নদ-নদীর পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা, জনজীবনে বিপর্যয় ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা

স্মরণকালের ভয়াবহ দাবদাহের সঙ্গে লাগাতার অনাবৃষ্টিতে উজানের পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সাগরের নোনা পানিতে সয়লাব দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী। এই নোনা পানি স্বাভাবিক জনজীবনে বিপর্যয়ের সঙ্গে মারাত্মকভাবে পরিবেশেও সংকট সৃষ্টি করছে। বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ইতোমধ্যে স্মরণকালের সর্বোচ্চ ৩৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে। যা স্বাভাবিকের থেকে ৫.৪ ডিগ্রি বেশি।

অব্যাহত তাপপ্রবাহে দক্ষিণাঞ্চলে চলমান ডায়রিয়া রোগীদের পানিশূন্যতা ত্বরান্বিত করে জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা ১২শ’ পিপিএম অতিক্রম করেছে। ফলে নদী-খালের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। যারা এই পানি ব্যবহার করছেন তাদের ডায়রিয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। সরকারি হিসাবে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। গত ৪ মাস ধরেই দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টির অভাবে ফসলি জমি থেকে শুরু করে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির। মুগ, ভুট্টা, সয়াবিন ও শাক-সবজিসহ সূর্যমুখীর উৎপাদনে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পানি সংকটে বরগুনা এলাকায় বোরো ধানের সেচ ব্যবস্থা পর্যন্ত ব্যাহত হচ্ছে।

গত অক্টোবর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টির অভাব। এটা শীত মৌসুমে তা ততটা অনুভূত না হলেও ক্রমশ সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। জানুয়ারি মাসে বরিশাল অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮.৯ মিলিমিটার হলেও এ বছর কোন বৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়া বিভাগের মতে, ফেব্রুয়ারিতে ২৭ মিলিমিটারের স্থলে বরিশাল অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১ মিলিমিটার। মার্চে ৫৭.১ মিলিমিটারের স্থলে মাত্র ০.৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা ছিল স্বাভাবিকের ৯৯.৫% কম। আর চলতি মাসে বরিশাল অঞ্চলে ১৩২.৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত কোন বৃষ্টিই হয়নি।

লাগাতার অনাবৃষ্টির সঙ্গে উজানের নদ-নদীর প্রবাহ প্রায় না থাকায় গত ডিসেম্বরের পর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে সাগরের নোনা পানি উঠে আসতে শুরু করে। ইতোমধ্যে লবণাক্ততার মাত্রা ১ হাজার পিপিএম অতিক্রম করেছে। বঙ্গোপসাগর থেকে ১১০ কিলোমিটার উজানে বরিশালের কীর্তনখোলায় লবণাক্ততার মাত্রা ১ হাজার ২শ’ পিপিএম অতিক্রম করেছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে। ইতোমধ্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম বিষয়টি নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণেরও নির্দেশ দিয়েছেন। সে আলোকে মন্ত্রীর কাছে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনও দাখিল করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

অনাবৃষ্টির সঙ্গে অত্যধিক তাপপ্রবাহ দক্ষিণাঞ্চলের মাঠে থাকা রবি ফসলের জন্য ক্রমাগত হুমকি সৃষ্টি করছে। ইতোমধ্যে বরিশালে তাপমাত্রার পারদ সর্বকালের রেকর্ড ছাপিয়ে ৩৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়সে উঠেছে গত ২৫ এপ্রিল। ২৬ এপ্রিল ছিল ৩৭.৫ অথচ আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে এপ্রিল মাসে বরিশালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকের চেয়ে ৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রায় জনজীবনে ভয়াবহ সংকট নেমে এসেছে। এমনকি ২৬ এপ্রিল তাপমাত্রা ১.৩ ডিগ্রি হ্রাস পেলেও তা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৪.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। চলতি মাসের প্রথম দিনেও বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ৩৬.২ ডিগ্রিতে উঠে গিয়েছিল। মার্চে বরিশালে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩২.২ ডিগ্রি থাকার কথা কিন্তু গত ২২ মার্চ বরিশালে তাপমাত্রা ছিল ৩৬.৭ এবং ২৫ ও ২৭ মার্চ ৩৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে বৃষ্টি অভাবেই তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ ওপরে উঠছে এবং গরমের অনুভূতিও বাড়ছে বলে মনে করছেন আবহাওয়া পর্যবেক্ষকরা। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে বরিশাল নগরীতে একজন শ্রমজীবী মানুষ মারা গেছেন।

কয়েক দফার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিগত ‘খরিপ-২’ মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে আমনের উৎপাদন প্রায় দেড় লাখ টন হ্রাস পায়। সে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে প্রায় ৭ লাখ ২ হাজার ১৭৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান, গম ও ভুট্টার মতো দানাদার খাদ্য ফসল এবং গোল আলু, সয়াবিন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের তেল ফসল, মসলা ও ডাল ফসলের আবাদ হয়েছে। এছাড়া এবার দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৪৭ হাজার চারশ’ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। ফলে প্রায় ১০ লাখ টন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের কথা কিন্তু লাগাতার অনাবৃষ্টির সঙ্গে সাগরের নোনা পানি কৃষকের সব আশাকে ম্লান করছে।

সঙ্গে অব্যাহত তাপপ্রবাহ দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবনকে অনেকটাই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। যা পরিবেশের জন্যও হুমকি বলে মনে করছেন একাধিক পরিবেশবিদ। আবহাওয়া বিভাগের মতে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলা জানানো হয়েছে। এমনকি দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।

শনিবার, ০১ মে ২০২১ , ১৯ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমজান ১৪৪২

অনাবৃষ্টিতে দক্ষিণাঞ্চল

নদ-নদীর পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা, জনজীবনে বিপর্যয় ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা

মানবেন্দ্র বটব্যাল, বরিশাল

স্মরণকালের ভয়াবহ দাবদাহের সঙ্গে লাগাতার অনাবৃষ্টিতে উজানের পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় সাগরের নোনা পানিতে সয়লাব দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী। এই নোনা পানি স্বাভাবিক জনজীবনে বিপর্যয়ের সঙ্গে মারাত্মকভাবে পরিবেশেও সংকট সৃষ্টি করছে। বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ইতোমধ্যে স্মরণকালের সর্বোচ্চ ৩৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে। যা স্বাভাবিকের থেকে ৫.৪ ডিগ্রি বেশি।

অব্যাহত তাপপ্রবাহে দক্ষিণাঞ্চলে চলমান ডায়রিয়া রোগীদের পানিশূন্যতা ত্বরান্বিত করে জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা ১২শ’ পিপিএম অতিক্রম করেছে। ফলে নদী-খালের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। যারা এই পানি ব্যবহার করছেন তাদের ডায়রিয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। সরকারি হিসাবে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। গত ৪ মাস ধরেই দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টির অভাবে ফসলি জমি থেকে শুরু করে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির। মুগ, ভুট্টা, সয়াবিন ও শাক-সবজিসহ সূর্যমুখীর উৎপাদনে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পানি সংকটে বরগুনা এলাকায় বোরো ধানের সেচ ব্যবস্থা পর্যন্ত ব্যাহত হচ্ছে।

গত অক্টোবর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টির অভাব। এটা শীত মৌসুমে তা ততটা অনুভূত না হলেও ক্রমশ সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। জানুয়ারি মাসে বরিশাল অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮.৯ মিলিমিটার হলেও এ বছর কোন বৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়া বিভাগের মতে, ফেব্রুয়ারিতে ২৭ মিলিমিটারের স্থলে বরিশাল অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১ মিলিমিটার। মার্চে ৫৭.১ মিলিমিটারের স্থলে মাত্র ০.৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা ছিল স্বাভাবিকের ৯৯.৫% কম। আর চলতি মাসে বরিশাল অঞ্চলে ১৩২.৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত কোন বৃষ্টিই হয়নি।

লাগাতার অনাবৃষ্টির সঙ্গে উজানের নদ-নদীর প্রবাহ প্রায় না থাকায় গত ডিসেম্বরের পর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে সাগরের নোনা পানি উঠে আসতে শুরু করে। ইতোমধ্যে লবণাক্ততার মাত্রা ১ হাজার পিপিএম অতিক্রম করেছে। বঙ্গোপসাগর থেকে ১১০ কিলোমিটার উজানে বরিশালের কীর্তনখোলায় লবণাক্ততার মাত্রা ১ হাজার ২শ’ পিপিএম অতিক্রম করেছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে। ইতোমধ্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম বিষয়টি নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণেরও নির্দেশ দিয়েছেন। সে আলোকে মন্ত্রীর কাছে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনও দাখিল করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

অনাবৃষ্টির সঙ্গে অত্যধিক তাপপ্রবাহ দক্ষিণাঞ্চলের মাঠে থাকা রবি ফসলের জন্য ক্রমাগত হুমকি সৃষ্টি করছে। ইতোমধ্যে বরিশালে তাপমাত্রার পারদ সর্বকালের রেকর্ড ছাপিয়ে ৩৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়সে উঠেছে গত ২৫ এপ্রিল। ২৬ এপ্রিল ছিল ৩৭.৫ অথচ আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে এপ্রিল মাসে বরিশালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকের চেয়ে ৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রায় জনজীবনে ভয়াবহ সংকট নেমে এসেছে। এমনকি ২৬ এপ্রিল তাপমাত্রা ১.৩ ডিগ্রি হ্রাস পেলেও তা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৪.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। চলতি মাসের প্রথম দিনেও বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ৩৬.২ ডিগ্রিতে উঠে গিয়েছিল। মার্চে বরিশালে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩২.২ ডিগ্রি থাকার কথা কিন্তু গত ২২ মার্চ বরিশালে তাপমাত্রা ছিল ৩৬.৭ এবং ২৫ ও ২৭ মার্চ ৩৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে বৃষ্টি অভাবেই তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ ওপরে উঠছে এবং গরমের অনুভূতিও বাড়ছে বলে মনে করছেন আবহাওয়া পর্যবেক্ষকরা। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে বরিশাল নগরীতে একজন শ্রমজীবী মানুষ মারা গেছেন।

কয়েক দফার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিগত ‘খরিপ-২’ মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে আমনের উৎপাদন প্রায় দেড় লাখ টন হ্রাস পায়। সে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে প্রায় ৭ লাখ ২ হাজার ১৭৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান, গম ও ভুট্টার মতো দানাদার খাদ্য ফসল এবং গোল আলু, সয়াবিন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের তেল ফসল, মসলা ও ডাল ফসলের আবাদ হয়েছে। এছাড়া এবার দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৪৭ হাজার চারশ’ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। ফলে প্রায় ১০ লাখ টন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের কথা কিন্তু লাগাতার অনাবৃষ্টির সঙ্গে সাগরের নোনা পানি কৃষকের সব আশাকে ম্লান করছে।

সঙ্গে অব্যাহত তাপপ্রবাহ দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবনকে অনেকটাই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। যা পরিবেশের জন্যও হুমকি বলে মনে করছেন একাধিক পরিবেশবিদ। আবহাওয়া বিভাগের মতে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলা জানানো হয়েছে। এমনকি দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।