সাহিত্যের অভিভাবকের জীবনাবসান সুশান্ত মজুমদার

বয়সের ভারে হাসান আজিজুল হক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আনার পর তার চিকিৎসা শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যে ভালো বোধ করতেই তিনি ফিরে গেলেন তার প্রিয় রাজশাহীর মতিহার সবুজে। ক’দিন পর সুস্থতা তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়। অমোঘ মৃত্যু পনের নভেম্বর রাতে নিঃশব্দে তাঁর আয়ু নিভিয়ে দিল। বিশ^বিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটির ‘বিভাসের উজানে’ চিরকালের জন্য নিঃস্তব্দ হয়ে গেল তাঁর পার্থিব শরীর। তিনি যে আয়ুস্মান সাহিত্য হৃদয়সংবাদী পাঠকের জন্য রেখে গেছেন তা যুগজয়ী নতুন। তার গল্প-উপন্যাসের বিষয় রূঢ় বাস্তবের মন্থন থেকে তুলে আনা। বিষয় প্রকাশে হাসান আজিজুল হকের গদ্য ও লিপিকৌশল পুরো বাংলা কথাসাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। নিজের সাহিত্য-শিল্পের জন্য নিবিড় মেধা ব্যয় করে তিনি নিজস্বতা নির্মাণ করেছেন।

হাসান আজিজুল হকের গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’ প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা ‘করতলে ছিন্ন মাথা’ উপন্যাস ‘আগুন পাখি’ বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। যারা কথাসাহিত্য চর্চা করতে আগ্রহী এই গ্রন্থসমূহ তাদের অবশ্যই পাঠ্য। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা উপলব্ধি করতে পারবেন হাসান আজিজুল হক লেখকদের লেখক। তাঁর নশ^র শরীর আমাদের মধ্য থেকে মুছে গেলেও অনিঃশেষ মহিমায় সাহিত্য শতাব্দীব্যাপী বেঁচে থাকবে।

হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও আলাপ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আসন্ন সময়ে তাদের ‘সন্দ্বীপন’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের বাগেরহাটে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হলেও স্বাধীনতার পর ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ গল্পগ্রন্থ পাঠ করে কলেজ জীবনে যথাসম্ভব বুঝেছিÑ জঙ্গম সূর্যের আলোর স্পর্শ যেন পেয়েছি। শিক্ষা জীবনে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের উত্তপ্ত ছোঁয়ায় খুলে গেছে মনের জানালা। তাঁর দু’টি গ্রন্থ ‘হাসান আজিজুল হকের মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও উপন্যাস ‘আগুন পাখি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। সন্ধানী প্রকাশনী কর্মকালে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প বাছাই করে তাঁকে জানাতেই তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। একথা তিনি গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন। ‘আগুন পাখি’ উপন্যাস কম্পোজ হওয়ার পর তিনি আবার সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন করেছেন। তখন তাঁর দুরূহ হাতের লেখা আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় আগুন পাখির বিভিন্ন লাইন, প্যারা যোগ করতে অসুবিধা হয়নি। পুরস্কারের জন্য বই জমা দেয়ার সময় চলে গেলে পুরস্কার প্রদানের কর্তৃপক্ষের আগ্রহে ‘আগুন পাখি’ বিলম্বে জমা দেয়ার পরও হাসান আজিজুল হক ‘প্রথম আলো সাহিত্য পুরস্কার’ ও কলকাতার ‘আনন্দ পুরস্কার’ তিনি অর্জন করেন।

বাস্তবতার মহান রূপকার, নতুন গদ্যশৈলীর নির্মাতা হাসান আজিজুল হক স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে সমাজের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা সম্বলিত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আন্দোলনে বিরাজ করেছেন প্রথমসারিতে। তাঁর চিন্তা-চেতনা, কর্মপ্রবাহ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের মননশীল যে ধারাটি অর্জিত যোগ্যতায় আকাশকে স্পর্শ করার সামর্থ্য রাখে, সেই ধারার শ্রেষ্ঠ রূপকারদের অন্যতম হাসান আজিজুল হক।

বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১ , ২ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১১ রবিউস সানি ১৪৪৩

সাহিত্যের অভিভাবকের জীবনাবসান সুশান্ত মজুমদার

বয়সের ভারে হাসান আজিজুল হক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আনার পর তার চিকিৎসা শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যে ভালো বোধ করতেই তিনি ফিরে গেলেন তার প্রিয় রাজশাহীর মতিহার সবুজে। ক’দিন পর সুস্থতা তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়। অমোঘ মৃত্যু পনের নভেম্বর রাতে নিঃশব্দে তাঁর আয়ু নিভিয়ে দিল। বিশ^বিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটির ‘বিভাসের উজানে’ চিরকালের জন্য নিঃস্তব্দ হয়ে গেল তাঁর পার্থিব শরীর। তিনি যে আয়ুস্মান সাহিত্য হৃদয়সংবাদী পাঠকের জন্য রেখে গেছেন তা যুগজয়ী নতুন। তার গল্প-উপন্যাসের বিষয় রূঢ় বাস্তবের মন্থন থেকে তুলে আনা। বিষয় প্রকাশে হাসান আজিজুল হকের গদ্য ও লিপিকৌশল পুরো বাংলা কথাসাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। নিজের সাহিত্য-শিল্পের জন্য নিবিড় মেধা ব্যয় করে তিনি নিজস্বতা নির্মাণ করেছেন।

হাসান আজিজুল হকের গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’ প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা ‘করতলে ছিন্ন মাথা’ উপন্যাস ‘আগুন পাখি’ বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। যারা কথাসাহিত্য চর্চা করতে আগ্রহী এই গ্রন্থসমূহ তাদের অবশ্যই পাঠ্য। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা উপলব্ধি করতে পারবেন হাসান আজিজুল হক লেখকদের লেখক। তাঁর নশ^র শরীর আমাদের মধ্য থেকে মুছে গেলেও অনিঃশেষ মহিমায় সাহিত্য শতাব্দীব্যাপী বেঁচে থাকবে।

হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও আলাপ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আসন্ন সময়ে তাদের ‘সন্দ্বীপন’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের বাগেরহাটে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হলেও স্বাধীনতার পর ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ গল্পগ্রন্থ পাঠ করে কলেজ জীবনে যথাসম্ভব বুঝেছিÑ জঙ্গম সূর্যের আলোর স্পর্শ যেন পেয়েছি। শিক্ষা জীবনে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের উত্তপ্ত ছোঁয়ায় খুলে গেছে মনের জানালা। তাঁর দু’টি গ্রন্থ ‘হাসান আজিজুল হকের মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও উপন্যাস ‘আগুন পাখি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। সন্ধানী প্রকাশনী কর্মকালে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প বাছাই করে তাঁকে জানাতেই তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। একথা তিনি গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন। ‘আগুন পাখি’ উপন্যাস কম্পোজ হওয়ার পর তিনি আবার সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন করেছেন। তখন তাঁর দুরূহ হাতের লেখা আমার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় আগুন পাখির বিভিন্ন লাইন, প্যারা যোগ করতে অসুবিধা হয়নি। পুরস্কারের জন্য বই জমা দেয়ার সময় চলে গেলে পুরস্কার প্রদানের কর্তৃপক্ষের আগ্রহে ‘আগুন পাখি’ বিলম্বে জমা দেয়ার পরও হাসান আজিজুল হক ‘প্রথম আলো সাহিত্য পুরস্কার’ ও কলকাতার ‘আনন্দ পুরস্কার’ তিনি অর্জন করেন।

বাস্তবতার মহান রূপকার, নতুন গদ্যশৈলীর নির্মাতা হাসান আজিজুল হক স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে সমাজের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা সম্বলিত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আন্দোলনে বিরাজ করেছেন প্রথমসারিতে। তাঁর চিন্তা-চেতনা, কর্মপ্রবাহ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের মননশীল যে ধারাটি অর্জিত যোগ্যতায় আকাশকে স্পর্শ করার সামর্থ্য রাখে, সেই ধারার শ্রেষ্ঠ রূপকারদের অন্যতম হাসান আজিজুল হক।