার। স্ত্রী বিয়োগের পর উত্তর কলকাতার সিঁথি ছেড়ে চলে এসেছিলেন পুত্রের কাছেই এম বাইপাসের ধারে। বাড়ির ল্যাব্রাডর পোষ্যের সঙ্গে শতবর্ষীয় অরবিন্দ পোদ্দারের সখ্য দেখার মতো ছিল। কেবলমাত্র শ্রবণশক্তির কিছুটা সমস্যা ছিল। হেয়ারিং এইড দিয়ে সেই সমস্যারও সমাধান হয়ে যাচ্ছিল। অল্প কদিন আগে কোভিড কেড়ে নেয় আদরের নাতিকে। সেই চরম দুঃসংবাদ অনেক চেষ্টা করেও বাড়ির মানুষেরা তাঁর কাছ থেকে গোপন করতে পারেন নি। নাতির অকাল মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারলেন শতবর্ষজীবী অরবিন্দ পোদ্দার। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হলেন। বেসরকারী হাসপাতালে যমে-মানুষে কটা দিনের লড়াই। অবশেষে ২০ জুন দুপুর ১টা নাগাদ চিরশান্ত হলেন।