রবীন্দ্রবোধন

ফিরোজ আহমেদ

আমি কান পেতে রই

‘আমি কান পেতে রই / ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে’ এই গানটির মর্ম অনুধাবন করতে আমরা প্রতিটি চরণের মূল শব্দের (কবু ড়িৎফং) দিকে নজর দেব। গানটি মূলত একজন কবি, সাহিত্যিক বা সৃজনশীল শিল্পীসত্তার চেতনাকে বিবৃত করে। প্রত্যেক শিল্প¯্রষ্টারই থাকে নিজের নিগূঢ় চেতনাকে ধরবার চেষ্টা। নিজের অন্তর্জগতে কী ভাব খেলা করে যায় সেসবকে অনুসরণ করার চেষ্টাই শিল্পীর আসল লক্ষ্য। কিন্তু শিল্পীমনের গভীরতা এত বেশি যে সেখানে ঠিক পুরোপুরি প্রবেশ করে সারা যায় না। তাইতো রবীন্দ্রনাথ শুধু তার ‘আপন হৃদয়গহন-দ্বারে’ কান পেতে শোনার চেষ্টা করেন। হৃদয়ের গহীন অঞ্চলের ভাবকে সীমান্তে বা দুয়ারে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করেন।

কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে- বারে বারে ॥

হৃদয়ের গভীরে যে সত্তা বাস করে তিনি একজন ‘গোপনবাসী’ (গোপনে বাস করেন যিনি = গোপনবাসী)। সেই গোপনবাসীর কথা শুনতেই হৃদয়ের গহনদ্বারে কান পেতে থাকতে হয়। এই গোপনবাসীর কী কথা শুনতে চান রবীন্দ্রনাথ? ‘কান্নাহাসির গোপন কথা’ শুনতে চান। এই গানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কী-ওয়ার্ড এটি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যকর্মে বিশ্বমানবের, বিশেষত বাঙালি নর-নারীর একান্ত আবেগ অনুভূতিগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে চান। তাই এই ‘গোপনবাসী’ আসলে বাঙালি নর-নারীর প্রতিনিধি বা পার্সনিফিকেশন। আর এই গোপনবাসীর ‘কান্নাহাসি’ হলো বাঙালি নর-নারীর সুখ-দুঃখের বিচিত্র অনুভূতিগুলো।

বাংলা ভাষার কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি নর-নারীর প্রতিভূ এই গোপনবাসীকেই তাঁর সাহিত্য রচনার প্রেরণা হিসেবে অন্তরে গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং ‘গোপনবাসীর কান্নাহাসি’কেই তার সকল রচনার উপজীব্য করে তুলতে চান। ফলে, তিনি বারবার এই গোপনবাসীর কান্নাহাসি শোনার চেষ্টায় থাকেন যাতে তাঁর লেখালেখিতে সেই কান্নাহাসি তুলে ধরতে পারেন।

ভ্রমর সেথা হয় বিবাগি নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,

এই চরণে ‘ভ্রমর’ এবং ‘নিভৃত নীলপদ্ম’ গুরুত্বপূর্ণ দু’টি শব্দ। রবীন্দ্রনাথ তার অন্তরের ‘গোপনবাসীর কান্নাহাসি’ শোনার জন্য কতটা মনোযোগী, অনুসন্ধানী ও ব্যাকুল হয়ে থাকেন তা এখানে প্রকাশ পেয়েছে। শিল্পীকে অবশ্যই তার ‘প্রেরণা’কে সশ্রম প্রচেষ্টায় অনুসরণ করতে হয়। ভ্রমর যেমন সবকিছু ছেড়ে ফুলের সন্ধানে আকুল হয়ে বেড়ায়। রবীন্দ্রনাথও ঠিক একটা ভ্রমরের মতো ‘বিবাগী’ হয়ে বা জগত সংসারের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ‘নীলপদ্ম’ খুঁজতে থাকেন।

এখানে ‘নীলপদ্ম’ কথাটি শিল্পসৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষাকে ব্যাখ্যা করে। ‘নীলপদ্ম’ হলো ‘সৃষ্টিযন্ত্রণা’ বা পৎবধঃরাব ুবধষ। প্রত্যেক শিল্পীই ভ্রমর হয়ে নীলপদ্মর সন্ধানে থাকেন। ভ্রমর তো ফুল খুঁজবেই। সাধারণ ভ্রমর সাধারণ ফুলেই সন্তুষ্ট থাকে কিন্তু একজন শিল্পী-ভ্রমর নীলপদ্ম খোঁজে। নীলপদ্ম হলো বিরল জাতের ফুল যা সহসা দেখা যায় না। অর্থাৎ শিল্পীকে এমন নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয় যা আগে খুব বেশি দেখা যায়নি। শিল্পীকে যে নতুন ভাব বা অনুভূতি সৃষ্টি করতে হবে তা নয়। কমপক্ষে উপস্থাপন, শৈলী ইত্যাদি তো নতুন বা অনন্য হতেই হয়। না তা হলে সেই শিল্প অনুকরণ দোষে দুষ্ট হবে, পাঠক গ্রহণ করবে না। তাই রবীন্দ্রনাথ জগত সংসারের কাজকর্ম ছেড়ে বিবাগী হয়ে ‘নিভৃত নীলপদ্ম’র সন্ধানে থাকেন। একে তো নীলপদ্ম তার উপর আবার নিভৃত। অর্থাৎ এমন নীলপদ্ম যা সকলের অগোচরে নিভৃতে ফুটে আছে, কেউ সেটিকে এখনও দেখেনি কিংবা স্পর্শ করেনি। তিনি এমন নীলপদ্মই তুলে এনে পাঠকের সামনে হাজির করতে চান। সৃজনশীল সকল শিল্পীরই একান্ত চাওয়া হলো- পাঠককে ‘নিভৃত নীলপদ্ম’ উপহার দেওয়া। শিল্পীসত্তার মনের জ্বালা বা সৃষ্টিযন্ত্রণা হলো এই নীলপদ্মর সন্ধান।

কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে ॥

এই চরণে গোপনবাসীর কান্নাহাসিকে নিঃসঙ্গ রাতের পাখির সাথে তুলনা করা হয়েছে। আসলে শিল্পীমনের সৃজনশীলতা শিল্পীকে বারবার প্ররোচিত করে শিল্পসৃষ্টি করার জন্য। রাতের অন্ধকারে নিরন্তর গীত হওয়া পাখির গানের মতো তার মনকে তাড়িত করে। এই তাড়না ঠিক চেতন মন থাকে আসে না, আসে অবচেতন থেকে। তাই পাখিটি যেন দিনের আলোতে গান গায় না। রাতের অন্ধকারে অবচেতনার গহীন স্তর থেকে গাইতে থাকে।

কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা।

কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।

এখানে এসে রবীন্দ্রনাথ গোপনবাসীর সাথে তাঁর নিজের সম্পর্ক নির্ণয় করতে চাইছেন। বিভিন্ন ভাষায় শিল্পসাহিত্যের প্রেরণাদায়ী দেব-দেবীর ধারণা রয়েছে। যেমন: গ্রিক সাহিত্যের মিউজ। রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন হৃদয়ের গহীনে বাস করে যিনি বাঙালির আবেগ-অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া করে চলেছেন তিনি কে? তার সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা কী? এটা কি দেবী আর ভক্তর সম্পর্ক? যাহোক, রবীন্দ্রনাথ এই গোপনবাসীকে গ্রিক সাহিত্যের মিউজ এর মতো কেনো দেবীর আসন দেননি। শিল্পসৃষ্টির প্রেরণাদায়ী এই গোপন সত্তাটিকে রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ এটিকে মিউজ এর মতো কোনো দেবী ভাবেননি বরং রহসম্যয় এক প্রেরণা হিসেবেই দেখেছেন এবং সেই প্রেরণাকে তিনটি স্তরে ব্যাখ্যা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ এই প্রেরণাদায়ীর কিছুটা ‘আভা’ দেখেন। অর্থাৎ কিছুটা চেতনায় সরাসরি প্রতিফলিত হয়। কিছুটা আবার পরিস্কার না বোঝার কারণে ‘অনুমান’ করে নিতে হয়। আর কিছুটা একেবারেই বোঝা যায় না। সত্যিই দারুণ। মানবিক বোধবুদ্ধির প্রতি চূড়ান্ত সম্মান রেখে করা অভিব্যক্তি। এখানেই গ্রিক দেবী মিউজের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণাদায়ীর পার্থক্য। মিউজ দেবী হয়ে মানবিক বোধবুদ্ধির ঊর্ধে চলে গেছেন। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের ‘গোপনবাসী’ মানবিক বোধবুদ্ধির কাছে যেভাবে ধরা দেয়ার কথা ঠিক সেভাবেই ধরা দিয়েছেন। কিছুটা সরাসরি চেতনায় চমকে ওঠে, কিছুটা অনুমান করে নিতে হয় আর কিছুটা বোঝাই যায় না। মানবিক চেতনার সাথে নিবিড়ভাবে মিলপূর্ণ। অদ্ভুত সুন্দর!

মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,

এখানেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবিক সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে যেসব ভাব অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেন সেগুলো কি এই গোপনবাসীরই বার্তা? তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত নন, তাই বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে...’ এখানে তিনি তার পাঠক/শ্রোতকেই যেন জিজ্ঞেস করছেন যে, তার সৃষ্টিকর্মগুলো সেই গোপনবাসীর বার্তা হওয়া সম্ভব কিনা।

ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে বারে বারে ॥

শেষ চরণটির ‘জানি’ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক। গোপনবাসী তাকে বাণী পাঠায় এ ব্যাপারে তিনি কি নিশ্চিত জানেন? তাই বললেন, ‘ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী?’ আমার ধারণা এখানে ‘জানি’ শব্দটি ‘যেন’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ অভিব্যক্তিটি হবে- ‘আমার মনে হয় যেন সে আমাকে বার্তা পাঠায়।’ ‘যেন’ বুঝাতে ‘জানি’ শব্দের ব্যবহার নতুন কিংবা অপ্রচলিতও নয়। এই চরণে কবি বলছেন, আমার মনে হয় যেন গোপনবাসী নিজেকে লুকিয়ে রেখে আমার কাছে তার বাণী গানের সুর আকারে পাঠিয়ে দেয়। ‘লুকিয়ে তারে’ অর্থ ‘নিজেকে লুকিয়ে রেখে’। গোপনবাসী নিজেকে লুকিয়ে রেখে শুধু বাণীটুকু গানের সুর আকারে পাঠিয়ে দেয়।

হে ক্ষণিকের অতিথি

‘হে ক্ষণিকের অতিথি, / এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া’- হারানো প্রেমের বেদনায় বিদগ্ধ নারীর জীবনে হঠাৎ করেই যখন নতুন কোনো প্রেমের আহ্বান আসে তখন তার মনের যে জটিল অবস্থা সেটাই বর্ণিত হয়েছে এ গানে। এই জটিল অবস্থাটি মানব জীবনে অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্রেক-আপ আর নতুন করে প্রেমের আগমন শুধু ইদানীংকালের বিষয় নয়। কারো কারো জীবনে এটি আগেও ঘটতো- এখনো যেমন প্রায়ই ঘটে। তবে, রবীন্দ্রনাথ এই ‘ব্রেক-আপ আর নতুন ক্রাশ’- বিষয়টিকে একটি চিরন্তন রূপ দিয়েছেন। ক্ল্যাসিক মাত্রায় নিয়ে গেছেন।

বিদগ্ধহৃদয় কোনো নারীর জীবনে যখন কেউ নতুনভাবে প্রেমের আবাহন নিয়ে আসে তখন অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সে নারীর মনে প্রথমেই হারানোর আশঙ্কা জাগে। তার পোড় খাওয়া জীবনে প্রেম থেকে পাওয়ার চাইতে হারানোর প্রস্তুতিই বেশি থাকে। নতুন প্রেম যদিও একটি ‘প্রভাত’ বয়ে আনে, নতুন এই প্রভাতের আলোয় অতীতের বিষণœতাময় অন্ধকার রাত্রিযাপনের অবসান হয়। সবকিছু নতুনভাবে শুরু করার আশা জাগে। তব্ওু প্রেমকে আবার হারানোর আশঙ্কাটি পুরোপুরি দূর হয় না। তাই নারীর জীবনে আগন্তুক হয়ে আসা এই নতুন প্রেমিকটিকে নারীর কাছে ‘ক্ষণিকের অতিথি’ বলেই আশঙ্কা হয়। নারী এই আগন্তুককে ঠিক অতিথির মতোই সম্মান আর আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে নিচ্ছে কিন্তু তার মনে আবার ভয় জাগে শেষ পর্যন্ত ইনি ‘ক্ষণিকের অতিথি’ হতে পারেন। হয়ত কোনো কারণে এই প্রেমটিও না টিকতে পারে। তাই এই নারীর মনে প্রেমের সহজাত আকাক্সক্ষাটি শুধু আছে কিন্তু কোনো মোহ নেই। আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটিকে বেঁধে ফেলার বা দখল করার ইচ্ছা তার নেই। নারীটি একথাও জানে যে, হয়তবা পুরুষটি তাকে তার নিজের কারণে ভালোবাসতে চায় এমন নয়, হয়ত পুরুষটি তার মধ্যে তার হারানো প্রেমের ছায়া খুঁজতে চায় তাই তাকে ভালোবাসে। ফলে নারীটি বলছে ‘তুমি আমার মধ্যে তোমার হারানো প্রেমিকার ছায়া খুঁজতে চাও কিনা আমি জানিনা’ তাই তার প্রশ্ন- ‘এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া।’ তুমি আমার মধ্যে কাকে দেখতে চাও? তবে নারীটি প্রেমিক পুরুষ কর্তৃক তার মধ্যে ‘অন্য কারো ছায়া’ দেখতে চাওয়ার বিষয়টিকে দোষারোপ করছে না। বরং মানুষের জীবনে এমনটি হতেই পারে ভেবে সহমর্মিতার সাথে তা মেনে নিচ্ছে।

ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া ॥

এই নারী মনে করেছেন আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটিও খুব সম্ভবত ‘ঝরা শেফালির’ পথ বেয়ে এসেছেন। বাংলা সাহিত্যে ব্যর্থ প্রেমের প্রতীক হিসেবে ঝরে যাওয়া ফুলের উপমা বহুল পরিচিত। সে হিসেবে প্রেমিক পুরুষটি ‘ঝরা শেফালি’র পথ বেয়ে এসেছে- এ অনুমানের অর্থ হলো, আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটিরও ব্যর্থ প্রেমের অতীত ইতিহাস থাকতে পারে। এই নারীর জীবনে যেমন অতীতের ব্যর্থ প্রেম আছে পুরুষটির জীবনেও তা থাকা অসম্ভব নয়। নারীটি এই অনুমান করে নিচ্ছে এবং প্রেমিকের অতীত ব্যর্থ প্রেমকে জীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে গণ্য করছে।

কোন্ অমরার বিরহিণীরে চাহ নি ফিরে,

এই নারী ধরে নিচ্ছে যে, আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটি হয়ত তার জীবনে এমন কোনো নারীকে ফিরিয়ে দিয়েছে যে নারী তাকে একান্ত করে চাইতো, যে নারী তাকে একতরফাভাবে ভালোবাসতো। অমরা হলো স্বর্গ। তো ‘স্বর্গের কোনো নারী’র অর্থাৎ নিষ্পাপ কোনো নারীর নিষ্কলুষ প্রথম প্রেমকে অস্বীকার করে চলে এসেছিল এই পুরুষ। অথবা পরিস্থিতির কারণে, কিংবা যেকোনো কারণেই হোক এই পুরুষটি সেই নিস্পাপ নারীর প্রথম প্রেমকে গ্রহণ করতে পারেনি, তার দিকে ফিরে তাকানো সম্ভব হয়নি।

কার বিষাদের শিশিরনীরে এলে নাহিয়া ॥

আবার হয়তবা, এই পুরুষটি অতীতে এমন কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করেছিল যে, নারীটি আবার এই পুরুষের প্রেম গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে এই পুরুষটি ‘বিষাদগ্রস্ত’ সময় পার করেছে, হয়তবা সেই কষ্টে অশ্রুপাতও করেছে। শিশির হলো জলবিন্দু, আর নীর হলো জল। যাহোক, শিশিরনীর বলতে এখানে চোখের জলকে বুঝানো হয়েছে। এই পুরুষটি হয়তো অতীতে কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে চোখের জলে নিজের কষ্ট বিসর্জন দিয়েছে।

এভাবে, এখানে মানব জীবনে প্রেম নামক আবেগটিকে বিভিন্ন মাত্রায়, নারী ও পুরুষ উভয়ের তরফ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মানুষের জীবনে প্রেম আসে স্বাভাবিকভাবেই। শুধু আসে না, মাঝেমাঝে চলেও যায়। এটাই স্বাভাবিক। প্রেমের এই আবেগ মানুষকে উদ্বেলিত করে যেমন কষ্টও দেয় তেমন। প্রেম চাইলেই যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি আবার চাইলেই সব প্রেমে সাড়া দেওয়া যায় না। মানুষের জীবনে প্রেম ছক বেঁধে আসে না। এই গানে উল্লিখিত নারীটি মানব জীবনে প্রেমের এই ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন। তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে যে, প্রেমে মোহ থাকলে সে প্রেম দুঃখ দেয়। মোহবিহীন প্রেমই সত্যিকারের প্রেম। আর ‘বিরহ’ই হলো প্রেমের আসল রস, ‘মিলন’ নয়।

ওগো অকরুণ, কী মায়া জানো,

মিলনছলে বিরহ আনো।

আপন করে না পাওয়ার আকুতিটিই প্রেমের আসল শক্তি। দু’জন নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রেমে পড়লে যদিও মনে হয় তাদের উভয়ের মনের মিলন ঘটলো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বিরহ বাড়িয়ে দেয়। মিলন এর আড়ালে বিরহ বাড়িয়ে দেয়। পরস্পরকে আরও নিবিড়ভাবে জানার ইচ্ছা যেন শেষ হয় না। না পাওয়ার বোধটি পীড়া দিতে থাকে। এখানে প্রেমিক পুরুষটিকে ‘অকরুণ’ বা নিষ্ঠুর বলা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, গানের এই পর্যায়ে এসে এই প্রেমিক পুরুষ বা ‘অকরুণ’ শেষ পর্যন্ত আর কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি থাকেন না, এখানে তিনি প্রেমের দেবতা স্বয়ং। এই অকরুণ প্রেমের দেবতা যুগে যুগে মানব মানবীর মনে প্রেমের তীর নিক্ষেপ করে চলেছেন। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছেন। প্রেম নামের এই কাঙ্খিত বস্তুটি মানুষের মনে বরং না পাওয়ার বেদনা বা বিরহই জাগিয়ে দেয় বেশি। তারপরও যুগে যুগে মানব-মানবী নতুন প্রেমে সাড়া না দিয়ে পারেনি। রক্তাক্ত হয়েও প্রেমের আবেগ তার পথ চলা থামিয়ে দেয় না। নানা ঘটনায় সে জীবনে নতুন করে আবার দেখা দেয়, আশা জাগায়, হতাশ জীবনকে নতুনভাবে আলোর সন্ধান দেয়, কর্মব্যস্ততার পথে পথে, জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রেম নতুন নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়।

চলেছ পথিক আলোকযানে আঁধার-পানে

মনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া ॥

‘চলেছ পথিক’-এর এই ‘পথিক’ হলো মানব-মানবীর চিরন্তন ‘প্রেমাকাক্সক্ষা’। সেই হিসেবে প্রেমের দেবী/দেবতা। ভাঙ্গা-গড়া, ব্রেক-আপ আর নতুন ক্রাশ নিয়ে মানব মানবীর এই চিরন্তন প্রেমাকাক্সক্ষা মহাকালের পথ ধরে যুগ থেকে যুগান্তরে বয়ে চলেছে। প্রেমের পথে না পাওয়া, ব্যর্থতা সত্ত্বেও মানুষ প্রেম নামের ‘আলো’ সাথে নিয়ে অজানা কোনো সম্পর্কের ‘অন্ধকার’ পথে এগিয়ে চলে। এখানে ‘আঁধার পানে’ অর্থ অজানার পথে। এই যে প্রেমের দেবী/দেবতা তিনি ‘আলোকযানে’ বা আলোর তৈরি বাহনে চড়ে ‘আঁধার পানে’ বা অজানা ও অনির্ণেয় ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেন। প্রেমের প্রতিটি সম্পর্ক মানে তা-ই। পরস্পর অচেনা দুজন নরনারী তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত পরিণতি না জানা সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রেম এর শক্তি বা ‘আলো’কে সম্বল করে আঁধার পানে অজানার পথে এগিয়ে যেতে থাকে।

এই আলোচনায় উদারহণ দেওয়ার জন্য যদিও ‘ব্রেক-আপ আর নতুন ক্রাশ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তবুও ‘ব্রেক-আপ’ ‘ক্রাশ’ এ শব্দগুলো যে অর্থ বহন করে তার সাথে মানব-মানবীর চিরন্তন প্রেমের আকাক্সক্ষার কমই সম্পর্ক রয়েছে। এখন তো চলছে ক্রাশ এর যুগ। মনের মধ্যে একটু ভালোলাগা, একটু আবেগ সাড়া দিলো কি দিলো না অমনি ক্রাশ হয়ে গেল। এমন অদূরদর্শী বা দায়িত্বহীন প্রেমের কথা বলা হয়নি এই গানে। এ গানের প্রকৃত অর্থ হয়তো প্রেম বিষয়ে একালের মানসিকতার সাথে পুরোপুরি যায় না। কিন্তু শেষ বিচারে গানটির বাণী ক্ল্যাসিক।

বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৩ , ০৫ মাঘ ১৪২৯, ২৬ জমাদিউল সানি ১৪৪৪

রবীন্দ্রবোধন

ফিরোজ আহমেদ

image

আমি কান পেতে রই

‘আমি কান পেতে রই / ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে’ এই গানটির মর্ম অনুধাবন করতে আমরা প্রতিটি চরণের মূল শব্দের (কবু ড়িৎফং) দিকে নজর দেব। গানটি মূলত একজন কবি, সাহিত্যিক বা সৃজনশীল শিল্পীসত্তার চেতনাকে বিবৃত করে। প্রত্যেক শিল্প¯্রষ্টারই থাকে নিজের নিগূঢ় চেতনাকে ধরবার চেষ্টা। নিজের অন্তর্জগতে কী ভাব খেলা করে যায় সেসবকে অনুসরণ করার চেষ্টাই শিল্পীর আসল লক্ষ্য। কিন্তু শিল্পীমনের গভীরতা এত বেশি যে সেখানে ঠিক পুরোপুরি প্রবেশ করে সারা যায় না। তাইতো রবীন্দ্রনাথ শুধু তার ‘আপন হৃদয়গহন-দ্বারে’ কান পেতে শোনার চেষ্টা করেন। হৃদয়ের গহীন অঞ্চলের ভাবকে সীমান্তে বা দুয়ারে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করেন।

কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে- বারে বারে ॥

হৃদয়ের গভীরে যে সত্তা বাস করে তিনি একজন ‘গোপনবাসী’ (গোপনে বাস করেন যিনি = গোপনবাসী)। সেই গোপনবাসীর কথা শুনতেই হৃদয়ের গহনদ্বারে কান পেতে থাকতে হয়। এই গোপনবাসীর কী কথা শুনতে চান রবীন্দ্রনাথ? ‘কান্নাহাসির গোপন কথা’ শুনতে চান। এই গানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কী-ওয়ার্ড এটি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যকর্মে বিশ্বমানবের, বিশেষত বাঙালি নর-নারীর একান্ত আবেগ অনুভূতিগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে চান। তাই এই ‘গোপনবাসী’ আসলে বাঙালি নর-নারীর প্রতিনিধি বা পার্সনিফিকেশন। আর এই গোপনবাসীর ‘কান্নাহাসি’ হলো বাঙালি নর-নারীর সুখ-দুঃখের বিচিত্র অনুভূতিগুলো।

বাংলা ভাষার কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি নর-নারীর প্রতিভূ এই গোপনবাসীকেই তাঁর সাহিত্য রচনার প্রেরণা হিসেবে অন্তরে গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং ‘গোপনবাসীর কান্নাহাসি’কেই তার সকল রচনার উপজীব্য করে তুলতে চান। ফলে, তিনি বারবার এই গোপনবাসীর কান্নাহাসি শোনার চেষ্টায় থাকেন যাতে তাঁর লেখালেখিতে সেই কান্নাহাসি তুলে ধরতে পারেন।

ভ্রমর সেথা হয় বিবাগি নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,

এই চরণে ‘ভ্রমর’ এবং ‘নিভৃত নীলপদ্ম’ গুরুত্বপূর্ণ দু’টি শব্দ। রবীন্দ্রনাথ তার অন্তরের ‘গোপনবাসীর কান্নাহাসি’ শোনার জন্য কতটা মনোযোগী, অনুসন্ধানী ও ব্যাকুল হয়ে থাকেন তা এখানে প্রকাশ পেয়েছে। শিল্পীকে অবশ্যই তার ‘প্রেরণা’কে সশ্রম প্রচেষ্টায় অনুসরণ করতে হয়। ভ্রমর যেমন সবকিছু ছেড়ে ফুলের সন্ধানে আকুল হয়ে বেড়ায়। রবীন্দ্রনাথও ঠিক একটা ভ্রমরের মতো ‘বিবাগী’ হয়ে বা জগত সংসারের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ‘নীলপদ্ম’ খুঁজতে থাকেন।

এখানে ‘নীলপদ্ম’ কথাটি শিল্পসৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষাকে ব্যাখ্যা করে। ‘নীলপদ্ম’ হলো ‘সৃষ্টিযন্ত্রণা’ বা পৎবধঃরাব ুবধষ। প্রত্যেক শিল্পীই ভ্রমর হয়ে নীলপদ্মর সন্ধানে থাকেন। ভ্রমর তো ফুল খুঁজবেই। সাধারণ ভ্রমর সাধারণ ফুলেই সন্তুষ্ট থাকে কিন্তু একজন শিল্পী-ভ্রমর নীলপদ্ম খোঁজে। নীলপদ্ম হলো বিরল জাতের ফুল যা সহসা দেখা যায় না। অর্থাৎ শিল্পীকে এমন নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয় যা আগে খুব বেশি দেখা যায়নি। শিল্পীকে যে নতুন ভাব বা অনুভূতি সৃষ্টি করতে হবে তা নয়। কমপক্ষে উপস্থাপন, শৈলী ইত্যাদি তো নতুন বা অনন্য হতেই হয়। না তা হলে সেই শিল্প অনুকরণ দোষে দুষ্ট হবে, পাঠক গ্রহণ করবে না। তাই রবীন্দ্রনাথ জগত সংসারের কাজকর্ম ছেড়ে বিবাগী হয়ে ‘নিভৃত নীলপদ্ম’র সন্ধানে থাকেন। একে তো নীলপদ্ম তার উপর আবার নিভৃত। অর্থাৎ এমন নীলপদ্ম যা সকলের অগোচরে নিভৃতে ফুটে আছে, কেউ সেটিকে এখনও দেখেনি কিংবা স্পর্শ করেনি। তিনি এমন নীলপদ্মই তুলে এনে পাঠকের সামনে হাজির করতে চান। সৃজনশীল সকল শিল্পীরই একান্ত চাওয়া হলো- পাঠককে ‘নিভৃত নীলপদ্ম’ উপহার দেওয়া। শিল্পীসত্তার মনের জ্বালা বা সৃষ্টিযন্ত্রণা হলো এই নীলপদ্মর সন্ধান।

কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে ॥

এই চরণে গোপনবাসীর কান্নাহাসিকে নিঃসঙ্গ রাতের পাখির সাথে তুলনা করা হয়েছে। আসলে শিল্পীমনের সৃজনশীলতা শিল্পীকে বারবার প্ররোচিত করে শিল্পসৃষ্টি করার জন্য। রাতের অন্ধকারে নিরন্তর গীত হওয়া পাখির গানের মতো তার মনকে তাড়িত করে। এই তাড়না ঠিক চেতন মন থাকে আসে না, আসে অবচেতন থেকে। তাই পাখিটি যেন দিনের আলোতে গান গায় না। রাতের অন্ধকারে অবচেতনার গহীন স্তর থেকে গাইতে থাকে।

কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা।

কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।

এখানে এসে রবীন্দ্রনাথ গোপনবাসীর সাথে তাঁর নিজের সম্পর্ক নির্ণয় করতে চাইছেন। বিভিন্ন ভাষায় শিল্পসাহিত্যের প্রেরণাদায়ী দেব-দেবীর ধারণা রয়েছে। যেমন: গ্রিক সাহিত্যের মিউজ। রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন হৃদয়ের গহীনে বাস করে যিনি বাঙালির আবেগ-অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া করে চলেছেন তিনি কে? তার সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা কী? এটা কি দেবী আর ভক্তর সম্পর্ক? যাহোক, রবীন্দ্রনাথ এই গোপনবাসীকে গ্রিক সাহিত্যের মিউজ এর মতো কেনো দেবীর আসন দেননি। শিল্পসৃষ্টির প্রেরণাদায়ী এই গোপন সত্তাটিকে রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ এটিকে মিউজ এর মতো কোনো দেবী ভাবেননি বরং রহসম্যয় এক প্রেরণা হিসেবেই দেখেছেন এবং সেই প্রেরণাকে তিনটি স্তরে ব্যাখ্যা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ এই প্রেরণাদায়ীর কিছুটা ‘আভা’ দেখেন। অর্থাৎ কিছুটা চেতনায় সরাসরি প্রতিফলিত হয়। কিছুটা আবার পরিস্কার না বোঝার কারণে ‘অনুমান’ করে নিতে হয়। আর কিছুটা একেবারেই বোঝা যায় না। সত্যিই দারুণ। মানবিক বোধবুদ্ধির প্রতি চূড়ান্ত সম্মান রেখে করা অভিব্যক্তি। এখানেই গ্রিক দেবী মিউজের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণাদায়ীর পার্থক্য। মিউজ দেবী হয়ে মানবিক বোধবুদ্ধির ঊর্ধে চলে গেছেন। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের ‘গোপনবাসী’ মানবিক বোধবুদ্ধির কাছে যেভাবে ধরা দেয়ার কথা ঠিক সেভাবেই ধরা দিয়েছেন। কিছুটা সরাসরি চেতনায় চমকে ওঠে, কিছুটা অনুমান করে নিতে হয় আর কিছুটা বোঝাই যায় না। মানবিক চেতনার সাথে নিবিড়ভাবে মিলপূর্ণ। অদ্ভুত সুন্দর!

মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,

এখানেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবিক সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে যেসব ভাব অনুভূতি তিনি ব্যক্ত করেন সেগুলো কি এই গোপনবাসীরই বার্তা? তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত নন, তাই বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে...’ এখানে তিনি তার পাঠক/শ্রোতকেই যেন জিজ্ঞেস করছেন যে, তার সৃষ্টিকর্মগুলো সেই গোপনবাসীর বার্তা হওয়া সম্ভব কিনা।

ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে বারে বারে ॥

শেষ চরণটির ‘জানি’ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক। গোপনবাসী তাকে বাণী পাঠায় এ ব্যাপারে তিনি কি নিশ্চিত জানেন? তাই বললেন, ‘ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী?’ আমার ধারণা এখানে ‘জানি’ শব্দটি ‘যেন’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ অভিব্যক্তিটি হবে- ‘আমার মনে হয় যেন সে আমাকে বার্তা পাঠায়।’ ‘যেন’ বুঝাতে ‘জানি’ শব্দের ব্যবহার নতুন কিংবা অপ্রচলিতও নয়। এই চরণে কবি বলছেন, আমার মনে হয় যেন গোপনবাসী নিজেকে লুকিয়ে রেখে আমার কাছে তার বাণী গানের সুর আকারে পাঠিয়ে দেয়। ‘লুকিয়ে তারে’ অর্থ ‘নিজেকে লুকিয়ে রেখে’। গোপনবাসী নিজেকে লুকিয়ে রেখে শুধু বাণীটুকু গানের সুর আকারে পাঠিয়ে দেয়।

হে ক্ষণিকের অতিথি

‘হে ক্ষণিকের অতিথি, / এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া’- হারানো প্রেমের বেদনায় বিদগ্ধ নারীর জীবনে হঠাৎ করেই যখন নতুন কোনো প্রেমের আহ্বান আসে তখন তার মনের যে জটিল অবস্থা সেটাই বর্ণিত হয়েছে এ গানে। এই জটিল অবস্থাটি মানব জীবনে অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্রেক-আপ আর নতুন করে প্রেমের আগমন শুধু ইদানীংকালের বিষয় নয়। কারো কারো জীবনে এটি আগেও ঘটতো- এখনো যেমন প্রায়ই ঘটে। তবে, রবীন্দ্রনাথ এই ‘ব্রেক-আপ আর নতুন ক্রাশ’- বিষয়টিকে একটি চিরন্তন রূপ দিয়েছেন। ক্ল্যাসিক মাত্রায় নিয়ে গেছেন।

বিদগ্ধহৃদয় কোনো নারীর জীবনে যখন কেউ নতুনভাবে প্রেমের আবাহন নিয়ে আসে তখন অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সে নারীর মনে প্রথমেই হারানোর আশঙ্কা জাগে। তার পোড় খাওয়া জীবনে প্রেম থেকে পাওয়ার চাইতে হারানোর প্রস্তুতিই বেশি থাকে। নতুন প্রেম যদিও একটি ‘প্রভাত’ বয়ে আনে, নতুন এই প্রভাতের আলোয় অতীতের বিষণœতাময় অন্ধকার রাত্রিযাপনের অবসান হয়। সবকিছু নতুনভাবে শুরু করার আশা জাগে। তব্ওু প্রেমকে আবার হারানোর আশঙ্কাটি পুরোপুরি দূর হয় না। তাই নারীর জীবনে আগন্তুক হয়ে আসা এই নতুন প্রেমিকটিকে নারীর কাছে ‘ক্ষণিকের অতিথি’ বলেই আশঙ্কা হয়। নারী এই আগন্তুককে ঠিক অতিথির মতোই সম্মান আর আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে নিচ্ছে কিন্তু তার মনে আবার ভয় জাগে শেষ পর্যন্ত ইনি ‘ক্ষণিকের অতিথি’ হতে পারেন। হয়ত কোনো কারণে এই প্রেমটিও না টিকতে পারে। তাই এই নারীর মনে প্রেমের সহজাত আকাক্সক্ষাটি শুধু আছে কিন্তু কোনো মোহ নেই। আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটিকে বেঁধে ফেলার বা দখল করার ইচ্ছা তার নেই। নারীটি একথাও জানে যে, হয়তবা পুরুষটি তাকে তার নিজের কারণে ভালোবাসতে চায় এমন নয়, হয়ত পুরুষটি তার মধ্যে তার হারানো প্রেমের ছায়া খুঁজতে চায় তাই তাকে ভালোবাসে। ফলে নারীটি বলছে ‘তুমি আমার মধ্যে তোমার হারানো প্রেমিকার ছায়া খুঁজতে চাও কিনা আমি জানিনা’ তাই তার প্রশ্ন- ‘এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া।’ তুমি আমার মধ্যে কাকে দেখতে চাও? তবে নারীটি প্রেমিক পুরুষ কর্তৃক তার মধ্যে ‘অন্য কারো ছায়া’ দেখতে চাওয়ার বিষয়টিকে দোষারোপ করছে না। বরং মানুষের জীবনে এমনটি হতেই পারে ভেবে সহমর্মিতার সাথে তা মেনে নিচ্ছে।

ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া ॥

এই নারী মনে করেছেন আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটিও খুব সম্ভবত ‘ঝরা শেফালির’ পথ বেয়ে এসেছেন। বাংলা সাহিত্যে ব্যর্থ প্রেমের প্রতীক হিসেবে ঝরে যাওয়া ফুলের উপমা বহুল পরিচিত। সে হিসেবে প্রেমিক পুরুষটি ‘ঝরা শেফালি’র পথ বেয়ে এসেছে- এ অনুমানের অর্থ হলো, আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটিরও ব্যর্থ প্রেমের অতীত ইতিহাস থাকতে পারে। এই নারীর জীবনে যেমন অতীতের ব্যর্থ প্রেম আছে পুরুষটির জীবনেও তা থাকা অসম্ভব নয়। নারীটি এই অনুমান করে নিচ্ছে এবং প্রেমিকের অতীত ব্যর্থ প্রেমকে জীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে গণ্য করছে।

কোন্ অমরার বিরহিণীরে চাহ নি ফিরে,

এই নারী ধরে নিচ্ছে যে, আগন্তুক প্রেমিক পুরুষটি হয়ত তার জীবনে এমন কোনো নারীকে ফিরিয়ে দিয়েছে যে নারী তাকে একান্ত করে চাইতো, যে নারী তাকে একতরফাভাবে ভালোবাসতো। অমরা হলো স্বর্গ। তো ‘স্বর্গের কোনো নারী’র অর্থাৎ নিষ্পাপ কোনো নারীর নিষ্কলুষ প্রথম প্রেমকে অস্বীকার করে চলে এসেছিল এই পুরুষ। অথবা পরিস্থিতির কারণে, কিংবা যেকোনো কারণেই হোক এই পুরুষটি সেই নিস্পাপ নারীর প্রথম প্রেমকে গ্রহণ করতে পারেনি, তার দিকে ফিরে তাকানো সম্ভব হয়নি।

কার বিষাদের শিশিরনীরে এলে নাহিয়া ॥

আবার হয়তবা, এই পুরুষটি অতীতে এমন কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করেছিল যে, নারীটি আবার এই পুরুষের প্রেম গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে এই পুরুষটি ‘বিষাদগ্রস্ত’ সময় পার করেছে, হয়তবা সেই কষ্টে অশ্রুপাতও করেছে। শিশির হলো জলবিন্দু, আর নীর হলো জল। যাহোক, শিশিরনীর বলতে এখানে চোখের জলকে বুঝানো হয়েছে। এই পুরুষটি হয়তো অতীতে কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে চোখের জলে নিজের কষ্ট বিসর্জন দিয়েছে।

এভাবে, এখানে মানব জীবনে প্রেম নামক আবেগটিকে বিভিন্ন মাত্রায়, নারী ও পুরুষ উভয়ের তরফ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মানুষের জীবনে প্রেম আসে স্বাভাবিকভাবেই। শুধু আসে না, মাঝেমাঝে চলেও যায়। এটাই স্বাভাবিক। প্রেমের এই আবেগ মানুষকে উদ্বেলিত করে যেমন কষ্টও দেয় তেমন। প্রেম চাইলেই যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি আবার চাইলেই সব প্রেমে সাড়া দেওয়া যায় না। মানুষের জীবনে প্রেম ছক বেঁধে আসে না। এই গানে উল্লিখিত নারীটি মানব জীবনে প্রেমের এই ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন। তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে যে, প্রেমে মোহ থাকলে সে প্রেম দুঃখ দেয়। মোহবিহীন প্রেমই সত্যিকারের প্রেম। আর ‘বিরহ’ই হলো প্রেমের আসল রস, ‘মিলন’ নয়।

ওগো অকরুণ, কী মায়া জানো,

মিলনছলে বিরহ আনো।

আপন করে না পাওয়ার আকুতিটিই প্রেমের আসল শক্তি। দু’জন নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রেমে পড়লে যদিও মনে হয় তাদের উভয়ের মনের মিলন ঘটলো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বিরহ বাড়িয়ে দেয়। মিলন এর আড়ালে বিরহ বাড়িয়ে দেয়। পরস্পরকে আরও নিবিড়ভাবে জানার ইচ্ছা যেন শেষ হয় না। না পাওয়ার বোধটি পীড়া দিতে থাকে। এখানে প্রেমিক পুরুষটিকে ‘অকরুণ’ বা নিষ্ঠুর বলা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, গানের এই পর্যায়ে এসে এই প্রেমিক পুরুষ বা ‘অকরুণ’ শেষ পর্যন্ত আর কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি থাকেন না, এখানে তিনি প্রেমের দেবতা স্বয়ং। এই অকরুণ প্রেমের দেবতা যুগে যুগে মানব মানবীর মনে প্রেমের তীর নিক্ষেপ করে চলেছেন। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছেন। প্রেম নামের এই কাঙ্খিত বস্তুটি মানুষের মনে বরং না পাওয়ার বেদনা বা বিরহই জাগিয়ে দেয় বেশি। তারপরও যুগে যুগে মানব-মানবী নতুন প্রেমে সাড়া না দিয়ে পারেনি। রক্তাক্ত হয়েও প্রেমের আবেগ তার পথ চলা থামিয়ে দেয় না। নানা ঘটনায় সে জীবনে নতুন করে আবার দেখা দেয়, আশা জাগায়, হতাশ জীবনকে নতুনভাবে আলোর সন্ধান দেয়, কর্মব্যস্ততার পথে পথে, জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রেম নতুন নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়।

চলেছ পথিক আলোকযানে আঁধার-পানে

মনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া ॥

‘চলেছ পথিক’-এর এই ‘পথিক’ হলো মানব-মানবীর চিরন্তন ‘প্রেমাকাক্সক্ষা’। সেই হিসেবে প্রেমের দেবী/দেবতা। ভাঙ্গা-গড়া, ব্রেক-আপ আর নতুন ক্রাশ নিয়ে মানব মানবীর এই চিরন্তন প্রেমাকাক্সক্ষা মহাকালের পথ ধরে যুগ থেকে যুগান্তরে বয়ে চলেছে। প্রেমের পথে না পাওয়া, ব্যর্থতা সত্ত্বেও মানুষ প্রেম নামের ‘আলো’ সাথে নিয়ে অজানা কোনো সম্পর্কের ‘অন্ধকার’ পথে এগিয়ে চলে। এখানে ‘আঁধার পানে’ অর্থ অজানার পথে। এই যে প্রেমের দেবী/দেবতা তিনি ‘আলোকযানে’ বা আলোর তৈরি বাহনে চড়ে ‘আঁধার পানে’ বা অজানা ও অনির্ণেয় ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেন। প্রেমের প্রতিটি সম্পর্ক মানে তা-ই। পরস্পর অচেনা দুজন নরনারী তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত পরিণতি না জানা সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রেম এর শক্তি বা ‘আলো’কে সম্বল করে আঁধার পানে অজানার পথে এগিয়ে যেতে থাকে।

এই আলোচনায় উদারহণ দেওয়ার জন্য যদিও ‘ব্রেক-আপ আর নতুন ক্রাশ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তবুও ‘ব্রেক-আপ’ ‘ক্রাশ’ এ শব্দগুলো যে অর্থ বহন করে তার সাথে মানব-মানবীর চিরন্তন প্রেমের আকাক্সক্ষার কমই সম্পর্ক রয়েছে। এখন তো চলছে ক্রাশ এর যুগ। মনের মধ্যে একটু ভালোলাগা, একটু আবেগ সাড়া দিলো কি দিলো না অমনি ক্রাশ হয়ে গেল। এমন অদূরদর্শী বা দায়িত্বহীন প্রেমের কথা বলা হয়নি এই গানে। এ গানের প্রকৃত অর্থ হয়তো প্রেম বিষয়ে একালের মানসিকতার সাথে পুরোপুরি যায় না। কিন্তু শেষ বিচারে গানটির বাণী ক্ল্যাসিক।