করোনায় শিক্ষা ঝুঁকিতে ৫৯ লাখ শিক্ষার্থী 

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ২০২০ সালের মার্চ থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের ৫৯ লাখ ২০ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল যৌথভাবে উপস্থাপন করেন পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।

করোনায় দেশে দারিদ্র্যের রূপ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা জানতে দেশজুড়ে যৌথভাবে তিন ধাপে একটি টেলিফোন জরিপ করে পিপিআরসি ও বিআইজিডি। গবেষণাটি শহর ও মফস্বলের ৬ হাজার ৯৯ জন অভিভাবকের ওপর জরিপের ভিত্তিতে করা হয়েছে। গত ১১ থেকে ৩১ মার্চ এ জরিপ করা হয়। গবেষণার তৃতীয় ধাপের দ্বিতীয় অংশ হলো, ‘কোভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অব চিলড্রেন’।

সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও ৬১ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী পড়াশোনার ক্ষতি এড়াতে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। করোনায় শিক্ষণ ঘাটতির মুখে রয়েছে প্রাথমিক স্তরের ১৯% এবং মাধ্যমিক স্তরের ২৫% শিক্ষার্থী। তৃতীয় ধাপের ৬ হাজার ৯৯টি পরিবারের মধ্যে দ্বিতীয় অংশের জরিপে ৪ হাজার ৯৪০টি পরিবারের স্কুলগামী শিশুদের ওপর গবেষণা করা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো স্কুলের ধরন (প্রাথমিক/মাধ্যমিক), স্থান (শহর/গ্রাম) এবং লিঙ্গ (পুরুষ/নারী)। হতদরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র, ঝুঁকিপুর্ণ দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন পরিবারগুলোর ওপর এই গবেষণা করা হয়।

এমনকি করোনা মহামারী শুরুর আগে মাধ্যমিক স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ (২১%) এবং প্রাথমিক স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ (১৪%) ঝরে যেত। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের মাঝে ঝরে পড়ার হার বেশি। যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের সব রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। যদিও অনেকেই পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, তবুও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছয়টি উপায়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়েছে। এগুলো হলো তদারকিবিহীন নিজস্ব পড়াশোনা, পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় পড়াশোনা, অনলাইনে বা টিভির মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষণ, কোচিং/প্রাইভেট এবং স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি। তবে এসব ক্ষেত্রেও অনেক অনিয়ম ছিল।

করোনার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশুদের মাঝে সৃষ্ট শিক্ষণ ঘাটতি পর্যবেক্ষণে এই সমীক্ষাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো তৈরি করেছে। দেখা গেছে, এই ঝুঁকিটি সৃষ্টি হয়েছে পড়াশোনা না করা এবং সঠিক পদ্ধতিতে পড়াশোনা না করার কারণে, যেমন- তদারকি ছাড়া নিজে নিজেই পড়া ও অনিয়মিত পড়া। প্রাথমিক স্তরের কমপক্ষে ১৯% এবং মাধ্যমিকের ২৫% শিক্ষার্থী শিক্ষণ ঘাটতিজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে এর ফলে ভবিষ্যতে শেখার ক্ষমতা কমে যাবে এবং ঝরে পড়ার হার বাড়বে। শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে, নারীদের ২৬% এবং পুরুষদের ৩০% রয়েছে এই ঝুঁকিতে। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের মাঝে যারা অতি দরিদ্র, সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩% পুরুষ শিক্ষার্র্থীর করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ফলাফলে আরও দেখা গেছে, দূরবর্তী শিক্ষণের জন্য যে সুবিধা থাকা দরকার তা আছে বা ব্যবহার করছে ১০% শিক্ষার্থী। ফলে সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে এই বন্ধে লেখাপড়া শেখার হার খুব কম। অবশ্য যারা দরিদ্র নয় এবং শহরের বস্তিতে থাকে মাধ্যমিক পর্যায়ের সেসব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই হার একটু বেশি। একই সঙ্গে কোচিংয়ে বা প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝেই বেশি (৬১%) বিশেষত যারা দরিদ্র নয়, তাদের মাঝে এই হার বেশি (৭৪%)। আবার শহরের বস্তি এলাকায় খরচ বেশি হওয়ায় কোচিংয়ে যুক্ত হওয়ার হার কম। পড়াশোনায় যুক্ত থাকার আরেকটি পদ্ধতি হলো পিতামাতা বা ভাইবোনের সহায়তায় পড়া। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ের চেয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে এই সহায়তাপ্রাপ্তির হার কম। মাদ্রাসায় বদলি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে আগের চেয়ে চারগুণ হয়েছে এবং মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।

জরিপে অংশ নেয়া ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক এবং মাধ্যমিকের ৯৬ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, পুনরায় স্কুল খুললে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। গবেষণায় পুনরায় স্কুল খোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসে গতিবিধি দেখে স্কুল খোলার দিনক্ষণ ঠিক করতে হবে। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মাচঅবদি শিক্ষাখরচ বেড়েছে ১২ গুণ। ফলে শিক্ষার সুযোগপ্রাপ্তিতে সংকট তৈরি হয়েছে। স্কুলগামী ছেলে শিশুদের ৮% এবং মেয়ে শিশুদের ৩% কোন না কোন উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে শহরের তুলনায় মানুষের আয় পুনরুদ্ধারের ও কাজের ভালো সুযোগ রয়েছে সেখানেও এই হার বেশি।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মহামারীতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন। শহরে বসবাসরত ১০ থেকে ২০ বছর বয়সীরা (১৫.৭%) গ্রামের (৮.৪%) তুলনায় দ্বিগুণ মানসিক চাপে রয়েছে। অভিভাবকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী এই মানসিক চাপের লক্ষণগুলো হলো অধৈর্য ভাব প্রকাশ, রাগ বা উগ্রভাব এবং বাইরে যেতে ভয় পাওয়া। ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা আবার গ্রামের চেয়ে শহরের তরুণদের মাঝে বেশি।

এই জরিপে পিতামাতার ব্যবহার ও সম্পৃক্ততাও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। অধিকাংশ অভিভাবক শিক্ষার ঘাটতি (৪৮%) এবং অনুৎসাহ (৫৯%) নিয়ে চিন্তিত। তারা (৪৬%) শিক্ষার ব্যয়ভার নিয়েও শঙ্কিত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে বরং তারা (১৪%) কম চিন্তিত। যদিও অর্ধেক অভিভাবক বিলম্বিত/স্নাতক পাস সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন, প্রায় ৪৪% স্থগিত পরীক্ষা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস হলে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ৩১% অভিভাবক।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গবেষণার উঠে আসা শিখতে না পারার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের শতাংশ দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর সঙ্গে মেলালে প্রায় ৬০ লাখ শিক্ষার্থী এ ঝুঁকিতে আছে। তারা ঝরে যাওয়ার হুমকির মুখে আছে। কারণ, তারা এখন মোটামুটি পড়াশোনার বাইরে রয়েছে। পুনরুদ্ধার করা না গেলে তাদের অবধারিত হবে ঝরে পড়া। তাই তাদের জন্য পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী প্রতি মাসিক ৫০০ টাকা করে মোট ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে পিপিআরসি এবং বিআইজিডি।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ২৩ মে থেকে স্কুল-কলেজ এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিদ্যমান পরিস্থিতি থাকলে ঘোষিত সময়ে খুলবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না।

মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১ , ২৮ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমজান ১৪৪২

করোনায় শিক্ষা ঝুঁকিতে ৫৯ লাখ শিক্ষার্থী 

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ২০২০ সালের মার্চ থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের ৫৯ লাখ ২০ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল যৌথভাবে উপস্থাপন করেন পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।

করোনায় দেশে দারিদ্র্যের রূপ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা জানতে দেশজুড়ে যৌথভাবে তিন ধাপে একটি টেলিফোন জরিপ করে পিপিআরসি ও বিআইজিডি। গবেষণাটি শহর ও মফস্বলের ৬ হাজার ৯৯ জন অভিভাবকের ওপর জরিপের ভিত্তিতে করা হয়েছে। গত ১১ থেকে ৩১ মার্চ এ জরিপ করা হয়। গবেষণার তৃতীয় ধাপের দ্বিতীয় অংশ হলো, ‘কোভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অব চিলড্রেন’।

সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও ৬১ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী পড়াশোনার ক্ষতি এড়াতে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ালেখা চালিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। করোনায় শিক্ষণ ঘাটতির মুখে রয়েছে প্রাথমিক স্তরের ১৯% এবং মাধ্যমিক স্তরের ২৫% শিক্ষার্থী। তৃতীয় ধাপের ৬ হাজার ৯৯টি পরিবারের মধ্যে দ্বিতীয় অংশের জরিপে ৪ হাজার ৯৪০টি পরিবারের স্কুলগামী শিশুদের ওপর গবেষণা করা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো স্কুলের ধরন (প্রাথমিক/মাধ্যমিক), স্থান (শহর/গ্রাম) এবং লিঙ্গ (পুরুষ/নারী)। হতদরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র, ঝুঁকিপুর্ণ দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন পরিবারগুলোর ওপর এই গবেষণা করা হয়।

এমনকি করোনা মহামারী শুরুর আগে মাধ্যমিক স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ (২১%) এবং প্রাথমিক স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ (১৪%) ঝরে যেত। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের মাঝে ঝরে পড়ার হার বেশি। যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের সব রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। যদিও অনেকেই পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, তবুও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছয়টি উপায়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়েছে। এগুলো হলো তদারকিবিহীন নিজস্ব পড়াশোনা, পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় পড়াশোনা, অনলাইনে বা টিভির মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষণ, কোচিং/প্রাইভেট এবং স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি। তবে এসব ক্ষেত্রেও অনেক অনিয়ম ছিল।

করোনার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশুদের মাঝে সৃষ্ট শিক্ষণ ঘাটতি পর্যবেক্ষণে এই সমীক্ষাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো তৈরি করেছে। দেখা গেছে, এই ঝুঁকিটি সৃষ্টি হয়েছে পড়াশোনা না করা এবং সঠিক পদ্ধতিতে পড়াশোনা না করার কারণে, যেমন- তদারকি ছাড়া নিজে নিজেই পড়া ও অনিয়মিত পড়া। প্রাথমিক স্তরের কমপক্ষে ১৯% এবং মাধ্যমিকের ২৫% শিক্ষার্থী শিক্ষণ ঘাটতিজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে এর ফলে ভবিষ্যতে শেখার ক্ষমতা কমে যাবে এবং ঝরে পড়ার হার বাড়বে। শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে, নারীদের ২৬% এবং পুরুষদের ৩০% রয়েছে এই ঝুঁকিতে। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের মাঝে যারা অতি দরিদ্র, সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩% পুরুষ শিক্ষার্র্থীর করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ফলাফলে আরও দেখা গেছে, দূরবর্তী শিক্ষণের জন্য যে সুবিধা থাকা দরকার তা আছে বা ব্যবহার করছে ১০% শিক্ষার্থী। ফলে সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে এই বন্ধে লেখাপড়া শেখার হার খুব কম। অবশ্য যারা দরিদ্র নয় এবং শহরের বস্তিতে থাকে মাধ্যমিক পর্যায়ের সেসব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই হার একটু বেশি। একই সঙ্গে কোচিংয়ে বা প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝেই বেশি (৬১%) বিশেষত যারা দরিদ্র নয়, তাদের মাঝে এই হার বেশি (৭৪%)। আবার শহরের বস্তি এলাকায় খরচ বেশি হওয়ায় কোচিংয়ে যুক্ত হওয়ার হার কম। পড়াশোনায় যুক্ত থাকার আরেকটি পদ্ধতি হলো পিতামাতা বা ভাইবোনের সহায়তায় পড়া। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ের চেয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে এই সহায়তাপ্রাপ্তির হার কম। মাদ্রাসায় বদলি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে আগের চেয়ে চারগুণ হয়েছে এবং মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।

জরিপে অংশ নেয়া ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক এবং মাধ্যমিকের ৯৬ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, পুনরায় স্কুল খুললে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। গবেষণায় পুনরায় স্কুল খোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসে গতিবিধি দেখে স্কুল খোলার দিনক্ষণ ঠিক করতে হবে। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মাচঅবদি শিক্ষাখরচ বেড়েছে ১২ গুণ। ফলে শিক্ষার সুযোগপ্রাপ্তিতে সংকট তৈরি হয়েছে। স্কুলগামী ছেলে শিশুদের ৮% এবং মেয়ে শিশুদের ৩% কোন না কোন উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে শহরের তুলনায় মানুষের আয় পুনরুদ্ধারের ও কাজের ভালো সুযোগ রয়েছে সেখানেও এই হার বেশি।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মহামারীতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন। শহরে বসবাসরত ১০ থেকে ২০ বছর বয়সীরা (১৫.৭%) গ্রামের (৮.৪%) তুলনায় দ্বিগুণ মানসিক চাপে রয়েছে। অভিভাবকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী এই মানসিক চাপের লক্ষণগুলো হলো অধৈর্য ভাব প্রকাশ, রাগ বা উগ্রভাব এবং বাইরে যেতে ভয় পাওয়া। ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা আবার গ্রামের চেয়ে শহরের তরুণদের মাঝে বেশি।

এই জরিপে পিতামাতার ব্যবহার ও সম্পৃক্ততাও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। অধিকাংশ অভিভাবক শিক্ষার ঘাটতি (৪৮%) এবং অনুৎসাহ (৫৯%) নিয়ে চিন্তিত। তারা (৪৬%) শিক্ষার ব্যয়ভার নিয়েও শঙ্কিত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে বরং তারা (১৪%) কম চিন্তিত। যদিও অর্ধেক অভিভাবক বিলম্বিত/স্নাতক পাস সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন, প্রায় ৪৪% স্থগিত পরীক্ষা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস হলে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ৩১% অভিভাবক।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গবেষণার উঠে আসা শিখতে না পারার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের শতাংশ দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর সঙ্গে মেলালে প্রায় ৬০ লাখ শিক্ষার্থী এ ঝুঁকিতে আছে। তারা ঝরে যাওয়ার হুমকির মুখে আছে। কারণ, তারা এখন মোটামুটি পড়াশোনার বাইরে রয়েছে। পুনরুদ্ধার করা না গেলে তাদের অবধারিত হবে ঝরে পড়া। তাই তাদের জন্য পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী প্রতি মাসিক ৫০০ টাকা করে মোট ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে পিপিআরসি এবং বিআইজিডি।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ২৩ মে থেকে স্কুল-কলেজ এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিদ্যমান পরিস্থিতি থাকলে ঘোষিত সময়ে খুলবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না।