তিনদিন ধরে ডাক্তার-নার্স আয়া কেউ নেই!

বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু

একদিকে করোনা সংক্রমণের অজুহাত অন্যদিকে ডিউটি থাকার পরও উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ঈদের আগের দিন থেকে ঈদের দিন এবং পরের দিন শনিবার পর্যন্ত কোন ডাক্তার নার্স আয়া হাসপাতালে আসেনি। ফলে নতুন ভর্তি হওয়া ও চিকিৎসাধীন রোগীরা বিনা চিকিৎসায় অমানবিকভাবে অবস্থান করেছে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে। এদিকে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালে গত ৭২ ঘণ্টায় ২১ রোগী মারা গেছেন।

সরেজমিন ঈদের দিন ও পরের দিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এবং বাস্তব অবস্থা দেখে বোঝা যায় ভয়াবহ অরাজক অবস্থা চলছে হাসপাতালটিতে। করোনা সংক্রমণের পর থেকে বিভাগীয় প্রধানসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আসেন না বললেই চলে। রেজিস্ট্রার সহকারী রেজিস্ট্রার আর ইন্টার্ন ডাক্তার দিয়ে চলছে হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা, কিন্তু ঈদের আগের দিন থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন তাদের কোন চিকিৎসা হচ্ছে না। ডাক্তার নার্স আয়া কেউই নেই। চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মচারী আছেন তারাই নার্সের দায়িত্ব পালন করছেন। রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ জরুরি বিভাগে রোগী নিয়ে এসে ভর্তি হতে ২শ’ টাকা দিতে হচ্ছে ট্রেচারে করে রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে দিতে হচ্ছে দেড় থেকে দুশ’ টাকা। ওয়ার্ডে আনার পর একবার নার্স এসে স্যালাইনসহ সব ওষুধ কিনে আনতে বলে। বাইরে থেকে স্যালাইন নেয়ার ব্যান্ডেজ সুইসহ স্যালাইন কিনে আনতে হচ্ছে। ব্যথার জন্য প্যারসিটামল পর্যন্ত কিনে আনতে হচ্ছে। সবগুলো ওয়ার্ডেই ডাক্তারের জন্য ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের রুমে গিয়ে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। সবগুলো কক্ষে চেয়ার-টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে। বিভাগীয় প্রধানসহ চিকিৎসকদের রুমে তালা ঝুলছে। মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কাঁদছেন তার মেয়ে আনোয়ারা বেগম। তিনি জানান, ঈদের আগের দিন থেকে কোন ডাক্তার আসেনাই। তার বাবা গুরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কি করবেন বুঝতে পারছেন না। নার্স ঈদের আগের দিন কিছু পরীক্ষা করতে বলেছেন অনেক কষ্টে বাইরে ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট নিয়ে অপেক্ষা করছেন কাকে দেখাবেন। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আনোয়ারা বেগম জানালেন তার বাবার যে অবস্থা বড় হাসপাতালে আনার পর কি লাভ হলো।

সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, লালমনিরহাটের মোগলহাট থেকে এসেছেন সাহাদত হোসেন, জানালেন তার বাবার পায়ে আঘাতজনিত কারণে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানান, তিন দিন ধরে ডাক্তার নার্স কেউ আসে না। তিনি গজ ব্যান্ডেজ দেখিয়ে বললেন এসব তিনি নিজেই ক্ষত স্থানের লাগানো ব্যান্ডেজ খুলে আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছেন। এখন ডাক্তার যদি না আসে ব্যবস্থাপত্র না দেয় তাহলে এখানে রেখে কি লাভ?

গাইনি ওয়ার্ডের আবস্থা ভয়াবহ, সেখানে শতাধিক রোগী অবস্থান করছে কারও বাচ্চা হয়েছে কারও বাচ্চা হওয়ার অপেক্ষায় অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করলেন ঈদের দুদিন আগে থেকে কোন ডাক্তার নার্স কেউ আসে না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া দুজন নার্স তাদের খোঁজ নিয়েছেন কিন্তু ডাক্তারের কোন খবর নেই। জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা গেল বিভিন্ন স্থান থেকে অ্যাম্বুলেন্স, ভ্যান, অটোরিকশায় আসছেন রোগীরা। তাদের জরুরি বিভাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর একজন কর্মচারী এসে নাম ঠিকানা লিখে ভর্তি সিøপ দিয়ে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ইন্টার্ন ডাক্তার সৌরভ সাহার কাছে পাঠাচ্ছেন। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন ভর্তি হতে জরুরি বিভাগের কর্মচারীরা জনপ্রতি দুশ’ টাকা নিচ্ছেন অনেকটা জোর করে। টাকা দিলে তাড়াতাড়ি ভর্তি স্লিপ দিচ্ছেন আর না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে কর্তব্যরত জরুরি বিভাগে কর্মরত কর্মচারী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দ্রুত চলে যান। এদিকে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ইন্টার্ন ডা. সৌরভ সাহা জানান, এক্সিডেন্ট সহ মুমূর্ষ রোগীরা আসছেন তাদের দেখভাল করতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার পরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অন্যদিকে ব্যবস্থাপত্রসহ নানা সমস্যায় রোগীরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও কোন ডাক্তার বা নার্স দেখতেও আসছে না। ফলে রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস ভারি হলেও দেখার কেউ নেই। এভাবেই দুদিন ধরে বিনা চিকিৎসায় অমানবিকভাবে অবস্থান করছে মরণাপন্ন রোগীরা। উত্তরাঞ্চলের বড় চিকিৎসা কেন্দ্রটি মানুষ মারার হাসপাতালে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। চিকিৎসা না পেয়ে বাধ্য হয়ে অনেক রোগী হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তবে গতকাল সকাল থেকে ইন্টার্ন ডাক্তার ও নার্সদের ওয়ার্ডগুলোতে দেখা গেছে।

সার্বিক বিষয় জানতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাসপাতালে অব্যবস্থা ডাক্তার নার্স আয়া না থাকার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি নন বলে জানিয়ে বলেন, তারা সাধ্যমতো কাজ করছেন। জরুরি বিভাগের অবস্থাপনা দুর্নীতির বিষয়টি দেখবেন বলে জানান তিনি।

সোমবার, ১৭ মে ২০২১ , ৩০ বৈশাখ ১৪২৮ ৩০ রমজান ১৪৪২

রংপুর মেডিকেল কলেজ

তিনদিন ধরে ডাক্তার-নার্স আয়া কেউ নেই!

বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু

লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর

একদিকে করোনা সংক্রমণের অজুহাত অন্যদিকে ডিউটি থাকার পরও উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ঈদের আগের দিন থেকে ঈদের দিন এবং পরের দিন শনিবার পর্যন্ত কোন ডাক্তার নার্স আয়া হাসপাতালে আসেনি। ফলে নতুন ভর্তি হওয়া ও চিকিৎসাধীন রোগীরা বিনা চিকিৎসায় অমানবিকভাবে অবস্থান করেছে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে। এদিকে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালে গত ৭২ ঘণ্টায় ২১ রোগী মারা গেছেন।

সরেজমিন ঈদের দিন ও পরের দিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এবং বাস্তব অবস্থা দেখে বোঝা যায় ভয়াবহ অরাজক অবস্থা চলছে হাসপাতালটিতে। করোনা সংক্রমণের পর থেকে বিভাগীয় প্রধানসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আসেন না বললেই চলে। রেজিস্ট্রার সহকারী রেজিস্ট্রার আর ইন্টার্ন ডাক্তার দিয়ে চলছে হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা, কিন্তু ঈদের আগের দিন থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন তাদের কোন চিকিৎসা হচ্ছে না। ডাক্তার নার্স আয়া কেউই নেই। চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মচারী আছেন তারাই নার্সের দায়িত্ব পালন করছেন। রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ জরুরি বিভাগে রোগী নিয়ে এসে ভর্তি হতে ২শ’ টাকা দিতে হচ্ছে ট্রেচারে করে রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে দিতে হচ্ছে দেড় থেকে দুশ’ টাকা। ওয়ার্ডে আনার পর একবার নার্স এসে স্যালাইনসহ সব ওষুধ কিনে আনতে বলে। বাইরে থেকে স্যালাইন নেয়ার ব্যান্ডেজ সুইসহ স্যালাইন কিনে আনতে হচ্ছে। ব্যথার জন্য প্যারসিটামল পর্যন্ত কিনে আনতে হচ্ছে। সবগুলো ওয়ার্ডেই ডাক্তারের জন্য ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের রুমে গিয়ে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। সবগুলো কক্ষে চেয়ার-টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে। বিভাগীয় প্রধানসহ চিকিৎসকদের রুমে তালা ঝুলছে। মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কাঁদছেন তার মেয়ে আনোয়ারা বেগম। তিনি জানান, ঈদের আগের দিন থেকে কোন ডাক্তার আসেনাই। তার বাবা গুরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কি করবেন বুঝতে পারছেন না। নার্স ঈদের আগের দিন কিছু পরীক্ষা করতে বলেছেন অনেক কষ্টে বাইরে ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট নিয়ে অপেক্ষা করছেন কাকে দেখাবেন। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আনোয়ারা বেগম জানালেন তার বাবার যে অবস্থা বড় হাসপাতালে আনার পর কি লাভ হলো।

সার্জারি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, লালমনিরহাটের মোগলহাট থেকে এসেছেন সাহাদত হোসেন, জানালেন তার বাবার পায়ে আঘাতজনিত কারণে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানান, তিন দিন ধরে ডাক্তার নার্স কেউ আসে না। তিনি গজ ব্যান্ডেজ দেখিয়ে বললেন এসব তিনি নিজেই ক্ষত স্থানের লাগানো ব্যান্ডেজ খুলে আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছেন। এখন ডাক্তার যদি না আসে ব্যবস্থাপত্র না দেয় তাহলে এখানে রেখে কি লাভ?

গাইনি ওয়ার্ডের আবস্থা ভয়াবহ, সেখানে শতাধিক রোগী অবস্থান করছে কারও বাচ্চা হয়েছে কারও বাচ্চা হওয়ার অপেক্ষায় অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করলেন ঈদের দুদিন আগে থেকে কোন ডাক্তার নার্স কেউ আসে না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া দুজন নার্স তাদের খোঁজ নিয়েছেন কিন্তু ডাক্তারের কোন খবর নেই। জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা গেল বিভিন্ন স্থান থেকে অ্যাম্বুলেন্স, ভ্যান, অটোরিকশায় আসছেন রোগীরা। তাদের জরুরি বিভাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর একজন কর্মচারী এসে নাম ঠিকানা লিখে ভর্তি সিøপ দিয়ে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ইন্টার্ন ডাক্তার সৌরভ সাহার কাছে পাঠাচ্ছেন। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন ভর্তি হতে জরুরি বিভাগের কর্মচারীরা জনপ্রতি দুশ’ টাকা নিচ্ছেন অনেকটা জোর করে। টাকা দিলে তাড়াতাড়ি ভর্তি স্লিপ দিচ্ছেন আর না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে কর্তব্যরত জরুরি বিভাগে কর্মরত কর্মচারী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দ্রুত চলে যান। এদিকে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ইন্টার্ন ডা. সৌরভ সাহা জানান, এক্সিডেন্ট সহ মুমূর্ষ রোগীরা আসছেন তাদের দেখভাল করতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার পরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অন্যদিকে ব্যবস্থাপত্রসহ নানা সমস্যায় রোগীরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও কোন ডাক্তার বা নার্স দেখতেও আসছে না। ফলে রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস ভারি হলেও দেখার কেউ নেই। এভাবেই দুদিন ধরে বিনা চিকিৎসায় অমানবিকভাবে অবস্থান করছে মরণাপন্ন রোগীরা। উত্তরাঞ্চলের বড় চিকিৎসা কেন্দ্রটি মানুষ মারার হাসপাতালে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ রোগীর স্বজনদের। চিকিৎসা না পেয়ে বাধ্য হয়ে অনেক রোগী হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তবে গতকাল সকাল থেকে ইন্টার্ন ডাক্তার ও নার্সদের ওয়ার্ডগুলোতে দেখা গেছে।

সার্বিক বিষয় জানতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাসপাতালে অব্যবস্থা ডাক্তার নার্স আয়া না থাকার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি নন বলে জানিয়ে বলেন, তারা সাধ্যমতো কাজ করছেন। জরুরি বিভাগের অবস্থাপনা দুর্নীতির বিষয়টি দেখবেন বলে জানান তিনি।