কোন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি

চীনে এপর্যন্ত ৩৬১ জনের মৃত্যু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়াচ্ছে ১৭ দেশে শনাক্ত চীন থেকে আসা বিমানের পাইলট ও ক্রুকে অন্য দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না

যত দিন গড়াচ্ছে চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস ক্রমেই বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এতে আতঙ্ক বাড়ছে বাংলাদেশেও। যদিও এখন পর্যন্ত চীন বা বাংলাদেশে কোন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এরইমধ্যে এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহান থেকে তিন শতাধিক বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এদের মধ্যে সন্দেহজনক আটজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পরীক্ষা করে তাদের দেহে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি বলে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যাদের দেহে তাপমাত্রা বেশি থাকায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭ জনকে পরীক্ষা শেষে রাজধানীর আশকোনা হজ ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। ওহান থেকে ফিরে আসা অন্যদের আশকোনা হজ ক্যাম্পে ১৪ দিনের জন্য পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এদিকে, করোনাভাইরাস যেন বাংলাদেশে না ছড়িয়ে পড়ে সেজন্য বিশেষ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে এক বিশেষ বৈঠকে করে তিনি বেশ কয়েকটি জরুরি নির্দেশ দিয়েছেন।

চীন থেকে যারা বাংলাদেশে আসছে তাদের যে কেউ বয়ে নিয়ে আসতে পারেন করোনাভাইরাস। তাই ভাইরাস ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত কেউ যেন দেশে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে বন্দরে বন্দরে কড়া নজরদারি রাখা হয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা ৫ হাজার ৯৫২ জনকে স্ক্যানিং করা হয়েছে। এরমধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৬২৩ জনকে স্ক্যানিং করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়। এছাড়া জরুরি দরকার ছাড়া চীন ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। আর দরকার ছাড়া চীনের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। নোবেল করোনাভাইরাস বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ঢাকায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) চারটি হটলাইন চালু করেছে। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে জানতে নিম্নোক্ত হটলাইনগুলোতে ফোন করা যাবে। হটলাইনগুলো হচ্ছে : ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯২৭৭১১৭৮৪ ও ০১৯২৭৭১১৭৮৫।

গত ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে। প্রতিনিয়ত এই ভাইরাসে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে শ্বাসকষ্ট, জ্বর, সর্দি, কাশির মতো সমস্যা দেখা দেয়। এরইমধ্যে অন্তত ১৭টি দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। চীনের প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬১ জনে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রোববার যারা মারা গেছেন তাদের ৫৬ জনই ভাইরাসটির উৎসস্থল হুবেই প্রদেশের। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮২৯ জন। মোট ১৭ হাজার ২০৫ জন এখন প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত।

চীনের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশি ভারতেও এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের আতঙ্ক এখন কড়া নাড়ছে বাংলাদেশে। এই ভাইরাসের বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মধ্যে ঢাকার একটি হাসপাতালে সর্দিজ্বর নিয়ে এক চীনের নাগরিক ভর্তি হলে উদ্বেগ দেখা দেয়। যদিও করোনাভাইরাসে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন কি না তা স্পষ্ট ছিল না।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হল সর্দিজ্বর। এর পাশাপাশি মাথাব্যথা, কাশি, শরীরের অস্বস্তি বোধ হয়। এজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও একাধিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গতকাল মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা. মীরজহাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে জ্বর নিয়ে ভর্তি হওয়া ৮ জনের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেছে, তাদের কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়। এরমধ্যে ৭ জনকে আশকোনা কোয়াণ্টাইন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

তিনি আরও জানান, কোণ্টাইন কেন্দ্রে অবস্থানরত চীন থেকে আসা ১ যাত্রীর জ্বর দেখা দেয়ায় তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের ৩ পরিবারের শিশুসহ ৮ জনকে পর্যবেক্ষণের জন রাখা হয়েছে। আশকোনা কেতায়াণ্টাইন কেন্দ্রে অবস্থানরতদের জন্য ওয়াই-ফাই সংযোগ ও টেলিভিশন দেয়া হয়েছে। আর গতকাল পর্যন্ত মহাখালী আইইডিসিআরে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ৩৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এখনও নিশ্চিতভাবে কোন করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। আইইডিসিআর এর পরিচালক বলেন, তবে সিএমএইচ হাসপাতালে যিনি ছিলেন তিনি এখনও সেই হাসপাতালেই পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তার সঙ্গে এক বছরের সন্তান থাকায় তাকে সেখানেই রাখা হয়েছে।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া চীনের উহান থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা বাংলাদেশি পাইলটদের অন্য দেশ ঢুকতে দিচ্ছে না। তাই ভাড়া করা বিমানের মাধ্যমে চীন থেকে আরও ১৭১ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের ব্রিফিংয়ের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর স্পেশালি ২০-২৫ জন নিয়ে বসে আলোচনা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে- যেভাবেই হোক এটাকে (করোনাভাইরাস) আমাদের দেশে ঢোকা প্রতিরোধ করতে হবে। এছাড়া যারা চীনের উহান থেকে আসবে সবাইকে...উহান থেকে তো চায়না একেবারে ক্লোজ করে দিয়েছে। সুতরাং বের হতে পারবে না। তারপরও বলা হয়েছে যদি সন্দেহ হয় উহান থেকে আসছে, তাকে অবশ্যই ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। কারণ আমরা এটা নিয়ে তো রিস্ক নেব না।

এখনও ১৭১ জন ছাত্রসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ চীনে রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তারা আসতে চাচ্ছে, এটা (নিয়ে আসার বিষয়টি) দেখতে বলা হয়েছে। আমাদের প্লেন পাঠাতে একটা অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের যে প্লেনটা গেছে, আসার পর এই পাইলটদের কোন দেশ ঢুকতে দিচ্ছে না। সে জন্য আলোচনা হয়েছে যে, এক্ষেত্রে যদি ভাড়া করা কোন বিমান পাওয়া যায়, চীনের কোন ভাড়া করা বিমান যদি আনা হয় সেটা, সেটাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের প্লেন পাঠানো যাচ্ছে না। আমাদের প্লেন পাঠালে যে ক্রুরা যাবে তাদের বাইরে ভিসা দেয় না। অলরেডি সিঙ্গাপুর না করে দিয়েছে, এই ক্রুরা আমাদের এখানে আসতে পারবে না। চীন ছাড়া অন্য দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ডাবল চেকআপ করা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিশেষ করে ভায়া হয়ে যারা আসে তারা সেফটি নিয়েই আসে। কারণ ব্যাংকক ও হংকংয়ে তো খুবই স্ট্রিক। কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুর হয়ে যারা আসে তাদের তো একটা ন্যাচারাল প্রটেকশন হয়। একবার সেখানে স্ক্যানিং হয়। এজন্য আমরা প্রটেকশন পাই। তারপরও আমাদের এখানে ডাবল প্রটেকশন সিস্টেম আছে।

গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস নিয়ে করণীয় নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়ার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় করোনাভাইরাসের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর-এসওপি প্রণয়ণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. জিলন মিঞা সরকারকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক আফজালুন নেছা, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিহা হাসিন।

সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগে. জেনা. একে মাহবুবুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর-এসওপিসহ প্রতিবেদন পেশ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার, কোষাধ্যক্ষ ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, মেডিসিন অনুষদে ডিন অধ্যাপক ডা. জিলন মিঞা সরকার, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল হান্নান, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ, ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী প্রমুখ।

আরও খবর
করোনাভাইরাস রোধ করতে হবেই প্রধানমন্ত্রী
ভুল প্রশ্নপত্র সরবরাহসহ নানা জটিলতা
সরকারিভাবে আর কাউকে আনা হবে না স্বাস্থ্যমন্ত্রী
উহান থেকে ৩১২ বাংলাদেশিকে আনতে ব্যয় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা
করোনাভাইরাস চিকিৎসায় সফলতার দাবি থাই চিকিৎসকদের
অনাগত শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ কেন অবৈধ নয় : হাইকোর্ট
গ্যাটকো দুর্নীতি খালেদার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ৩ মার্চ
গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনকে দুদকে তলব
জামানত হারাবেন ৯ মেয়র প্রার্থী
বহিষ্কৃতদের নাম প্রকাশের আল্টিমেটাম
এখন থেকে বিদেশ যেতে সঙ্গে নেয়া যাবে ১০ হাজার ডলার
বিআরটিসির বাস বন্ধ করে দিয়েছে মোটর মালিক সমিতি
আ-মরি বাংলা ভাষা
ক্ষণগণনা : আর ৪১ দিন

মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ , ২১ মাঘ ১৪২৬, ৯ জমাদিউল সানি ১৪৪১

চীন ফেরত ৮ জন নিরাপদ

কোন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি

চীনে এপর্যন্ত ৩৬১ জনের মৃত্যু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়াচ্ছে ১৭ দেশে শনাক্ত চীন থেকে আসা বিমানের পাইলট ও ক্রুকে অন্য দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

যত দিন গড়াচ্ছে চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস ক্রমেই বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এতে আতঙ্ক বাড়ছে বাংলাদেশেও। যদিও এখন পর্যন্ত চীন বা বাংলাদেশে কোন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এরইমধ্যে এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহান থেকে তিন শতাধিক বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এদের মধ্যে সন্দেহজনক আটজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পরীক্ষা করে তাদের দেহে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি বলে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যাদের দেহে তাপমাত্রা বেশি থাকায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭ জনকে পরীক্ষা শেষে রাজধানীর আশকোনা হজ ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। ওহান থেকে ফিরে আসা অন্যদের আশকোনা হজ ক্যাম্পে ১৪ দিনের জন্য পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এদিকে, করোনাভাইরাস যেন বাংলাদেশে না ছড়িয়ে পড়ে সেজন্য বিশেষ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে এক বিশেষ বৈঠকে করে তিনি বেশ কয়েকটি জরুরি নির্দেশ দিয়েছেন।

চীন থেকে যারা বাংলাদেশে আসছে তাদের যে কেউ বয়ে নিয়ে আসতে পারেন করোনাভাইরাস। তাই ভাইরাস ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত কেউ যেন দেশে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে বন্দরে বন্দরে কড়া নজরদারি রাখা হয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা ৫ হাজার ৯৫২ জনকে স্ক্যানিং করা হয়েছে। এরমধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৬২৩ জনকে স্ক্যানিং করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়। এছাড়া জরুরি দরকার ছাড়া চীন ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। আর দরকার ছাড়া চীনের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। নোবেল করোনাভাইরাস বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ঢাকায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) চারটি হটলাইন চালু করেছে। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে জানতে নিম্নোক্ত হটলাইনগুলোতে ফোন করা যাবে। হটলাইনগুলো হচ্ছে : ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯২৭৭১১৭৮৪ ও ০১৯২৭৭১১৭৮৫।

গত ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে। প্রতিনিয়ত এই ভাইরাসে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে শ্বাসকষ্ট, জ্বর, সর্দি, কাশির মতো সমস্যা দেখা দেয়। এরইমধ্যে অন্তত ১৭টি দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। চীনের প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬১ জনে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রোববার যারা মারা গেছেন তাদের ৫৬ জনই ভাইরাসটির উৎসস্থল হুবেই প্রদেশের। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮২৯ জন। মোট ১৭ হাজার ২০৫ জন এখন প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত।

চীনের বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশি ভারতেও এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের আতঙ্ক এখন কড়া নাড়ছে বাংলাদেশে। এই ভাইরাসের বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মধ্যে ঢাকার একটি হাসপাতালে সর্দিজ্বর নিয়ে এক চীনের নাগরিক ভর্তি হলে উদ্বেগ দেখা দেয়। যদিও করোনাভাইরাসে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন কি না তা স্পষ্ট ছিল না।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হল সর্দিজ্বর। এর পাশাপাশি মাথাব্যথা, কাশি, শরীরের অস্বস্তি বোধ হয়। এজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও একাধিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গতকাল মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা. মীরজহাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে জ্বর নিয়ে ভর্তি হওয়া ৮ জনের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেছে, তাদের কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়। এরমধ্যে ৭ জনকে আশকোনা কোয়াণ্টাইন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

তিনি আরও জানান, কোণ্টাইন কেন্দ্রে অবস্থানরত চীন থেকে আসা ১ যাত্রীর জ্বর দেখা দেয়ায় তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের ৩ পরিবারের শিশুসহ ৮ জনকে পর্যবেক্ষণের জন রাখা হয়েছে। আশকোনা কেতায়াণ্টাইন কেন্দ্রে অবস্থানরতদের জন্য ওয়াই-ফাই সংযোগ ও টেলিভিশন দেয়া হয়েছে। আর গতকাল পর্যন্ত মহাখালী আইইডিসিআরে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ৩৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এখনও নিশ্চিতভাবে কোন করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। আইইডিসিআর এর পরিচালক বলেন, তবে সিএমএইচ হাসপাতালে যিনি ছিলেন তিনি এখনও সেই হাসপাতালেই পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তার সঙ্গে এক বছরের সন্তান থাকায় তাকে সেখানেই রাখা হয়েছে।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া চীনের উহান থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা বাংলাদেশি পাইলটদের অন্য দেশ ঢুকতে দিচ্ছে না। তাই ভাড়া করা বিমানের মাধ্যমে চীন থেকে আরও ১৭১ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের ব্রিফিংয়ের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর স্পেশালি ২০-২৫ জন নিয়ে বসে আলোচনা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে- যেভাবেই হোক এটাকে (করোনাভাইরাস) আমাদের দেশে ঢোকা প্রতিরোধ করতে হবে। এছাড়া যারা চীনের উহান থেকে আসবে সবাইকে...উহান থেকে তো চায়না একেবারে ক্লোজ করে দিয়েছে। সুতরাং বের হতে পারবে না। তারপরও বলা হয়েছে যদি সন্দেহ হয় উহান থেকে আসছে, তাকে অবশ্যই ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। কারণ আমরা এটা নিয়ে তো রিস্ক নেব না।

এখনও ১৭১ জন ছাত্রসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ চীনে রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তারা আসতে চাচ্ছে, এটা (নিয়ে আসার বিষয়টি) দেখতে বলা হয়েছে। আমাদের প্লেন পাঠাতে একটা অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের যে প্লেনটা গেছে, আসার পর এই পাইলটদের কোন দেশ ঢুকতে দিচ্ছে না। সে জন্য আলোচনা হয়েছে যে, এক্ষেত্রে যদি ভাড়া করা কোন বিমান পাওয়া যায়, চীনের কোন ভাড়া করা বিমান যদি আনা হয় সেটা, সেটাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের প্লেন পাঠানো যাচ্ছে না। আমাদের প্লেন পাঠালে যে ক্রুরা যাবে তাদের বাইরে ভিসা দেয় না। অলরেডি সিঙ্গাপুর না করে দিয়েছে, এই ক্রুরা আমাদের এখানে আসতে পারবে না। চীন ছাড়া অন্য দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ডাবল চেকআপ করা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিশেষ করে ভায়া হয়ে যারা আসে তারা সেফটি নিয়েই আসে। কারণ ব্যাংকক ও হংকংয়ে তো খুবই স্ট্রিক। কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুর হয়ে যারা আসে তাদের তো একটা ন্যাচারাল প্রটেকশন হয়। একবার সেখানে স্ক্যানিং হয়। এজন্য আমরা প্রটেকশন পাই। তারপরও আমাদের এখানে ডাবল প্রটেকশন সিস্টেম আছে।

গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস নিয়ে করণীয় নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়ার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় করোনাভাইরাসের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর-এসওপি প্রণয়ণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. জিলন মিঞা সরকারকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক আফজালুন নেছা, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিহা হাসিন।

সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগে. জেনা. একে মাহবুবুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর-এসওপিসহ প্রতিবেদন পেশ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার, কোষাধ্যক্ষ ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, মেডিসিন অনুষদে ডিন অধ্যাপক ডা. জিলন মিঞা সরকার, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল হান্নান, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ, ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী প্রমুখ।