উদ্বেগে বছর শেষ সুখবর নেই শুরুতেও

মহামন্দায় পড়ে রয়েছে পুঁজিবাজার, দুরাবস্থা কাটিয়ে ওঠতে পারেনি মুদ্রাবাজার, রপ্তানি বাণিজ্যে ধস, রাজস্ব আদায় কমছে, মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী, বিনিয়োগ খড়ায় ব্যাহত উৎপাদন, আমদানি কমছে, তারপরও চাপে আছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ- সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নেতিবাচক রেখে শেষ হয়েছে ২০১৯ সাল। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে সরকার নিজেও খরচ যোগাচ্ছে ব্যাংক থেকে ধার বাড়িয়ে। শুরু হওয়া ২০২০ সালে আশা জাগাতে পারে- এমন কোন আলমতও দেখা যাচ্ছে না। নতুন বছরের ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট সুদ কার্যকর ছিল আশা জাগানোর মতো সিদ্ধান্ত। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া সেই সিদ্ধান্তও শেষ পর্যন্ত উল্টো ফল বয়ে আনবে বলেই অনেকের আশঙ্কা। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিলে শিল্পে বিনিয়োগ খড়া বাড়বে আরও। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে বছর শেষে প্রশ্ন ওঠছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না অর্থনীতিদ ও গবেষকরা। তারা বলছেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস ‘বেশ খারাপ’ গেছে। বাকি ছয় মাসে বড় ধরনের উন্নতি না হলে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ‘খুব কঠিন’ হবে। তারা বলছেন, সংকটের মুখে পড়েছে আমাদের অর্থনীতি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য এখন খুবই দুর্বল। গত কয়েক বছরে যতোটা সবল হয়েছিল সেটা আর এখন নেই। দিন যত যাচ্ছে দুর্বলতা বাড়ছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবীদ আহসান মনসুরের বিশ্লেষণ, এমন পরিস্থিতির পিছনে গত কয়েক বছরের সাফল্যের ‘আত্মতুষ্টি’ একটি কারণ। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন ছিল সেটা খাওয়াইনি। অর্থাৎ যে রিফর্মসগুলো (সংস্কার) জোরালোভাবে করা উচিৎ ছিল সেটা করিনি। উল্টো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও খারাপ করেছে। আর ব্যাংক খাতের এই নাজুক দশাই অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে ‘দুর্বল’ থেকে ‘দুর্বলতর’ করছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ‘সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাজস্ব আদায়ে। এবার প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত (অক্টোবর) মাত্র ৪ শতাংশ বেড়েছে। এখানে বড় ঘাটতি থাকলে উন্নয়ন কাজসহ অন্য ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বড় ধাক্কা রপ্তানিতে : টানা চার মাস ধরে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া ২০১৯ সালে বড় ধাক্কা খেয়েছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক। আগামী দিনগুলোতেও ‘এই নেতিবাচক’ ধারা অব্যাহত থাকবে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে সরকারের সহায়তা চেয়েছে রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানির অংক ছিল এক হাজার ৭০৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। এবার এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৮০৫ কোটি ডলার। এ হিসাবে চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। এই মাসে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১৮ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫ দশমিক ৫০ বিলিয়ন) ডলার।

আমদানিও কমছে : বেশ কিছুদিন ধরেই আমদানিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, দেশের মানুষের ভোগ ব্যয় কমেছে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ কমেছে। গত অর্থবছর আমদানি ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই চার মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। জ্বালনি তেল আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

সুখবর শুধু রেমিট্যান্সে : সব কিছুর পরও প্রবাসীরা তাদের উপার্জিত টাকা দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছেন। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি (৭ দশমিক ৭১ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। এ বছর থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।

রিজার্ভে চাপ : প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় কমার পরও চাপে রয়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালের পর রিজার্ভ আর কখনও ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি।

মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী : পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) এবার নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ, গত বছরের নভেম্বর মাসে তা ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ চার বছর পর মূল্যস্ফীতি ৬ এর ঘর অতিক্রম করল। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অক্টোবরের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির বাড়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে খাদ্য খাত। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আরও সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রধান কারণ পিয়াজ। নভেম্বরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের একই মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।

রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে কম : চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আদায় হয়েছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি। আর মূল্য বাজেটের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলছেন, আমদানি-রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ে।

পুরো বছরের ঋণ ৫ মাসেই : এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু তার প্রায় পুরোটা নেয়া হয়ে গেছে পাঁচ মাসেই। ১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে।

বিনিয়োগ সেই অন্ধকারেই : রাজনৈতিক অস্থিরতা, জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ না থাকায়, বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হওয়ায় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের সমস্যা কমে আসায় সুফল পাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু এর তেমন কোন প্রভাব বিনিয়োগে দেখা যাচ্ছে না। অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

গত অর্থবছর শেষে যা ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর এটাকেই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, মরার উপর খারার ঘাঁ, এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ, তার ওপর সরকার ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয়ায় সংকট আরও বেড়েছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ এর ঘরে, সেই প্রবৃদ্ধি এই দশ বছরে বেড়ে ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, গত দশ বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে সামান্যই।

পুঁজিবাজারের করুণ দশা : পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশের দাম অভিহিত মূল্যের ( ফেস ভ্যালু, ১ টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকার কম। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বুধবার লেনদেন ছিল ৩০৫ কোটি টাকার সামান্য বেশি। অথচ ২০১০ সালের উত্তাল সময়েও এ বাজারে লেনদেন ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ছিল। ২০১৯ সালের শুরুতেও হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।

ব্যাংক খাত ভঙ্গুর অবস্থায় : এক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রবণতা অত্যন্ত গভীর। প্রভাবশালী ও ধনী কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেয়ার কোন তাগিদই অনুভব করেন না। ওপর মহলেও তাদের ভালো যোগাযোগ আছে। ক্ষমতাধর এই ঋণগ্রাহকরা এখন বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতের এই দুরাবস্থা হয়েছে বলে মনে বিশ্লেষকরা।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি একদিকে দুর্বল, অন্যদিকে ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ ‘বেপরোয়া’। নিয়ম ভাঙলে এখানে শাস্তি হয় না। বরং খেলাপিদের এখানে আড়াল করে রাখা হচ্ছে। সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণের অংক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ শতাংশ।

বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৮ পৌষ ১৪২৬, ৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

অর্থনীতির উনিশ-কুড়ি

উদ্বেগে বছর শেষ সুখবর নেই শুরুতেও

রোকন মাহমুদ |

মহামন্দায় পড়ে রয়েছে পুঁজিবাজার, দুরাবস্থা কাটিয়ে ওঠতে পারেনি মুদ্রাবাজার, রপ্তানি বাণিজ্যে ধস, রাজস্ব আদায় কমছে, মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী, বিনিয়োগ খড়ায় ব্যাহত উৎপাদন, আমদানি কমছে, তারপরও চাপে আছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ- সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নেতিবাচক রেখে শেষ হয়েছে ২০১৯ সাল। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে সরকার নিজেও খরচ যোগাচ্ছে ব্যাংক থেকে ধার বাড়িয়ে। শুরু হওয়া ২০২০ সালে আশা জাগাতে পারে- এমন কোন আলমতও দেখা যাচ্ছে না। নতুন বছরের ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট সুদ কার্যকর ছিল আশা জাগানোর মতো সিদ্ধান্ত। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া সেই সিদ্ধান্তও শেষ পর্যন্ত উল্টো ফল বয়ে আনবে বলেই অনেকের আশঙ্কা। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিলে শিল্পে বিনিয়োগ খড়া বাড়বে আরও। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে বছর শেষে প্রশ্ন ওঠছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না অর্থনীতিদ ও গবেষকরা। তারা বলছেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস ‘বেশ খারাপ’ গেছে। বাকি ছয় মাসে বড় ধরনের উন্নতি না হলে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ‘খুব কঠিন’ হবে। তারা বলছেন, সংকটের মুখে পড়েছে আমাদের অর্থনীতি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য এখন খুবই দুর্বল। গত কয়েক বছরে যতোটা সবল হয়েছিল সেটা আর এখন নেই। দিন যত যাচ্ছে দুর্বলতা বাড়ছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবীদ আহসান মনসুরের বিশ্লেষণ, এমন পরিস্থিতির পিছনে গত কয়েক বছরের সাফল্যের ‘আত্মতুষ্টি’ একটি কারণ। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন ছিল সেটা খাওয়াইনি। অর্থাৎ যে রিফর্মসগুলো (সংস্কার) জোরালোভাবে করা উচিৎ ছিল সেটা করিনি। উল্টো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও খারাপ করেছে। আর ব্যাংক খাতের এই নাজুক দশাই অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে ‘দুর্বল’ থেকে ‘দুর্বলতর’ করছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ‘সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাজস্ব আদায়ে। এবার প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত (অক্টোবর) মাত্র ৪ শতাংশ বেড়েছে। এখানে বড় ঘাটতি থাকলে উন্নয়ন কাজসহ অন্য ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বড় ধাক্কা রপ্তানিতে : টানা চার মাস ধরে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া ২০১৯ সালে বড় ধাক্কা খেয়েছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক। আগামী দিনগুলোতেও ‘এই নেতিবাচক’ ধারা অব্যাহত থাকবে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে সরকারের সহায়তা চেয়েছে রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানির অংক ছিল এক হাজার ৭০৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। এবার এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৮০৫ কোটি ডলার। এ হিসাবে চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। এই মাসে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১৮ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫ দশমিক ৫০ বিলিয়ন) ডলার।

আমদানিও কমছে : বেশ কিছুদিন ধরেই আমদানিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, দেশের মানুষের ভোগ ব্যয় কমেছে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ কমেছে। গত অর্থবছর আমদানি ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই চার মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। জ্বালনি তেল আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

সুখবর শুধু রেমিট্যান্সে : সব কিছুর পরও প্রবাসীরা তাদের উপার্জিত টাকা দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছেন। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি (৭ দশমিক ৭১ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। এ বছর থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।

রিজার্ভে চাপ : প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় কমার পরও চাপে রয়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালের পর রিজার্ভ আর কখনও ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি।

মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী : পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) এবার নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ, গত বছরের নভেম্বর মাসে তা ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ চার বছর পর মূল্যস্ফীতি ৬ এর ঘর অতিক্রম করল। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অক্টোবরের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির বাড়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে খাদ্য খাত। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আরও সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রধান কারণ পিয়াজ। নভেম্বরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের একই মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।

রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে কম : চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আদায় হয়েছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি। আর মূল্য বাজেটের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলছেন, আমদানি-রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ে।

পুরো বছরের ঋণ ৫ মাসেই : এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু তার প্রায় পুরোটা নেয়া হয়ে গেছে পাঁচ মাসেই। ১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে।

বিনিয়োগ সেই অন্ধকারেই : রাজনৈতিক অস্থিরতা, জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ না থাকায়, বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হওয়ায় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের সমস্যা কমে আসায় সুফল পাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু এর তেমন কোন প্রভাব বিনিয়োগে দেখা যাচ্ছে না। অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

গত অর্থবছর শেষে যা ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর এটাকেই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, মরার উপর খারার ঘাঁ, এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ, তার ওপর সরকার ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয়ায় সংকট আরও বেড়েছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ এর ঘরে, সেই প্রবৃদ্ধি এই দশ বছরে বেড়ে ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, গত দশ বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে সামান্যই।

পুঁজিবাজারের করুণ দশা : পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশের দাম অভিহিত মূল্যের ( ফেস ভ্যালু, ১ টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকার কম। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বুধবার লেনদেন ছিল ৩০৫ কোটি টাকার সামান্য বেশি। অথচ ২০১০ সালের উত্তাল সময়েও এ বাজারে লেনদেন ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ছিল। ২০১৯ সালের শুরুতেও হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।

ব্যাংক খাত ভঙ্গুর অবস্থায় : এক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রবণতা অত্যন্ত গভীর। প্রভাবশালী ও ধনী কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেয়ার কোন তাগিদই অনুভব করেন না। ওপর মহলেও তাদের ভালো যোগাযোগ আছে। ক্ষমতাধর এই ঋণগ্রাহকরা এখন বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতের এই দুরাবস্থা হয়েছে বলে মনে বিশ্লেষকরা।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি একদিকে দুর্বল, অন্যদিকে ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ ‘বেপরোয়া’। নিয়ম ভাঙলে এখানে শাস্তি হয় না। বরং খেলাপিদের এখানে আড়াল করে রাখা হচ্ছে। সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণের অংক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ শতাংশ।