ঢাকা লিট ফেস্টে নোবেল বিজয়ী

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ

জেমকন গ্রুপ আয়োজন করেছে বাংলা একডেমিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব ঢাকা লিট ফেস্ট ২০২৩। সকলের আগ্রহ ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তানজানিয়ার বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহর প্রতি। আমি জেনেছি তিনি এবং ওরহান পামুকও আসবেন। বেখেয়ালি মনে খেয়াল করিনি ওরহান পামুক আসেননি, এসেছেনশুধু গুনরাহ। উদ্বোধনী সেশনে অনেক আগে পৌঁছুলেও পেছনে বসেছি। এগারোটায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটা জরুরি সভা। সুতরাং পেছনে বসার সুবিধে নেয়া। যাতে করে চুপ করে পালানো যায়। এমন একটা লোক আমি, আর তার ওপর তৃতীয় দিনে দায়িত্ব এসে পড়লো গুনরাহের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। কী করা যায়!

কাজ সেরে একাডেমি চত্বরে ফিরলাম দুপরে। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে চলছে সোমালিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক নুরুদ্দিন ফারাহ, গীতাঞ্জলি শ্রী এবং বুকার জয়ী শেহান করুনাতিলকার আলাপ বারবারা এপলারের সঞ্চালনায়। বেশ জমাট আলাপ। তাদেরকে দেখে চিনে রাখলাম। আলোচনা শেষে হলের বাইরে দেখা মিললো শেহান করুনাতিলকার। ওর সাথে তার সাহিত্য এজেন্ট কনিষ্ক গুপ্তা। দুজনের দিকে এগুলাম। সম্ভাষণ বিনিময়।প্রথম পরিচয়। শুরুতে শেহানের একটু জড়তা। আমার আন্তরিকতায় খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কনিষ্কও বেশ আগ্রহ বোধ করলো। বাড়িয়ে দিলো ওর নাম লেখা কার্ড। শেহানকে জানালাম ওর কথা শুনে ভালো লেগেছে। চোখের দৃষ্টিতে ঔজ্জ্বল্য ফুটলো। আমার সম্পর্কে জানতে চোখে প্রশ্ন। বললাম কবিতা এবং কথাসাহিত্য নিয়ে বিগত চুয়াল্লিশ বছর ধরে কাজ করি। মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক! এত্ত বছর। হেসে ফেলে আমার বয়সের ধাঁধা কাটিয়ে দিলাম। আমার কথা বলার ধরনে কনিষ্ক জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি অধ্যাপক? প্রতিউত্তরে জানালাম, বিদেশী কূটনৈতিক মিশনে সিকি শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাজ করেছি। এখন সাংবাদিকতা। তিনজনে মিলে সবটাতেই ছিলো মূলতই পরিচয়। ছবি তোলায় আগ্রহ দেখালাম না। আমার সাথে ছবি তোলার কোনো ইচ্ছে ওর দিক থেকে থাকতেই পারেনা। হেসে বিদায় নিলাম। পা বাড়ালাম দুপুরে খাবারের দিকে।

অতিথিদের জন্যে দোতলায় খাবারের আয়োজন। হালকা করে খাবার নিয়ে বসার জায়গা খুঁজতেই দেখি গোল টেবিলে সামনে নুরুদ্দিন ফারাহ বসা। তার পাশের চেয়ার ফাঁকা। উল্টোদিকে একজন বয়ষ্ক লোক। কাঁটা চামচে প্লেট থেকে কিছু গেঁথে নিলেন। পুরু ঠোঁট। বড় এবং গোলাকার চোখ। সাদা রঙ ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি।সাদা রঙ ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ির আড়ালে চোয়ালের কিছুটা শিথিল মাসল বোঝা যায়। কিছুটা ইউরোপিয়ান দেখতে লাগছে। তার পাশে একজন বয়ষ্ক নারী। ইউরোপিয়ান ছাঁটের চেহারা। চারদিক দেখে নিয়ে বসার জায়গা হিসেব কষলাম। নুরুদ্দিন ফারাহকে চোখে ইশারার সাথে প্রশ্ন, বসতে পারি? তাঁর সৌজন্য। নিশ্চয়। কাঁটাচামচে মাছ ভেঙে মুখে দিয়েই তার দিকে চেয়ে স্মিত হাসি। মুহূর্তে তার চোখে ঝিলিক। কথা বলার সময় চোখের মণিতেমিটিমিটি হাসি টানছেন। হাসছেন প্রতিবার। মনে হলো বড়ই উষ্ণ হৃদয়ের। প্যাঁচ কম। সরল ধাঁচের কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। আমাদের দেশ, সমাজ। তার দেশ এবং সংস্কৃতি। সাহিত্য এবং গতিপথ। সোশ্যাল মিডিয়া তিনি ব্যবহার করেন না। এসব মিলিয়েদুজনে দ্রুত জমিয়ে আলাপ। নুরুদ্দিন জানালেন,পাঞ্জাবে কেটেছে ছাত্র জীবন। ঢাকায় প্রথম। এরপর আমার নাম লেখা কার্ডে নামটা পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, মুজতবা? এটা কি আরবি শব্দ? শব্দটাই কি মুস্তফা? না তো। আমি বোঝাই তাকে। আমাদের নবীর নাম এটাও। নুরুদ্দিন বললেন, আমি কিন্তু আরবি জানি। বললাম, বেশ তো। তবে তো আপনার জন্যে আর কোনো ধাঁধা থাকে না।

সামনের ভদ্রলোক আমাদের আলাপে মন রেখেছেন। টের পাওয়া যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে যখনি চোখ তুলে সামনে তাকাই, ততবার দেখি তার নিষ্পলক দৃষ্টি আমাদের ওপর। কিন্তু মনে হবে শুধুই তাকালেন। সে চোখে কোনো অনুসন্ধান নাই। তার পাশের বয়ষ্ক ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করে। সকল মনোযোগ খাবার প্লেটে।

কথা বলতে বলতেই মনে ভাবছি, লোকটাকে চোখের ইশারায় একটু সম্ভাষণ জানাই। কিন্তু তার চোখে এতোটা মিথ্যে করে নিস্পৃহ চাউনি, যে সমস্ত মনোযোগ নুরুদ্দিনের দিকেই রাখলাম। এটাও ঠিক, নুরুদ্দিন চেয়ার ঘুরিয়ে আমার দিকে। আমাকে দেখছেন। কথা বলছেন। আর মিটিমিটি হাসি। এখানের গল্পটা আরও অনেক দীর্ঘ নয়। নুরদ্দিদন ফারাহ সকল সৌজন্য দেখিয়ে বিদায় নিলেন। দুজনেই আশাবাদ ব্যক্ত করলাম, এই গোল এবং ছোট্ট পৃথিবীর কোনো না কোনো কোনায় আমাদের দেখা হবেই।

খাবার শেষে রুম থেকে বেরিয়ে লনের দিকে এগুচ্ছি। একটা পোস্টারে চোখ আটকে গেলো। খাবার টেবিলে আমার সামনে বসা লোকটার ছবি। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আব্দুলরাজাক গুনরাহ। মনের মাঝে বিস্ময়। ভাবলাম গাধা রে আমি। সে একজন সম্মানিত অতিথি। প্রধান অতিথি। অথচ সামনে বসে ঘণ্টা পারকরেও তাঁকে চিনলাম না। একবার ছোট করে হ্যালো করলাম না। আমার সাথে মেলামেশা করা সকলেই জানে, কী পরিমাণ উষ্ণ লোক আমি। অচেনা মানুষকেও পথে সম্ভাষণ জানাই, সে কিনা চোখের সাননে বসা এতো বড় একজনকে চিনতে পারলো না! আর তখুনি নুুরুদ্দিন ফরাহর মিটিমিটি হাসির গূঢ় অর্থ মাথায় খেলে গেলো। তিনি হয়তো ধরেই নিয়েছেন, আমি গুরনাহকে পাত্তা না দিয়ে কেবলমাত্র তাঁকেই হিসেব করছি। মনে মনে ধরেছেন, আরে বাবা গুনরাহ, তুমি যতই নোবেল পাও, দেখো বাংলাদেশে তোমার চেয়ে কেবল আমাকে সম্মান দেয় এমন কবিও আছে। অন্যদিকে, একইভাবে হয়তো গুরনাহ লোকটিও ভেবেছেন, সামনে বসা লোকটা তো আমাকে পাত্তাই দিলো না। অথচ উদ্বোধনের পর ছবি তুলতে গিয়ে অনেকেই আমার জান খারাপ করে দিয়েছে।

যাকগে মনে মনে এমন সব ভেবে কলকাতা থেকে আসা বন্ধু এবং ছোটভাই এর মতো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাক আহমেদ এবং জলপাইগুড়ির কবি গৌতম গুহরায়ের সাথে আড্ডায় ডুবলাম।

লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিন রাতে আমার কবিতা পড়া। কসমিক টেন্ট। কবি ফরিদ কবির সঞ্চালক। তালিকায় সাঁইত্রিশ জন কবি। হাজির মাত্র পনেরো জন। কবিতা পড়া এবং হৈহুল্লোড় শেষে বাড়ি ফেরার পথ নিলাম। এমন সময় সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশের আব্দার, মুরশেদ ভাই, আগামীকাল আব্দুলরাজাক গুরনাহর সাথে একটা সাক্ষাৎকার চাই। আপনি আলাপ করবেন। আপনি ছাড়া এ কাজ হবে না। গুরনাহর সাথে ওর ধাঁচে ইংরেজিতে কথা বলতে হলে আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। গুনরাহর কাজ কথাসাহিত্যে। আপনি কবিতার সাথে সাথে কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। এ জায়গায় আপনার যে শক্তি, তার কারণে গুনরাহকে সহজেই প্রশ্ন করতে এবং বুঝতে পারবেন।

আকাশের অনুরোধ রাখা ছাড়া কোনো গতি নাই। কিন্তু এ্যাপয়েন্টমেন্ট! আকাশ, এ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেলে এ কাজ করবো কেমনে! দুম করে ওর সামনে হাজির হয়ে তো বলা যায় না, শোনেন, আপনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে চাই। আরেকটা ঘটনা বলি, আজকে খাবার টেবিলে আমার সামনইে তিনি ছিলেন। এক টেবিলে বসে খেলাম। কিন্তু ভাই রে, আমি তো তাঁকে পাত্তাই দেইনি!

যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেও ওবায়েদ আকাশ সময় পেলো না গুনরাহর এর সাক্ষাৎকার নেবার। বললাম বাদ দাও। তা কেন! আকাশ বলল, তৃতীয় দিনে সকাল এগারোটায় মূল মিলনায়তনে অমিতাভ ঘোষ, আব্দুলরাজাক গুরনাহ, পঙ্কজ মিশ্রর সাথে আলাপ করবে ভারতীয় সাংবাদিক, সাহিত্য-সমালোচক, সম্পাদক এবং লেখক নীলাঞ্জন এস রায়। চলে আসেন, সে আলাপ শুনতে। হয় তো তারপর একটু সময় পাবো সাক্ষাৎকার নেবার। রাজি হলাম। ঠিক আছে। হাজির হবো।

শনিবার ঢাকা লিট ফেস্টের তৃতীয় দিনে বাংলা একাডেমির আব্দুুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন। সময় করে হাজির হয়েও দেখি ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। মিলনায়তনের পাশে আরেকটা দরজা। স্বেচ্ছাসেবক তরুণ যারা আমাকে চেনে, বিনয়ে বললো, স্যার, এদিক দিয়ে ভেতরে যেতে পারেন, কিন্তু বসার জায়গা পাবেন না। তাই সই। ঠেলেঠুলে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘কেন্দ্রবিহীন এক বিশ্ব’ শীর্ষক সেশনে পুরো আলোচনা এবং প্রশ্ন মিলিয়ে নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ বললেন, “আমি তাদের নিয়ে আগ্রহী নই, যারা মূল মঞ্চ দখল করে থাকে বা যারা পত্রিকার পাতায় থাকেন। কারণ, তারা ইতোমধ্যেই সেখানে অবস্থান করছেন, তাদের কাজ তারা করে যাচ্ছেন।আমি মনে করি, সাধারণ মানুষের জীবনের জটিলতা নিয়ে আমি বেশি পরিমাণে আগ্রহী। কারণ, সেই জীবনেই আমাদের সবার বসবাস। আর সেখানেই মানুষের সংশয় ও কষ্টগুলো প্রতিভাত হয়; আর এটা প্রতিফলিত হয় না বড় মঞ্চে কিংবা সংবাদপত্রে।”

গুরনাহ বলেন, “লেখার পর পড়ে মনে হয়- হয়তো এটিই লিখতে চাচ্ছিলাম, আবার কখনো মনে হয়, কী আবোলতাবোল লিখলাম! আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কারো পক্ষে লেখা নয়, তবে আমি যেভাবে দেখি সেটিকে তুলে ধরা। আমি যখন কোনো কিছু পড়ি তখন আমার মতো করেই পড়ি। আমি সবার উদ্দেশ্যেই বলি, আমি কখনো দেখি না আমার দর্শক কিংবা পাঠক কারা। আমি সবার জন্য লিখি- যারা আমার লেখা পড়ে।” গুরনাহ বলেন, “লেখক হিসেবে আমার শুরুটা ছিল কোনো কিছুর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া থেকে। এটা এমন না যে আমি মাইগ্রেট করছি, এটি জীবনের একটা সিদ্ধান্ত ছিল। প্রতিশ্রুতিটি এমন ছিল না যে, কোনো কিছু লেখার জন্য লিখতে হবে। এটি অতটা সহজ ছিল না, আবার অন্য কিছু করব বলেও হাল ছেড়ে দেইনি। যখন প্রকাশ করতে পারিনি, তখন মন খারাপ হয়নি। তার মানে এই না যে অন্য কিছু করার জন্য বসে থাকব। তখন মনে হতো, ইশ! যদি কেউ আমার বই প্রকাশ করত! তারপর আরেকটা লিখব, যেটা আমি করেছি। একই সময় সেই প্রতিশ্রুতি, আকাক্সক্ষাটা ছিল লেখার প্রতি।” গুরনাহ আরো বলেন, “সাধারণ জীবনযাপন করতে গেলে কিছুটা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। আমরা এর মধ্য দিয়েই জীবনযাপন করি। মানুষ হওয়ার মধ্যে অনেক কঠিন বিষয় থাকে।” প্রথম প্রথম পাণ্ডুলিপি প্রত্যাখ্যান হয়ে প্রকাশকের কাছ থেকে ফিরে আসার কথা জানান গুরনাহ। তিনি বলেন, “বই প্রকাশ করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে আমার মন খারাপ হয়নি। এ জন্য বসেও থাকিনি, তবে এটা সত্যি যে, মনে হতো আহা যদি কেউ আমার বইটা প্রকাশ করত!’

এর বাইরে তিনি যা বললেন, তা হলো উপনিবেশের উত্তরাধিকারের ক্ষত, যন্ত্রণা এবং কীভাবে তা তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেসবকে কী রকমভাবে তিনি তাঁর লেখায় নিয়ে এসছেন। আমার ভেতর একটু উসখুস। এমন আলাপ আমাকে টানছিলো না। আমি আকাক্সক্ষা করছিলাম, উপনিবেশের ঘটনাচক্রের বাইরে এসে তিনি একটা আলাদা জায়গা নিয়ে কথা বলবেন, তা হলো বিশ্বে শান্তি নির্মাণ বা শান্তি প্রক্রিয়া। বিশ্বখ্যাত এত বড় লেখক বা লেখকরা শান্তি আনয়নে বিশ্বে বা ইতিবাচক সমাজ বিনির্মাণে লেখায় কী ইঙ্গিত করলে সঠিক, তা বলবেন। একটুখানি বিরক্তি, একটুখানি অভুক্ত। মন ভরলো না। ভাবলাম, হলভর্তি মানুষের এ কী হাল! সকলের প্রশ্ন ঐ উপনিবেশ আমলের চত্বরে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ দুনিয়া এগুচ্ছে অসংখ্য সংঘাত মাথায় নিয়ে। সমাজ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে নানা নেতি দিয়ে। সেখানে লেখক কী ধরনের উপজীব্য পাবে, তা নিয়ে লিখবে। সেসব কথা কই! সে সকল উপাদানে ধারালো লেখায় মানুষ নিজের অস্বিত্বের দিকে ফিরে তাকাবে এবং কী করে তাকাবে? কেননা, আমার ছোটগল্পের উপাদানগুলোই এরকম। ফলে বিশ্বের খ্যাতিমানরা কী ভাবেন, তাদের সাথে আমার ভাবনার যোগসূত্র মিলিয়ে নিতে চাই। আরও ভিন্ন দিক নিয়ে জানতে আমি উন্মুখ। কিন্তু আমার সামনে আলাপের এমন হাল হলে, আমি যদি সাক্ষাৎকার নেবার সময়ও পাই, তবুও এর বাইরে আলাদা কিছু পাওয়া যাবে না গুরনাহর কাছ থেকে। বলা ভালো, গুরনাহর সাক্ষাৎকার নেবার আগ্রহে ভাটা দেখা দিলো।

আমার ভাবনার মাঝেই কবি ওবায়েদ আকাশ জানাল, ভাই, সময় পাওয়া যাবে না। তার সাথে কথা বলার জন্যে আগেই দু’তিনজনকে সময় দেয়া আছে। নতুন করে আর কাউকে কথা বলতে সে সময় দিবে না। আকাশ আরও বললো, মনে হচ্ছে তিনি ভিড় এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন। একটু নমনীয় হয়ে আকাশকে বললাম, তবে আমার ধারণা হলো বৃটিশ মাটিতে বাস করা মানুষেরা আমেরিকান বা ফরাসিদের মতো দিলখোলা হয় না। বেশ ফর্মাল। সুতরাং আনুষ্ঠানিকভাবে সময় পাওয়া গেলে কিছুটা আনুষ্ঠানিক আলাপ হতে পারে। আকাশ বলে উঠলো, ভাই, সময় পাবার জন্যে তবুও একটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

দুজনেই মোটামুটি এ সিদ্ধান্তে এলাম, থাক। বাদ। এমন ভাবনা নিয়েই খাবারের হলে এলাম। গোলটেবিল ঘিরে আমরা কজন জমিয়ে আড্ডা। আমার বামে নাট্যাভিনেত্রী বন্যা মির্জা, তারপর অধ্যাপক মানস চৌধুরী। আমার ডানে কবি ওবায়েদ আকাশ। সামনে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক হামীম কামরুল হক। সাহিত্য এবং গত সেশনটাকে ধরে যে যার মতো মন্তব্য। এমন সময় আমাদের কাক্সিক্ষত মানুষটি হাজির। একা। খাবার নেবার জায়গায়। হাতে প্লেট। প্লেটে খাবার নিয়ে গম্ভীর মুখে সকলের গা বাঁচিয়ে, অতি সতর্কভাবে আমাদেরকে তার বামে রেখে গট গট হেঁটে শেষ কোনায় পাতা টেবিলের দিকে গেলেন। যেতে পথেই আমার চোখে চোখ পড়লো। কিন্তু তিনি যেনো আশপাশের কিছুই দেখছেন না। আমার চোখের সীমানায় তিনি তখন কবিগুরু রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুরের ছোটবেলার ব্রজেশ্বর। দুনিয়ার তাবত কিছুর ছোঁয়া থেকে গা বাঁচিয়ে চলতেন। আমাদের মনোযোগের লোকটি গিয়ে বসলেন। সাদা রঙের দুজন মানুষ আগে থেকেই বসা। আমাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছেন সকলে। তিনজনের পিঠে পিঠে একটা দেয়াল। সে দেয়ালের এপারে আমাদের গোল টেবিল এবং আমরা কয়েকজন বাঙালি মূর্তি।

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৩ , ২৮ পৌষ ১৪২৯, ১৯ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

ঢাকা লিট ফেস্টে নোবেল বিজয়ী

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ

image

জেমকন গ্রুপ আয়োজন করেছে বাংলা একডেমিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব ঢাকা লিট ফেস্ট ২০২৩। সকলের আগ্রহ ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তানজানিয়ার বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহর প্রতি। আমি জেনেছি তিনি এবং ওরহান পামুকও আসবেন। বেখেয়ালি মনে খেয়াল করিনি ওরহান পামুক আসেননি, এসেছেনশুধু গুনরাহ। উদ্বোধনী সেশনে অনেক আগে পৌঁছুলেও পেছনে বসেছি। এগারোটায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটা জরুরি সভা। সুতরাং পেছনে বসার সুবিধে নেয়া। যাতে করে চুপ করে পালানো যায়। এমন একটা লোক আমি, আর তার ওপর তৃতীয় দিনে দায়িত্ব এসে পড়লো গুনরাহের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। কী করা যায়!

কাজ সেরে একাডেমি চত্বরে ফিরলাম দুপরে। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে চলছে সোমালিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক নুরুদ্দিন ফারাহ, গীতাঞ্জলি শ্রী এবং বুকার জয়ী শেহান করুনাতিলকার আলাপ বারবারা এপলারের সঞ্চালনায়। বেশ জমাট আলাপ। তাদেরকে দেখে চিনে রাখলাম। আলোচনা শেষে হলের বাইরে দেখা মিললো শেহান করুনাতিলকার। ওর সাথে তার সাহিত্য এজেন্ট কনিষ্ক গুপ্তা। দুজনের দিকে এগুলাম। সম্ভাষণ বিনিময়।প্রথম পরিচয়। শুরুতে শেহানের একটু জড়তা। আমার আন্তরিকতায় খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কনিষ্কও বেশ আগ্রহ বোধ করলো। বাড়িয়ে দিলো ওর নাম লেখা কার্ড। শেহানকে জানালাম ওর কথা শুনে ভালো লেগেছে। চোখের দৃষ্টিতে ঔজ্জ্বল্য ফুটলো। আমার সম্পর্কে জানতে চোখে প্রশ্ন। বললাম কবিতা এবং কথাসাহিত্য নিয়ে বিগত চুয়াল্লিশ বছর ধরে কাজ করি। মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক! এত্ত বছর। হেসে ফেলে আমার বয়সের ধাঁধা কাটিয়ে দিলাম। আমার কথা বলার ধরনে কনিষ্ক জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি অধ্যাপক? প্রতিউত্তরে জানালাম, বিদেশী কূটনৈতিক মিশনে সিকি শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাজ করেছি। এখন সাংবাদিকতা। তিনজনে মিলে সবটাতেই ছিলো মূলতই পরিচয়। ছবি তোলায় আগ্রহ দেখালাম না। আমার সাথে ছবি তোলার কোনো ইচ্ছে ওর দিক থেকে থাকতেই পারেনা। হেসে বিদায় নিলাম। পা বাড়ালাম দুপুরে খাবারের দিকে।

অতিথিদের জন্যে দোতলায় খাবারের আয়োজন। হালকা করে খাবার নিয়ে বসার জায়গা খুঁজতেই দেখি গোল টেবিলে সামনে নুরুদ্দিন ফারাহ বসা। তার পাশের চেয়ার ফাঁকা। উল্টোদিকে একজন বয়ষ্ক লোক। কাঁটা চামচে প্লেট থেকে কিছু গেঁথে নিলেন। পুরু ঠোঁট। বড় এবং গোলাকার চোখ। সাদা রঙ ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি।সাদা রঙ ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ির আড়ালে চোয়ালের কিছুটা শিথিল মাসল বোঝা যায়। কিছুটা ইউরোপিয়ান দেখতে লাগছে। তার পাশে একজন বয়ষ্ক নারী। ইউরোপিয়ান ছাঁটের চেহারা। চারদিক দেখে নিয়ে বসার জায়গা হিসেব কষলাম। নুরুদ্দিন ফারাহকে চোখে ইশারার সাথে প্রশ্ন, বসতে পারি? তাঁর সৌজন্য। নিশ্চয়। কাঁটাচামচে মাছ ভেঙে মুখে দিয়েই তার দিকে চেয়ে স্মিত হাসি। মুহূর্তে তার চোখে ঝিলিক। কথা বলার সময় চোখের মণিতেমিটিমিটি হাসি টানছেন। হাসছেন প্রতিবার। মনে হলো বড়ই উষ্ণ হৃদয়ের। প্যাঁচ কম। সরল ধাঁচের কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। আমাদের দেশ, সমাজ। তার দেশ এবং সংস্কৃতি। সাহিত্য এবং গতিপথ। সোশ্যাল মিডিয়া তিনি ব্যবহার করেন না। এসব মিলিয়েদুজনে দ্রুত জমিয়ে আলাপ। নুরুদ্দিন জানালেন,পাঞ্জাবে কেটেছে ছাত্র জীবন। ঢাকায় প্রথম। এরপর আমার নাম লেখা কার্ডে নামটা পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, মুজতবা? এটা কি আরবি শব্দ? শব্দটাই কি মুস্তফা? না তো। আমি বোঝাই তাকে। আমাদের নবীর নাম এটাও। নুরুদ্দিন বললেন, আমি কিন্তু আরবি জানি। বললাম, বেশ তো। তবে তো আপনার জন্যে আর কোনো ধাঁধা থাকে না।

সামনের ভদ্রলোক আমাদের আলাপে মন রেখেছেন। টের পাওয়া যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে যখনি চোখ তুলে সামনে তাকাই, ততবার দেখি তার নিষ্পলক দৃষ্টি আমাদের ওপর। কিন্তু মনে হবে শুধুই তাকালেন। সে চোখে কোনো অনুসন্ধান নাই। তার পাশের বয়ষ্ক ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করে। সকল মনোযোগ খাবার প্লেটে।

কথা বলতে বলতেই মনে ভাবছি, লোকটাকে চোখের ইশারায় একটু সম্ভাষণ জানাই। কিন্তু তার চোখে এতোটা মিথ্যে করে নিস্পৃহ চাউনি, যে সমস্ত মনোযোগ নুরুদ্দিনের দিকেই রাখলাম। এটাও ঠিক, নুরুদ্দিন চেয়ার ঘুরিয়ে আমার দিকে। আমাকে দেখছেন। কথা বলছেন। আর মিটিমিটি হাসি। এখানের গল্পটা আরও অনেক দীর্ঘ নয়। নুরদ্দিদন ফারাহ সকল সৌজন্য দেখিয়ে বিদায় নিলেন। দুজনেই আশাবাদ ব্যক্ত করলাম, এই গোল এবং ছোট্ট পৃথিবীর কোনো না কোনো কোনায় আমাদের দেখা হবেই।

খাবার শেষে রুম থেকে বেরিয়ে লনের দিকে এগুচ্ছি। একটা পোস্টারে চোখ আটকে গেলো। খাবার টেবিলে আমার সামনে বসা লোকটার ছবি। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আব্দুলরাজাক গুনরাহ। মনের মাঝে বিস্ময়। ভাবলাম গাধা রে আমি। সে একজন সম্মানিত অতিথি। প্রধান অতিথি। অথচ সামনে বসে ঘণ্টা পারকরেও তাঁকে চিনলাম না। একবার ছোট করে হ্যালো করলাম না। আমার সাথে মেলামেশা করা সকলেই জানে, কী পরিমাণ উষ্ণ লোক আমি। অচেনা মানুষকেও পথে সম্ভাষণ জানাই, সে কিনা চোখের সাননে বসা এতো বড় একজনকে চিনতে পারলো না! আর তখুনি নুুরুদ্দিন ফরাহর মিটিমিটি হাসির গূঢ় অর্থ মাথায় খেলে গেলো। তিনি হয়তো ধরেই নিয়েছেন, আমি গুরনাহকে পাত্তা না দিয়ে কেবলমাত্র তাঁকেই হিসেব করছি। মনে মনে ধরেছেন, আরে বাবা গুনরাহ, তুমি যতই নোবেল পাও, দেখো বাংলাদেশে তোমার চেয়ে কেবল আমাকে সম্মান দেয় এমন কবিও আছে। অন্যদিকে, একইভাবে হয়তো গুরনাহ লোকটিও ভেবেছেন, সামনে বসা লোকটা তো আমাকে পাত্তাই দিলো না। অথচ উদ্বোধনের পর ছবি তুলতে গিয়ে অনেকেই আমার জান খারাপ করে দিয়েছে।

যাকগে মনে মনে এমন সব ভেবে কলকাতা থেকে আসা বন্ধু এবং ছোটভাই এর মতো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাক আহমেদ এবং জলপাইগুড়ির কবি গৌতম গুহরায়ের সাথে আড্ডায় ডুবলাম।

লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিন রাতে আমার কবিতা পড়া। কসমিক টেন্ট। কবি ফরিদ কবির সঞ্চালক। তালিকায় সাঁইত্রিশ জন কবি। হাজির মাত্র পনেরো জন। কবিতা পড়া এবং হৈহুল্লোড় শেষে বাড়ি ফেরার পথ নিলাম। এমন সময় সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশের আব্দার, মুরশেদ ভাই, আগামীকাল আব্দুলরাজাক গুরনাহর সাথে একটা সাক্ষাৎকার চাই। আপনি আলাপ করবেন। আপনি ছাড়া এ কাজ হবে না। গুরনাহর সাথে ওর ধাঁচে ইংরেজিতে কথা বলতে হলে আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। গুনরাহর কাজ কথাসাহিত্যে। আপনি কবিতার সাথে সাথে কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। এ জায়গায় আপনার যে শক্তি, তার কারণে গুনরাহকে সহজেই প্রশ্ন করতে এবং বুঝতে পারবেন।

আকাশের অনুরোধ রাখা ছাড়া কোনো গতি নাই। কিন্তু এ্যাপয়েন্টমেন্ট! আকাশ, এ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেলে এ কাজ করবো কেমনে! দুম করে ওর সামনে হাজির হয়ে তো বলা যায় না, শোনেন, আপনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে চাই। আরেকটা ঘটনা বলি, আজকে খাবার টেবিলে আমার সামনইে তিনি ছিলেন। এক টেবিলে বসে খেলাম। কিন্তু ভাই রে, আমি তো তাঁকে পাত্তাই দেইনি!

যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেও ওবায়েদ আকাশ সময় পেলো না গুনরাহর এর সাক্ষাৎকার নেবার। বললাম বাদ দাও। তা কেন! আকাশ বলল, তৃতীয় দিনে সকাল এগারোটায় মূল মিলনায়তনে অমিতাভ ঘোষ, আব্দুলরাজাক গুরনাহ, পঙ্কজ মিশ্রর সাথে আলাপ করবে ভারতীয় সাংবাদিক, সাহিত্য-সমালোচক, সম্পাদক এবং লেখক নীলাঞ্জন এস রায়। চলে আসেন, সে আলাপ শুনতে। হয় তো তারপর একটু সময় পাবো সাক্ষাৎকার নেবার। রাজি হলাম। ঠিক আছে। হাজির হবো।

শনিবার ঢাকা লিট ফেস্টের তৃতীয় দিনে বাংলা একাডেমির আব্দুুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন। সময় করে হাজির হয়েও দেখি ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। মিলনায়তনের পাশে আরেকটা দরজা। স্বেচ্ছাসেবক তরুণ যারা আমাকে চেনে, বিনয়ে বললো, স্যার, এদিক দিয়ে ভেতরে যেতে পারেন, কিন্তু বসার জায়গা পাবেন না। তাই সই। ঠেলেঠুলে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘কেন্দ্রবিহীন এক বিশ্ব’ শীর্ষক সেশনে পুরো আলোচনা এবং প্রশ্ন মিলিয়ে নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ বললেন, “আমি তাদের নিয়ে আগ্রহী নই, যারা মূল মঞ্চ দখল করে থাকে বা যারা পত্রিকার পাতায় থাকেন। কারণ, তারা ইতোমধ্যেই সেখানে অবস্থান করছেন, তাদের কাজ তারা করে যাচ্ছেন।আমি মনে করি, সাধারণ মানুষের জীবনের জটিলতা নিয়ে আমি বেশি পরিমাণে আগ্রহী। কারণ, সেই জীবনেই আমাদের সবার বসবাস। আর সেখানেই মানুষের সংশয় ও কষ্টগুলো প্রতিভাত হয়; আর এটা প্রতিফলিত হয় না বড় মঞ্চে কিংবা সংবাদপত্রে।”

গুরনাহ বলেন, “লেখার পর পড়ে মনে হয়- হয়তো এটিই লিখতে চাচ্ছিলাম, আবার কখনো মনে হয়, কী আবোলতাবোল লিখলাম! আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কারো পক্ষে লেখা নয়, তবে আমি যেভাবে দেখি সেটিকে তুলে ধরা। আমি যখন কোনো কিছু পড়ি তখন আমার মতো করেই পড়ি। আমি সবার উদ্দেশ্যেই বলি, আমি কখনো দেখি না আমার দর্শক কিংবা পাঠক কারা। আমি সবার জন্য লিখি- যারা আমার লেখা পড়ে।” গুরনাহ বলেন, “লেখক হিসেবে আমার শুরুটা ছিল কোনো কিছুর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া থেকে। এটা এমন না যে আমি মাইগ্রেট করছি, এটি জীবনের একটা সিদ্ধান্ত ছিল। প্রতিশ্রুতিটি এমন ছিল না যে, কোনো কিছু লেখার জন্য লিখতে হবে। এটি অতটা সহজ ছিল না, আবার অন্য কিছু করব বলেও হাল ছেড়ে দেইনি। যখন প্রকাশ করতে পারিনি, তখন মন খারাপ হয়নি। তার মানে এই না যে অন্য কিছু করার জন্য বসে থাকব। তখন মনে হতো, ইশ! যদি কেউ আমার বই প্রকাশ করত! তারপর আরেকটা লিখব, যেটা আমি করেছি। একই সময় সেই প্রতিশ্রুতি, আকাক্সক্ষাটা ছিল লেখার প্রতি।” গুরনাহ আরো বলেন, “সাধারণ জীবনযাপন করতে গেলে কিছুটা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। আমরা এর মধ্য দিয়েই জীবনযাপন করি। মানুষ হওয়ার মধ্যে অনেক কঠিন বিষয় থাকে।” প্রথম প্রথম পাণ্ডুলিপি প্রত্যাখ্যান হয়ে প্রকাশকের কাছ থেকে ফিরে আসার কথা জানান গুরনাহ। তিনি বলেন, “বই প্রকাশ করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে আমার মন খারাপ হয়নি। এ জন্য বসেও থাকিনি, তবে এটা সত্যি যে, মনে হতো আহা যদি কেউ আমার বইটা প্রকাশ করত!’

এর বাইরে তিনি যা বললেন, তা হলো উপনিবেশের উত্তরাধিকারের ক্ষত, যন্ত্রণা এবং কীভাবে তা তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেসবকে কী রকমভাবে তিনি তাঁর লেখায় নিয়ে এসছেন। আমার ভেতর একটু উসখুস। এমন আলাপ আমাকে টানছিলো না। আমি আকাক্সক্ষা করছিলাম, উপনিবেশের ঘটনাচক্রের বাইরে এসে তিনি একটা আলাদা জায়গা নিয়ে কথা বলবেন, তা হলো বিশ্বে শান্তি নির্মাণ বা শান্তি প্রক্রিয়া। বিশ্বখ্যাত এত বড় লেখক বা লেখকরা শান্তি আনয়নে বিশ্বে বা ইতিবাচক সমাজ বিনির্মাণে লেখায় কী ইঙ্গিত করলে সঠিক, তা বলবেন। একটুখানি বিরক্তি, একটুখানি অভুক্ত। মন ভরলো না। ভাবলাম, হলভর্তি মানুষের এ কী হাল! সকলের প্রশ্ন ঐ উপনিবেশ আমলের চত্বরে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ দুনিয়া এগুচ্ছে অসংখ্য সংঘাত মাথায় নিয়ে। সমাজ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে নানা নেতি দিয়ে। সেখানে লেখক কী ধরনের উপজীব্য পাবে, তা নিয়ে লিখবে। সেসব কথা কই! সে সকল উপাদানে ধারালো লেখায় মানুষ নিজের অস্বিত্বের দিকে ফিরে তাকাবে এবং কী করে তাকাবে? কেননা, আমার ছোটগল্পের উপাদানগুলোই এরকম। ফলে বিশ্বের খ্যাতিমানরা কী ভাবেন, তাদের সাথে আমার ভাবনার যোগসূত্র মিলিয়ে নিতে চাই। আরও ভিন্ন দিক নিয়ে জানতে আমি উন্মুখ। কিন্তু আমার সামনে আলাপের এমন হাল হলে, আমি যদি সাক্ষাৎকার নেবার সময়ও পাই, তবুও এর বাইরে আলাদা কিছু পাওয়া যাবে না গুরনাহর কাছ থেকে। বলা ভালো, গুরনাহর সাক্ষাৎকার নেবার আগ্রহে ভাটা দেখা দিলো।

আমার ভাবনার মাঝেই কবি ওবায়েদ আকাশ জানাল, ভাই, সময় পাওয়া যাবে না। তার সাথে কথা বলার জন্যে আগেই দু’তিনজনকে সময় দেয়া আছে। নতুন করে আর কাউকে কথা বলতে সে সময় দিবে না। আকাশ আরও বললো, মনে হচ্ছে তিনি ভিড় এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন। একটু নমনীয় হয়ে আকাশকে বললাম, তবে আমার ধারণা হলো বৃটিশ মাটিতে বাস করা মানুষেরা আমেরিকান বা ফরাসিদের মতো দিলখোলা হয় না। বেশ ফর্মাল। সুতরাং আনুষ্ঠানিকভাবে সময় পাওয়া গেলে কিছুটা আনুষ্ঠানিক আলাপ হতে পারে। আকাশ বলে উঠলো, ভাই, সময় পাবার জন্যে তবুও একটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

দুজনেই মোটামুটি এ সিদ্ধান্তে এলাম, থাক। বাদ। এমন ভাবনা নিয়েই খাবারের হলে এলাম। গোলটেবিল ঘিরে আমরা কজন জমিয়ে আড্ডা। আমার বামে নাট্যাভিনেত্রী বন্যা মির্জা, তারপর অধ্যাপক মানস চৌধুরী। আমার ডানে কবি ওবায়েদ আকাশ। সামনে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক হামীম কামরুল হক। সাহিত্য এবং গত সেশনটাকে ধরে যে যার মতো মন্তব্য। এমন সময় আমাদের কাক্সিক্ষত মানুষটি হাজির। একা। খাবার নেবার জায়গায়। হাতে প্লেট। প্লেটে খাবার নিয়ে গম্ভীর মুখে সকলের গা বাঁচিয়ে, অতি সতর্কভাবে আমাদেরকে তার বামে রেখে গট গট হেঁটে শেষ কোনায় পাতা টেবিলের দিকে গেলেন। যেতে পথেই আমার চোখে চোখ পড়লো। কিন্তু তিনি যেনো আশপাশের কিছুই দেখছেন না। আমার চোখের সীমানায় তিনি তখন কবিগুরু রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুরের ছোটবেলার ব্রজেশ্বর। দুনিয়ার তাবত কিছুর ছোঁয়া থেকে গা বাঁচিয়ে চলতেন। আমাদের মনোযোগের লোকটি গিয়ে বসলেন। সাদা রঙের দুজন মানুষ আগে থেকেই বসা। আমাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছেন সকলে। তিনজনের পিঠে পিঠে একটা দেয়াল। সে দেয়ালের এপারে আমাদের গোল টেবিল এবং আমরা কয়েকজন বাঙালি মূর্তি।