ঘুষ-তদবির ছাড়াই ১০৩ টাকায় পুলিশে চাকরি

প্রথমবারের মতো দেশের ৬৪ জেলায় ১০৩ টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেলেন ৯ হাজার ৬৮০ নারী-পুরুষ। ১০০ টাকা ট্রেজারি চালান আর ৩ টাকার ফরমের মূল্যÑ সব মিলিয়ে ১০৩ টাকায় ‘ঘুষ ও রাজনৈতিক তদবির’ ছাড়াই মেধার ভিত্তিতে কনস্টেবল পদে নিয়োগ দিয়ে ব্যাপক ইতিবাচক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পুলিশ সদর দফতর। তবে কঠোর নজরদারির মধ্যেও দেশের ১৮ জেলায় কনস্টেবল নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হওয়ার ঘটনায় ১৮টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় পুলিশের এক এসআইসহ ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্ট্যান্ড রিলিজ করে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে এই প্রথমবারের মতো ঘুষ ছাড়াই কনস্টেবল পদে নিয়োগের ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। ঘুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১০৩ টাকায় কনস্টেবল পদে প্রার্থীদের চাকরি নিশ্চিত করতে পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটরিং থাকায় এ অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে। ঘুষ ছাড়া চাকরির এ ধারা অব্যাহত থাকলে পুলিশের বিরুদ্ধে যে দুর্নাম রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলেও যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ চাকরির জন্য আর্থিক লেনদেন করেছেন কি না কিংবা পুলিশের কোন কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে কাউকে নিয়োগ নিয়েছেন কিনা, তা গোপনে তদন্ত করে যাচ্ছে পুলিশ সদর দফতর।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬৪ জেলায় ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে ৯ হাজার ৬৮০ জনকে নিয়োগের লক্ষ্যে গত ২৪ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ৮০০ পুরুষ ও ২ হাজার ৮৮০ নারী কনস্টেবল নেয়ার কথা জানানো হয়। নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকা রেঞ্জের ১৩ জেলায় সাধারণ কোটায় ৫৮৩ ও বিশেষ কোটায় ২ হাজার ১৫৯ জনসহ মোট ২ হাজার ৭৩৬ নারী-পুরুষকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ রেঞ্জের ৪ জেলায় সাধারণ কোটায় ১৪৫ ও বিশেষ কোটায় ৩০০ জনসহ মোট ৪৪৫, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১১ জেলায় সাধারণ কোটায় ৪১২ ও বিশেষ কোটায় ২ হাজার ২৮০ জনসহ মোট ২ হাজার ৬৯২, সিলেট রেঞ্জের ৪ জেলায় সাধারণ কোটায় ১৫৯ ও বিশেষ কোটায় ৬৭৭ জনসহ মোট ৮৩৬, বরিশাল রেঞ্জের ৬ জেলায় সাধারণ কোটায় ১৩৩ ও বিশেষ কোটায় ৩৩৯ জনসহ মোট ৪৭২, খুলনা রেঞ্জের ১০ জেলায় সাধারণ কোটায় ২৫১ ও বিশেষ কোটায় ৩৮১ জনসহ মোট ৬৩২, রংপুর রেঞ্জের ৮ জেলায় সাধারণ কোটায় ২৫৩ ও বিশেষ কোটায় ৫০০ জনসহ মোট ৭৫৩, রাজশাহী রেঞ্জের ৮ জেলায় সাধারণ কোটায় ২৯৬ ও বিশেষ কোটায় ৬৬৭ জনসহ মোট ৯৬৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৬৪ জেলায় ২ লাখের বেশি প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে যাচাই-বাচাই করে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৩ জন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে যোগ্যতা বিবেচনা করে নিয়োগ নেয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী এ বছর বিশেষ কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে প্রথমবারের মতো যেসব জেলায় কোটা পূরণ হয়নি, সেসব জেলায় কোটায় সাধারণ প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগের বছরগুলোয় কোটা পূরণ না হলে কোটা খালি রাখা হতো। কিন্তু বর্তমান আইজিপির নির্দেশে কোটার শূন্য স্থানে সাধারণ কোটা থেকে মেধাবী প্রার্থীদের যোগ্যতা বিবেচনা করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

খুলনা রেঞ্জের সাতক্ষীরা জেলায় এবার ১০৩ টাকায় চাকরি পেয়েছেন ১৫২ জন। ২৬ জুন জেলা পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান ফল ঘোষণা করেন। জেলা পুলিশ সুপার গত বছর ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে ১০৩ টাকায় পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তা এ বছর পুলিশ সদর দফতর ৬৪ জেলায় সূচনা করে।

পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, খুবই স্বচ্ছভাবে ১০৩ টাকায় সাতক্ষীরা জেলায় ১৫২ নারী-পুরুষের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রার্থী ছিলেন একেবারেই দরিদ্র। ঘুষ ছাড়া চাকরি গত বছর সাতক্ষীরায় শুরু করেছিলাম। এ বছর সারাদেশে আইজিপির নির্দেশে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সাতক্ষীরায় ১০৩ টাকায় চাকরি পুরোপুরি স্বচ্ছ হয়েছে।

দিনাজপুরে ১০৩ টাকায় মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন ৮০ নারী-পুরুষ। ৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টায় দিনাজপুর পুলিশ লাইনস অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে নিয়োগ পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ আবু সায়েম। তিনি বলেন, ৮০ নারী-পুরুষকে প্রার্থী পুলিশের কনস্টেবল পদে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৬ নারী ও ৫৪ পুরুষ। তাদের মধ্যে ৫ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী-পুরুষকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে পুলিশের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। এখানে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন থেকে আর কাউকে দালাল বা কোন রাজনৈতিক নেতার কাছে যেতে হবে না। তিনি বলেন, এ বছর দিনাজপুরে পুলিশের নিয়োগের সময় এক পরীক্ষার্থীর পক্ষে তার বড় ভাই পরীক্ষা দিতে এসে ধরা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া দিনাজপুরে পুলিশ নিয়োগের কার্যক্রম পরিচালনা করাকালীন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক সদস্য ও রংপুরের আরআরএফের এক সদস্যকে আটক করা হয়। আটক দুই পুলিশ সদস্য কার্যক্রমের ভেতরে প্রার্থীদের বিভিন্ন লোভ দেখাচ্ছিল।

রংপুর রেঞ্চের ঠাকুরগাঁও জেলায় নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ৩৮ জনের চাকরি হয়েছে ১০৩ টাকায়। ২ জুলাই এ জেলায় চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন জেলা পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে ৩৮ প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কোনভাবে যেন চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে কেউ ঘুষ দাবি করতে না পারে অথবা চাকরি প্রার্থীরা যাতে কোনভাবে প্রতারিত না হন, এ জন্য সর্বদা সতর্ক অবস্থান ছিল। আইজিপির নির্দেশনা অনুযায়ী যৌগ্য প্রার্থীদেরই চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জে পুলিশ কনস্টেবল পদে প্রায় সাড় ৩ হাজার নারী-পুরুষ প্রাথমিক বাছাই পর্বে অংশ নেন। বাছাই শেষে ১ হাজার ৫০৫ জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়। লিখিত পরীক্ষায় ৩০৮ জন উত্তীর্ণ হলে তাদের মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। মৌখিক পরীক্ষা শেষে ১৩৬ পুরুষ ও ৪৩ নারীসহ মোট ১৭৯ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১ জন হলেন সদর উপজেলার বহুলী গ্রামের মৃত আকতার হোসেনের ছেলে মো. ঘাসান। কয়েক বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই শাহ আলম বিয়ে করে মা-ভাইকে ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন। এরপর বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয় কাকে। সংসার চালাতে রিকশা চালানোর পেশা বেছে নেন তিনি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা হাসান নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে লাইনে দাঁড়ান। প্রাথমিকভাবে টিকে যাওয়ার পর লিখিত ও মৌখিত পরীক্ষায় ভালো করায় চূড়ান্তভাবে চাকরি পেয়ে যান। ১০৩ টাকায় চাকরি পাবেন কল্পনাও করেননি তিনি।

চাকরি পেয়ে আবেগে আপ্লুত হাসান সাংবাদিকদের জানান, বাবার মৃত্যুর পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বড় ভাই বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। মা ও তাকে বাড়িতে রেখে যান। সংসার চালাতে রিকশা চালানোর পথ বেছে নিতে হয় তাকে। পুলিশে চাকরি পাবেনÑ এমন ধারণা ছিল না। তবুও বন্ধুদের সঙ্গে হুজুগের বশে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাওয়ার পর লিখিত পরীক্ষাতেও টিকে গেলেন। তারপরও মনে হচ্ছিল, তাদের মতো গরিব মানুষের চাকরি হবে না। কারণ তারা তো টাকা দিতে পারবেন না। মৌখিক পরীক্ষায় ঠিকই বাদ পড়ে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি চাকরি পেয়েছেন।

সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর অনেক আগে থেকেই ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। কেউ যাতে দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে অর্থনৈতিক লেনদেন না করেন, এ জন্য লিফলেট বিতরণ ও পোস্টার লাগনো হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রাথমিক বাছাই পর্ব থেকে সব পরীক্ষায় প্রার্থীরা কারও সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন করেছেন কি না, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ বিভাগের সব কর্মকর্তার সহযোগিতায় স্বচ্ছভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

খুলনায় গত ২৯ জুন প্রাথমিক বাছাই মেষে ৫৪৩ জন লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন। পরীক্ষা শেষে ১১৪ জনকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন হলেন আবুল হাসান। যেদিন তিনি চাকরি পাওয়া আশায় পুলিশ লাইনে যান, সেদিন পকেটে টাকা না থাকায় ২০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। রাতে ও সকালে টাকার অভাবে খেতেও পারেননি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা পর চূড়ান্ত ফলাফলে যখন নিজের নাম শুনতে পান, তখন অনেকটা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে তিনি। মাত্র ৩ দিন বয়সে বাবা ও মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত আবুল হাসান মানুষ হয়েছেন এতিমখানায়। মাঠে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি তিনি পড়াশোনা করেছেন অনেক কষ্টে।

খুলনা জেলা সদর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, আমরা অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ সদস্য নিয়োগ করেছি। এক্ষেত্রে ১০০ টাকা ট্রেজারি চালান ও ৩ টাকার একটি ফরম ছাড়া প্রার্থীদের আর কোন খরচ হয়নি। পুলিশের মহাপরিদর্শকের নির্দেশনা অনুযায়ী মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি দিতে পেরে আমরাও খুশি।

নিয়োগে ঘুষ লেনদেন করার অভিযোগে ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা : পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, এ বছর নিয়োগ পরীক্ষার আগেই পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটর করা হয়। কোনভাবেই যাতে টাকার বিনিময়ে কেউ চাকরি না পায় অথবা কোন আর্থিক লেনদেন না না হয়, এ জন্য বিশেষ টিমের মাধ্যমে জেলাগুলোয় নজরদারি রাখা হয়েছে। কনস্টেবল নিয়োগের জন্য ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ জেলায় ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে টাঙ্গাইলে এক এসআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

চাকরি দেয়ার চুক্তিকে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় টাঙ্গাইলে এক এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গাজীপুরে ২ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩ জনের বিরুদ্ধে ২টি মামলা করা হয়েছে। নাটোরে ৯ জনের বিরুদ্ধে ১ মামলা, বগুড়ায় ৪টি পৃথক মামলায় ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। খুলনায় ২ মামলায় ৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। সাতক্ষীরায় ১ মামলায় ২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ঝিনাইদহে ১ মামলায় ২, নড়াইলে ১ মামলায় ১, কুষ্টিয়ায় ২ মামলায় ৫, রংপুরে ১ মামলায় ৩, গাইবান্ধায় ১ মামলায় ২ জনকে আসামি করা হয়েছে। ১২ জেলায় ১৮ মামলায় মোট ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে চাকরি দেয়ার কথা বলে নিয়োগ প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়ার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। ঘুষ লেনদেনসহ তদবির চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সারাদেশে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শতাধিক পুলিশ সদস্যকে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এ বছর বিনা ঘুষে পুলিশে চাকরির যে রেওয়াজ শুরু হয়েছে, এতে শতভাগ সফলতার চেষ্টা ছিল পুলিশ সদর দফতরের। ১০৩ টাকায় চাকরি দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি পুলিশ সদর দফতরের ছিল, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। তবে কয়েকটি জেলায় টাকার বিনিময়ে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ শোনা গেছে। এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ সদর দফতর অনুসন্ধান করছে। যদি কারও বিরুদ্ধে ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ওই চাকরি পাওয়া প্রার্থীকে যে কোন সময় বাদ দেয়া হবে। এর পাশাপাশি পুলিশ বা যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পুলিশ সদর দফরের এক কর্মকর্তা বলেন, কনস্টেবল নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ায় জেলা এসপিরা কাজ করছেন। পুলিশ সদর দফতরের এক এসপি ও এক অতিরিক্ত এসপি লিখিত পরীক্ষার দিন সংশ্লিষ্ট জেলায় পরীক্ষা নিয়েছেন। কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চতা নির্ধারণ করে কনস্টেবল সিলেকশন করছেন জেলা এসপিরা। এরপর নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা নেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছর পুলিশ কনস্টেবল ও এসআই নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ লাখ থেকে শুরু করে ৮ লাখ টাকাও চুক্তির বিষয়ে গুঞ্জন রয়েছে। এবারও একই রকম আর্থিক লেনদেনের আশঙ্কায় সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে পারে না। এসব পুলিশ সদস্য চাকরিতে এসে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তা পুলিশের ভাবমূর্তি সংকটে ফেলে। রাজনৈতিক বা আর্থিক সুবিধায় চাকরি পাওয়া পুলিশ সদস্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর পরই চাকরি হওয়ার সময় যে অর্থ ঘুষ দেয়, তা তুলতে ঘুষ দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সচ্ছতা আনতে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন বর্তমান আইজিপি।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মীর মো. সোহেল রানা বলেন, স্বচ্ছভাবে নিয়োগের মাধ্যমে পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুটিং কনস্টেবল নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। শতভাগ চেষ্টা ছিল মেধার ভিত্তিতে ১০৩ টাকায় নিয়োগ বাস্তবায়ন করা। প্রথমবারের মতো এ উদ্যোগ অনেকটা সফল হয়েছে। তবে দু’একটি জেলায় ত্রুটিবিচ্যুতি তথা আর্থিক লেনদেনে নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর কাজ করছে। কারও বিরুদ্ধে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ মিললে নিয়োগ বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বুধবার, ১৭ জুলাই ২০১৯ , ৩ শ্রাবন ১৪২৫, ১৩ জিলকদ ১৪৪০

ঘুষ-তদবির ছাড়াই ১০৩ টাকায় পুলিশে চাকরি

সাইফ বাবলু

প্রথমবারের মতো দেশের ৬৪ জেলায় ১০৩ টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেলেন ৯ হাজার ৬৮০ নারী-পুরুষ। ১০০ টাকা ট্রেজারি চালান আর ৩ টাকার ফরমের মূল্যÑ সব মিলিয়ে ১০৩ টাকায় ‘ঘুষ ও রাজনৈতিক তদবির’ ছাড়াই মেধার ভিত্তিতে কনস্টেবল পদে নিয়োগ দিয়ে ব্যাপক ইতিবাচক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পুলিশ সদর দফতর। তবে কঠোর নজরদারির মধ্যেও দেশের ১৮ জেলায় কনস্টেবল নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হওয়ার ঘটনায় ১৮টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় পুলিশের এক এসআইসহ ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্ট্যান্ড রিলিজ করে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে এই প্রথমবারের মতো ঘুষ ছাড়াই কনস্টেবল পদে নিয়োগের ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। ঘুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১০৩ টাকায় কনস্টেবল পদে প্রার্থীদের চাকরি নিশ্চিত করতে পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটরিং থাকায় এ অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে। ঘুষ ছাড়া চাকরির এ ধারা অব্যাহত থাকলে পুলিশের বিরুদ্ধে যে দুর্নাম রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলেও যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ চাকরির জন্য আর্থিক লেনদেন করেছেন কি না কিংবা পুলিশের কোন কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে কাউকে নিয়োগ নিয়েছেন কিনা, তা গোপনে তদন্ত করে যাচ্ছে পুলিশ সদর দফতর।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬৪ জেলায় ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে ৯ হাজার ৬৮০ জনকে নিয়োগের লক্ষ্যে গত ২৪ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাদের মধ্যে ৬ হাজার ৮০০ পুরুষ ও ২ হাজার ৮৮০ নারী কনস্টেবল নেয়ার কথা জানানো হয়। নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকা রেঞ্জের ১৩ জেলায় সাধারণ কোটায় ৫৮৩ ও বিশেষ কোটায় ২ হাজার ১৫৯ জনসহ মোট ২ হাজার ৭৩৬ নারী-পুরুষকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ রেঞ্জের ৪ জেলায় সাধারণ কোটায় ১৪৫ ও বিশেষ কোটায় ৩০০ জনসহ মোট ৪৪৫, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১১ জেলায় সাধারণ কোটায় ৪১২ ও বিশেষ কোটায় ২ হাজার ২৮০ জনসহ মোট ২ হাজার ৬৯২, সিলেট রেঞ্জের ৪ জেলায় সাধারণ কোটায় ১৫৯ ও বিশেষ কোটায় ৬৭৭ জনসহ মোট ৮৩৬, বরিশাল রেঞ্জের ৬ জেলায় সাধারণ কোটায় ১৩৩ ও বিশেষ কোটায় ৩৩৯ জনসহ মোট ৪৭২, খুলনা রেঞ্জের ১০ জেলায় সাধারণ কোটায় ২৫১ ও বিশেষ কোটায় ৩৮১ জনসহ মোট ৬৩২, রংপুর রেঞ্জের ৮ জেলায় সাধারণ কোটায় ২৫৩ ও বিশেষ কোটায় ৫০০ জনসহ মোট ৭৫৩, রাজশাহী রেঞ্জের ৮ জেলায় সাধারণ কোটায় ২৯৬ ও বিশেষ কোটায় ৬৬৭ জনসহ মোট ৯৬৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৬৪ জেলায় ২ লাখের বেশি প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে যাচাই-বাচাই করে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৩ জন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে যোগ্যতা বিবেচনা করে নিয়োগ নেয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী এ বছর বিশেষ কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে প্রথমবারের মতো যেসব জেলায় কোটা পূরণ হয়নি, সেসব জেলায় কোটায় সাধারণ প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগের বছরগুলোয় কোটা পূরণ না হলে কোটা খালি রাখা হতো। কিন্তু বর্তমান আইজিপির নির্দেশে কোটার শূন্য স্থানে সাধারণ কোটা থেকে মেধাবী প্রার্থীদের যোগ্যতা বিবেচনা করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

খুলনা রেঞ্জের সাতক্ষীরা জেলায় এবার ১০৩ টাকায় চাকরি পেয়েছেন ১৫২ জন। ২৬ জুন জেলা পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান ফল ঘোষণা করেন। জেলা পুলিশ সুপার গত বছর ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে ১০৩ টাকায় পুলিশে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তা এ বছর পুলিশ সদর দফতর ৬৪ জেলায় সূচনা করে।

পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, খুবই স্বচ্ছভাবে ১০৩ টাকায় সাতক্ষীরা জেলায় ১৫২ নারী-পুরুষের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রার্থী ছিলেন একেবারেই দরিদ্র। ঘুষ ছাড়া চাকরি গত বছর সাতক্ষীরায় শুরু করেছিলাম। এ বছর সারাদেশে আইজিপির নির্দেশে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সাতক্ষীরায় ১০৩ টাকায় চাকরি পুরোপুরি স্বচ্ছ হয়েছে।

দিনাজপুরে ১০৩ টাকায় মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন ৮০ নারী-পুরুষ। ৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টায় দিনাজপুর পুলিশ লাইনস অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে নিয়োগ পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ আবু সায়েম। তিনি বলেন, ৮০ নারী-পুরুষকে প্রার্থী পুলিশের কনস্টেবল পদে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৬ নারী ও ৫৪ পুরুষ। তাদের মধ্যে ৫ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী-পুরুষকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে পুলিশের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। এখানে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন থেকে আর কাউকে দালাল বা কোন রাজনৈতিক নেতার কাছে যেতে হবে না। তিনি বলেন, এ বছর দিনাজপুরে পুলিশের নিয়োগের সময় এক পরীক্ষার্থীর পক্ষে তার বড় ভাই পরীক্ষা দিতে এসে ধরা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া দিনাজপুরে পুলিশ নিয়োগের কার্যক্রম পরিচালনা করাকালীন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক সদস্য ও রংপুরের আরআরএফের এক সদস্যকে আটক করা হয়। আটক দুই পুলিশ সদস্য কার্যক্রমের ভেতরে প্রার্থীদের বিভিন্ন লোভ দেখাচ্ছিল।

রংপুর রেঞ্চের ঠাকুরগাঁও জেলায় নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ৩৮ জনের চাকরি হয়েছে ১০৩ টাকায়। ২ জুলাই এ জেলায় চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন জেলা পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে ৩৮ প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কোনভাবে যেন চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে কেউ ঘুষ দাবি করতে না পারে অথবা চাকরি প্রার্থীরা যাতে কোনভাবে প্রতারিত না হন, এ জন্য সর্বদা সতর্ক অবস্থান ছিল। আইজিপির নির্দেশনা অনুযায়ী যৌগ্য প্রার্থীদেরই চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জে পুলিশ কনস্টেবল পদে প্রায় সাড় ৩ হাজার নারী-পুরুষ প্রাথমিক বাছাই পর্বে অংশ নেন। বাছাই শেষে ১ হাজার ৫০৫ জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত করা হয়। লিখিত পরীক্ষায় ৩০৮ জন উত্তীর্ণ হলে তাদের মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। মৌখিক পরীক্ষা শেষে ১৩৬ পুরুষ ও ৪৩ নারীসহ মোট ১৭৯ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১ জন হলেন সদর উপজেলার বহুলী গ্রামের মৃত আকতার হোসেনের ছেলে মো. ঘাসান। কয়েক বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই শাহ আলম বিয়ে করে মা-ভাইকে ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন। এরপর বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয় কাকে। সংসার চালাতে রিকশা চালানোর পেশা বেছে নেন তিনি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা হাসান নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে লাইনে দাঁড়ান। প্রাথমিকভাবে টিকে যাওয়ার পর লিখিত ও মৌখিত পরীক্ষায় ভালো করায় চূড়ান্তভাবে চাকরি পেয়ে যান। ১০৩ টাকায় চাকরি পাবেন কল্পনাও করেননি তিনি।

চাকরি পেয়ে আবেগে আপ্লুত হাসান সাংবাদিকদের জানান, বাবার মৃত্যুর পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বড় ভাই বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। মা ও তাকে বাড়িতে রেখে যান। সংসার চালাতে রিকশা চালানোর পথ বেছে নিতে হয় তাকে। পুলিশে চাকরি পাবেনÑ এমন ধারণা ছিল না। তবুও বন্ধুদের সঙ্গে হুজুগের বশে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাওয়ার পর লিখিত পরীক্ষাতেও টিকে গেলেন। তারপরও মনে হচ্ছিল, তাদের মতো গরিব মানুষের চাকরি হবে না। কারণ তারা তো টাকা দিতে পারবেন না। মৌখিক পরীক্ষায় ঠিকই বাদ পড়ে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি চাকরি পেয়েছেন।

সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর অনেক আগে থেকেই ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। কেউ যাতে দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে অর্থনৈতিক লেনদেন না করেন, এ জন্য লিফলেট বিতরণ ও পোস্টার লাগনো হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রাথমিক বাছাই পর্ব থেকে সব পরীক্ষায় প্রার্থীরা কারও সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন করেছেন কি না, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ বিভাগের সব কর্মকর্তার সহযোগিতায় স্বচ্ছভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

খুলনায় গত ২৯ জুন প্রাথমিক বাছাই মেষে ৫৪৩ জন লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন। পরীক্ষা শেষে ১১৪ জনকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন হলেন আবুল হাসান। যেদিন তিনি চাকরি পাওয়া আশায় পুলিশ লাইনে যান, সেদিন পকেটে টাকা না থাকায় ২০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। রাতে ও সকালে টাকার অভাবে খেতেও পারেননি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা পর চূড়ান্ত ফলাফলে যখন নিজের নাম শুনতে পান, তখন অনেকটা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে তিনি। মাত্র ৩ দিন বয়সে বাবা ও মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত আবুল হাসান মানুষ হয়েছেন এতিমখানায়। মাঠে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি তিনি পড়াশোনা করেছেন অনেক কষ্টে।

খুলনা জেলা সদর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, আমরা অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশ সদস্য নিয়োগ করেছি। এক্ষেত্রে ১০০ টাকা ট্রেজারি চালান ও ৩ টাকার একটি ফরম ছাড়া প্রার্থীদের আর কোন খরচ হয়নি। পুলিশের মহাপরিদর্শকের নির্দেশনা অনুযায়ী মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি দিতে পেরে আমরাও খুশি।

নিয়োগে ঘুষ লেনদেন করার অভিযোগে ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা : পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, এ বছর নিয়োগ পরীক্ষার আগেই পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটর করা হয়। কোনভাবেই যাতে টাকার বিনিময়ে কেউ চাকরি না পায় অথবা কোন আর্থিক লেনদেন না না হয়, এ জন্য বিশেষ টিমের মাধ্যমে জেলাগুলোয় নজরদারি রাখা হয়েছে। কনস্টেবল নিয়োগের জন্য ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ জেলায় ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে টাঙ্গাইলে এক এসআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

চাকরি দেয়ার চুক্তিকে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় টাঙ্গাইলে এক এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গাজীপুরে ২ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩ জনের বিরুদ্ধে ২টি মামলা করা হয়েছে। নাটোরে ৯ জনের বিরুদ্ধে ১ মামলা, বগুড়ায় ৪টি পৃথক মামলায় ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। খুলনায় ২ মামলায় ৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। সাতক্ষীরায় ১ মামলায় ২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ঝিনাইদহে ১ মামলায় ২, নড়াইলে ১ মামলায় ১, কুষ্টিয়ায় ২ মামলায় ৫, রংপুরে ১ মামলায় ৩, গাইবান্ধায় ১ মামলায় ২ জনকে আসামি করা হয়েছে। ১২ জেলায় ১৮ মামলায় মোট ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে চাকরি দেয়ার কথা বলে নিয়োগ প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়ার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। ঘুষ লেনদেনসহ তদবির চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সারাদেশে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শতাধিক পুলিশ সদস্যকে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে।

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এ বছর বিনা ঘুষে পুলিশে চাকরির যে রেওয়াজ শুরু হয়েছে, এতে শতভাগ সফলতার চেষ্টা ছিল পুলিশ সদর দফতরের। ১০৩ টাকায় চাকরি দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি পুলিশ সদর দফতরের ছিল, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। তবে কয়েকটি জেলায় টাকার বিনিময়ে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ শোনা গেছে। এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ সদর দফতর অনুসন্ধান করছে। যদি কারও বিরুদ্ধে ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ওই চাকরি পাওয়া প্রার্থীকে যে কোন সময় বাদ দেয়া হবে। এর পাশাপাশি পুলিশ বা যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পুলিশ সদর দফরের এক কর্মকর্তা বলেন, কনস্টেবল নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ায় জেলা এসপিরা কাজ করছেন। পুলিশ সদর দফতরের এক এসপি ও এক অতিরিক্ত এসপি লিখিত পরীক্ষার দিন সংশ্লিষ্ট জেলায় পরীক্ষা নিয়েছেন। কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চতা নির্ধারণ করে কনস্টেবল সিলেকশন করছেন জেলা এসপিরা। এরপর নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা নেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছর পুলিশ কনস্টেবল ও এসআই নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ লাখ থেকে শুরু করে ৮ লাখ টাকাও চুক্তির বিষয়ে গুঞ্জন রয়েছে। এবারও একই রকম আর্থিক লেনদেনের আশঙ্কায় সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে পারে না। এসব পুলিশ সদস্য চাকরিতে এসে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তা পুলিশের ভাবমূর্তি সংকটে ফেলে। রাজনৈতিক বা আর্থিক সুবিধায় চাকরি পাওয়া পুলিশ সদস্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর পরই চাকরি হওয়ার সময় যে অর্থ ঘুষ দেয়, তা তুলতে ঘুষ দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সচ্ছতা আনতে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন বর্তমান আইজিপি।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মীর মো. সোহেল রানা বলেন, স্বচ্ছভাবে নিয়োগের মাধ্যমে পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুটিং কনস্টেবল নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। শতভাগ চেষ্টা ছিল মেধার ভিত্তিতে ১০৩ টাকায় নিয়োগ বাস্তবায়ন করা। প্রথমবারের মতো এ উদ্যোগ অনেকটা সফল হয়েছে। তবে দু’একটি জেলায় ত্রুটিবিচ্যুতি তথা আর্থিক লেনদেনে নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর কাজ করছে। কারও বিরুদ্ধে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ মিললে নিয়োগ বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।