রাজউকে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিভিন্ন কার্যক্রম এবং উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সংস্থাটির সেবার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় স্তরেই দুর্নীতি ও অনিয়ম রয়েছে। আর এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে রাজউক কর্মকর্তাদের একাংশ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাত স্পষ্ট। ফলে রাজউক কর্তৃক সার্বিক জবাবদিহি কাঠামো কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন ব্যহত হচ্ছে। অন্যদিকে, রাজউকে বর্তমানে উন্নয়নমূলক কাজে অধিক গুরুত্বারোপ করায় এবং আবাসন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা অর্জনকে প্রাধান্য দেয়ায় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রমের মতো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ সবসময় উপেক্ষিত থাকছে।

গতকাল টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সময় রাজউকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এবং সমস্যা থেকে উত্তরণে ১৪ দফা সুপারিশ প্রদান করেসংস্থাটি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা আফরোজ।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাজউকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের জন্য সুপারিশ প্রস্তাব করার উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ গবেষণায় রাজউকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নমূলক কার্যক্রম/প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়, পরিকল্পনা প্রণয়ন (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান- ড্যাপ) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইন ও নীতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই গবেষণায় রাজউকের নানা আইনি সীমাবদ্ধতা ও প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ; প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও অনিয়ম; জবাবদিহিতা; তথ্য সরবরাহে স্বচ্ছতা; সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন এবং প্রকল্প সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন এমন একটা ধারণা করা হয় যে, রাজউক আর দুর্নীতি সমার্থক। রাজউক এতদিনেও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। এমনকি রাজউক নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রতিষ্ঠানও নয়। রাজউকের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার যে দায়িত্ব অর্পিত, তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ড্যাপ ও ডিএমডিপি রক্ষায়ও ব্যর্থ হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাজউক এখন তার মূল ভূমিকা থেকেই সরে গেছে। তাই রাজউকের দুর্নীতির বিষয়গুলো দুদকের গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা বাদ দিয়ে রাজউক এখন মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের নামে মুনাফা অর্জন ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা আলাদা করতেই হবে। দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে রাজউকের ব্যবসায়িক মানসিকতা যেহেতু আর বদলানো যাবে বলে মনে হয় না, তাই আইনের যথাযথ সংশোধন করে রাজউকের সার্বিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক, নিরপেক্ষ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়িত ও প্রভাবমুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজউকের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন ধরনের আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, নগর উন্নয়ন (টাউন ইম্প্রুভমেন্ট) আইন-১৯৫৩ এ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের যোগ্যতার মানদ- নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। ইমারত নির্মাণ আইন-১৯৫২ এ দুর্ঘটনার ভয়াবহতার মাত্রা বিবেচনায় নকশা অনুমোদন ও বাস্তবায়নে আইনের ব্যত্যয়ের শাস্তি সীমিত হওয়ায় আইন লংঘনের প্রবণতা দেখা যায়। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ এ বহুতল ভবনের সংজ্ঞায়নে দশতলা বা ৩৩ মিটারের ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হলেও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০৬ অনুযায়ী ২০ মিটার বা তার ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে, ন্যাশনাল ফায়ার প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী ২৩ মিটার বা তার ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ অনুযায়ী সাত তলা বা তার ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ফলে দশতলা পর্যন্ত, বিশেষ করে সাত থেকে দশতলা উচ্চতার ভবন অগ্নি নিরাপত্তার বাইরে রয়েছে। অন্যদিকে, ঢাকা উন্নয়ন ট্রাস্ট (ভূমি বরাদ্দ) বিধিমালা-১৯৬৯ এ কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হলে সেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত কোটা সম্পর্কিত কোন নির্দেশনা নেই, প্লটের জন্য আবেদনকারী হিসেবে ‘জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তি’র মানদ- স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজউকে অনুমোদিত পদের বিপরীতে পর্যাপ্ত জনবল নেই। অনুমোদিত ১৯৮০টি পদের মধ্যে ১১৮৭টি পদে জনবল কর্মরত রয়েছে। কর্মরত নারীদের হার মাত্র ৯.৭%। সার্বিকভাবে অনুমোদিত পদের মধ্যে ৪০.১% পদ শূন্য রয়েছে। নিয়োগ, পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতিতেও অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। গবেষণাকালে রাজউকের আয় ও ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ের হিসাব থেকে দেখা যায় প্রতি অর্থবছরে রাজউকের উদ্বৃত্ত আয় ২৫.৩% থেকে ৬০.১% পর্যন্ত থাকে। তবে বাজেট পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নে রাজউকের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয় তা খরচ করা হয় না।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজউকে অবকাঠামোগত নানা সমস্যা বিদ্যমান। আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর দু’টিতে নিজস্ব অফিস ভবন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু বিভাগ বা শাখার কার্যক্রম নেই। ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে রাজউকে মৌজাভিত্তিক নকশা অনুমোদনের এবং প্লট ও ফ্ল্যাট সংক্রান্ত নথি সংরক্ষণ করা হয় যার ফলে সেবা পেতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং অনেক সময় নথি হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। রাজউকের আওতাভুক্ত এলাকায় রাজউকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুসারে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের তথ্য জমা দেয়া কিংবা প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে রাজউক বোর্ডের কার্যক্রম কার্যকরভাবে তদারকি করা হয় না এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা প্রেষণে নিযুক্ত হওয়ায় অধস্তন পর্যায়ের প্রেষণে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেন না এমন অভিযোগ রয়েছে। মহাপরিদর্শক ও নিরীক্ষকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে রাজউকের নিরীক্ষা কার্যক্রমের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ প্রদান করে ও রাজউক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, ডিটেইল্ড এরিয়া প্লান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন জনস্বার্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য জনগণ- এমনকি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদেরও সর্বশেষ ড্যাপ রিভিউয়ের কাজে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত না করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ড্যাপ পর্যালোচনায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এবং ড্যাপ রিভিউয়ের কাজ রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার মাধ্যমে স্বার্থের সংঘাত ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালে ড্যাপ অনুমোদিত হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়ে মোট ১৫৮ বার সংশোধিত হয়েছে। ড্যাপ সংশোধনের মাধ্যমে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে ডেভেলপার, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে, রাজউকের ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। যেমন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে নিয়ম বহির্ভূত অর্থ নেয়া হয়। জরিপের সময়ও চুক্তিভিত্তিক নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তি ও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে এর পরিমাণ দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। ছাড়পত্র অনুমোদনে ব্যক্তি পর্যায়ে ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভলপার পর্যায়ে এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। সেবাগ্রহীতারা ইমারত নকশা অনুমোদনের সেবা গ্রহণেও নির্ধারিত ফি-এর অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন। ব্যক্তি পর্যায়ে দশতলা পর্যন্ত ইমারতের নকশা অনুমোদনে ফি-এর অতিরিক্ত ৫০ হাজার থেকে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভলপার পর্যায়ে দুই লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। আবার দশ তলার ঊর্ধ্বের ইমারতের নকশা অনুমোদনে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ফি-এর অতিরিক্ত ১৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বৃহদায়তন বা বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ডেভলপার পর্যায়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পরিমাণ ১৫ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত। নাগরিক সনদ ও বিধিমালা অনুয়ায়ী নকশা অনুমোদনের নির্ধারিত সময় যথাক্রম ২০ দিন ও ৪৫ দিন হলেও সে অনুযায়ী অনুমোদন না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণত চার মাসে নকশা অনুমোদন হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে, অর্থের পরিমাণ বেশি হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও কাজ সম্পন্ন হয়।

টিআইবির অভিযোগ সত্য নয় : গণপূর্তমন্ত্রী

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজউকের বিরুদ্ধে টিআইবি কর্তৃক আনীত অভিযোগের তথ্য কোনভাবে সত্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শম রেজাউল করিম। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রীর দফতর কক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী বলেন, টিআইবির অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই এবং এটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। জনবান্ধব একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে কারও দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হেয় প্রতিপন্ন করে আলাদা বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছেন তারা। আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে বিশেষ কোন প্রকল্পের অনুমোদনই হয়নি। সুতরাং এ সংক্রান্ত ঘুষ দেয়ার তথ্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে জনহয়রানির প্রতিষ্ঠান নয়, জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা করছি। দৃশ্যমান অনেক পরিবর্তন হয়েছে যা ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। মন্ত্রণালয়াধীন দফতরসমূহে যেখানেই অনিয়ম পাচ্ছি সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি যেন কোনভাবেই ন্যূনতম দুর্নীতি না থাকে।

অনুমানভিত্তিক অভিযোগ এনে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা থেকে টিআইবিসহ অন্যদের সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান গণপূর্তমন্ত্রী। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতির প্রভাব সংক্রান্ত টিআইবির এক অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আমি মন্ত্রী হওয়ার পরে রাজউকে কোন নিয়োগ হয়নি। শুধু আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। টিআইবি বলেছে ফ্ল্যাটের চাবি প্রদানের ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয়। উত্তরায় ফ্ল্যাট বরাদ্দ অনলাইন পদ্ধতিতে করে সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে ওইদিনই তাদের চাবি দেয়া হয়েছে। শুধু সেদিন অনুপস্থিত ব্যক্তিরাই পরবর্তীতে চাবি নিয়েছেন।

ভূমির ছাড়পত্র, আমমোক্তারনামার ক্ষেত্রে টাকা প্রদানের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, রাজউকে নির্ধারিত আইন করে দিয়েছি, নির্ধারিত সময়ের ভেতরে সেবা প্রদান করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা অটোমেশন চালু করেছি। এক্ষেত্রে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আসার যৌক্তিকতাই নেই। তিনি আরও বলেন, রাজউকে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। একটা সময় রাজউক দালাল পরিবেষ্টিত বলে অভিযোগ ছিল। বেশকিছু দালালদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হয়েছে। দৃশ্যমানভাবে কোন দালালের উপস্থিতি রাজউকে নেই। তারপরও সুনির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা টিআইবি বললে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতাম। আমি আশা করি টিআইবি এ জাতীয় অভিযোগ আনার পূর্বে আমাদেরকে জানাবেন কী অভিযোগ পেয়েছেন, কাদের কাছে পেয়েছেন।

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২০ , ১৬ মাঘ ১৪২৬, ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪১

রাজউকে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

image

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিভিন্ন কার্যক্রম এবং উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সংস্থাটির সেবার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় স্তরেই দুর্নীতি ও অনিয়ম রয়েছে। আর এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে রাজউক কর্মকর্তাদের একাংশ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাত স্পষ্ট। ফলে রাজউক কর্তৃক সার্বিক জবাবদিহি কাঠামো কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন ব্যহত হচ্ছে। অন্যদিকে, রাজউকে বর্তমানে উন্নয়নমূলক কাজে অধিক গুরুত্বারোপ করায় এবং আবাসন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা অর্জনকে প্রাধান্য দেয়ায় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রমের মতো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ সবসময় উপেক্ষিত থাকছে।

গতকাল টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সময় রাজউকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এবং সমস্যা থেকে উত্তরণে ১৪ দফা সুপারিশ প্রদান করেসংস্থাটি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা রহমান এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা আফরোজ।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাজউকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের জন্য সুপারিশ প্রস্তাব করার উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ গবেষণায় রাজউকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নমূলক কার্যক্রম/প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়, পরিকল্পনা প্রণয়ন (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান- ড্যাপ) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইন ও নীতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই গবেষণায় রাজউকের নানা আইনি সীমাবদ্ধতা ও প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ; প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও অনিয়ম; জবাবদিহিতা; তথ্য সরবরাহে স্বচ্ছতা; সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন এবং প্রকল্প সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন এমন একটা ধারণা করা হয় যে, রাজউক আর দুর্নীতি সমার্থক। রাজউক এতদিনেও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। এমনকি রাজউক নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রতিষ্ঠানও নয়। রাজউকের ওপর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার যে দায়িত্ব অর্পিত, তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ড্যাপ ও ডিএমডিপি রক্ষায়ও ব্যর্থ হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাজউক এখন তার মূল ভূমিকা থেকেই সরে গেছে। তাই রাজউকের দুর্নীতির বিষয়গুলো দুদকের গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা বাদ দিয়ে রাজউক এখন মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের নামে মুনাফা অর্জন ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা আলাদা করতেই হবে। দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে রাজউকের ব্যবসায়িক মানসিকতা যেহেতু আর বদলানো যাবে বলে মনে হয় না, তাই আইনের যথাযথ সংশোধন করে রাজউকের সার্বিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক, নিরপেক্ষ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়িত ও প্রভাবমুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজউকের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন ধরনের আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, নগর উন্নয়ন (টাউন ইম্প্রুভমেন্ট) আইন-১৯৫৩ এ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের যোগ্যতার মানদ- নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। ইমারত নির্মাণ আইন-১৯৫২ এ দুর্ঘটনার ভয়াবহতার মাত্রা বিবেচনায় নকশা অনুমোদন ও বাস্তবায়নে আইনের ব্যত্যয়ের শাস্তি সীমিত হওয়ায় আইন লংঘনের প্রবণতা দেখা যায়। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ এ বহুতল ভবনের সংজ্ঞায়নে দশতলা বা ৩৩ মিটারের ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হলেও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০০৬ অনুযায়ী ২০ মিটার বা তার ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে, ন্যাশনাল ফায়ার প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী ২৩ মিটার বা তার ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ অনুযায়ী সাত তলা বা তার ঊর্ধ্বে নির্মিত ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ফলে দশতলা পর্যন্ত, বিশেষ করে সাত থেকে দশতলা উচ্চতার ভবন অগ্নি নিরাপত্তার বাইরে রয়েছে। অন্যদিকে, ঢাকা উন্নয়ন ট্রাস্ট (ভূমি বরাদ্দ) বিধিমালা-১৯৬৯ এ কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হলে সেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত কোটা সম্পর্কিত কোন নির্দেশনা নেই, প্লটের জন্য আবেদনকারী হিসেবে ‘জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তি’র মানদ- স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজউকে অনুমোদিত পদের বিপরীতে পর্যাপ্ত জনবল নেই। অনুমোদিত ১৯৮০টি পদের মধ্যে ১১৮৭টি পদে জনবল কর্মরত রয়েছে। কর্মরত নারীদের হার মাত্র ৯.৭%। সার্বিকভাবে অনুমোদিত পদের মধ্যে ৪০.১% পদ শূন্য রয়েছে। নিয়োগ, পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতিতেও অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। গবেষণাকালে রাজউকের আয় ও ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ের হিসাব থেকে দেখা যায় প্রতি অর্থবছরে রাজউকের উদ্বৃত্ত আয় ২৫.৩% থেকে ৬০.১% পর্যন্ত থাকে। তবে বাজেট পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নে রাজউকের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয় তা খরচ করা হয় না।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজউকে অবকাঠামোগত নানা সমস্যা বিদ্যমান। আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর দু’টিতে নিজস্ব অফিস ভবন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু বিভাগ বা শাখার কার্যক্রম নেই। ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে রাজউকে মৌজাভিত্তিক নকশা অনুমোদনের এবং প্লট ও ফ্ল্যাট সংক্রান্ত নথি সংরক্ষণ করা হয় যার ফলে সেবা পেতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং অনেক সময় নথি হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। রাজউকের আওতাভুক্ত এলাকায় রাজউকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুসারে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের তথ্য জমা দেয়া কিংবা প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে রাজউক বোর্ডের কার্যক্রম কার্যকরভাবে তদারকি করা হয় না এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা প্রেষণে নিযুক্ত হওয়ায় অধস্তন পর্যায়ের প্রেষণে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেন না এমন অভিযোগ রয়েছে। মহাপরিদর্শক ও নিরীক্ষকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে রাজউকের নিরীক্ষা কার্যক্রমের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ প্রদান করে ও রাজউক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, ডিটেইল্ড এরিয়া প্লান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন জনস্বার্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য জনগণ- এমনকি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদেরও সর্বশেষ ড্যাপ রিভিউয়ের কাজে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত না করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ড্যাপ পর্যালোচনায় রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এবং ড্যাপ রিভিউয়ের কাজ রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার মাধ্যমে স্বার্থের সংঘাত ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালে ড্যাপ অনুমোদিত হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়ে মোট ১৫৮ বার সংশোধিত হয়েছে। ড্যাপ সংশোধনের মাধ্যমে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে ডেভেলপার, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে, রাজউকের ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। যেমন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে নিয়ম বহির্ভূত অর্থ নেয়া হয়। জরিপের সময়ও চুক্তিভিত্তিক নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তি ও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে এর পরিমাণ দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। ছাড়পত্র অনুমোদনে ব্যক্তি পর্যায়ে ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভলপার পর্যায়ে এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। সেবাগ্রহীতারা ইমারত নকশা অনুমোদনের সেবা গ্রহণেও নির্ধারিত ফি-এর অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন। ব্যক্তি পর্যায়ে দশতলা পর্যন্ত ইমারতের নকশা অনুমোদনে ফি-এর অতিরিক্ত ৫০ হাজার থেকে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট ডেভলপার পর্যায়ে দুই লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। আবার দশ তলার ঊর্ধ্বের ইমারতের নকশা অনুমোদনে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে ফি-এর অতিরিক্ত ১৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বৃহদায়তন বা বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ডেভলপার পর্যায়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পরিমাণ ১৫ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত। নাগরিক সনদ ও বিধিমালা অনুয়ায়ী নকশা অনুমোদনের নির্ধারিত সময় যথাক্রম ২০ দিন ও ৪৫ দিন হলেও সে অনুযায়ী অনুমোদন না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণত চার মাসে নকশা অনুমোদন হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে, অর্থের পরিমাণ বেশি হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও কাজ সম্পন্ন হয়।

টিআইবির অভিযোগ সত্য নয় : গণপূর্তমন্ত্রী

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজউকের বিরুদ্ধে টিআইবি কর্তৃক আনীত অভিযোগের তথ্য কোনভাবে সত্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শম রেজাউল করিম। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রীর দফতর কক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী বলেন, টিআইবির অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই এবং এটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। জনবান্ধব একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে কারও দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হেয় প্রতিপন্ন করে আলাদা বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছেন তারা। আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার পর্যায়ে বিশেষ কোন প্রকল্পের অনুমোদনই হয়নি। সুতরাং এ সংক্রান্ত ঘুষ দেয়ার তথ্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে জনহয়রানির প্রতিষ্ঠান নয়, জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা করছি। দৃশ্যমান অনেক পরিবর্তন হয়েছে যা ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। মন্ত্রণালয়াধীন দফতরসমূহে যেখানেই অনিয়ম পাচ্ছি সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি যেন কোনভাবেই ন্যূনতম দুর্নীতি না থাকে।

অনুমানভিত্তিক অভিযোগ এনে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা থেকে টিআইবিসহ অন্যদের সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান গণপূর্তমন্ত্রী। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতির প্রভাব সংক্রান্ত টিআইবির এক অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আমি মন্ত্রী হওয়ার পরে রাজউকে কোন নিয়োগ হয়নি। শুধু আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। টিআইবি বলেছে ফ্ল্যাটের চাবি প্রদানের ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয়। উত্তরায় ফ্ল্যাট বরাদ্দ অনলাইন পদ্ধতিতে করে সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে ওইদিনই তাদের চাবি দেয়া হয়েছে। শুধু সেদিন অনুপস্থিত ব্যক্তিরাই পরবর্তীতে চাবি নিয়েছেন।

ভূমির ছাড়পত্র, আমমোক্তারনামার ক্ষেত্রে টাকা প্রদানের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, রাজউকে নির্ধারিত আইন করে দিয়েছি, নির্ধারিত সময়ের ভেতরে সেবা প্রদান করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা অটোমেশন চালু করেছি। এক্ষেত্রে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আসার যৌক্তিকতাই নেই। তিনি আরও বলেন, রাজউকে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। একটা সময় রাজউক দালাল পরিবেষ্টিত বলে অভিযোগ ছিল। বেশকিছু দালালদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হয়েছে। দৃশ্যমানভাবে কোন দালালের উপস্থিতি রাজউকে নেই। তারপরও সুনির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা টিআইবি বললে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতাম। আমি আশা করি টিআইবি এ জাতীয় অভিযোগ আনার পূর্বে আমাদেরকে জানাবেন কী অভিযোগ পেয়েছেন, কাদের কাছে পেয়েছেন।