স্বাস্থ্য বিভাগের আশা সংক্রমণ কমবে, তা না হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির শঙ্কা

‘কঠোর লকডাউন’র দুই সপ্তাহ চলছে। করোনা সংক্রমণের ‘চেইন’ ভেঙে যাওয়ার আশা করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা, চলতি সপ্তাহে ‘করোনা সংক্রমণ’ কমতে শুরু করবে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে হাসপাতালে শয্যা আর খালি থাকবে না, এতে পরিস্থিতি ‘অত্যন্ত করুণ’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২৩০ জনের মৃত্যু এবং ১১ হাজার ৮৭৪ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হলেও আগের দিনের তুলনায় সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণের হার দুই শতাংশ কমেছে।

সংক্রমণ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএমএম আলমগীর গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘লকডাউনের ১৪ দিন হয়ে যাচ্ছে। এখন ইনকিউবেশন প্রিয়ড (রোগজীবাণু থেকে অনুকূল পরিবেশ বিকাশ হওয়া)। সংক্রমণ এখন কমে আসায় উচিৎ। সংক্রমণের চেইন হয়তো দুর্বল হয়েছে, আমরা আশা করছি, সংক্রমণ এখন থেকে কমতে থাকবে। কিন্তু সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে সময় লাগবে না।’

করোনা সংক্রমণ খুব সহসাই কমতে পারে কী না জানতে চাইলে করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত ‘জাতীয় পরামর্শক কমিটি’র সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আজকে যেমন সংক্রমণের হার কিছুটা কমেছে, সেটা হয়তো এখন কমতে থাকবে। কিন্তু মৃত্যু কমতে সময় লাগবে। কারণ এখন যারা মারা যাচ্ছেন তাদের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১০-১৫ দিন আগে। এখন যাদের সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে তাদের অবস্থা আস্তে আস্তে ভালো বা খারাপ হতে থাকবে।’

গত ১ জুলাই থেকে সারাদেশে ‘কঠোর লকডাউন’ চলছে। এর আগে ২২ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাত জেলায় ‘লকডাউন’র মাধ্যমে মানুষ ও যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জেলাগুলো হলো, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ।

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে এক সপ্তাহ পর করুণ পরিস্থিতির শঙ্কা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমি গতকাল এক ভার্চুয়াল সংবাদ বুলেটিনে বলেন, ‘বর্তমান ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে মৃত্যু শুধু বয়স্ক মানুষের হচ্ছে না, তরুণদেরও হচ্ছে।’

চলমান ‘লকডাউন সফল’ করতে পুলিশ এবং বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীও মাঠে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে বাইরে বের হচ্ছেন।’

সংক্রমণের চলমান ঊর্ধ্বগতিতে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সংক্রমণের হার এভাবে চলতে থাকলে এক দিনে ১৫ হাজার শনাক্ত হতে বেশি সময় লাগবে না। আর তাতে করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে সবাইকে বিপদে পড়তে হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ হয়ে যাবে।’

গত মাসে সারাদেশে সংক্রমণের হার অনেক বেশি ছিল-উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘জুন মাসে এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী সংক্রমিত হয়েছেন। শুধু জুলাইয়ের প্রথম ১০ দিনে প্রায় এক লাখ রোগীকে সংক্রমিত হতে দেখতে পেয়েছি। আমরা যেভাবে সংক্রমিত হচ্ছি, হাসপাতালে রোগীর চাপ যদি বাড়তেই থাকে, আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে হাসপাতালের শয্যা আর খালি থাকবে না।’

সারাদেশে গত মাসেও অসংখ্য বেড খালি ছিল জানিয়ে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ‘আইসিইউ বেড খালি ছিল। সেই খালি বেডের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে মাত্র ৩০০’র মতো কোভিড-১৯ আইসিইউ বেড খালি আছে।’

তিনি জানান, বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে সব জেলাতেই করোনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং সংক্রমণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশি।

শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সারাদেশে ২৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৬ হাজার ৪১৯ জনে।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হওয়া ১১ হাজার ৮৭৪ জনকে নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো দশ লাখ ২১ হাজার ১৮৯ জনে।

এর আগে ৯ জুলাই দেশে ২১২ জনের মৃত্যু হয়। ১০ জুলাই ১৮৫ জন, ৮ জুলাই ১৯৯ জন ও ৭ জুলাই প্রথমবারের মতো করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়ায়। ওইদিন ২০১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সরকারি ও বেসরকারি ৬১৩টি ল্যাবরেটরিতে ৪০ হাজার ১৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়ালো ৬৯ লাখ ৭১ হাজার ১৬৭টি।

সর্বশেষ একদিনে নমুনা পরীক্ষার তুলনায় করোনা শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, আগের দিন তা ছিল ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ছয় হাজার ৩৬২ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো আট লাখ ৭৪ হাজার ৫০১ জনে।

সর্বশেষ একদিনে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে পুরুষ ১৩৩ জন ও নারী ৯৭ জন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৬৯ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ৪২ জন এবং বাসায় ১৯ জনের মৃত্যু হয়।

বয়স বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একদিনে মারা যাওয়া ২৩০ জনের মধ্যে সাতজনের বয়স ছিল ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১৯ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৪২ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৫১ জন এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী ছিল ১১১ জন।

বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকায় ৫৬ জন, চট্টগ্রামে ৩৯ জন, রাজশাহীতে ২৬ জন, খুলনায় ৬৬ জন, বরিশালে ৮ জন, সিলেটে ৮ জন, রংপুরে ২২ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়।

সংক্রমণের হারে শীর্ষে সিলেট ও বরিশাল বিভাগ

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা শনাক্তের হার সবচেয়ে সিলেট বিভাগে। সংক্রমণের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট বিভাগ। তবে শনাক্তের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ।

২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে ১৮ হাজার ৪৬০টি নমুনা পরীক্ষায় চার হাজার ৯৬১ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

এর মধ্যে ঢাকা মহানগরসহ জেলায় এদিন ১৪ হাজার ৬৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় তিন হাজার ৬৯০ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। ঢাকায় সংক্রমণের হার ২৫ দশমিক ১১ শতাংশ।

ময়মনসিংহ বিভাগে একদিনে এক হাজার ৮৩৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৫৫৬ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ বিভাগে শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৬৯৬টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় চট্টগ্রামে এক হাজার ৫৫৩ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে সংক্রমণের হার ৩৩ দশমিক ০৭ শতাংশ।

রাজশাহীতে একদিনে চার হাজার ৮৩৫টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় এক হাজার ১৫৩ জনের শরীরে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে সংক্রমণের হার ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

রংপুর বিভাগে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ১৪৭টি নমুনা পরীক্ষায় ৭৪৮ জনের শরীরে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এই বিভাগে শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

খুলনায় একদিনে চার হাজার ৭৭১টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এতে এক হাজার ৫৯১ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। খুলনা বিভাগে সংক্রমণের হার ৩৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

বরিশাল বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৮৩৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৭১০ জনের দেহে জীবাণু পাওয়া গেছে। এই বিভাগে সংক্রমণের হার ৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

সিলেট বিভাগে একদিনে এক হাজার ৪৩৬টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় ৬০২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ মিলেছে। সিলেটে সংক্রমণের হার ৪১ দশমিক ৯২ শতাংশ।

সোমবার, ১২ জুলাই ২০২১ , ২৮ আষাঢ় ১৪২৮ ১ জিলহজ্জ ১৪৪২

স্বাস্থ্য বিভাগের আশা সংক্রমণ কমবে, তা না হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির শঙ্কা

রাকিব উদ্দিন

‘কঠোর লকডাউন’র দুই সপ্তাহ চলছে। করোনা সংক্রমণের ‘চেইন’ ভেঙে যাওয়ার আশা করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা, চলতি সপ্তাহে ‘করোনা সংক্রমণ’ কমতে শুরু করবে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে হাসপাতালে শয্যা আর খালি থাকবে না, এতে পরিস্থিতি ‘অত্যন্ত করুণ’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২৩০ জনের মৃত্যু এবং ১১ হাজার ৮৭৪ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হলেও আগের দিনের তুলনায় সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণের হার দুই শতাংশ কমেছে।

সংক্রমণ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএমএম আলমগীর গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘লকডাউনের ১৪ দিন হয়ে যাচ্ছে। এখন ইনকিউবেশন প্রিয়ড (রোগজীবাণু থেকে অনুকূল পরিবেশ বিকাশ হওয়া)। সংক্রমণ এখন কমে আসায় উচিৎ। সংক্রমণের চেইন হয়তো দুর্বল হয়েছে, আমরা আশা করছি, সংক্রমণ এখন থেকে কমতে থাকবে। কিন্তু সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে সময় লাগবে না।’

করোনা সংক্রমণ খুব সহসাই কমতে পারে কী না জানতে চাইলে করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত ‘জাতীয় পরামর্শক কমিটি’র সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আজকে যেমন সংক্রমণের হার কিছুটা কমেছে, সেটা হয়তো এখন কমতে থাকবে। কিন্তু মৃত্যু কমতে সময় লাগবে। কারণ এখন যারা মারা যাচ্ছেন তাদের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১০-১৫ দিন আগে। এখন যাদের সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে তাদের অবস্থা আস্তে আস্তে ভালো বা খারাপ হতে থাকবে।’

গত ১ জুলাই থেকে সারাদেশে ‘কঠোর লকডাউন’ চলছে। এর আগে ২২ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাত জেলায় ‘লকডাউন’র মাধ্যমে মানুষ ও যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জেলাগুলো হলো, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ।

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে এক সপ্তাহ পর করুণ পরিস্থিতির শঙ্কা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমি গতকাল এক ভার্চুয়াল সংবাদ বুলেটিনে বলেন, ‘বর্তমান ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে মৃত্যু শুধু বয়স্ক মানুষের হচ্ছে না, তরুণদেরও হচ্ছে।’

চলমান ‘লকডাউন সফল’ করতে পুলিশ এবং বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীও মাঠে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে বাইরে বের হচ্ছেন।’

সংক্রমণের চলমান ঊর্ধ্বগতিতে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সংক্রমণের হার এভাবে চলতে থাকলে এক দিনে ১৫ হাজার শনাক্ত হতে বেশি সময় লাগবে না। আর তাতে করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে সবাইকে বিপদে পড়তে হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ হয়ে যাবে।’

গত মাসে সারাদেশে সংক্রমণের হার অনেক বেশি ছিল-উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘জুন মাসে এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী সংক্রমিত হয়েছেন। শুধু জুলাইয়ের প্রথম ১০ দিনে প্রায় এক লাখ রোগীকে সংক্রমিত হতে দেখতে পেয়েছি। আমরা যেভাবে সংক্রমিত হচ্ছি, হাসপাতালে রোগীর চাপ যদি বাড়তেই থাকে, আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে হাসপাতালের শয্যা আর খালি থাকবে না।’

সারাদেশে গত মাসেও অসংখ্য বেড খালি ছিল জানিয়ে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ‘আইসিইউ বেড খালি ছিল। সেই খালি বেডের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে মাত্র ৩০০’র মতো কোভিড-১৯ আইসিইউ বেড খালি আছে।’

তিনি জানান, বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে সব জেলাতেই করোনা ছড়িয়ে পড়েছে এবং সংক্রমণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশি।

শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সারাদেশে ২৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৬ হাজার ৪১৯ জনে।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হওয়া ১১ হাজার ৮৭৪ জনকে নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো দশ লাখ ২১ হাজার ১৮৯ জনে।

এর আগে ৯ জুলাই দেশে ২১২ জনের মৃত্যু হয়। ১০ জুলাই ১৮৫ জন, ৮ জুলাই ১৯৯ জন ও ৭ জুলাই প্রথমবারের মতো করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়ায়। ওইদিন ২০১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সরকারি ও বেসরকারি ৬১৩টি ল্যাবরেটরিতে ৪০ হাজার ১৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়ালো ৬৯ লাখ ৭১ হাজার ১৬৭টি।

সর্বশেষ একদিনে নমুনা পরীক্ষার তুলনায় করোনা শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, আগের দিন তা ছিল ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ছয় হাজার ৩৬২ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো আট লাখ ৭৪ হাজার ৫০১ জনে।

সর্বশেষ একদিনে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে পুরুষ ১৩৩ জন ও নারী ৯৭ জন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৬৯ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ৪২ জন এবং বাসায় ১৯ জনের মৃত্যু হয়।

বয়স বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একদিনে মারা যাওয়া ২৩০ জনের মধ্যে সাতজনের বয়স ছিল ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১৯ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৪২ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৫১ জন এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী ছিল ১১১ জন।

বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকায় ৫৬ জন, চট্টগ্রামে ৩৯ জন, রাজশাহীতে ২৬ জন, খুলনায় ৬৬ জন, বরিশালে ৮ জন, সিলেটে ৮ জন, রংপুরে ২২ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়।

সংক্রমণের হারে শীর্ষে সিলেট ও বরিশাল বিভাগ

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা শনাক্তের হার সবচেয়ে সিলেট বিভাগে। সংক্রমণের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট বিভাগ। তবে শনাক্তের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ।

২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে ১৮ হাজার ৪৬০টি নমুনা পরীক্ষায় চার হাজার ৯৬১ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

এর মধ্যে ঢাকা মহানগরসহ জেলায় এদিন ১৪ হাজার ৬৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় তিন হাজার ৬৯০ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। ঢাকায় সংক্রমণের হার ২৫ দশমিক ১১ শতাংশ।

ময়মনসিংহ বিভাগে একদিনে এক হাজার ৮৩৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৫৫৬ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ বিভাগে শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৬৯৬টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় চট্টগ্রামে এক হাজার ৫৫৩ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে সংক্রমণের হার ৩৩ দশমিক ০৭ শতাংশ।

রাজশাহীতে একদিনে চার হাজার ৮৩৫টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় এক হাজার ১৫৩ জনের শরীরে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে সংক্রমণের হার ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

রংপুর বিভাগে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ১৪৭টি নমুনা পরীক্ষায় ৭৪৮ জনের শরীরে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এই বিভাগে শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

খুলনায় একদিনে চার হাজার ৭৭১টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এতে এক হাজার ৫৯১ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। খুলনা বিভাগে সংক্রমণের হার ৩৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

বরিশাল বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৮৩৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৭১০ জনের দেহে জীবাণু পাওয়া গেছে। এই বিভাগে সংক্রমণের হার ৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

সিলেট বিভাগে একদিনে এক হাজার ৪৩৬টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় ৬০২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ মিলেছে। সিলেটে সংক্রমণের হার ৪১ দশমিক ৯২ শতাংশ।